#শেষটা_সুন্দর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৪৫।
‘হ্যাঁ, উনারা একসময় নাকি বেস্ট ফ্রেন্ড ছিলেন। আর একজন অন্যজনকে তখন অনেক ভালোও বাসতেন।’
‘তাহলে তারপর এমন কী হলো যে দুজন এখন একজন অন্যজনকে একদম সহ্যই করতে পারেন না?’
‘জানি না, আমাদের সেই কারণটাই খুঁজে বের করতে হবে। আমি তো আর সাদরাজকে এসব ব্যাপারে জিজ্ঞেস করতে পারব না তাই তুই ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করবি। ভাইয়ার কাছ থেকে সব জানবি। আর ঐদিকে আমি চেষ্টা করব খালার কাছ থেকে আরো কিছু জানা যায় কিনা।’
মেহুল চিন্তিত সুরে বলে,
‘কিন্তু, রাবীর কি আদৌ আমায় সব বলবে?’
‘বলবে। তুই জোর করলেই ভাইয়া সব বলবে।’
‘আচ্ছা, আমি চেষ্টা করব। কিন্তু, তুই কি এখন সাদরাজের সাথেই থাকবি? উনি যদি তোর সাথে খারাপ কিছু করে বসে?’
রিতা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
‘আর খারাপ কিছু। তোর কি মনে হয়, পুলিশকে সব বলে দিলে আমি রেহাই পেয়ে যাব? উনি জেল থেকে বেরুতে পারবেন না? উনার কাছে এইটা দু মিনিটের ব্যাপার। আর তারপর উনি আমার উপর আরো ক্ষেপে যাবেন। আমার উপর রাগ মেটাতে গিয়ে উনি সিয়ামের তো ক্ষতি করবেনই সাথে আমার মা বাবারও ক্ষতি করবেন। আর এতকিছুর পরও আমি কীভাবে এখন সত্যি কথাটা বলব বল?’
‘কিন্তু রিতা, এই খারাপ লোকটাকে তো শাস্তি দিতেই হবে। এভাবে তো ছাড় দেওয়া যায় না।’
‘হ্যাঁ, শাস্তি দিতে হবে। আর সেই শাস্তি আমি দিব।’
‘কীভাবে?’
‘জানিস, উনাদের বাড়ির খালা আমাকে একটা কথা বলেছেন। বলেছেন, মেয়েরা নাকি ভালোবাসাকে অস্ত্র বানিয়ে সব করতে পারে। আর আমি এই ভালোবাসাকেই অস্ত্র বানাব। উনি টেরও পাবেন না, উনাকে আমি কীভাবে মারব। শুধু তুই আমাকে পাশে থাকিস, তাহলেই হবে।’
মেহুল রিতার দুহাত ধরে বলে,
‘আমি, রাবীর, আমরা সবাই তোর পাশে আছি।’
‘ঠিক আছে, চল এখন। সাদরাজ নয়তো পরে সন্দেহ করবে।’
মেহুল রিতাকে নিয়ে আবার স্টেজের কাছে যায়। গিয়ে দেখে সাংবাদিকদের প্রশ্ন এখনো চলছে। রিতা তা দেখে কিছু স্বস্তি পায়।
সাংবাদিকদের কাছ থেকে সরেই সাদরাজ রিতার কাছে আসে। তার কাছে গিয়ে মৃদু সুরে বলে,
‘কোনো চালাকি করছো না তো?’
রিতা মিইয়ে যাওয়া সুরে বলে,
‘আমার কি আর অত সাহস আছে?’
সাদরাজ বাঁকা হাসে। বলে,
‘গুড। তা, তোমার বান্ধবীকে আমাদের পক্ষ থেকে উপহারটা দিয়েছ?’
‘না, সেটা তো আপনার কাছে।’
‘হ্যাঁ, তাই তো। চলো, উপহারটা দিয়ে আসি।’
রিতা আর সাদরাজ আবার তাদের কাছে যায়। সাদরাজ হেসে বলে,
‘আমার সবথেকে প্রিয় শত্রু, ওহ সরি, প্রিয় মানুষদের জন্য আমাদের তরফ থেকে একটা ছোট্ট গিফ্ট। গিফ্টটা গ্রহণ করলে আমরা খুব খুশি হব।’
রাবীর সাদরাজের হাত থেকে গিফ্টের বক্সটা নিল। সাদরাজ বলল,
‘খুলে দেখো, পছন্দ হয় কিনা?’
বক্সটা খুলে দেখল বড়ো দুটো রিং। দেখেই বোঝা যাচ্ছে ডায়মন্ড। রাবীর মৃদু হাসে। বলে,
‘হ্যাঁ, ভীষণ পছন্দ হয়েছে।’
পরে সে মেহুলের দিকে চেয়ে বলে,
‘মেহুল, আমাদের গিফ্টটাও দিন।’
মেহুল হেসে আরেকটা বক্স রিতার হাতে দিল। রিতা সেটা খুলে দেখল, সেখানে একটা বড়ো নেকলেস। নেকলেসটা দেখে রিতা বেশ অবাক হয়। মেহুল হেসে বলে,
‘তোর মনে আছে, একবার তুই বলেছিলি, তোর বিয়েতে যেন আমি এমন একটা নেকলেস দেই। তাই দিলাম, নিজের টাকায় পারিনি যদিও। তবে হাজবেন্ডের টাকা মানেও তো নিজের টাকাই তাই না? পছন্দ হয়েছে তোর?’
রিতা খুশি হয়ে বলল,
‘ভীষণ।’
তবে সাদরাজ এতে খুশি হতে পারেনি। কারণ সাদরাজের দেওয়া গিফ্টের তুলনায় রাবীরের দেওয়া গিফ্টের দাম বেশি। তাই সে রিতার দিকে চেয়ে বলল,
‘রিতা, চলো। তাড়াতাড়ি খেয়ে আমাদের বেরুতে হবে।’
রাবীর সাদরাজকে জ্বলতে দেখে বেশ খুশি হয়। রিতা আর সাদরাজের সাথে রাবীরও মেহুলকে নিয়ে একই টেবিলে গিয়ে বসে।
খাওয়া দাওয়া শেষ করে সাদরাজ আর বেশিক্ষণ অপেক্ষা না করে রিতাকে নিয়ে বেরিয়ে যায়। আর মেহুল আর রাবীরও রওনা হয় তার বাপের বাড়ির উদ্দেশ্যে।
________
গাড়ি থেকে নেমেই সাদরাজ রিতার হাত থেকে সেই গয়নার বক্সটা টেনে নিয়ে বলে,
‘এটা তোমার নিতে হবে না?’
‘কেন?’
‘এমনি। যাও ভেতরে যাও।’
‘কিন্তু, এটা…’
‘কী বলেছি কানে যায়নি? ভেতরে যাও।’
‘এটা ফেলবেন না, প্লিজ।’
‘রিতা, ভেতরে যাও।’
সাদরাজ দাঁতে দাঁত চেপে বলল। রিতা ভয়ে আর দ্বিতীয় কোনো কথা না বলে চুপচাপ ভেতরে চলে যায়।
____________
মেহুল বিছানার সাথে হেলান দিয়ে বসে আছে। রাবীর তার পাশে চোখ বুজে শুয়ে আছে। মেহুল মনে মনে ভাবছে এখন তাকে একবার সাদরাজের কথা জিজ্ঞেস করবে কিনা? উনারা কি সত্যিই একসময় বেস্ট ফ্রেন্ড ছিলেন?
আবার সে ভাবছে, জিজ্ঞেস করলে যদি রাবীর রেগে যায়? তাও, জিজ্ঞেস তো করতেই হবে। মেহুল আস্তে করে রাবীরের মাথায় হাত রাখে। তার চুল টেনে দেয়। চুলে বিলি কেটে দেয়। মাথা টিপে দেয়। মূলত যতভাবে রাবীরের মাথাকে ঠান্ডা রাখা যায় তার সবই করে। রাবীরও ভীষণ আরাম পায় তাতে। সে এগিয়ে এসে মেহুলের কোলে মাথা রাখে। মেহুল একটু নড়ে বসে। মনে মনে ঠিক করে এখনই জিজ্ঞেস করবে। সে একটা ঢোক গিলে মৃদু সুরে বলে,
‘একটা কথা জিজ্ঞেস করব, রাবীর?’
‘হু, বলুন।’
‘আচ্ছা, আপনি আর সাদরাজ কি একসময় বেস্ট ফ্রেন্ড ছিলেন?’
কথাটা শোনা মাত্রই রাবীর চট করে উঠে বসে। মেহুল ভয় পেয়ে যায়। রাবীর কি খুব রেগে গিয়েছেন। রাবীর তার দিকে কিছুক্ষণ কপাল কুঁচকে চেয়ে থেকে জিজ্ঞেস করে,
‘আপনি এই কথা কোথ থেকে শুনেছেন?’
‘আসলে, আমাকে রিতা বলেছে।’
‘রিতা কী করে জেনেছেন?’
‘আমি ঠিক জানি না। কিন্তু, এটা কি সত্যিই? আপনি আর সাদরাজ বেস্টফ্রেন্ড ছিলেন?’
রাবীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তপ্ত স্বরে বলে,
‘হ্যাঁ, ছিলাম।’
মেহুল এবার দ্বিতীয় প্রশ্ন করার সাহস করে। সে জিজ্ঞেস করে,
‘তাহলে এখন আপনাদের সম্পর্ক এত খারাপ হয়ে গেল কী করে?’
রাবীর আবার তার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে। বলে,
‘থাক না এসব। এই ব্যাপারগুলো নিয়ে কথা বলতে আমার এখন আর ভালো লাগে না। চুলগুলো টেনে দিন। মাথা ব্যথা করছে।’
মেহুল আবার কিছুক্ষণ চুপচাপ তার চুল টেনে দিল। কিন্তু মনের অস্থিরতা তার এখনো যাচ্ছে না। সবটা জানতে পারলে হয়তো যেত। কিন্তু পুনরায় কোনো প্রশ্ন করার সাহসও পাচ্ছে না সে।
রাবীর তার দিকে ঘুরে শুয়ে আছে। মেহুল চুল থেকে হাত সরিয়ে তার গালে হাত রাখে। গালের উপর একটু হাত বুলিয়ে দিয়ে মৃদু সুরে ডাকে,
‘রাবীর।’
রাবীর চোখ বুজেই বলে,
‘বলুন।’
‘আমার মনের অস্থিরতা তো কমছে না। আপনি বলুন না আমায় সবকিছু, প্লিজ।’
রাবীর তার দিকে তাকায়। মেহুল অসহায় ভাবে তাকিয়ে আছে। রাবীর জিজ্ঞেস করে,
‘এসব শুনে আপনি কী করবেন?’
‘কিছু না। তাও, বলুন প্লিজ।’
রাবীর আবার চোখ বুজে। ফিচেল স্বরে বলে,
‘একটা সম্পর্কের মূল ভিত্তি কী জানেন? বিশ্বাস। আর সম্পর্কের মধ্য থেকে একবার যদি সেই বিশ্বাসটা হারিয়ে যায় তখন হাজার চেষ্টা করেও সেই সম্পর্কটাকে আর ঠিক রাখা যায় না। সেটা তখন ভাঙ্গবেই। আমাদের বেলায়ও তাই হয়েছিল। বিশ্বাস হারিয়ে গিয়েছিল। সাদরাজ আমাকে আর বিশ্বাস করতে পারেনি। ভুল বুঝেছিল। আর তার পরিণতি আজকে এই। একসময় যে আমার জন্য জীবন দিতে চাইতো আজকে সে আমার জীবন নিতেও দু’বার ভাববে না।’
‘আর এই বিশ্বাসটা কী কারনে হারিয়েছিল?’
‘সেটা এক অনেক বড়ো কাহিনী। অন্যদিন বলব। আজকে আর ইচ্ছে করছে না।’
______________
‘আমার ফ্রেন্ড এটা আমাকে ভালোবেসে দিয়েছিল, কোথায় রেখেছেন আপনি এটা?’
‘যেখানে রাখা দরকার সেখানেই। আমার এই বাড়িতে রাবীরের দেওয়া কোনো জিনিসের কোনো স্থান নেই।’
‘সাদরাজ, আপনি এত অমানবিক কেন বলুন তো? আপনার মধ্যে কি একটুও মায়া দয়া নেই?’
সাদরাজ প্রচন্ড রেগে যায়। সে রিতার দিকে এগিয়ে এসে বলে,
‘আমি খুব অমানবিক, তাই না? আর কী, আমার মধ্যে কোনো মায়া দয়া নেই কেন জিজ্ঞেস করছিলে, তাই না? কারণ আমি তো মানুষই না, পশু। আর কোনো পশুর মধ্যে কোনো মায়া দয়া থাকে না।’
এই বলে সে রিতাকে এক ধাক্কায় বিছানায় ফেলে দেয়। রিতা তখন তার দিকে চেয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে,
‘আপনাকে মানুষ বানিয়ে তবেই আমি মরব। এর আগে না।’
চলবে….