#বিবর্ণ_বৈশাখে_রংধনু (২য় পরিচ্ছেদ)
#নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৫
ঘুম থেকে উঠে রুহানী মাথা চেপে ধরে বসে আছে। প্রচন্ড ভার ভার লাগছে পুরো শরীর। তেষ্টায় গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাওয়ার দশা। আশেপাশে পানি খুঁজেও পানি পায় না সে। হঠাৎ তার খেয়াল হলো সে অন্য কোথাও আছে। বেশ বিলাশবহুল কক্ষে নিজেকে আবিষ্কার করে কিঞ্চিত নয়, বেশ অবাক হয়েছে রুহানী। ঘড়িতে সময় দেখল সকাল ৭ টা। দ্রুত বিছানা থেকে নেমে জানালার কাছে গিয়ে থাই খুলতে নিতেই দরজা খোলার শব্দ কর্ণগোচর হয়। পেছন ফিরে চেয়ে দেখে রাফাত!
হঠাৎ অপরিচিত জায়গায় রাফাতকে দেখে ভীষণ খুশি হয় রুহানী। রাফাত নাস্তার ট্রে হাতে ভেতরে ঢুকে টেবিলে ট্রেটা রাখতেই রুহানী তার কাছে ছুটে আসে। রুহানীর চোখে খুশি চকচক করতে দেখে রাফাত তাচ্ছিল্য হাসে। রুহানী ইশারায় বুঝাচ্ছে,
“তোমরা আমাকে কীভাবে খুঁজে পেলে? আরহান কোথায়?”
তারপর রুহানী জবাবের অপেক্ষা না করে দরজার কাছে গিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আরহানকে খুঁজতে থাকে। তা দেখে রাফাতের দাঁত কিড়মিড় করে ওঠে। রাগে সে রুহানীর হাত ধরে হেচকা টান দিয়ে নিজের সামনে এনে দাঁড় করায়। রাফাতের এহেন কঠোর ব্যবহারে রুহানী হতভম্ব নজরে তাকায়। রাফাত দাঁতে দাঁত পিষে বলে,
“আরহান নেই এখানে। বুঝতে পেরেছ? আরহান এখানে নেই। তাই ওকে খুঁজো না।”
রুহানী ইশারায় বলে,
“কোথায় ও?”
“যেখানে থাকার সেখানেই আছে।”
এই বলে রাফাত রুহানীর হাত ছেড়ে খাবারের ট্রে এর কাছে যায়। তারপর বলে,
“আসো খেয়ে নাও।”
রুহানী নিজের কাঙ্ক্ষিত জবাব না পেয়ে রাফাতের সামনে এসে দাঁড়িয়ে ওকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে ইশারায় বুঝায়,
“কোথায় আরহান?”
রাফাত বিরক্ত হয়ে রুহানীর হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলে,
“বললাম তো নেই। বারবার প্রশ্ন করছ কেন? খেয়ে নাও।”
রুহানীও নিজের বাক্যে বহাল রইল। সে ইশারায় বলল,
“আরহানকে ভিডিও কল করো। আমি ওকে দেখব।”
রাফাত এতোটা সময় নিজেকে কাবু করে রাখলেও এখন আর পারছে না। রুহানীকে ধা*ক্কা দিয়ে ফে*লে দিয়ে চিৎকার করে বলল,
“আরে তোকে আমি এখানে এনেছি কি আরহানের সাথে ভিডিও কলে কথা বলাতে? আমি তো আরহানকে কখনও জানতেই দিব না তুই কোথায় আছিস! তুইও আর কখনো আরহানের কাছে যেতে পারবি না। এই কথাটা কান খুলে শুনে রাখ আর মা*থায় ঢুকিয়ে রাখ। বুঝেছিস? তোকে কি*ডন্যা*প আমিই করেছি। এই লন্ডনে তোকে আনতে আমার কতোটা কা’টখোর পু*ড়াতে হয়েছে জানিস? টানা সাতাশ ঘণ্টা তুই সেন্সে ছিলি না। ইমিগ্রেশন ফাঁকি দিয়ে তোকে এখানে এনেছি। অবশ্য পাইলট হওয়াতে সুবিধা তো হয়েছেই। আমার রেফারেন্সে আমার লোকেরা তোকে এখানে আনতে পেরেছে। একদম নতুন পরিচয়ে! কিছুদিন আগেই এক অ্যা*কসিডেন্ট কে*সে চেহারা খারাপ হওয়া মৃ*ত মেয়ের পরিচয় তোকে দেওয়া হয়েছে। তাতে আমাকে সাহায্য করেছে আমারই চাচা। তোর আরহানের এতো গার্ডের সামনে দিয়ে তোকে উড়িয়ে নিয়ে এলাম কিন্তু আরহান বুঝতেই পারল না। সো স্যাড!”
রুহানী মেঝেতে বসে হতভম্ব চিত্তে বিমূঢ় হয়ে রাফাতের দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে। রাফাত রুহানীকে এভাবে দেখে উচ্চস্বরে হাসে। অতঃপর মেঝেতে ওর পাশে বসে দুঃখী ভাব করে বলে,
“শ*ক হয়েছ না? ইশ! কতো বড়ো ধোঁ*কা! বন্ধু যখন শত্রু! তাই না? নাকি ঘর শত্রু বিভীষণ! কোনটা? যাইহোক, এখন ভালো মেয়ের মতো খেয়ে নাও তো। তারপর তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে। যা দেখে তুমি কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেলবে! ওহ উফস! আমি ভুলেই যাই যে তুমি কথা বলতে পারো না! ভাষা আর হারাবে কী! ”
রাফাত এবার উঠতে নিলে রুহানী ওর শার্টের কলার ধরে চিৎকার করে কিছু বলতে চেয়ে গলায় প্রচণ্ড ব্যাথা অনুভব করায় ছেড়ে দিয়ে কাশতে শুরু করে। রাফাত দ্রুত গ্লাসে পানি ঢেলে রুহানীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,
“কথা বলার এত চেষ্টা কেন তোমার? তুমি কেন মানতে চাও না? এই মৌনতাই তোমার আজীবনের সঙ্গী! এখন চুপচাপ নাস্তা খেয়ে নাও। তারপর তোমার জন্য ধা*মাকাদার কিছু আছে। যেই কারণে তুমি আজ এখানে। জানতে চাও না? কী তোমার দোষ? কেন আজ তুমি এখানে? আমি জানি তুমি জানতে চাও। তাই যা বলছি তাই করো। যদি না মানো তবে তোমার সাথে খা*রাপ কিছু হবে বলে রাখলাম।”
কথাগুলো বলে রাফাত দরজা লক করে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। রুহানী মেঝেতে বসে কাঁদতে থাকে।
__________
“দেখ দোস্ত, এভাবে আর কতদিন বসে থাকবি। রুহানীর খোঁজ তো চলছেই। সেটা চলতে থাক। তুই তোর পড়ালেখা, জব এসবে আর গাফিলতি করিস না। যত ব্যস্ত থাকবি তত মন খারাপ কম থাকবে। নিজেকে ব্যস্ত রাখ। ইন্টারন্যাশনাল ফ্লাইটগুলোতে আমি তোর জায়গায় যাচ্ছি, কিন্তু তুই অন্তত ডোমেস্টিক ফ্লাইটগুলোতে যেতে পারিস। পাইলট হয়ে আকাশে উড়া তোর শখ, তোর স্বপ্ন। তোর মন ভালো করতে পারবে এটাই। কতগুলো দিন পেরিয়ে গেল। কিড*ন্যা*পাররা এখনো কোন ফোন বা ক্লু ছাড়েনি। আমরা কি বেসিসে রুহানীকে খুঁজবো?
আরহান ফ্লোরে বসা অবস্থায় বিছানায় মাথা হেলিয়ে হতাশ চিত্তে বলে,
“ওকে কোথায় পাব রাফাত? আমার কিছু ভালো লাগছে না। সবকিছু কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। রুহানী কোথায় হারিয়ে গেল? কোথায় পাব ওকে?”
“ধৈর্য্য ধর আরহান। আমি এখন যাই। নাস্তা করব। শরীরটাও খারাপ লাগছে।”
“হু।”
আরহান কল ডিসকানেক্ট করে কৃষ্ণাভ অন্তরিক্ষে নির্নিমেষ চেয়ে রইল। গভীর রাত। ভোরের আলো ফুটতে এখনও ঢের বাকি। হঠাৎ তাহাজ্জুদের নামাজের কথা মনে পরলো। এই সময়টা তাহাজ্জুদের জন্য সর্বোত্তম। দোয়া কবুলের সময়। আরহান দ্রুত অজু করে এসে নামাজে দাঁড়ালো। নামাজের সিজদাহতে রুহানীর সহি-সালামত ফিরে আসার দোয়া করল।
অপরদিকে রহমত শেখ ও তার স্ত্রী তাহাজ্জুদের নামাজ শেষ করে বসেছে। জাহানারা শেখ পানি খেতে বেড সাইড টেবিল থেকে জগ নিয়ে দেখেন তাতে পানি নেই। তিনি স্বামীকে বললেন,
“আজ মনে হয় পানি রাখতে ভুলে গেছে।”
“আচ্ছা আমি এনে দিচ্ছি।”
এই বলে রহমত শেখ জগটা নিয়ে নিচে ডাইনিং টেবিলের কাছে যান। জগে পানি ভরে আসার সময় রিহার ঘরের দরজার নিচ দিয়ে আলো জ্বলতে দেখে সেদিকে যান। রিহা এখন একা ঘরে। ওর স্বামী তিন দিন ছিল তারপর কাজ পরাতে ফিরে গেছে। রহমত শেখ দরজার টোকা দিলেন। বার কয়েক টোকা দেওয়ার পরেও দরজা না খোলাতে তিনি ফিরে যেতে সিঁড়ির কাছে যেতেই দরজা খুলে রিহা বেরিয়ে এলো।
“বাবা, তুমি এতো রাতে?”
রহমত শেখ পেছনে ঘুরে দেখেন তার মেয়ে শুভ্র হিজাব পরিহিত অবস্থায় দাঁড়িয়ে। রহমত শেখ কিঞ্চিত অবাক হলেন। তিনি জিজ্ঞেসা করলেন,
“তোমার ঘরের আলো জ্বলছিল। তাই ভাবলাম, কী করছিলে? দেখতে এলাম।”
“ওহ আচ্ছা। নামাজ পড়ছিলাম।”
মেয়ের জবাব পেয়ে রহমত শেখ অবাক হলেও ভীষণ খুশি হলেন। তিনি মুচকি হেসে সিঁড়ি দিয়ে উপরে চলে গেলেন।
________
কিছু সময় পর রাফাত রুহানীর ঘরে এসে দেখল রুহানী খাবার খায়নি। শুধু পানিটুকু খেয়েছে। এখন সে জানালার পাশে হেলান দিয়ে নিরলস বসে আছে। রাফাত মুখাবয়বে কোনো প্রতিক্রিয়া পদর্শন করল না। রুহানীর থেকে খানিক দূরত্বে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করল,
“খাওনি তাই না? এই কয়েকদিন পানির সাথে ড্রা**গ মিশিয়ে দিলে ঠিকই খেয়ে নিতে। আজ ভাবলাম, তোমাকে হুঁশে রাখা জরুরী। যাইহোক, চলো। তোমার সারপ্রাইজ দেখিয়ে আনি।”
রুহানী ভাবশূণ্য ভঙ্গিতে পূর্বের ন্যায়ই বসে আছে। যেন রাফাতের কোনো কথা তার কর্ণকুহরে প্রবেশ করেনি। রাফাত ওর এমন ব্যবহার দেখে হুট করে বলে ওঠল,
“সাফাকে মনে আছে?”
রুহানী হঠাৎ সাফার নাম শুনে চট করে রাফাতের দিকে ফিরল। রাফাত মাথা নুইয়ে তাচ্ছিল্য হেসে বলল,
“মনে থাকবে না আবার! যার জীবন তছনছ করে দিয়েছ, তাকে ভুলবে কী করে? তাই না?”
রুহানী জানালার পাশ থেকে উঠে রাফাতের সামনে এসে দাঁড়ায়। অতঃপর ইশারায় বলে,
“কী বলতে চাইছ? আমি কী করেছি?”
রাফাত তাচ্ছিল্য হেসে জানালার দিকে অগ্রসর হয়ে পকেটে হাত গুঁজে বাহিরে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বলে,
“হাহ্! এখন জানো না? তুমি তো আবার সবকিছু না জেনেই করো!”
রাফাতের কথার এতো পহেলি রুহানীর মস্তিষ্ক বুঝতে পারছে না। সে রাফাতের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে রাফাতকে নিজের দিকে ঘুরায়। তারপর খোলশা করে বলতে বলে। রাফাত রুহানীর চোখের দিকে কয়েক সেকেন্ড নিষ্পলক চেয়ে থেকে কোনো মৌখিক জবাব না দিয়ে হাত ধরে টেনে নিয়ে যায়। পাশের ঘরে নিয়ে একপ্রকার ছুঁ*ড়ে ফেলে। তারপর বলে,
“নিজের চোখেই দেখে নাও।”
ছুঁড়ে ফেলার দরুণ রুহানী হাতে ব্যাথা পেয়েছে। ব্যাথায় চোখ-মুখ কুঁচকে উঠে বসে দেখে বিছানায় কেউ একজন শুয়ে আছে ও বিভিন্ন মেডিকেল যন্ত্রপাতি লাগানো। তা দেখে তার কৌতুহলী মনের ইচ্ছায় উঠে দাঁড়ায়। বিছানায় শুয়ে থাকা ঘুমন্ত মানুষটাকে দেখে রুহানী দুই পা পিছিয়ে যায়। অবাকতার রেশে মুখে হাত চলে যায় তার। রাফাতের দিকে তাকিয়ে আঙুল বরাবার বিছানায় শুয়ে থাকা মানুষটাকে দেখালে রাফাত ভাঙা স্বরে বলে,
“হ্যাঁ ও সাফা। দেখেছ ওর কী অবস্থা? টানা এক মাস হসপিটালে মৃত্যুর সাথে ল*ড়াই করে সে এখন কো*মাতে।আমার ছোটো হাস্যজ্জ্বল বোনটার জীবনে তুমি অমাবস্যার গ্রহণ হয়ে এসেছ। আই হেইট ইউ রুহানী শেখ। আই হেইট ইউ।”
রুহানী হতবাক হয়ে একবার রাফাতের দিকে তাকায় তো একবার ঘুমন্ত সাফার দিকে তাকায়।
চলবে ইনশাআল্লাহ,
আমার প্রথম বই “মেঘের আড়ালে উড়োচিঠি” প্রিঅর্ডার করুণ আপনাদের পছন্দের যেকোনো বুকশপে। রিচেক করা হয়নি। ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। কপি নিষিদ্ধ।