#আমার_ভীনদেশী_এক_তারা
#পর্ব১১
#Raiha_Zubair_Ripte
হসপিটালে ডক্টর জেলেক্সের সামনে বসে আছে পিটার অনেকটা প্রত্যাশা নিয়ে। ডক্টর পিটারের রিপোর্ট গুলো দেখতেছে উল্টে পাল্টে। পিটার এবার অধৈর্য্য হয়ে বলে উঠলো,,
” ডক্টর আর কতো রিপোর্ট দেখবেন এবার তো বলুন কিভাবে এই মরণব্যাধি রোগ থেকে মুক্তি পাবো।
ডক্টর জেলেক্স রিপোর্ট টা হাত থেকে টেবিলের উপর রেখে চোখ থেকে চশমা টা খুলে বলে,,
” পিটার আপনি তো রেক্টাম বা মলাশয় ও কোলন অথবা বৃহদন্ত্রের ক্যান্সারে আক্রান্ত। ক্যানসার শব্দটাই আমাদের ডরানোর জন্য যথেষ্ঠ। এই অসুখের নাম শুনলেই বুকের ভিতরটা কেঁপে ওঠে। তবে তারপরও বেশিরভাগের মধ্যেই এই রোগ নিয়ে সচেতনতা নেই। বরং অসুখ অনেকটা গড়িয়ে যাওয়ার পরই চিকিৎসকের কাছে যান। তখন চিকিৎসার বিকল্প কমে যায়। তাই বিশেষজ্ঞরা বারবার ক্যানসারের লক্ষণ সম্পর্কে সকলকেই সচেতন হতে বলেন। কিন্তু আপনি শুরু থেকেই এটার ট্রিটমেন্ট করে যাচ্ছেন।
এবার ক্যানসার থেকে সুস্থ হওয়া কিছুটা হলেও সহজ হতে চলেছে। ‘ডসটারলিম্যাব’ নামক নতুন এই ওষুধের পরীক্ষামূলক প্রয়োগের পর তেমনই আশা দেখছেন গবেষকদের একাংশ। আমেরিকায় এক পরীক্ষাগারে প্রস্তুত ‘ডসটারলিম্যাব’ নামক ওষুধটি মানবদেহে উৎপন্ন হওয়া অ্যান্টিবডির বিকল্প হিসেবে কাজ করতে পারে। পরীক্ষামূলকভাবে মাস ছয়েক ধরে ১৮ জন মলদ্বারের ক্যানসারে আক্রান্ত ব্যক্তির দেহে এই ওষুধটি প্রয়োগ করেন গবেষকরা। পরীক্ষার শেষে দেখা যায়, প্রত্যেক রোগীর দেহ থেকেই পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে ক্যানসার! এই খবর ছড়িয়ে পড়তেই চিকিৎসক মহলে হইচই পড়ে গিয়েছে।
যে রোগীদের ওপর গবেষণা চালানো হয়েছে, তাদের সকলের শরীরে কেবল মলদ্বার ও তার চারপাশে লসিকাগ্রন্থির মধ্যেই ক্যানসার ছড়িয়ে পড়ে। শরীরের আর কোনো অংশে এই রোগের বিস্তার তখনো ঘটেনি।
গবেষকরা প্রথমে ভেবেছিলেন, এই ওষুধ প্রয়োগের পরেও রোগীদের হয়তো অস্ত্রোপচার, কেমোথেরাপি ও রেডিয়েশনের মতো প্রথাগত চিকিৎসা পদ্ধতির প্রয়োজন হবে। কিন্তু এখন তাদের আর এই সব চিকিৎসার কোনোটিরই প্রয়োজন নেই। এন্ডোস্কোপি, পিইটি স্ক্যান এবং এমআরআই স্ক্যানের মাধ্যমে তারা দেখেন সেই ১৮ জন রোগীর শরীরে ক্যানসার সম্পূর্ণরূপে নিরাময় হয়ে গিয়েছে।
” তাহলে ডক্টর এই পদ্ধতি টা অবলম্বন করছেন না কেনো?
” এটা অনেক ব্যায়বহুল পিটার নিউইয়র্ক টাইমস জানিয়েছে, এই ওষুধের প্রতি ডোজের দাম প্রায় ১১,০০০ মার্কিন ডলার বা ৮.৫৫ লক্ষ টাকা।
” সমস্যা নেই ডক্টর যতো টাকা লাগবে দিবো।
” বেশ তবে চলো আগে তোমায় আবার পরীক্ষা করে দেখি এটা আসলে এক স্থানেই সীমাবদ্ধ আছে নাকি ছড়িয়ে গেছে তোমার শরীরে।
পিটার সায় জানিয়ে ডক্টরের সাথে গিয়ে সব রকম টেস্ট পুনরায় করিয়ে আসে। ডক্টর রিপোর্ট টা দেখে বলে,,
” থ্যাংক’স গড তোমার শরীরে এখনো এই ক্যান্সার অন্য অঙ্গ পতঙ্গে ছড়িয়ে যায় নি। এই মেডিসিন টা মূলত ক্যানসার একই স্তরে অর্থাৎ মলদ্বারে সীমাবদ্ধ থাকলে এবং তা শরীরের অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে ছড়িয়ে না পড়লে তখন দেওয়া হয়।
” ডক্টর তাহলে কবে এই মেডিসিন টা পাবো?
” আমি কালই আনাবো এটা চিন্তা করো না। পরিচিত ডক্টরের সাথে কথা বলা আছে। তবে এটা ছয় মাসের এই ট্রায়ালের সময় রোগীদের প্রতি তিন সপ্তাহ পরপর ডোস্টারলিম্যাব দেওয়া হয়। বা এর বেশি ও সময় লাগতে পারে।
” সিউর সুস্থ হবো তো ডক্টর। আমি আর এই তিক্ত জীবন নিয়ে পেরে উঠছি না। ক্লান্ত হয়ে গেছি।
” চিন্তা করো না পিটার ৮০% সিউর আর বাকি ২০% উপর ওয়ালার হাতে।
” আমি এখনি টাকা ট্রান্সফার করে দিচ্ছি আপনি যতো দ্রুত সম্ভব মেডিসিন টা ক্রয় করে আনুন। আমি আমার স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চাই। না পাওয়া মানুষটাকে নিয়ে ফের নতুন ভাবে বাঁচতে চাই।
ডক্টরের সাথে আরো বেশ টুকটাক কথা বলে পিটার হসপিটাল থেকে বেরিয়ে আসে। আজ অনেক টা ভালো লাগছে জীবনে একফালি আলোর দেখা পেয়ে। আজ অনেক গুলো বছর পর অনেকটা ভালো লাগছে পিটারের। না আর না এবার আমি আমার জীবন টাকে এনার সাথে কাটাবো সুস্থ জীবনে।
পিটার বাসায় এসেছে। বাসায় আসার আগে অ্যাঞ্জেলেকার জন্য চকলেট আইসক্রিম নিয়ে এসেছে। বাসার ভেতর ঢুকে প্যাকেট গুলো টি-টেবিলের উপর রেখে সোফায় গা এলিয়ে দেয়। চোখ বুঝলেই শুধু এনাকে নিয়ে তার ভবিষ্যতের প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠছে। গলা ছেড়ে অ্যাঞ্জেলেকা কে ডেকে নেয় পিটার। অ্যাঞ্জেলেকা পিটারের গলার আওয়াজ পেয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসে। পিটাের গলা জড়িয়ে ধরে বলে,,
” পাপা কোথায় ছিলে তুমি। আমি স্কুল থেকে এসে তোমায় পাই নি কোথাও।
পিটার অ্যাঞ্জেলেকার মাথায় হাত দিয়ে বলে,,
” তোমার জন্য চকলেট আইসক্রিম আনতে গিয়েছিলাম মা। এই যে দেখো কত চকলেট আইসক্রিম এনেছি।
অ্যাঞ্জেলেকা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে অনেক চকলেট আইসক্রিম। অ্যাঞ্জেলেকা ওয়াও বলে চিৎকার করে চকলেট আর আইসক্রিম গুলোতে হাত বুলিয়ে বলে,,
” পাপা আই লাভ ইউ।
পিটার অ্যাঞ্জেলেকার কপালে চুমু খেয়ে বলে,,
” লাভ ইউ টু মা। যাও রেডি হয়ে আসো আজ তোমার পাপা তোমাকে নিয়ে ঘুরতে যাবে। আজ প্রচু এনজয় করবো আমরা তিনজন।
” আমরা কোথায় তিনজন পাপা। আর কে যাবে আমাদের সাথে?
” তোমার এক আন্টি মা। যাও এখন রেডি হয়ে আসো।
অ্যাঞ্জলেকা মাথা নাড়িয়ে চকলেট আইসক্রিম গুলো নিয়ে রুমে চলে যায়। অ্যাডেলা দূর থেকে পিটার কে পর্যবেক্ষণ করছিলো। হঠাৎ আজ পিটারের এতো উৎফুল্লতা দেখে আপনা-আপনি অ্যাডেলার ভ্রু কুঁচকে আসে। পরক্ষণেই ভাবলো হয়তো এমনি অ্যাঞ্জলেকার সাথে ঘুরতে চাইছে। তাই বিষয় টাকে সেভাবে আয়ত্তে না নিয়ে রুমে চলে যায়।
এনা আরাভ হেফজিবা কে নিয়ে তাদের বাসায় এসেছে। হেফজিবা অবশ্য আসতে চেয়েছিল না কিন্তু আরাভ আর এনার জোড়াজুড়িতে আসতে বাধ্য হলো। হেফজিবা এনার ঘরেই আছে,আরাভ অবশ্য একবার পুলিশ স্টেশনে গিয়েছিল। স্যামিয়ুলের থেকে ডিভোর্স পেপারে সই করিয়ে এনেছে। আশ্চর্য হলেও স্যামিয়ুলকে বলার সাথপ সাথে স্যামিয়ুল সই করে দেয় ডিভোর্স পেপারে। হেফজিবার চাচিও এখন পুলিশ স্টেশনে তাদের হেফাজতে।
আরাভ হেফজিবার মাথায় হাত দিয়ে বলে,,
” চিন্তা করো না হেফজিবা তোমার জীবনটাকে সুন্দর করে গুছিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব আমার। আমি এখন যা করবো তাতে তোমার ভালোই হবে। শুধু আমার সিদ্ধান্ত টাকে মেনে নিয়ো।
হেফজিবা কিছুই বুঝলো না আরাভের কথার। আরাভ হেফজিবার চোখ মুখ দেখে স্মিত হেঁসে বেরিয়ে আসে রুম থেকে।
সোজা নিজের মায়ের রুমে গিয়ে মায়ের সামনা সামনি দাঁড়িয়ে বলে,,
” মা তোমার সাথে আমার কথা আছে।
রত্না বেগম আরাভের দিকে চোখ গরম করে বলে,,
” তুমি কি বলতে এসেছো আমি জানি তাই বলছি ও কথা মুখে আনা তো দূরে থাক মাথাতেও এনো না।
” আমি হেফজিবা কে বিয়ে করবো।
রত্না বেগম আরাভের দিকে তাকিয়ে হুংকার দিয়ে বলে,,
” মাথা খারাপ তোমার মেয়েটা খ্রিস্টান আর আমরা মুসলিম। তার চেয়ে বড় মেয়েটা বিবাহিত ছিলো আজই তার ডিভোর্স হলো আর তুমি এসব বলছো ছিঃ দেশে কি মেয়ের অভাব পড়েছে?
” মেয়ের অভাব হয়তো পড়ে নি মা কিন্তু ভালোবাসার মেয়ের অভাব পড়েছে। আচ্ছা ধরো আমি যদি হেফজিবা কে মুসলিম করি তখন কি মানবে।
” আমি তোমার কথা শুনে আশ্চর্য হচ্ছি আরাভ। তুমহ মেয়েটাকে পাবার জন্য এখন তাকে তার ধর্ম থেকে সরিয়ে আনবে।
” মা এটাতো কোনো অপরাধ না।
” হেফজিবা তোমায় ভালোবাসে?
কথাটা শুনে চমকে উঠে আরাভ সত্যিই তো হেফজিবা কি তাকে ভালোবাসে। আমি যে তাকে পাবার জন্য এতো কিছু করতে চাইছে সে কি আদৌও আমাকে চাইছে। রত্না বেগমের কথার প্রেক্ষিতে আর কিছু বলতে পারলো না আরাভ। রত্না বেগম আরাভের কাঁধে হাত দিয়ে বলে,,
” দেখ বাবা এটা হবার নয়। তুই শুধু শুধু বৃথা চেষ্টা করছিস। তোর বাবা ভাই এদের কানে গেলে কিন্তু কুরুক্ষেত্র ঘটে যাবে।
” আমি হেফজিবা কে ভালোবাসি মা। আমার ভালেবাসা কি তাহলে কখনো পূর্ণতা পাবে না?
” ভুল মানুষকে ভালোবাসলে কিভাবে পূর্ণতা পাবে।
” কিন্তু চাচি ভালোবাসা তো অপরাধ না।
রত্না বেগম সামনে তাকিয়ে দেখে এনা সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামছে। রত্না বেগমের সামনে দাঁড়িয়ে বলে,,
” চাচি ভালোবাসা তো অপরাধ না। সবার উর্ধে তারা মানুষ।
” তোর চাচা মানবে না এনা বুঝতেছিস না কেনো।
” চাচা রাজি হলে তুমি মানবে?
” আমার আপত্তি নেই তোর চাচা মানলে।
” বেশ তাহলে চাচাকে আমি রাজি করাবো। আরাভ ভাই তুমি হেফজিবা কে জানাও বিষয় টা।
আরাভ বেশ অবাক হয় এনার কথা শুনে। মাথা নাড়িয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে যায় হেফজিবার কাছে আরাভ। রত্না বেগম ও নিজের ঘরে চলে যায়। সোফায় বসে থাকা নিরব দর্শক ফারাহ্ এর কাছে গিয়ে বসে পড়ে এনা। ফারহ্ এর কাঁধে মাথা এলিয়ে দিয়ে বলে,,
” আচ্ছা ভাবি আমরা কেনো শুধু এমন মানুষকে ভালোবাসি যাদের কখনো পাওয়া যাবে না।
ফারাহ্ এনার মাথা হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,,
” এটার উওর আমার জানা নেই এনা। তবে তোমরা কেনে ধর্মের উর্ধে গিয়ে ভালোবাসো।
” ভালেবাসা কি আর জাত ধর্ম বর্ন পরিস্থিতি দেখে আসে ভাবি?
” তা ঠিক বলেছো।
এনা তপ্ত শ্বাস ফেলে। চোখ বুঝতে নিবে এমন সময় হঠাৎ ফোন টা বেজে উঠে। এনা ফোনের স্কিনে তাকিয়ে দেখে সেই পুরোনো নাম্বার আজ ছয় বছর পর আবার সেই নাম্বার থেকে ফোনে কল আসলে। রীতিমতো বুকের ভেতর ঝড় বয়ে যাচ্ছে। কাঁপা কাঁপা হাতে ফোনটা রিসিভ করে বাসার বাহিরে চলে আসে। হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে ভেসে আসে।
” ভালোবাসা নামের অভিশাপ থেকে
মুক্তি পেয়েছি আমি।
তাই তো আজ খুশিতে আত্মহারা
আমার মুখের হাসি।
তোমার তরে সোপে ছিলাম যে ভালোবাসা
পেয়েছি ফিরে আজ তা আমি,
তাইতো আজ খুশির তরে ফিরেছি এই আমি ভালোবাসি এনা তোমায়।
#চলবে?
( ভুলত্রুটি ধরিয়ে দিবেন। হ্যাপি রিডিং)