#হৃদয়জুড়ে_প্রেয়সীর_আভাস
#পর্ব_২৭
#মোহনা_হক
সকাল সকাল ইনিমা আর জাফরি চলে এসেছে। রুয়াত আগের দিন চলে আসায় তার ও ভালো লাগছিলো না। তাই ইনিমা আরহাম কে বলে। ভেবেছিল কয়েক দিন থাকবে। কিন্তু রুয়াত চলে আসায় ইনিমার আর থাকতে ইচ্ছে হলো। সবেমাত্র আটটা বাজতে চললো। আয়াজ ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে গিয়েছে। এখন রেডি হচ্ছে। একটু পরেই আবার কাজে বের হবে। দিনকাল মোটামুটি ভালো খারাপের মধ্যে ব্যস্ততায় কাটছে। জনসভায় আজ মিটিং রয়েছে। সেজন্য আগে আগেই উঠে রেডি হয়ে গিয়েছে।
-‘দরজা খুলো।’
জাফরি দরজার অপাশ থেকে ডাকছে। রুয়াত ঘুমিয়ে থাকার কারণে আয়াজ নিজে গিয়েই দরজা খুলে দিলো। এমা জাফরি কোমড়ে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চোখেমুখে ঝাপসা রাগ। আয়াজ হেসে দু হাত বাড়িয়ে কোলে নেয় বাচ্চাটা কে। নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে নেয়। আহ্লাদী স্বরে বলে-
-‘কখন এসেছো তুমি?’
জাফরিও তার চাচ্চু কে পেয়ে গলা জড়িয়ে ধরে। আগে অস্পষ্ট কথাগুলো এখন স্পষ্ট হয়েছে জাফরির। আয়াজ জাফরি মাথায় চুমু দেয়।
-‘একটু আগে এসেছি। বাবা নিয়ে এসেছে। আমার মিম্মিম কোঁথায়?’
আয়াজ জাফরি কে রুয়াতের কাছে নিয়ে যায়। সে তো কাঁথা জড়িয়ে ঘুমাচ্ছে। জাফরি একবার তার চাচ্চুর দিকে তাকায় আরেকবার মিম্মিমের দিকে তাকায়। আয়াজ নিঃশব্দে জাফরির কান্ড দেখে চলছে।
-‘দেখেছো তোমার মিম্মিম ঘুমাচ্ছে।’
মাথা নাড়ায় জাফরি। রুয়াতের হাত ধরে ডাকা শুরু করে দিয়েছে। হঠাৎ বাচ্চা কন্ঠস্বর শুনে ঘুম ভেঙ্গে যায় রুয়াতের। এতো সকাল জাফরি কে দেখে কিছুটা অবাক হয়। উঠে বসে আয়াজের কোল থেকে জাফরি কে কোলে নেয়। আয়াজ উঠে দাঁড়ায়।
-‘ওরা এসেছে একটু আগে।’
রুয়াত আয়াজের দিকে নজর দেয় একবার। ঘুম ঘুম স্বরে বলে-
-‘আপনি রেডি হয়ে গিয়েছেন? আমায় ডাকবেন না?’
-‘তুমি ঘুমাচ্ছিলে। অযথা ডেকে কি করবো? জাফরি না আসলেও তোমায় আমি ডাকতাম না।’
রুয়াত জাফরি কে কোল থেকে নামায়। একবার দেয়াল ঘড়িতে তাকায়। মাত্র আটটা বারো বাজে। আয়াজের দিকে তাকিয়ে ফ্রেশ হতে চলে যায়। আয়াজ জাফরির সাথে দুষ্টুমি করছে। জাফরির নতুন নতুন কথা শুনে হাসছে। রুয়াত ফ্রেশ হয়ে এসে দেখে আয়াজ আর জাফরি কথা বলছে। আর আয়াজ ও জাফরির কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছে। মুচকি হাসে রুয়াত।
-‘শুনেছেন! আমি নিচে যাচ্ছি।’
আয়াজ মাথা নাড়ায়। রুয়াত নিচে চলে আসে। ইনিমা আর মায়া চৌধুরী সকালের নাস্তা তৈরি করতে ব্যস্ত। রুয়াত ও তাদের সাথে কাজে হাত লাগায়। মায়া চৌধুরী থাকলে রান্নাটা তিনিই করেন। শুধুমাত্র রুয়াত আর ইনিমা তার পাশে থেকে হেল্প করে। নাস্তা তৈরি শেষে ইনিমা তাদের ডেকে আনে। সবাই খেয়েদেয়ে বের হয়ে যায়। মায়া চৌধুরী আর আজকে রান্নার কাজে আসলেন না। তার পায়ের ব্যাথা বেড়েছে। তাই রুয়াত আর ইনিমা দু’জন মিলে আজ রান্না করে।
বিকেলে ইনিমা আর জাফরি একা রুমে শুয়ে আছে। আজ বিকেলটা একটু মেঘলা। রুয়াতের একা ভালো লাগছিলো না দেখে ইনিমার রুমে আসলো। ইনিমা ভিডিও কলে কথা বলছে আরহামের সাথে। পাশেই জাফরি ঘুমাচ্ছে।
রুয়াত কন্ঠস্বর একটু উঁচু করে বলে-
-‘আপু আসবো?’
ইনিমা কল কেঁটে দেয়।
-‘হ্যাঁ আয়।’
ধীর পায়ে রুমে প্রবেশ করে রুয়াত। ইনিমা উঠে বসে। পর্দা সরিয়ে দেয়। অন্ধকার রুমে আলো এসে পড়ে। রুয়াত এসে বোনের পাশে বসে।
-‘কাজ থাকায় তখন জিগ্যেস করতে পারিনি। তুমি থাকলে না কয়েকদিন মায়ের কাছে?’
-‘তুই এসে পড়েছিস আর আমার ও ভালো লাগছিলো না। তাই চলে এসেছি।’
ছোট্ট করে রুয়াত উত্তর দেয়।
-‘ওহ্।’
-‘তোর চোখমুখ এতো শুকনো লাগছে কেনো?’
হকচকিয়ে যায় রুয়াত।
-‘আমার? কই না তো। সব ঠিক আছে।’
ইনিমা উচ্চস্বরে হেসে ওঠে তার বোনের কথায়। একটা কথাকে কয়বার ভেঙ্গে বলেছে। ছোট ছোট চোখ করে রুয়াত তাকায় ইনিমার দিকে।
-‘হাসছো যে?’
হাসি থামে ইনিমার। রুয়াতের গাল টেনে বলে-
-‘তুমি যে কথা ভেঙ্গে বলো সেজন্য হাসছি।’
-‘জাফরি তো ঘুমাচ্ছে চলো আপু বারান্দায় গিয়ে বসি। এখানে ভালো লাগছে না।’
রুয়াতের কথা মতো ইনিমা আর রুয়াত বারান্দায় এসে বসেছে। সাথে হাজার গল্প জুড়ে দিয়েছে। মায়া চৌধুরী ও শেষ মুহুর্তে এসে যোগ দেয়। সব সময় তিনি দেখেছেন রুয়াত একটু চুপচাপ। কিন্তু আজ তার ভাবনাটাই পাল্টে গিয়েছে। হাসিখুশি মেয়ে। হয়তো কারো সামনে তা প্রকাশ করতো না। মায়া চৌধুরী কিছুটা অবাক হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিলো। রুয়াতের সেদিকটায় খেয়াল নেই। সে ব্যস্ত কথা বলায়। প্রায় তাদের আড্ডা চলে সন্ধ্যা পর্যন্ত। এরপর ও থামেনি। যখন শুনেছে ফজলুল চৌধুরী এসেছে তখনই মায়া চৌধুরী সরে আসে আড্ডা থেকে। কিন্তু রুয়াত আর ইনিমার আড্ডা চলমান।
(*)
-‘স্যার এবারের ইলেকশনে আপনিই জিতবেন। রাজনীতিতে আপনার নাম বেশ আলোচিত।’
টেবিল থেকে মাথা তুলে আয়াজ সাহেদের দিকে তাকায়। সাহেদ তার চকচকে সাদা দাঁতগুলো দেখিয়ে হেসে আছে। আয়াজের চোখমুখে গম্ভীরতা।
-‘জানি না এসব। কিন্তু রাজনীতি তে আমি যোগ দেওয়ার পর প্রতিটি কাজ খুব গুরুত্ব দিয়ে করেছি।’
সাহেদের চোখমুখে খুশির ঝলক।
-‘স্যার আজকের জনসভায় সবার মুখে শুধু আপনার জয়ধ্বনি শুনেছি।’
একবার চোখ বুজে আয়াজ। মাথার উপর ফ্যান চলছে। চেয়ারে মাথা হেলিয়ে দেয়। জানালার পাশ থেকে বাতাস আসছে। তুবও ঘেমে একাকার। চোখ খুলে প্রথমে উপরে তাকালো। কয়েকবার পলক ঝাপটায়।
-‘তুমিও কি দিন শেষে সবার মতো বেঈমানী করবে আমার সাথে সাহেদ?’
আচমকা আয়াজের মুখে এমন কথা শুনে যেনো হৃদয় নেড়ে উঠে তার৷ কন্ঠস্বর স্বাভাবিক ছিলো। কথার মাঝে ছিলো হাজারো কষ্ট। মানুষ বাহিরের দিকটায় দেখে ভিতরের সত্তাটি কে কেও দেখতে চায় না। আর আয়াজ মানুষ কে নিজের দূর্বল জায়গাটি কে কখনো দেখাতে চায় না। তার বাহিরের আসল কঠিন, শক্ত রূপটি মানুষের কাছে পরিচিত।
-‘স্যার সবাই কে অবিশ্বাস করলেও আমায় করবেন না। আমি সহ্য করতে পারবো না। আপনার জন্যই আমার রাজনীতি তে যোগ দেওয়া। আপনি যদি আমায় নিজ ইচ্ছায় মেরে ফেলেন আমি তাও হাসিমুখে গ্রহণ করে নিবো।’
আয়াজ একবার সাহেদের দিকে তাকায়। টেবিল থেকে মোবাইল নিয়ে তা পাঞ্জাবীর পকেটে পুড়ে। সাহেদের দৃষ্টি মেঝেতে। আয়াজ তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।
-‘বাসায় যাও সাহেদ।’
বের হয়ে আসে আয়াজ। এখন সোজা বাসায় যাবে। সাহেদ ও চলে আসে। আজ আয়াজ কে একটু অন্য রকম লাগছিলো। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ে সাহেদ।
(*)
খুব মনোযোগ দিয়ে আরহাম টিভি দেখছে। এসেছে অনেক্ক্ষণ হয়েছে। ইনিমা আরহামের সামনে কফিটা ধরলো। বিরক্ত হলো আরহাম।
-‘এভাবে সামনে দাঁড়ালে কেনো?’
-‘টিভিতে এতো মনোযোগ দিয়ে কি দেখছো? আমার তো মনে হয়না কখনো এতো মনোযোগ দিয়ে কাজ করেছো কোনো দিন।’
ইনিমার হাত থেকে আরহাম মুখটা বেজার করে কফিটা নেয়।
-‘এর থেকেও বেশি মনোযোগ দিয়ে কাজ করি।’
আরহাম মুখটা সরিয়ে দূরে সরে গেলো। ইনিমা আড়চোখে তাকালো তার।
-‘একটু ভালো করে কথাও বলতে পারো না তুমি। সারাক্ষণ শুধু কিভাবে আমার সাথে ঝগড়া করবে সেটা ভাবো।’
আরহামের চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। শুরুটা তো ইনিমাই করেছে। এখন যতো দোষ এখন আরহাম ঘোষ। কিছু বলতে যাবে ওমনিই ক্রলিং বেজে ওঠলো। ইনিমা দরজা খুলে দিলো। আয়াজ এসেছে। আয়াজ ইনিমার দিকে একটু তাকিয়েই আবার মাথা নিচু করে ভিতরে ঢুকে। তারপর চোখ যায় আরহামের দিকে। কিছু না বলেই উপরে এসে পড়ে।
.
বারান্দায় আয়াজ আর রুয়াত দাঁড়িয়ে আছে। কেউই কিছু বলছে না। একদম নিশ্চুপ হয়ে আছে। রুয়াত বারবার আয়াজের দিকে তাকাচ্ছে। কিন্তু তার দৃষ্টি সামনের দিকে। আশেপাশে তার খেয়াল নেই। ভ্রু কুচকে রুয়াত তাকিয়ে আছে আয়াজের দিকে।
-‘কিছু হয়েছে আপনার?’
প্রেয়সীর কন্ঠস্বর শুনে আয়াজ তার দিকে তাকায়।
-‘নাহ্। কিছু হয়নি।’
কিছু একটা বলতে গিয়েও রুয়াত থেমে যায়। আয়াজের হাত ধরে বলে-
-‘ছাদে যাবো। চলুন।’
শুরুতেই আয়াজ নাকোচ করে দিলো।
-‘যাবো না।’
মনটা খারাপ হয় রুয়াতের। আয়াজের বাহু জড়িয়ে ধরে।
-‘প্রেয়সীর আবদার পূরণ করবেন না?’
আয়াজ এবার রুয়াতের দিকে তাকায়। যেভাবে আবদার করে বসলো! ব্যাপারটা সত্যিই দারুন। আয়াজ রুয়াতের হাত মুঠোয় পুড়ে। যার একটু আগে মন খারাপ ছিলো সে এখন হাসছে। অবাক হয়ে আয়াজ একবার রুয়াতের দিকে তাকায়। অমায়িক সুন্দর হাসি মেয়েটার। দু’জন ছাদে থাকা চেয়ারে বসে পড়লো। মৃদু বাতাস বইছে। রুয়াত মনোযোগ দিয়ে চারপাশ দেখছে। পাশেই আয়াজ মোবাইল দেখতে ব্যস্ত। হঠাৎ আকাশে মেঘের গর্জন। পুরো শরীর কেঁপে ওঠে আয়াজের। রুয়াতের দিকটায় তাকাতেই দেখে সে চোখ বন্ধ করে আছে ভয়।
-‘বৃষ্টি আসবে রুয়াত। নিচে চলো।’
চোখ মেলে রুয়াত আয়াজের দিকে তাকায়। তার চোখ মুখে অস্থিরতা।
-‘বৃষ্টিতে ভিজবো আজ।’
-‘ দরকার নেই। নিচে চলো বলছি।’
পাত্তাও দিলো না রুয়াত।
-‘বলেছি ভিজবো।’
-‘আগে তুমি এমন ছিলে না রুয়াত। কথার অবাধ্য হওনি কখনো।’
চোখগুলো ছোট ছোট করে রুয়াত আয়াজের দিকে তাকায়।
-‘আমি আপনার কথার অবাধ্য কখনো হবো না। সারাদিন প্রেয়সী বলে ভালোবাসতে পারেন অথচ আজ প্রেয়সীর সাথে বৃষ্টিতে ভিজতে পারবেন না?’
চুপ হয়ে গেলো আয়াজ। রুয়াত তার জায়গা থেকে উঠে দাঁড়ালো। কিছুক্ষণের মধ্যে বৃষ্টি চলে আসলো। হাত বাড়িয়ে রুয়াত বৃষ্টির পানি স্পর্শ করছে। মনের সুখে বৃষ্টিতে ভিজে চলেছে। আয়াজ তার প্রেয়সীর পানে তাকিয়ে আছে। মেয়েটা কে যে বৃষ্টি পানিগুলো ছুঁয়ে দিচ্ছে। চেয়ারে হেলিয়ে দেয় শরীর। মন আপাতত রুয়াতের দিকে। সে তো নিজে ভিজে যাচ্ছে সাথে আয়াজ কে ও ভেজাচ্ছ। এক সময় রুয়াত ছাদে বসে। বৃষ্টির পানিতে পরিষ্কার হয়ে যায় সব। আয়াজ হেসে রুয়াতের পাশে বসে পড়ে। রুয়াত তাকায় তার প্রেমিক পুরুষের দিকে।
-‘তোমার কোলে মাথা রাখি?’
অবাক চোখে রুয়াত আয়াজের দিকে তাকায়। মানে এমপি সাহেব অনুমতি নিচ্ছে। অবিশ্বাস্য! মাথা নেড়ে রুয়াত সম্মতি জানায়। আয়াজ মাথা হেলিয়ে দেয় রুয়াতের কোলে। বৃষ্টি থামার নাম নেই। লম্বা হয়ে আয়াজ তার হাত পা ছাড়িয়ে ছাদের মেঝে তে শুয়েছে। মাথাটা আগলে ধরেছে রুয়াত। নরম হাতের স্পর্শ বুলিয়ে দিচ্ছে আয়াজের মাথায়। চোখ বন্ধ করে আছে সে।
-‘আচ্ছা প্রেয়সী এই বৃষ্টিতে অসুখ হলে কি করবে?’
-‘মনের সুখের কাছে এসব কিছুই না।’
চুপ হয়ে যায় আয়াজ। এই মুহুর্তটা সত্যিই মন মুগ্ধকর। রুয়াতের হাত টেনে আয়াজ তার বক্ষ বরাবর রাখে। ভীষণ শান্তি লাগছে তার। ঠোঁট মেলে হেসে আয়াজ বলে-
-‘তোমার আমার এমন সুন্দর মুহুর্তের প্রহর কখনো না কাঁটুক প্রেয়সী।’
রুয়াত ও আয়াজের কথায় তাল মিলিয়ে বললো-
-‘কখনো না কাঁটুক এমপি সাহেব।’
#চলবে….