#আবার_প্রেম_হোক
#নুসরাত_জাহান_মিম
২৫.
“শুধু তাই না,হানিমুন করতে শ্বশুরবাড়িও চলে গেছে”
দরজার সম্মুখে দাঁড়ানো পূর্ণতার উপরিউক্ত বাক্যটি কর্ণকুহর হতেই অতীত ছাপিয়ে বর্তমানকে আকড়ে ধরতে হয় ফায়ানের।অতঃপর ইফাদের বিস্ময়কর কন্ঠে তাকায় বন্ধুর পানে,
“চাঁদের বিয়ে হয়েছে?হানিমুনেও গেছে?কিন্তু বিয়েটা হলো কিভাবে?কার সাথে?আর এতো খোজার পরেও যাকে পাইনি সে হঠাৎ বিয়ে করে ঢাকা চলে আসলো?”
পূর্ণতা কেবিনে ঢুকতে ঢুকতে তাচ্ছিল্য করে বললো,
“সবই হচ্ছে তোমাদের বান্ধবীর সাজানো নাটক।একেতো আমার এক বন্ধুর প্রা!ণটা খেতে খেতে সেরেছে।অন্যদিকে আরেকজনের জীবন নষ্ট করতে বসেছে”
ফায়ানের ঠান্ডা কন্ঠস্বর,
“আপনি কি প্রণয় ভাইয়ার কথা বলছেন আপু?”
মিরা জবাব দেয়,
“ও বাদে আর কাকে এক্সপেক্ট করছিলে ফায়ান?”
ফায়ানের হৃদয় দ্বিতীয়বারের ন্যায় শব্দহীন চুরমার হয়।লম্বা শ্বাস টেনে সে বলে,
“অথচ আপনি একটু আগেই মেয়েটাকে অপ!বাদ দিচ্ছিলেন”
“আরও দেবো।যা সত্যি তা চিরকাল সত্যি”
“আর যা মিথ্যে তা আজন্ম মিথ্যে”
ইফাদ ফায়ানকে বললো,
“চল না চাঁদের সাথে দেখা করে আসি।কত বছর হলো মেয়েটাকে দেখিনা!”
ফায়ান স্মিত হেসে বললো,
“অবশ্যই করবো।কতশত পাওনা বাকি আছে যে!”
এয়ারপোর্টে বসে আছে এক তরুণী।বয়স তার চব্বিশ-পচিশের এপার ওপার।পরণে ট্রাউজার আর টপ্স।টপ্স এর উপর কালো রঙের ব্যারিস্টারি পোশাক।কাধ পর্যন্ত খোল চুলগুলো বাতাসে উড়ছে।চুলেতে খানিকটা লালাভাও দৃশ্যমান।বোধহয় রঙিন করেছে।চোখে চাচের বড় ফ্রেমের কালো রঙের বর্গাকার চশমা।নাকের ডগায় আসা চশমাখানা ভালো করে চোখে এঁটে ব্যাগ থেকে ফোন বের করে ডায়াল লিস্টের তৃতীয় নম্বরটিতে ডায়াল করে সে।অতঃপর কিছুক্ষণ কথা বলে ওপাশের মানুষটার কাছে নিঃসংকোচে আবেদন করে বসে,
“আমাকে ছেড়ে সবাই মজা করছে।এটা মানতে পারিনি চাচিম্মা।তাইতো চলে এসেছি।খুব শীঘ্রই সেখানেও পৌছে যাবো।যেতে যেতে দুপুর গড়িয়ে পড়বে।তুমি কিন্তু কাউকে কিছু বলবেনা।চমকে দেবো ওদের”
সারারাত ঘুমায়নি রিদি।ব্যাপারটা আর কেউ খেয়াল না করলেও চাঁদ করতে বাধ্য হয়েছে।কেনোনা এখানে আসার পর থেকেই চুপচাপ স্বভাবের মেয়েটা কেমন যেনো বোবাই হয়ে গেছে!জানালার পাশে হেলান দিয়ে ঘুমন্ত রিদিকে দেখেই চাঁদের মায়া হলো।কি সুন্দর মুখশ্রী!মায়ামায়া মুখখানা।এই মেয়েটাও কি তার ন্যায় দুখী?উহু তার ন্যায় দুখী এ ধরণীতে আদৌ কেউ আছে?থাকতে পারে কি?হয়তো পারে,হয়তো নয়।তবে এই ছোট্ট মেয়েটার কিসের এতো দুঃখ?জানতে ইচ্ছে হলো চাঁদের।তাই বিছানার ডান পাশে শোয়া শিফাকে আলতো হাতে ডাকলো সে।খুব ধীর কন্ঠ তার।পাছে রুবা,রিহা,অমৃতারা উঠে যায়?শিফা চোখ ডলতে ডলতে বললো,
“কী ভাবি?”
চাঁদ শিফার মুখ আলতো করে চে!পে ধরে বলে,
“হিশ!চলো আমার সাথে”
বলেই শিফাকে নিয়ে বারান্দায় উপস্থিত হয় সে।অতঃপর শিফাকে প্রশ্ন করে,
“রিদির কী হয়েছে?আসার পর থেকে দেখছি মেয়েটা তেমন কথা বলেনা”
চোখ ডলতে ডলতে হাই তুলছিলো শিফা।চাঁদের হঠাৎ প্রশ্নে ঘুমঘুম ভাব উবে যায় তার।বারকয়েক পলক ঝাপটে বলে,
“রি..রিদুর আবার কী হবে ভাবি?”
চাঁদ শান্তস্বরে বলে,
“কিছু যে হয়েছে তা আমি জানি।কী হয়েছে তা জানতেই তোমাকে ডাকা।কোনো এক্সকিউজ শুনবোনা শিফা।”
হতাশ হয়ে শিফা বলে,
“আমি যে বলতে পারবোনা ভাবি।বোনতো আমার।সেই সাথে বেস্ট ফ্রেন্ডও।যে কথা কখনো কাউকে বলিনি তোমায় কী করে বলবো বলো?”
“আমি কি ডিরেক্ট রিদিকেই জিগেস করবো তাহলে?”
“কী জিজ্ঞেস করবে ভাবি?”
রিদির কন্ঠ পেয়ে দুজনেই তাকায় পেছনে।অতঃপর রিদিকে দেখে চাঁদ আবারও শিফাকে বলে,
“কী হলো বলো?”
শিফা দৃষ্টি নত করে বলে,
“করতে পারো।তবে আমি কিছু বলতে পারবোনা ভাবি।সরি”
বলেই বারান্দা থেকে চলে আসে শিফা।শিফা যেতেই বারান্দার টুলে রিদিকে বসায় চাঁদ।অতঃপর তার সামনে হাটুগেরে বসে হাতদু’টো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলে,
“ভাবিকে বলবেনা?মন খারাপ কেনো তোমার?আমায় বলো সমাধান দেয়ার চেষ্টা করবো”
রিদি ইতস্তত করে বলে,
“না ভাবি তেমন কিছুইনা”
রিদির থুতনিতে হাত রেখে তার মাথা ডানে-বায়ে ঘুরিয়ে চাঁদ বলে,
“তাহলে কেমন কিছু রিদুসোনা?ভাবি তোমার বোনের মতো।তুমি আমায় বলো।তুমি-আমি ব্যতীত কেউ জানবেনা প্রমিজ”
রিদি কিছুক্ষণ ভাবলো।অতঃপর চাঁদের দু’হাত ধরে বললো,
“কাউকে বলবেনাতো?”
রিদির হাত ছাড়িয়ে দাঁড়ায় চাঁদ।মেয়েটার ডান গালে হাত রেখে বলে,
“বলবোনা।তিন সত্যি”
বলেই রিদির মাথা নিজের বুকের সাথে আগলিয়ে মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরে।অতঃপর চুলে হাত বুলিয়ে বলে,
“এবার ভাবিকে বলো সবটা।ভাবি তোমার যথাসাধ্য সাহায্য করবো”
রিদি চাঁদের এমন স্নেহময়ী স্পর্শ পেয়ে তার কোমড় দু’হাতে জড়িয়ে চোখের অশ্রু বিসর্জন দিয়ে বলে,
“ভাবি তুমিতো মিরের সাথে খুব ফ্রেন্ডলি,তাইনা?তার কি সত্যিই গার্লফ্রেন্ড আছে?”
রিদির কথায় চমকে ভ্রু কুচকায় চাঁদ।অতঃপর দুষ্টু হেসে চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বলে,
“কেন গো ননদিনী?আমার মিরজাফর ভাইয়াকে মন দিয়ে বসেছো নাকি?”
রিদি লজ্জা পেয়ে বলে,
“যাহ ভাবি!বলোনা”
“বললে কিন্তু কষ্ট পাবে সোনা”
“আমি তাও শুনবো।”
“আমার মনে হচ্ছে তুমি ভাইয়াকে খুব পছন্দ করো হা?”
চাঁদকে আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরে লম্বা শ্বাস নিয়ে রিদি বলে,
“আমি তাকে ভালোবাসি ভাবি”
“তাই?”
“হিম”
“কবে থেকে?”
“যখন আমি সেভেনে পড়ি তখন থেকেই।না না।সেভেনে থাকতে ক্রাশ খেয়েছিলাম।আস্তে আস্তে ভালোলাগা এরপরই…”
“ভালোবাসা?”
“হিম”
“তাহলেতো বিষয়টা বেশ জটিল।তুমি কিন্তু কষ্ট পাবে।কিছুটা হলেও খারাপ লাগবে রিদু”
“লাগুক।তুমি বলো”
“আহামরি আমি জানিনা।তাদের সাথে আমার প্রায় তিনবছরের মতো থাকা হয়েছে।মানে পরিচয় আরকি।তোমার প্রণয় ভাইয়া যখন থার্ড ইয়ারে পড়ে আমি কেবলই মেডিকেলে পা দিলাম।সেই হিসেবে তারা আমার দু’ক্লাস সিনিয়র।তাদের সার্কেলে পূর্ণপু বাদে বাকি সবার সাথেই আমার ভালো সম্পর্ক ছিলো।সবচাইতে বেশি ফ্রেন্ডলি আমি মির ভাইয়ার সাথেই ছিলাম।তুমি খেয়াল করলে বুঝবে আজও আমরা আগের ন্যায়ই আছি।হ্যা হয়তো পুরোপুরি না।তবে অনেকটাই।ভাইয়া আমায় খুব স্নেহ করে।তারতো ছোট বোন নেই।তাই খুব ভালোবাসে আমায়।আমার বড় ভাই আছে।তবুও মির ভাইয়াকেও আমি খুব ভালোবাসি।শ্রদ্ধা করি।তার সম্পর্কে এভাবে আমি বলতে চাইনা বা বলতে ভালোও লাগছেনা।কিন্তু যখন থেকে ভাইয়াকে চিনি তখন থেকেই দেখতাম বেশিরভাগ সময় মোবাইলে ব্যস্ত থাকে।এখনো বোধহয় তেমনই।আস্তেধীরে জানতে পারলাম ভাইয়া ওয়ান কাইন্ড অফ প্লেবয়।তার লাইফে মেয়েদের আনাগোনা বেশি।ফ্লার্ট করা তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিদ্যমান।তবে আমার সাথে তা কখনোই করেনি।শুরু থেকেই আমি ছিলাম তার ছোটবোন সমতুল্য।তার চিন্তাধারা এমন ছিলো যে ‘একটা গেলে দশটা আসবে’।আর একই সাথে নিম্নে দু’টো রিলেশন কন্টিনু করতোই।যদি উর্ধ্বে শুনতে চাও তবে বলি।একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম,ভাইয়া বলেছিলো হায়েস্ট নাকি পাঁচটাও কন্টিনু করেছে।দেখা সাক্ষাৎ,ফোনালাপ সবই হতো।আমি জানিনা ভাইয়া আদোতে তাদের ভালোবাসতো কিনা।তবে মনেতো হয়না বাসতো বলে।যদি বাসারই হতো ছাড়তো আর ধরতো নাকি?”
রিদির গরম শ্বাস চাঁদের পেটে এসে লাগছে।ফোপানোর আওয়াজও পাচ্ছে সে।নাক টানার শব্দ কর্ণকুহর হতেই চাঁদ রিদির মাথা বুক থেকে সরিয়ে দু’গালে হাত রেখে বলে,
“বোকা মেয়ে কাদছো কেনো?”
রিদি টুল থেকে উঠে হাত দিয়ে চোখের পানি মুছে বলে,
“মির এমন কেনো ভাবি?”
“ভাইয়া এখনো এমনই আছে কিনা তাতো জানিনা।তবে একটা কথা মনে রাখবে সে যদি তোমার ভাগ্যে থাকে যত বাধা বিপত্তি ই আসুক না কেনো তুমি তাকে পাবেই।আর ছেলে হিসেবে মির ভাইয়া কিন্তু একদমই খারাপ না।কখনো কোনো মেয়ের সাথে মিসবিহেভ করতে দেখিনি।এমনকি রিহাপু আর পূর্ণপুর সাথে বেশি ঘে!ষতেও দেখিনি।আই মিন মেয়েফ্রেন্ড থাকলে ছেলেরা স্পেশালি প্লেবয়গুলো….বুঝতেই তো পারছো?তবে মির ভাইয়া মোটেও তেমন না।রিলেশন অনেকগুলোই করেছে তা মানছি।কিন্তু তুমি যদি ভাইয়াকে সত্যিই ভালোবাসো আশা ছেড়ে দিওনা।ভালোবাসো।খুব করে বাসো তবে আড়ালে-আবডালে,নীরবে-নিভৃতে।যাতে কাকপক্ষীও টের না পায়।”
মুখটা ছোট হয়ে যায় রিদির।আফসোসের সুরে বলে,
“কিন্তু ভাবি…”
“কিন্তু?”
“মির বোধহয় বুঝে গেছে আমি তাকে ভালোবাসি”
কপাল কুচকে চাঁদ বলে,
“কিভাবে?”
অতঃপর গতকাল রাতের মিরের বলা সব কথাগুলো রিদি চাঁদকে বলে।সেসব শুনে চাঁদ স্মিত হেসে বলে,
“যেহেতু জেনে গেছে আর তোমাকে নিষেধাজ্ঞাও দিয়ে দিয়েছে।তাহলে তুমিও তার নিষেধাজ্ঞা পালন করো।তাকে বুঝিয়ে দাও ওসব তোমার আবেগ ছিলো।ছোট বয়সের আবেগ।যা ধীরে ধীরে কেটে যাচ্ছে”
“কিন্তু ভাবি…”
“ভালোবাসা হলে কাটবেনা মেয়ে।তবে মির ভাইয়ারও তো একটু বোঝা উচিত যে ওসব কেবলই তোমার আবেগ ছিলো।তুমি স্ট্রং পার্সোনালিটির একটা মেয়ে।তার কথা তোমার ইগো হার্ট করেছে।জাস্ট টোটালি ইগনোর হিম”
হতাশ হয়ে রিদি বলে,
“এসব কিছু শিফু বা রুবাকে বললে তাও চলতো ভাবি।আমিতো এসব কিছুই পারবোনা।আমার দ্বারা হয়না যে”
“একটা কথা বলি শোনো”
“বলো ভাবি”
“মানুষ পারেনা এমন কিছুই নেই।এই যে আমাকে দেখছো।সেদিন শিফা জিজ্ঞেস করেছিলোনা টেকনাফ কেনো গিয়েছি?ঢামেক ছেড়ে কি করে আসলাম?তাহলে বলছি।শোনো।ঢামেক কেবল আমার স্বপ্ন ছিলোনা এটা ছিলো আমার ভালোবাসা,আমার হৃদয়াবেগ।পরিবারের পর আমার দ্বিতীয় ভালোবাসা ছিলো এটাই।কখনো কল্পনায়ও ভাবিনি এই ঢামেক ছেড়ে একদিন আমায় এতোদূর চলে আসতে হবে।পরিস্থিতির জাতাকলে পড়ে আজ আমি এখানে।মানুষ এমনই মেয়ে।মানুষ সবকিছু পারে।সবকিছু পারতে হয়!পরিস্থিতি সব শিখিয়ে দেয়।তুমিও পারবে।তোমাকে পারতে হবে”
যোহরের আযান দিয়েছে কেবল।ঘড়িতে মিনিটের কাটাটি বারোটা তেপ্পান্নোতে এসে ঠেকেছে।সেকেন্ডের কাটাটা চলছে বিরামহীন।ঠিক এমন সময় দরজার কড়াঘাতে কোমড়ে ওড়না পেচানো চাঁদ রান্নাঘর থেকে দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে হাত দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে দরজার দিকে এগোচ্ছে।হঠাৎ করে তার পাশে রামিম এসে বলে,
“ডোন্ট ওরি প্রিটি লেডি!আমিই খুলে দিচ্ছি”
চাঁদ হাসার চেষ্টা করে বলে,
“সমস্যা নেই ভাইয়া।আপনি বসুন আমিই যাচ্ছি”
“কিন্তু তুমি রান্না করছিলেতো”
“চুলার আচ কমিয়েই এসেছি।তাছাড়া দেখিতো এসময় কে আসলো।সবাইতো ভেতরেই আছে।বোধহয় খালামনি এসেছে।আপনি যান আমিই দেখছি”
“ওকে অ্যাজ ইওর উইশ”
বলেই রামিম চৈত্রের রুমের দিকে এগোয়।ওখানেই ছেলেদের নিবাস আপাতত।
চাঁদ দরজা খুলতেই দেখতে পায় ব্যারিস্টারি পোশাকে খানিকটা ওয়েস্টার্ন কালচারে নিজেকে উপস্থাপন করা এক মেয়েকে।চাঁদ কিছু বলতে নিলেই মেয়েটা চাঁদকে পাশ কাটিয়ে ভেতরে এসে খানিকটা উচু গলায় উৎফুল্লতার সহিত বলে উঠে,
“হেই লিটেল অ্যাঞ্জেলস আ’ম ব্যাক!”
To be continued…