#বিবর্ণ_বৈশাখে_রংধনু
#নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_১২
আরহান রুহানীকে আলতো হাতে নরম স্বরে ডাকে।
“রুহানী কোথায় হারালে?”
আরহানের মৃদু স্বরে ডাকও যেন রুহানীকে ভয় পাইয়ে দিল। ধড়ফড়িয়ে উঠে কিঞ্চিত দূরে সরে গেল। গলা দিয়ে পীড়াদায়ক গোঙ্গানি বের হচ্ছে। রুহানীর এহেন অবস্থা দেখে আরহান ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলে,
“এমন করছ কেন তুমি? রিল্যাক্স হও প্লিজ। কিছু হয়নি। এভরিথিং ইজ ফাইন।”
আরহান যতোই রুহানীকে শান্ত করতে চাইছে রুহানী ততোই হাইপার হয়ে যাচ্ছে। তার শ্বাস উঠে যাচ্ছে। চোখ-মুখ র*ক্ত বর্ণ ধারণ করছে। ক্রমাগত শরীর ঝাঁকি দিয়ে ঠান্ডা হচ্ছে সেই সাথে ঘাম! প্যা*নিক অ্যা*টাক করেছে ওর। আরহানও এবার ভয় পেয়ে যায়। দ্রুত রুহানীকে নিজের সাথে চেপে ধরে শান্ত করার প্রয়াস করে তারপর সময় জ্ঞাপন না করে দ্রুত কোলে তুলে নিয়ে হাঁটা শুরু করে। আরহান বুঝতে পারছে রুহানীর শরীর তার ভার ছেড়ে দিচ্ছে। তাই সে অনবরত কথা বলতে শুরু করে।
“চোখ বন্ধ করবে না। কিছু হয়নি। পাখির শব্দ শুনতে থাক। ওভারথিংকিং করবে না। ভালো কিছু ভাব। তোমার ফেভারিট কাজ, খাবার সব। ভাবতে থাক। মাইন্ড ডাইভার্ট করো।”
আরহান পায়ের গতি বাড়াচ্ছে। ঢাল দিয়ে সাবধানে নেমে প্রায় পাঁচ-সাত মিনিটের মধ্যে রুহানীদের বাংলোর কাছে পৌঁছে যায়। দারোয়ান একটা ছেলের কোলে রুহানীকে দেখে ছুটে এসে জিজ্ঞাসা করেন,
“কী হয়েছে আপার?(সিলেটি ভাষাকে কনভার্ট)”
“গেইট খুলেন আঙ্কেল। মিসেস জাহানারা শেখকে ডাকুন।”
দারোয়ান দ্রুত বড়ো গেইট খুলে দেয় যাতে আরহান আরামছে রুহানীকে নিয়ে ঢুকতে পারে। অতঃপর দ্রুত পায়ে বাড়ির ভেতরে গিয়ে জাহানারা শেখকে বলেন। আরহান রুহানীকে নিয়ে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করা মাত্রই জাহানারা শেখ অস্থির কণ্ঠে শুধান,
“কী হয়েছে ওর? এমন প্যা*নিক অ্যা*টাক কেন করছে?”
“আন্টি রুহানী কি কোন ইনহেলার ইউজ করে? ওটা দ্রুত নিয়ে আসুন। ওর শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি অনেক কমে এসেছে।”
আরহানের কথা শুনে জাহানারা শেখ দ্রুত রুহানীর ইনহেলার নিয়ে এসে আরহানের হাতে দেয়। আরহান রুহানীকে এক বার পাম্প দিয়ে আস্তে আস্তে মাথায় হাত বুলাতে থাকে। জাহানারা শেখ রুহানীর পিঠে ম্যাসাজ করতে থাকে। জাহানারা শেখ ইনহেলার নিয়ে আরেকবার দিতে চাইলে আরহান বাধ সাধে।
“না আন্টি। একবারই। এটা রিলিফার। একবারই দিবেন। একসাথে একাধিকবার দিলে হিতে বিপরীত হতে পারে। এয়ারওয়ে ব্লক হয়ে যেতে পারে। রুহানী একটু স্টেবল হলে তারপর দেখা যাবে।”
জাহানারা শেখ মাথা দুলিয়ে মেনে নেন। সার্ভন্টকে ডেকে পানি আনতে বলে। আস্তে আস্তে কয়েক মিনিটের মধ্যে রুহানীর শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক হতে শুরু করে। তারপর জাহানারা শেখ ওকে পানি খাইয়ে আরহানকে জিজ্ঞেসা করে,
“ওর এরকমটা কিভাবে হলো?”
“রুহানীকে দেখেছিলাম ও ছবি তুলছিল। তখন আমি পেছন থেকে ডেকে আমি আমার পালিত খরগোশটাকে আমি নিয়ে এসেছিলাম সেটা দেখাতে আসতে বলেছিলাম। যখন ও পেছনে ঘুরে আমার কাছে আসতে নিবে তখনি ওর কানের কাছ ঘেষে একটা গু*লি গিয়ে সামনের গাছে বসা একটি পাখিকে আঘা*ত করে। তারপরই ওর এই অবস্থা?”
জাহানারা শেখ ভীত হলেন। হড়বড়িয়ে বলেন,
“গু*লিটা কি ওকে উদ্দেশ্য করে ছিল? তুমি শু*টারের চেহারা দেখেছ? কে সে?”
জাহানারা শেখের উৎকণ্ঠা আরহান বুঝল। সে বলল,
“না আন্টি। আমি তো চেহারা দেখিনি। তাছাড়া এখানে শি*কা*রিরা আড়ালে পাখি শি*কার করে। যে গু*লি করেছে সে কোন শি*কা*রি হবে। তাছাড়া আজ তো ছুটির দিন। কোনো শ্রমিক নেই চা বাগানে। তাই হয়তো এই সুযোগে পাখি শি*কা*র করতে এসেছিল। তারপর আমাদের দেখে পালিয়ে গেছে। আপনি হাইপার হবেন না। আজকে চা বাগান অনেকটাই নির্জন।”
আরহান জাহানারা শেখকে যা বুঝিয়েই শান্ত করতে চাক না কেন, জাহানারা শেখের মনের মধ্যে ভয় রয়েই গেছে। আঠারো বছর আগের ঘটনার কি তবে পুনরাবৃত্তি হতে চলেছে? তিনি তার শঙ্কা আরহানকে বুঝতে দিলেন না। ঠোঁটকোলে মৃদু হাসি ফুটিয়ে বললেন,
“তুমি যদি সময় মতো ওকে না সামলাতে তাহলে যে আজ কী হতো জানি না বাবা। অনেক অনেক ধন্যবাদ।”
“না আন্টি, ধন্যবাদ দিতে হবে না। বিপদে পাশে দাঁড়ানো সব মানুষের কর্তব্য।”
আরহানের কথায় জাহানারা শেখ মুচকি হেসে বলেন,
“তুমি বসো। আমাদের সাথে নাস্তা করবে।”
আরহান হাতঘড়ির দিকে চেয়ে বলে,
“আন্টি, আজ না। দাদী অপেক্ষা করে আছে। আমি না যাওয়া অবধি তিনি খাবেন না। তাছাড়া আজ তো আপনাদের সাথে আবার দেখা হচ্ছে।”
“একটু তো কিছু মুখে দাও। জুসটাই নাহয়। এটা আমি না শুনব না। পাঁচ মিনিট বসো। ফ্রেশ মালটার জুস আনছি।”
জাহানারা শেখ আরহানের আর একটা কথাও শুনলেন না। তিনি রান্নাঘরের দিকে চলে গেলেন। আরহান রুহানীর কাছে গিয়ে ফ্লোরে হাঁটু মুড়ে বসে। রুহানী চোখ বন্ধ করে সোফায় গা এলিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে। আরহান ওর ঘন পাঁপড়িযুক্ত মুদিত নয়নজোড়া দিকে চেয়ে কপালে পড়ে থাকা চুলগুলো সরিয়ে দিলে তৎক্ষণাৎ রুহানী চোখ খুলে তাকায়। আরহান জিজ্ঞাসা করে,
“এখন ঠিক লাগছে?”
রুহানী ইশারায় হ্যাঁ বোধক বুঝিয়ে উঠে বসে। আরহান বলে,
“জানি তোমার একাকি প্রকৃতিতে ঘোরাফেরা করতে ভালো লাগে। কিন্তু সব সময় তো আর বিপদ বলে কয়ে আসে না। যেমন দেখো আজকে যদি ওখানে আমি না থাকতাম তাহলে তুমি এই গু*লির শব্দে ওখানেই সেন্সলেস হয়ে পড়ে থাকতে। তারপর তোমাকে কে বাঁচাতো? কারণ আজকে কোন শ্রমিক চা বাগানে যাবে না। ফাঁকা বাগানে তুমি কোথায় আছ কে জানত? সেদিনও তুমি একা একা নির্জন চা বাগানে রাতের বেলায় বেরিয়ে পরেছিলে। তোমার কি এটা ভাবনায় আসেনি এই অন্ধকারে তোমার কোন বিপদ হলে তোমাকে কে বাঁচাতো? দুইবার তুমি আমার সামনে পড়েছ বলে কি প্রতিবার আমি থাকব? একটু কেয়ারফুল হও। কাউকে সাথে করে নিয়ে বের হও। আর আমি এটাও জানি তুমি তা করবে না! তোমার চোখ-মুখ বলে দিচ্ছে তুমি বারবার একা একা চা বাগানে ঘুরতে বেরিয়ে পরবে।”
আরহানের প্রথম দিকের কথাগুলোতে রুহানী মাথা নিচু করে শুনছিল কিন্তু তার শেষোক্ত কথায় রুহানী মুখে হাত দিয়ে হাসে। আরহান বলে,
“দাদী বলল, তোমরা নাকি এখানে পার্মানেন্ট থাকতে এসেছ? এখানেই নাকি ভর্তি হয়েছ?”
রুহানী হ্যাঁ বোধক মাথা দুলালে আরহান বলে,
“বছরের প্রায় মাঝামাঝিতে ভর্তি হলে। পড়াশোনায় মনোযোগ দাও। তা কোন সাবজেক্টে?”
রুহানী ঠোঁট নাড়িয়ে নিঃশব্দে বলে,
“বোটানি।”
“বোটানি?”
আরহানের প্রশ্নে রুহানী মাথা নাড়ায়।
“তাহলে তো ভালোই। প্রকৃতিকে বইয়ের পাতায় পড়বে। বেস্ট অফ লাক।”
ততক্ষণে জাহানারা শেখ জুস নিয়ে চলে আসলে আরহান জুস খেয়ে বিদায় নিয়ে চলে যায়। তারপর জাহানারা শেখ রুহানীকে নিয়ে রুহানীর ঘরে যায়। রুহানী তার চাচিকে ইশারায় বলে যেন চাচাকে ঘটনাটা না বলে।
“কেন বলব না? সেফটির ব্যাপার এটা।”
রুহানী খাতায় লিখে,
“আরহান তো বলল, এমনভাবে আড়ালে পাখি শি*কার হয়। পাখিটা তো র*ক্তাক্ত অবস্থায় জমিনে পরেছিল। তুমি চাচুকে বলো না। টেনশন করবে। আমি একটু ঘুমালে ঠিক হয়ে যাব। তারপর তো দাওয়াতে যেতে হবে। তাই না? প্লিজ বলো না।”
জাহানারা শেখ লেখাটা পড়ে বলেন,
“এখন না বলি তবে তোমার পায়ে আমি লাগাম টানতে ঠিক বলব। হুটহাট একা একা বের হওয়া বের করছি।”
রুহানী মায়াবি দৃষ্টিতে তাকালেও জাহানারা শেখ তা আগ্রাহ্য করে ওকে রেস্ট করতে দিয়ে বাহিরে চলে যান। চাচির চলে যাওয়া দেখে রুহানী লম্বা নিঃশ্বাস ত্যাগ করে চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করে।
_____
“আজকেও পারলে না? আজ কতো মুক্ষোম সুযোগ ছিল। আজ যদি গু*লিটা পাখির গায়ে না লেগে রুহানীর শরীরে লাগত তবে সব কাহিনী খ*তম! কিন্তু আমি যে কয়েকটা অপ*দার্থকে রেখেছি! কিচ্ছু হবে না তোমাদের দিয়ে। কোনদিন যেন আমি তোমাদেরকেই পৃথিবী ছা’ড়া করি! ”
ফোনের অপরপাশ থেকে হুং-কার শুনে লোকগুলো তটস্থ হলো। বড়ো ঢোক গিলে বলল,
“মাফ করবেন। ওই ছেলেটা না থাকলে আজকেই কাজ হয়ে যেত। এরপর থেকে আমরা যথাসম্ভব চেষ্টা করব। আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন।”
“তাই যেন হয়। আবারও নতুন সুযোগ খুঁজো। কোনোভাবেই ধরা পরা চলবে না। এমন ভাবে সব করবে যাতে সা*পও ম*রে লাঠিল না ভাঙে!”
“জি জি। মনে থাকবে।”
ফোন ডিসকানেক্ট হয়ে যায়।
চলবে ইনশাআল্লাহ,
ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। কপি নিষিদ্ধ।