#আবার_প্রেম_হোক
#নুসরাত_জাহান_মিম
৫১.
সময়টা চৈত্র মাসের।সূর্যের প্রকোপ তাপ,ধরণীকে যেনো তার উত্তাপে ফেলার আয়োজনে সর্বদা মত্ত।আকাশ ক্ষণে ক্ষণেই ঘনকালো মেঘে হয় আচ্ছাদিত।বৃষ্টি আসেনা,তবুও বর্ষণের অপেক্ষায় প্রাণিকুলের হৃদয় হয়ে থাকে চঞ্চল।সেই চঞ্চল হৃদয় খা খা করে উঠে এক পশলা বৃষ্টির জন্য।অথচ নিষ্ঠুর আকাশের করুনা হয়না।মায়া জন্মায়না নিরীহ প্রাণী,ফে!টে চৌচির হওয়া মাঠ,শুকিয়ে যাওয়া ঘাস অথবা নিস্তেজ তরুর জন্য।চৈত্রের আগমণে ধরণীর সকলকিছু হয়ে উঠে নির্দয়,নিঠুর।সর্বনাশা চৈত্রমাস সমস্ত কিছু গ্রাস করে নেয় যেনো।এমনই কোনো অজানা আশংকা চিত্ত চি!ড়ে দিচ্ছে চাঁদের।গরমে হাশফাশ করছে সে।বান্ধবীদের সাথে অযথা কলেজের আসার কারণ খুঁজে পাচ্ছেনা।তাদের পাশে বসে থেকেও শান্তি মিলছেনা।এই মাসটা আসার পর থেকেই মনের মাঝে নানান কু ডাকে চাঁদের।সে জানেনা কেনো তবে অদ্ভুত অদ্ভুত ভাবনা মনের মাঝে হানা দেয়।সে চায়না সেসব কখনো সত্যি হোক।কবি-গুরুদের বিভিন্ন উক্তি তার মনে পড়ে।এবং সে চৈত্রমাস নিয়ে ভাবে।কেবলই ভাবে আর ভাবনার সাগরে ডুবে যেতে চায়।হঠাৎ করেই চাঁদ অবনীকে জিজ্ঞেস করে,
“দোস্ত?চৈত্রমাসকে সর্বনাশা বলা হয় ক্যান বলতো?”
কপাল কুচকে অবনী বলে,
“কিসব বলছিস?”
ইপ্সিও জিজ্ঞেস করে,
“এসবই ভাবছিলি এতোক্ষণ ধরে?”
খানিকটা হেসে দুই পা ঘাসের উপর মেলে দিয়ে দু’হাত পেছন দিকে দিয়ে আকাশপানে দৃষ্টি রেখে চাঁদ বলে,
“ধ্বং!সাত্মক চৈত্রমাস,ডেকে আনে সর্বনাশ!”
হঠাৎ ই ইপ্সির প্রশ্ন,
“কী আজগুবি কথাবার্তা বলছিস?”
এবার নিজেকে ঠিক করে চাঁদ বলে,
“এক্সাম শেষ হলো এক সপ্তাহও হয়নি।রেজাল্ট দিতে ঢের বাকি।তোরা বল বিনাকারণে আমায় কলেজে কেনো আনিয়েছিস?”
মুখ গোমড়া করে অবনী বলে,
“আমাদের সাথে বুঝি তোর দেখা করতে ইচ্ছা হয়না?”
চাঁদ সন্দিহান চোখে অবনীকে দেখে বলে,
“আমি কিন্তু খালা ননি পুতুল নই,যে তোমার কথায় গলে যাবো।কাহিনী কী তা বলো”
চাঁদের কথায় চ!টে গিয়ে অবনী বলে,
“হ্যা হ্যা তুই কেন গলবি?তুইতো হচ্ছিস পাথরে মোড়ানো হৃদযন্ত্রের মানবী”
দীর্ঘশ্বাস ফেলে চাঁদ বলে,
“এই পাথরের হৃদযন্ত্রটাও মাঝেমধ্যে নিখুঁতভাবে ভেঙে যায়”
এমনি সময় ইফাদ আর ফায়ান এসে তাদের দুইপাশে বসে।বসেই ফায়ান বলে,
“আমাদের ছাড়াই গল্প করা হচ্ছে?”
আরেকবার লম্বা করে শ্বাস ফেলে চাঁদ শুধায়,
“কী আর করবো গল্প?জীবনের দৈর্ঘ্য তো খুবই স্বল্প!”
খানিকটা রাগ দেখিয়ে ইফাদ বলে,
“এসব কেমন কথা চাঁদ?”
চাঁদের পালটা প্রশ্ন,
“কেমন কথা ইফাদ?”
“এভাবে বলছো কেনো?”
“কীভাবে বললাম?”
“কেমন যেনো!”
“কেমন?”
অবনী কপাল কুচকে বলে,
“তখন থেকেই তোর নেগেটিভ কথা শুনে যাচ্ছি।মেজাজ খারাপ করিস না বললাম”
ফায়ান জিজ্ঞেস করে,
“তখন থেকে মানে?”
ইপ্সি উত্তর দেয়,
“আসার পর থেকেই কেমন উদ্ভট উদ্ভট কথাবার্তা বলছে”
ফায়ান চাঁদকে জিজ্ঞেস করে,
“কী হয়েছে তোমার?আমাদের বলবে?সমস্যাটা আসলে কোথায়?”
চাঁদ উদাসীনভাবে বলে,
“হৃদয় পো*ড়ায় চৈত্রমাস!চিত্তজুড়ে তার বাস”
ফায়ান নিম্নকন্ঠে বলে,
“কারো জন্যই জীবন থেমে থাকেনা”
ইফাদ বলে,
“সেদিন কিন্তু চলে গেলে চাঁদ।আজ আমরা সারাদিন ঘুরবো,আড্ডা দেবো।এই প্ল্যানিং করেই বেরিয়েছি সবাই”
অবনীও বলে,
“আর টেনশন নিবিনা আন্টির সাথে আমার কথা হয়েছে।আন্টিকে বলেছি আজ আমরা ঘুরবো।আন্টি বলেছেন রাত করে ফিরলেও সমস্যা নেই।তাই বলেই দিয়েছি আজ তুই আমার বাসায় থাকবি।ইপ্সিও থাকবে”
কপাল কুচকে চাঁদ জিজ্ঞেস করে,
“আম্মু রাজি হয়েছে?”
ইপ্সি জবাব দেয়,
“আলবাত হয়েছে!উলটো আন্টি বললেন আগামীকাল বিকালে যেনো তোকে দিয়ে আসি।তোর মন নাকি ইদানীং ভালো যাচ্ছেনা?”
প্রসঙ্গ এড়িয়ে চাঁদ ইফাদকে বলে,
“তা ইফাদ,কোথায় কোথায় ঘুরবো আমরা?”
ঠিক তখনই ফায়ানের ফোনটা বেজে উঠে।বাজতেই সে ফোনের দিকে চেয়ে সকলকে বলে,
“তোরা ডিসাইড কর কোথায় কোথায় যাবি।আমি একটু আসছি”
বলেই কল রিসিভ করে ফোন কানে লাগিয়ে বন্ধুদের থেকে খানিকটা দূরে আসে ফায়ান।
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
বন্ধুমহলকে নিয়ে শপিং এ বেরিয়েছে প্রণয়।কাউকেই আজ হাসপাতালে যেতে দেয়নি।অবশ্য ওরাও যেতো না।মনমরা কেবল পূর্ণতা।তবুও হাসিমুখে বন্ধুর সাথে এসেছে।আগে অতিরিক্ত খারাপ লাগলে প্রকাশ করে ফেলতো তবে এখন নিজেকে বুঝ দিয়েছে,যথেষ্ট সামলে নিয়েছে।যদিও সকলকে দায়িত্ব ভাগাভাগি করে দিয়েছে তবুও শান্তি মিলছেনা প্রণয়ের।সে অস্থির হয়ে আছে।এই আজকের এই দিনটার জন্য অনেক অপেক্ষা করেছে এবং প্রিয় কাউকে করিয়েছেও।তাই কোনোপ্রকার ত্রুটি সে রাখতে চায়না।সেজন্যই সবকিছুর তদারকি ঘুরেফিরে নিজেই দেখছে।পূর্ণতা এক ধ্যানে বন্ধুকে দেখছে।অতঃপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে তার পানে এগিয়ে এসে শুধায়,
“খুব ভালোবাসিস চাঁদকে?”
প্রণয় কিছু বলেনা কেবল ঠোটের দু’পাশ অল্প একটু প্রসারিত করে।যার ফলস্বরূপ অধরযুগোলে হাসির রেখা স্পষ্ট না হলেও চোখ দুটো স্বেচ্ছায় হেসে উঠে।অতঃপর অরণের ডাকে সে পানে তাকায় পূর্ণতা আর প্রণয় যায় মিরের কাছে।প্রণয় যেতেই খানিকটা দূরে এনে অরণ পূর্নতাকে বলে,
“খুব কষ্ট হয় তোর তাইনা?”
ম্লান হেসে পূর্ণতা বলে,
“আগে হতো।এখন হয়না রে”
“মানিয়ে নিয়েছিস?”
“মানিয়ে নেওয়ার কিছু নেই।ও তো কখনোই আমার ছিলোনা।আমিই বেশি এক্সপেক্ট করেছি।এয়ো জানতাম কখনো আমার হবেও না।কিন্তু ভাবতে পারিনি কারো জন্য প্রেমের ফোয়ারা হৃদয়ে লালন করে ফেলবে অথবা করতে পারবে কখনো”
“কিন্তু প্রণয়ের হৃদয়ে তো ফোয়ারা নয় সাগর লালিত আছে”
“হয়তো তেমনটাই”
অরণের হঠাৎ প্রশ্ন,
“আমরা যাদের কখনোই পাবোনা অথবা যাদের থেকে ভালোবাসা পাওয়া একেবারেই অসম্ভব তাদেরই কেনো ভালোবাসি রে?”
“এই প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে নেই রে”
“প্রণয়কেতো তুই আজ থেকে না কলেজ লাইফ থেকেই পছন্দ করিস।মেডিকেলে এসেও কখনো বলিস নি কেনো?”
“এ প্রশ্নটা আদোতে মানালো তোকে অরণ?”
“কেনো?”
“প্রণয় আমায় কেবলই বন্ধু ভাবে।আর আমি চাইনি আমার বন্ধুকে হারাতে।থাক না কিছু অনুভূতি লুক্কায়িত।কাউকে কখনো জানাস নারে আমার মনের এই সুপ্ত অনুভূতি।আর এয়ো চাইনা প্রণয় কখনো জানুক অথবা বুঝে যাক”
“এজন্যই নিজেকে খুশি দেখানোর নাটক করছিস?”
“নাটক নারে।আমি চাঁদ আর প্রণয়ের জন্য সত্যিই খুশি।কেনোনা এটা দুইপাক্ষিক।আমারটাতো একপাক্ষিক,যা কখনোই পূর্ণতা পাবার নয়”
বলেই হাসে পূর্ণতা।তা দেখে অরণ জিজ্ঞেস করে,
“হাসছিস কেনো?”
“হাসছি নিজের ভাগ্যের উপর”
“কেনো?”
“দেখ না।নিজের ভালোবাসার পূর্ণতাই পেলাম না।অথচ নাম আমার পূর্ণতা।আমার নামও আমার সাথে মশকরা করে রে”
“পূর্ণ!”
“ভালো লাগছেনা।আমি একটু বাইরে থেকে আসছি।তুই প্রণয়ের সাথে যা”
বলেই পূর্ণতা শপিং মলের বাইরে বের হয়।পূর্ণতা যেতেই তার পাশে এসে দাঁড়ায় মিরা।অরণ পাশে ঘুরেই বলে,
“পূর্ণ মন খারা…”
বলতে গিয়েও থেমে যায় অরণ।তা দেখে স্মিত হেসে মিরা বলে,
“পূর্ণকে এক্সপেক্ট করছিলি?”
“না মানে”
“দেখেছি তোদের।দুঃখিত,কথাও শুনলাম”
“দুঃখিত কেনো বলছিস?এমনতো না যে পূর্ণর ব্যাপারে তুই কিছু জানিসনা”
“তা জানি।তবে এটা জানতাম না কেউ কাউকে এতোটা চাওয়ার পরেও,বিনিময়ে কষ্ট ব্যতীত কিছু না পাওয়ার পরেও কেবল তারই মঙ্গল চায়।এমন ভালোবাসা ক’জনের ভাগ্যে জোটে?নিশ্চয়ই পূর্ণ ভাগ্যবতী কেউ”
কোনোকিছু না বলে কেবল মিরার পানে চেয়ে আছে অরণ।তা দেখে মিরা বলে,
“আমি যে কিছুই বুঝিনা বা বুঝতে পারবোনা এটা ভাবা বোকামি বৈ কিছুনা।আর আমি জানি তুই বোকাদের তালিকায় পড়িস না”
দীর্ঘশ্বাস ফেলে অরণ বলে,
“একটু আগে শুনিস নি?ভাগ্যকে উপহাস করে গেলো”
“তুই কখনো জানাস নি তাই”
“জানালেও যে খুব কিছু হয়ে যেতো এমনও না।উলটো বন্ধুত্বে ফাটল ধরতো”
“একপাক্ষিক সর্বদা দুঃখই দেয় রে অরণ”
“তোর কাছেতো সবকিছুর উত্তর থাকে।আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দিবি?”
“আমি হয়তো জানি।তবুও বল”
“কী জানিস?”
“এই যে তুই কী প্রশ্ন করবি”
“বল তাহলে?”
“যাকে জিজ্ঞেস করেছিস সেতো বললোনা”
“উত্তর জানতে পারিনি বিধায়ই তোকে জিজ্ঞেস করা”
“প্রশ্নটা আবার কর।তোর মুখ থেকে শুনতে চাচ্ছি”
“জানিসই তো”
“শোনা না?”
মিরার কথায় কী যেনো ছিলো।কিসের এক টান!অরণ উদাস গলায় বললো,
“যাদের পাওয়া একেবারেই দুষ্কর তাদের প্রতিই আমাদের ভালোবাসা কেনো জন্মায় বলতে পারিস?”
ম্লান হেসে মিরা জবাব দেয়,
“ভালোবাসার সংজ্ঞা একেক জনের কাছে একেক রকম।তন্মধ্যে একপাক্ষিক ভালোবাসাটা কারো কাছে প্রশান্তির তো কারো আছে অশান্তির।আমি মনে করি দু’টোর মিশ্রণই এটা।যাকে ভালোবাসি তাকে নিয়ে ভাবতেই প্রশান্তি অনুভূত হয় আর অন্যের সাথে দেখলে অথবা ভাবলে হৃদয় পু*ড়ে অশান্তি বাড়িয়ে দেয়।আর রইলো যাকে পাবোনা তাকে ভালোবাসার কথা?তাহলে বলবো ভালোবাসা জেনেশুনে হয়না।কখন হবে,কার সাথে হবে,কোন প্রহরে হবে সবটা বিধাতাই নির্ধারণ করে রাখেন।নিশ্চয়ই তিনি সর্বোত্তম পরিকল্পনাকারী।যার দরুন হৃদয়ে এমন কারো বসবাস হয়ে যায় যাকে কখনোই পাওয়া সম্ভবনা জেনেও মন কেবল তাকেই চায়।তাকে পাওয়ার আশা রাখে,জানে পাবেনা তবুও!”
“যাদেরকে আমরা ভালোবাসি তারা কেনো অন্যকে মন উজাড় করে ভালোবাসে বলতে পারিস?”
খানিকটা হেসে মিরা শুধায়,
“এ যেনো এক ধারাবাহিকতায় পরিণত হয়েছে।আমরা যাকে ভালোবাসি তারা অন্যের ভালোবাসায় মত্ত।আবার আমরা যাদেরকে কখনো ভালোবাসতে পারবোনা,প্রায় অসম্ভব তারা আমাদের মন উজাড় করে ভালোবাসে”
“কেনো হয় এমনটা?”
“আল্লাহ চান বলেই হয়।তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে গাছের একটা পাতাও তো নড়েনা রে”
লালবাগ এসেছে চাঁদেরা পাঁচজনে।বর্তমানে তারা কেল্লার ভেতরে ঘাসের উপর বসে চিপ্স চিবাতে ব্যস্ত আর গল্পে হয়ে আছে মশগুল।চাঁদ বেশ বিরক্ত হয়ে বলেই ফেলে,
“শা*লা গরম লাগছে।এই গরমে কেউ কেল্লায় আসে?আর কেল্লায় এমন আছে টা কী ভাই?তোরা না বের হলে কিন্তু আমি একাই বেরিয়ে যাবো আর ডিরেক্ট বাসায় যাবো”
লাফিয়ে উঠে ইপ্সি আর অবনী।ইপ্সি চিপ্সের প্যাকেট মোচড়াতে মোচড়াতে বলে,
“না বোইন বাসায় যাওয়া লাগবেনা।বেরুচ্ছি আমরা”
ইফাদ উঠতে উঠতে বলে,
“পাস্তা ক্লাবে চল লাঞ্চ করে বেরুবো”
ফায়ান বলে,
“এখান থেকে আমার বাসা কাছে।চল বাসায় লাঞ্চ করাবো।পাস্তা টাস্তা খেতে ইচ্ছা করছেনা”
চাঁদও তাল মেলায়,
“এই গরমে আপাতত আমি একটু ঠান্ডা হতে চাই।তোমার বাসায়ই যাচ্ছি।তোদের মুখ দিয়ে যাতে কোনো সাউন্ড না হয় বলে দিলাম।নাহয় সোজা বাসায়!”
অবনী ধমকে উঠে বলে,
“পাইছে একটা!বাসায় যাওয়ার হুম!কি।শ*য়তা*ন মহিলা।চল”
অতঃপর পাঁচজনই হাটা ধরে ফায়ানের বাসার উদ্দেশ্যে।
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
বিকাল পাঁচটা,
ফায়ানের রুমে একেকজন চিৎপটাং হয়ে পড়ে আছে।ইফাদ এক পা সোফায় অপর পা ফ্লোরে দিয়ে শুয়ে আছে।অবনী শুয়ে আছে ফায়ানের বিছানার অর্ধেকের বেশি জায়গা জুড়ে।তার পায়ের কাছেই ঠেলে ঠুলে হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে ইপ্সি।চাঁদ আরেক পাশের সোফায় কনুই ঠেকিয়ে কপালে হাত রেখে আধশোয়া হয়ে আছে।আর ফায়ান তার পড়ার টেবিলের কাছের চেয়ারটায় বসে বন্ধুবান্ধবের কান্ড পর্যবেক্ষণ করছে।তা দেখে খেকিয়ে উঠে অবনী বলে,
“চোখ দিয়ে গি*লে খাচ্ছিস ক্যান?”
ফায়ান ঠোট উলটে বলে,
“তোদের খেতে আমার বয়েই গেছে!দ*জ্জাল কোথাকার”
অবনী তেতে উঠে শোয়া থেকে উঠে বসে বলে,
“অ্যাই কী বললি তুই?”
ধড়ফড়িয়ে ইফাদ উঠে বলে,
“ভূমিকম্প হচ্ছে?”
চাঁদ খানিকটা হেসে ঠোট টিপে বলে,
“না।অবনীকম্প হচ্ছে”
ইপ্সিও উঠে বসে অবনীকে বলে,
“এই বেডি কম চিল্লাবি।কানের পোকা নাড়িয়ে ফেলেছে একদম,বে*য়াদব কোথাকার”
অতঃপর ফায়ান বলে,
“রোদ পড়ে গেছে।তোরা ফ্রেশ হয়ে রেডি হয়ে নে বেরুবো আমরা।ভাল্লাগছেনা বাসায় বসে বসে”
অবনী ফায়ানের দিকে চেয়ে ভড়কে বলে,
“শা*লা তোর কারণে আমার আয়রণ করা জামাকাপড় নষ্ট হয়েছে”
কপাল কুচকে ফায়ান বলে,
“আমি কী করেছি?”
“তোর কারণেইতো বাসায় এসেছি।আর এখন এই দেখ জামা,ওড়না কুচকে গেছে আমার”
“তো এটা আমার দোষ?”
“তা নয়তো কী?”
ইফাদ জবাব দেয়,
“নিজে যে দুইজনের জায়গা খেয়ে গড়াগড়ি খেয়েছে সেটার কোনো দোষ নাই”
“অ্যাই কী বললি তুই?”
ইপ্সি বলে,
“আমরা সবাই যা শুনেছি।নিজের দোষ স্বীকার কর বে!য়াদব মহিলা”
অবনী চেচিয়ে বলে,
“দেখ তোরা!”
তখনই চাঁদ বলে,
“থাম বলছি!কখন থেকে ঝগড়া করেই যাচ্ছে করেই যাচ্ছে।এই ইফাদ,ফায়ান বেরোয় তো তোমরা।আমরা ঠিকঠাক হয়ে বাইরে আসছি”
“ঠিক আছে”
বলেই ফায়ান আর ইফাদ বেরিয়ে পড়ে।অতঃপর পৌনে ছয়টার দিকে সকলে মিলে বের হয় হাতিরঝিলের উদ্দেশ্যে।সেখানে যেতে যেতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে যাবে।আর রাত্রের বেলাই হাতিরঝিলের পরিবেশ সুন্দরভাবে অবলোকন করা যায়।সেই দরুনই সেখানে যাওয়ার পরিকল্পনা তাদের।
সন্ধ্যা তখন সাতটা বেজে সতেরো মিনিট,
প্রণয়সহ তার বন্ধুমহলের সকলেই অবনীর বাসার ছাদে উপস্থিত।সেইসাথে আছে অবনীর ছোটবোন লাবনীও।সকলে মিলেই সবকিছু ডেকোরেট করতে ব্যস্ত।প্রণয়ই সবকিছু বলে দিচ্ছে কিভাবে কী করবে,কোনটা কোথায় লাগাবে,কীভাবে সবটা সাজানো হবে ইত্যাদি বিষয়াদি।নিজেও মাঝেমাঝে এটা ওটা করছে।পুরো ছাদটাকে গোলাপি আর সাদার মাঝে সজ্জিত করতে ব্যস্ত প্রতিটা ছেলেমেয়ে।বেলুন ফোলানোর কাজে আছে রবিন,লাবনী আর মিরা।রিহা আর পূর্ণতা সামলাচ্ছে লাইটিং এর তারগুলো।অরণ আর মির মিলে মই বেয়ে পর্দাগুলো লাগাতে ব্যস্ত।আর প্রণয় সবাইকে সঠিক নির্দেশনা দিচ্ছে।
নয়টা পয়তাল্লিশে ছাদে এসে হাজির হয় ইফাদ আর ফায়ান।এসে দেখে ডেকোরেশন প্রায় শেষের পথে।ইফাদ প্রণয়ের কাছে এসে জিজ্ঞেস করে,
“কোনো হেল্প কি লাগবে ভাইয়া?”
প্রণয় জবাব দেয়,
“না,শেষই প্রায়।তোমরা বলো চাঁদ কিছু টের পায়নিতো?”
“না ভাইয়া”
“এখন কোথায় সে?”
“রাস্তায় আছে ওরা”
“তোমরা এতো জলদি?”
“আমরা আগেই বেরিয়েছি”
প্রণয় ইফাদের দিকে কয়েকটা শপিং ব্যাগ এগিয়ে দিয়ে বলে,
“এগুলো ধরো”
ইফাদ সবগুলো ব্যাগ নিতে পারছেনা দেখে প্রণয় ফায়ানকে ডাকে।ফায়ান এগিয়ে আসতেই প্রণয় বলে,
“দু’জন মিলে ব্যাগগুলো অবনীর রুমে রেখে আসো।আর খানিকটা লুকিয়ে চাঁদ যেনো টের না পায়”
ফায়ানের প্রশ্ন,
“কিন্তু এগুলোতে কী?”
“ড্রেস আর জুয়েলারিস”
ইফাদ জিজ্ঞেস করে,
“এতোগুলো!”
“সবার জন্যই আছে।আর এই যে এই ব্যাগটা এটা চাঁদের জন্য।এটা আলাদা রাখবে”
অবনীর বাসায় এসে তার রুমে কিছুক্ষণ রেস্টের পরই ইপ্সি আর অবনী মিলে চাঁদকে ঠেলেঠুলে ওয়াশরুমে পাঠায় ড্রেস চেঞ্জ করতে।বারবার জিজ্ঞেস করার পরেও যখন তারা কিছুই বলেনা হতাশ হয়ে চাঁদ তাদের কথাই মেনে নেয়।কিছুটা আঁচ করতে পেরেছে,বন্ধুরা হয়তো সারপ্রাইজ দেবে।তাই বিষয়টা আর ঘাটায়না সে।বান্ধবীদের কথানুযায়ী তৈরি হতে শুরু করে।ঠিক এগারোটা বেজে সাতচল্লিশ মিনিটে সবাই তৈরি হয়ে নেয়।তৈরি হয়েই ইপ্সি আর অবনী দুইপাশ দিয়ে চাঁদকে ধরে ছাদে উঠতে আরম্ভ করে।আর চাঁদ ব্যস্ত তার ড্রেস সামলাতে।কাচের জুতো কখনো পরেনি সে তাই বেশ সামলে একেকটা সিড়িতে পা দিচ্ছে,পাছে ভেঙে যায়?সবকিছুই পছন্দ হয়েছে চাঁদের।সে ভাবতেও পারেনি তার বন্ধুরা এভাবে তাকে সারপ্রাইজ দেবে।ছাদে কিভাবে কী করেছে তা জানতেই মন আঁকুপাঁকু করছে চাঁদের।ছটফট করছে হৃদযন্ত্রটা।বুকের ভেতর দ্রিমদ্রিম শব্দ বেগতিক বাড়ছে।সেতো মেডিকেলের স্টুডেন্ট সে দরুনই ডান হাত দিয়ে বুকের বাম পাশে হাত রাখে।শোনার চেষ্টা করে শব্দটা ঠিক কিরকম?বইয়ে যেমন পড়েছে তেমনই?নাকি অন্যরকম?এবং সে মনোযোগ দিয়ে শুনতে চায় শব্দটা ঠিক ‘লাব ডাব’ কিনা?চাঁদের এমন কাজে চেচিয়ে উঠে অবনী বলে,
“এমন করছিস কেনো?নিজেও পড়বি আমাদেরও ফালাবি”
ইপ্সিও বলে,
“সামলে হাট।জুতো ভাঙলে খবর আছে বলে দিলাম”
চাঁদ বান্ধবীদের হাত ধরে উপরে উঠতে উঠতে বলে,
“একেতো নিজেরাই চোখ বাধিয়েছিস আবার খোটাও দিচ্ছিস?আমি বলেছি এগুলো কর?”
অবনী আবারও বলে,
“হাসের মতো প্যাকপ্যাক না করে উপরে উঠতো।অলরেডি এগারোটা বায়ান্ন বেজে গেছে।জলদি কর”
“তোদের ছাদই তো আটতলা।এতে আমার কী দোষ?”
ইপ্সি বলে,
“তোরা ঝগড়া না করে উঠতো”
অতঃপর অপেক্ষার অবসান ঘটে।তিনজনে এসে ছাদের দরজার কাছে দাঁড়ায়।অবনী দরজায় টোকা দিতেই ওপাশ থেকে ইফাদ বলে,
“চলে আয়”
বন্ধুর কন্ঠ শুনে সাসপেন্স বাড়ে চাঁদের।না জানি কী কী করেছে তারা।অতঃপর বান্ধবীদের হাত ধরেই পা বাড়ায় ছাদের ভেতরে।
আকাশ থেকে মেঘের ‘গুড়ুম গুড়ুম’ ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।ক্ষণে ক্ষণেই বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে গগণে।ফাগুনের গরমকে পেছনে ফেলে চৈত্রের বৃষ্টি আকাশ চি*ড়ে ধরণীতে তার আগমন ঘটাতে চাচ্ছে যেনো।রাত্রি তখন এগারোটা বেজে ছাপ্পান্ন মিনিট।ছাদের উপর স্টেজ সাজানো হয়েছে সাদা আর গোলাপি কম্বিনেশনে।সাদা আর গোলাপি পর্দা দ্বারা মেইন জায়গাটা সাজানো হয়েছে।যেখানটায় সকলে বসবে।সাদা আর গোলাপি লাইটিং করা হয়েছে পুরো ছাদজুড়ে।ছাদের জমিনটায় সাদা-গোলাপি বেলুনের সমাহার।পুরো ছাদ মজে উঠেছে সাদা-গোলাপির মিশ্রণে।আর সকলের পরণে আকাশি রঙের ড্রেস।মেয়েরা গাউন আর ছেলেরা টাই-কোর্ট।কেবল চাঁদ আর প্রণয়ের গায়ে বিদ্যমান সাদা রঙ।চোখ বেধে সাদায় মোড়ানো প্রিন্সেস ড্রেসে আবৃত চাঁদকে ছাদের কিনার ঘে*ষে দাড় করায় অবনী।পুরো ছাদটাকে আকাশে বিদ্যমান অর্ধচন্দ্র তার আলোয় আলোকিত করতে ব্যস্ত।চাঁদের ঠিক ডান পাশেই গগণ হতে চন্দ্রিমা সফেদ কন্যারূপী চাঁদকে তার আলোয় করে তুলছে অভূতপূর্ব!এমতাবস্থায় ছাদজুড়ে ইপ্সির মিষ্টি আর কম্পিত কন্ঠ বারংবার প্রতিধ্বনিত হয়,
“চোখের বাঁধন টা খুলে ফেল চাঁদ!”
ঘড়িতে তখন ঠিক বারোটা বেজে শূন্য এক সেকেন্ড।বাঁধন খোলামাত্রই চাঁদের সম্মুখে নিজের প্রিয় মানবকে দেখে যতটানা সে অবাক হয়েছে তার চাইতেও বেশি অবাক হয়েছে তার কন্ঠস্বরে এরূপ এক বাক্য শুনে,
“হ্যাপি টুয়েন্টি মিস হোয়াইট বাটারফ্লাই”
স্তম্ভিত অবস্থা থেকে চাঁদের স্বাভাবিক হওয়ার পূর্বেই অবাকের চরম পর্যায়ে চাঁদকে ফে*লে দিতে প্রণয় তার সামনে গিয়ে তার দিকে পিঠ করে দাঁড়িয়ে আধারিয়া অম্বরে বিদ্যমান অর্ধচন্দ্রিমার দিকে তাকিয়ে বললো,
“দ্যা মুন ইজ বিউটিফুল”
বলেই অল্প একটু থেমে নিশ্বাস সঞ্চয় করে চাঁদের দিকে ঘুরে তার দিকেই খানিকটা হেলে উভয় ভ্রু উচিয়ে বললো,
“ইজন্ট ইট?”
বুক ধড়াক করে উঠে চাঁদের।এই বাক্যটা সম্পর্কে সে শুনেছে।এর অর্থও সে জানে।যার দরুন হৃদস্পন্দন তীব্র হয় তার,নিশ্বাস বাড়ে।পলকহীন তাকিয়ে থাকে তার বিড়ালাক্ষী মানবের দিকে।এই মাত্র কী বললো সে?সে কি তাকে ভালোবাসি কথাটা অবশেষে বলেই ফেললো?তবে এতোদিন কেনো এতো অবহেলা?ভালোই যখন বাসে কেনো কোনো খোঁজ নেয়নি তিন তিনটা মাস?কেনো নিজের থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে তাকে?আজকের এই দিনটার জন্য?এভাবে তাকে চমকে দেবে বলে?বাক্যটা কি সেই অর্থেই প্রণয় বলেছে যেটা চাঁদের মস্তিষ্কজুড়ে বিচরণ চালাচ্ছে?নাকি কেবলই চাঁদের রূপের প্রশংসা করলো সে?ভেবে পাচ্ছেনা চাঁদ।নানান চিন্তায় গ্রাসিত হচ্ছে সে।প্রণয়কে কিছু বলতে নিলেই প্রণয়ের ফোন বেজে উঠে।তার ফোনের ডাটা অন ছিলো বিধায় ফোনটা কেপে উঠেছে।মেসেঞ্জারের টুংটাং শব্দ।সুন্দরতম মুহুর্তে বিরক্তিতে কপাল খানিকটা কুচকে যায় প্রণয়ের।সে মোবাইল হাতে নিতেই দেখে মেসেঞ্জারে মেসেজ রিকুয়েস্ট এসেছে।সেদিকে তোয়াক্কা না করে ফোন পকেটে গুজে রেখে চাঁদের পানে কিছুক্ষণ,অনেক্ক্ষণ নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে সে।চাঁদের দৃষ্টিও প্রণয়ের পানে।কতগুলো মাস পর চোখের তৃষ্ণা মেটাচ্ছে প্রেমিকযুগোল।চোখজোড়া ভিজে যাচ্ছে চাঁদের।সে ঠোট কামড়ে কান্না আটকাবার প্রয়াস চালায়।অতঃপর না পেরে প্রণয়ের কাছে গিয়ে ঘাড় উঁচিয়ে তার দিকে তাকিয়ে বলে,
“সে কি জানেনা?তাকে ব্যতীত একেকটা প্রহর বিরহে কাটায় তার চন্দ্রময়ী?তবে কেনো এতো যন্ত্রণা?”
কথাগুলো বলেই আকস্মিক প্রণয়ের বুকে মুখ গুজে চাঁদ।আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে তাকে।ফোপানোর আওয়াজ নিস্তব্ধ ছাদে খানিকটা জোরেই শোনা যাচ্ছে।প্রণয় তার প্রেমমানবীকে দু’বাহু দ্বারা আলিঙ্গণ করে শুধায়,
“উষ্ণ হৃদয় শীতল করতে তার সুধাকণ্ঠই যথেষ্ট।তবুও হৃদয় শীতল না হয়ে তার অশ্রুজল অগ্নিবর্ষণরূপে চিত্ত পু*ড়িয়ে দিচ্ছে লালগোলাপ।কান্নার ফোয়ারা থামান।থামান বলছি”
To be continued….