#ফাগুন_হাওয়ায়_হওয়ায়
#লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_২
ফাগুন হাওয়া এসেছিল মীরার জীবনে। উচ্ছলতা প্রিয় মীরা যেখানে কলেজ দাপিয়ে ভার্সিটির প্রাঙ্গণে মুখর ছিল। যার কণ্ঠে মাধুর্যতা ঝড়ত। বসন্ত উৎসবে মীরার কণ্ঠে ফাগুনের গান ছাড়া যেন অসম্পূর্ণ। সেই মীরার জীবনে ফাগুনের ছোঁয়া এসে তাকে রিক্ত করে চলে গেল! এইযে প্রকৃতিতে চৈত্রমাস, এখনও অবধি সে বসন্ত বন্দনা করেনি। আমূল পাল্টে গেছে সে।
এসব কিছু ভাবতে ভাবতে ডাক পরলো মীরার। শাওয়ারের নিচে বসে দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াল। তারপর চেঞ্জ করে বেরিয়ে আসল। বেরিয়ে দরজা খুলে দেখল তার ছোটো ভাবী নিধি হাতে শাড়ি নিয়ে দাঁড়ানো। নিধি বলল,
“নাও ননদী। শাড়িটা সুন্দর করে পড়ে নাও।”
মীরা শাড়ির দিকে একবার তাকায়। বেশ সুন্দর শাড়ি। বাসন্তী রংয়ের জামদানি শাড়ি। রংটা তার একসময়কার ভীষণ প্রিয়র তালিকায় ছিল। কিন্তু এই প্রিয় রংটাই এখন তার পড়তে ইচ্ছে করে না। মীরা দুর্বল কন্ঠে বলল,
“এই শাড়িটা পড়ব না ভাবী। নিয়ে যাও।”
নিধি শাড়িটার দিকে একবার ভালো করে দেখে মীরার দিকে তাকিয়ে বিস্ময়ের সুরে বলে,
“ওমা! শাড়িটা পড়বে না কেন? কী সুন্দর রংটা। তোমার গায়ে কিন্তু খুব সুন্দর মানাবে। তাছাড়া তোমার পছন্দের রং বলে কথা।”
মীরা বিড়বিড় করে বলল,
“তাই জন্যই তো পড়ব না। এই রং যে একবার আমার ধ্বং*সের কারণ হয়েছে! কী করে ভুলি সব!”
মীরাকে অন্যমনস্ক দেখে নিধি ওর চোখের সামনে হাত নাড়িয়ে শুধায়,
“কী হলো? কোথায় হারালে? নেও শাড়িটা পড়ে নাও।”
“ভাবি, শাড়ি পড়ার কী দরকার? থ্রি-পিস পড়লেই তো হয়ে যায়।”
নিধি মুখে হাত দিয়ে ভণিতা করে বলে,
“কি যে বলোনা তুমি! যেই তুমি শাড়ি বলতে পাগল ছিলে! সেই তুমি কী-না শাড়ি পড়বে না! শাড়ি পড়তে অস্বীকার করছ? শোনো, এসব চলবে না। মা বলেছেন, তোমায় শাড়ি পড়তেই হবে।”
মীরা তার ভাবির সামনে থেকে সরে গিয়ে বিছানায় বসে হতাশা মিশ্রিত কন্ঠে বলে ওঠে,
“কী লাভ বলো তো? আগেরবারও তো পড়লাম শাড়ি। কোন কি লাভ হয়েছে? অযথাই এসব করছ। আগেরবারের প্রবলেম কি ছিল? মেয়ের বয়স বেশি। শাড়িতে কি আমার বয়স ঢেকে যাবে ভাবি?”
নিধির চেহারার খুশি ভাবটা নিমিষেই উবে গেল। সে মীরার পাশে এসে বসে। অতঃপর মিহি স্বরে বলে,
“সব সময় এত নেগেটিভ ভাবো কেন? সব সময় তো একই রকম নাও হতে পারে তাই না? ভালো কিছুও হতে পারে। আগেরবার যেই পরিবার তোমায় দেখতে এসেছিল সেই পরিবার সম্বন্ধে বাবা খুব একটা খোঁজ খবর নেননি। ঘটক বাবাকে মন ভোলানো কথাবার্তায় ভুলিয়ে ফেলেছিল। ওরা চাইছিল ১৭-১৮ বছর বয়সের বাচ্চা মেয়ে। ঘটক এসব আমাদের জানায়নি। তাই তো ঘটকটাই এবার বদলে ফেলা হয়েছে। নতুন ঘটক খোঁজখবর নিয়ে পাত্রের খোঁজ বলেছে। বয়স বেশির কথা এবার ঘটককে পইপই করে জানানো হয়েছে। এবার তোমাকে ওসব বিড়ম্বনায় পরতে হবে না। তাই সুন্দর করে তৈরি হয়ে নাও তো। কথায় আছে, ‘আগে দর্শনধারী, পরে গুণবিচারী।’ বুঝেছ? আর আমাদের মেয়ের গুণ, কোন দিক দিয়ে কম? কোনো দিক দিয়ে খামতি নেই।”
শেষোক্ত লাইন নিধি একটু মজা করেই বললো। উদ্দেশ্য তার মীরার মুখে হাসি ফোটানো। হলোও তাই। মীরা হালকা হাসলো। নিধি এবার তাড়া দিয়ে দেয়াল ঘড়িতে একবার চোখ বুলিয়ে বলল,
“এই জলদি তৈরি হয়ে নাও তো। বেশি একটা সময় নেই। তুমি একা শাড়িটা পড়তে না পারলে আমাকে বলো আমি পড়িয়ে দিচ্ছি। অবশ্য আমি জানি তুমি শাড়ি ভালোই করতে পারো।”
“আমি পড়তে পারবো ভাবি।”
“আচ্ছা তবে আমি গেলাম। রান্নাঘরের কাজগুলো একটু গুছিয়ে দেখি। তুমি কিন্তু জলদি তৈরি হয়ে নিবে। পরে কিন্তু মা এসে আমাকে ব*কবে। কেন আমি তোমাকে তৈরি করা রেখে রান্নাঘরে গিয়েছি!”
নিধি উঠে যেতে যেতে কথাটা বলল। মীরা কৃত্রিম হেসে মাথা নাড়ায়। তারপর দরজা লাগিয়ে ধপ করে বিছানায় বসে। ভালো লাগছে না তার। কেন যেন মনে হচ্ছে, এইবারও কোন একটা ঝামেলা হবে। আর তারপর ছেলেপক্ষ তাকে প্রত্যাখান করে চলে যাবে। তাও মায়ের কথায় এক প্রকার বাধ্য হয়েই সে তৈরি হতে চলল। দেখা যাবে কী হয়।
_________
বায়োটেকনোলজি ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড: আকবর রেহমান তার রিসার্চ স্টুডেন্টদের কাজ দেখে এসে নিজের অফিস কক্ষে বসলেন। এখন বিকেল চারটার মত বাজে। তিনি তার জুনিয়র কলিগ অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর ড: শেহজাদ নেওয়াজকে কল করলেন। ড: শেহজাদ নেওয়াজ সবে আজকের দিনের লাস্ট ক্লাস শেষ করে নিজের অফিস কক্ষে গেছেন। ব্যাগ নিয়ে তিনি বেরোবেন তখনই কল আসাতে রিসিভ করে সালাম দিলেন। চেয়ারম্যান স্যার বলেন,
“তোমার ক্লাস শেষ শেহজাদ?”
“ইয়েস স্যার।”
“কাম টু মাই রুম।”
ড: শেহজাদ ভাবলেন হয়তো স্টুডেন্ট ড্রপ লিস্ট চাইবে। আজকেই তো সাবজেক্ট উইথড্র করার শেষ দিন ছিল। তাই তিনি সেই লিস্টটা নিয়ে চেয়ারম্যান স্যারের রুমে গেলেন। ড: শেহজাদকে দেখে চেয়ারম্যান স্যার বললেন,
“বসো শেহজাদ।”
ড: শেহজাদ হাতের কাগজটা বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,
“স্যার, হেয়ার ইজ স্টুডেন্ট ড্রপ লিস্ট এন্ড অল ডিটেইলস। অ্যাই অলসো ইমেইলড ইউ।”
“ওকে। নাউ লিসেন টু মি। অ্যাই হ্যাভ সামথিং ইমপর্টেন্ট টু টক।”
“শিউর স্যার। প্লিজ টেইল।”
“দেখো শেহজাদ, আমি ভূমিকা করে বলব না। কিন্তু এভাবে চলতে পারে না।”
ড: শেহজাদের মুখশ্রীতে কিঞ্চিত বিরক্তির আভাস ফুটে ওঠল। তিনি এক কথায় বললেন।
“বাট স্যার ইটস টাইম টু রিটার্ন। আমি আমেরিকায় ফিরতে চাই।”
“আমি তোমাকে আবারও বলব, প্লিজ স্টে। স্টুডেন্টদের তোমাকে সত্যি প্রয়োজন।”
“থাকতেই এসেছিলাম কিন্তু ব্যাক্তিগত কারণে পারছি না। আমার মনে হচ্ছে, নাউ ইটস হাই টাইম টু ফোকাস অন মাই ক্যারিয়ার।”
এটা বলেই ড: শেহজাদ আর কালক্ষেপণ না করে উঠে গেলেন। ড: শেহজাদ চলে যেতেই ড: আকবর রেহমান দীর্ঘশ্বাস ফেলে চেয়ারে চোখ বন্ধ করে মাথা এলিয়ে দিলেন। অনেক কাঠখড় পু*ড়িয়ে তিনি ড: শেহজাদকে এই ডিপার্টমেন্টে এনেছিলেন যাতে স্টুডেন্টরা উপকৃত হয়। বেশ দায়িত্ববান ও চৌকস ছেলে। আস্তে আস্তে ডিপার্টমেন্টের পুরোনো অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ শিক্ষকরা চলে যাচ্ছেন। এডজাংক্ট ফ্যাকাল্টি আনতে হচ্ছে।
ড: শেহজাদ চেয়ারম্যান স্যারের রুম থেকে বেরিয়ে নিজের রুমে গিয়ে ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। বেরোতে বেরোতে আমেরিকার যে ইউনিভার্মিসিটিতে এপ্লাই করেছেন সেখানকার মেইল এসেছে কী-না দেখে নিলেন।
_______
পাত্রপক্ষের সামনে বসে আছে মীরা। পাত্রের মা ও বোন মীরাকে বেশ বিচক্ষণতার সাথে পর্যবেক্ষণ করে চলেছে। এদিকে পাত্রও যে তাকে পলকহীন দৃষ্টিতে দেখতে তা তার অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাত্রের বোন বলে ওঠলেন,
“মেয়ের বয়স বেশি শুনলাম। তা তোমার বয়স কত?”
মীরা মাথা নিচু রেখেই নম্র স্বরে জবাব দিলো,
“ছাব্বিশ বছর এক মাস।”
“বাহ! মাস সহ বলে দিলে। যাতে একটু বেশি না ভেবে ফেলি? তা শুনেছি তুমি নাকি চাকরি করো। কোথায় চাকরি করো? বিয়ের পরও কি চাকরি করবে নাকি? ”
মীরা এবার মাথা উঠাল। পূর্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে প্রত্যুত্তর করল,
“হ্যাঁ আমি চাকরি করি। আর বিয়ের পরও চাকরি করব। আমি ইন্ডিয়াতে একটা বায়োটেক ল্যাবে আছি।”
মীরার জবাব শুনে পাত্র-পক্ষের মাথায় যেন ব*জ্রপাত হলো! তাদের চোখের মনি যেন অক্ষিগোলক ছেড়ে বেরিয়ে আসবে! পাত্রের মা আঁতকে উঠে শুধালেন,
“ইন্ডিয়াতে? আবার বিয়ের পর চাকরিও করবে?”
উনার এহেনো স্বর ও প্রশ্ন শুনে মীরার ভীষণ হাসি পেলো। তাও সে হাসলো না। হাসলে তো তাকে অভদ্রের অ্যাখ্যা দিয়ে বসবে! সুন্দর করে জবাব দিল,
“কেন আন্টি? কী হয়েছে তাতে?”
“কী আর হবে বলো? আমাদেরই বোঝার ভুল ছিল। বয়স্ক মেয়ে এতদিন কি বাড়িতে শুধু শুধু বসিয়ে রাখবে! কোন কারণ ছিল তাই তো বসে আছে।”
মীরা তাদের কথার ধরন বুঝলেও ইচ্ছে করেই না বোঝার ভান করে প্রশ্ন করলো,
“কী কারন ছিল আন্টি? না মানে আপনারা বললেন কারণ ছিল, কারণটা তো আমার জানা নেই। যদি বলতেন তাহলে সুবিধা হতো।”
“থাক মা, আর কথা বাড়িও না। যা বোঝার বুঝে গেছি।”
পাত্রের মায়ের কথা শুনে মীরাও বুঝে গেল, কী হতে চলেছে? তাই সে মুচকি হাসলো। তার বাবা-মায়ের মুখের দিকে এক পলক চেয়ে ভারী দুঃখ বোধ করল। বড্ড বাজে ভাবে ফেঁসে গেছেন উনারা।
চলবে ইনশাআল্লাহ,
রিচেক করা হয়নি। ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। রেসপন্স করবেন প্লিজ।