#আমার_ভীনদেশী_এক_তারা
#পর্ব১০
#Raiha_Zubair_Ripte
সবেই চোখ মেলে তাকিয়েছে হেফজিবা। সারা শরীর এখনে ব্যাথা করছে। হালকা মাথা ঘুরিয়ে সামনে তাকাতেই দেখতে পায় আরাভ ঘুমাচ্ছে এক হাত মাথায় ঠেকিয়ে। আরাভ কে দেখে ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে উঠলো হেফজিবার। হালকা একটু নড়েচড়ে উঠতেই ধরফরিয়ে তাকায় আরাভ বিচলিত হয়ে জিজ্ঞেস করে,,
” কি হয়েছে কোথাও ব্যাথা লাগছে? ডক্টর কে ডাকবো?
হেফজিবা আরাভের এমন বিচলিত দেখে বলে,,
” না ডক্টর ডাকতে হবে না। আমহ ঠিক আছি।
” আর ইউ সিউর?
” হুমমম।
” আচ্ছা তুমি কি সাইন করতে পারবে।
হেফজিবা আরাভের কথার মানে বুঝলল না। না বোঝার ভঙ্গিতে বলল,,
” হুমমম?
” বলেছি কিছু পেপার দিবো সাইন করতে পারবে?
” কিসের পেপার?
” ডিভোর্স পেপার।
হেফজিবা অবাক হয়।
” ডিভোর্স পেপার মানে কার?
” তোমার আর স্যামিয়ুলের। আমি আর চাইছি না তুমি স্যামিয়ুলের সাথে সংসার করো।
” হুমম পারবো দিন এখনই সাইন করবো। ওর মতে জা”নোয়ারের সাথে আমি আর সংসার করতে রাজি নই।
আরাভ স্মিত হেসে ডিভোর্স পেপার আর কলম এনে হেফজিবার হাতে ধরিয়ে দিতেই হেফজিবা তপ্ত শ্বাস ছাড়লো। অনেক সহ্য করেছে আর না। আমার সন্তান কে হ”ত্যা করেছে। যখন স্যামিয়ুল পেটে লা”থি মেরেছিলো তখনই বোঝা শেষ এ বাচ্চা আর বাঁচবে না। আফসোস হচ্ছে না বাচ্চার জন্য বরং রাগ লাগছে নিজের উপর। কেনো সে তাদের অন্তরঙ্গতার সময় সতর্কতা ছিলো না। যদি সতর্কতা থাকতাম তাহলে বাচ্চাটার এই করুন অবস্থা হতো না। বাচ্চা টাকে নিয়ে অতো টা প্রত্যাশা ছিলো না। তবুও খারাপ লাগছে প্রথম মা হওয়ার অনুভূতি পাচ্ছিলাম তার মাধ্যমে। এক সপ্তাহ হয়েছিল জেনে ছিলাম মা হচ্ছি। যেখানে নিজেরই সঠিক ভবিষ্যৎ নেই সেখানে এই বাচ্চার ভবিষ্যৎ কি? তবুও চাইছিলাম বাচ্চাটা পৃথিবীতে আসলে হয়তো স্যামিয়ুল শুধরে যাবে কিন্তু কি হলো। নিজের বাবার হাতেই প্রা”ণ টা চলে গেলো তার।
হেফজিবা চোখের কার্নিশ বেয়ে গড়িয়ে পড়া জল টুকু মুছে ডিভোর্স পেপারে সাইন করে দেয়।
আরাভ পেপার টা নিয়ে হেফজিবার করা সাইন দেখে প্রশান্তির একটা হাসি দেয়।
হসপিটালের বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে এনা। পিটার গিয়েছে খাবার কিনতে। তখনকার পিটারের বলা সেই কথাটা খুব ভাবাচ্ছে এনা কে। অন্য মনস্ক হয়ে হাঁটছিল। হঠাৎ কারো সাথে ধাক্কা খাওয়ায় এনার ভাবনায় বিচ্ছেদ ঘটে। এনা ধাক্কা খাওয়া ব্যাক্তিটাকে না দেখে সরি বলতে নিবে আর তখনই গুরুগম্ভীর হয়ে ভেসে আসে,,
” চোখে দেখে হাঁটতে পারেন না ইডিয়েট।
কথাটা বলে লোকটা চলে যায়। কয়েক কদম এগিয়ে যেতেই লোকটা ফের ঘুরে এসে বলে,,
” আপনার নাম এনা না?
আকস্মিক নিজের নাম অচেনা এক ছেলের মুখে শুনে চমকে উঠে এনা। পেছন ঘুরে দেখে সেই লোকটা।
” আপনি কি আমাকে বলছেন?
বিরক্তিতে কাপলে দু ভাজ পড়লো লোকটির।
” আপনি ছাড়া কি এখানে আর কেউ আছে?
এনা আশেপাশ টা একবার চোখ বুলিয়ে দেখে এনা আর লোকটা ব্যাতিত এখানে কেউ নেই।
” আমি আর আপনি ছাড়া তো আর কেউ নেই এখানে।
এনার কথা শুনে গম্ভীর মুখে থাকা লেকটার মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠে।
” আপনি এনা?
” হ্যাঁ আমি এনা কিন্তু আপনি কে?
” কানাডা এসেছেন কবে?
” আপনাকে কেনো বলবো? হু আর ইউ?
লোকটা আর কিছু বললো না মুখে গম্ভীরতা এনে উল্টো ঘুরে চলে যায়।
এনা লোকটার যাওয়ার পানে চেয়ে সামনে তাকায় দেখে পিটার খাবার নিয়ে আসতেছে। এতোক্ষণ পিটার দূর থেকে সব পর্যবেক্ষণ করছিলো। এনার কাছে এসে বলে,,
” লোকটা কে ছিলো এনা?
” আমি চিনি না। লোকটা আমার নাম বললো।
” তাহলে লোকটা তোমায় চিনে।
” হতে পারে।
” আচ্ছা খাবার গুলো নিয়ে যাও আমি আসছি কাজ আছে।
এনা মাথা নাড়িয়ে খাবার টা নিয়ে হসপিটালে ঢুকে পরে।
রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে পিটার। সামনে কয়েকদল প্রেমিক প্রেমিকা হেঁটে যাচ্ছে তার ভালেবাসার মানুষটির হাত ধরে। এনাকে তখন লোকটার সাথে কথা বলতে দেখে কেনো জানি পিটারের খুব রাগ হচ্ছিল। দূরে থাকা এক বেঞ্চে বসে পড়ে পিটার। তার পাশের বেঞ্চে বসে আছে এক তরুণ-তরুণী। তাদের বলা কথোপকথন গুলো পিটারে কানে আসছে। মেয়েটা বারবার ছেলেটাকে বিয়ে করার জন্য বলছে আর ছেলেটা বারবার নাকচ করছে।
” দেখো আলিশা আমি তোমাকে বিয়ে করতে পারবো না।
” কিন্তু কেনো।
” আমি মাইশা কে ভালোবাসি। মাইশা কে প্রতিশ্রুতি দিয়েছি কোনো পরিস্থিতিতেই আমি তার হাত ছাড়বো না।
” তোমার মা তো মেনে নিবে না জেকি।
” না মানলে নেই। মায়ের মানা না মানার জন্য আমি আমার ভালেবাসা কে ছাড়তে পারবো না। আমার স্বাধীনতা আছে আমি কাকে বিয়ে করবো কি করবে না সেটা ঠিক করার। তোমাকে এজন্যই এখানে নিয়ে এসেছি তুমি নিশ্চয়ই চাইবে না তোমার স্বামীর মনে অন্য মেয়ের বসবাস থাকুক। তাই বলছি তুমি তোমার মা বাবাকে বলে দিয়ো তুমি আমায় বিয়ে করবে না।
মেয়েটা ছেলেটার কথা শুনে হনহন করে চলে যায়। ছেলেটা মেয়েটার যাওয়া দেখে উঠে চলে যেতে নিলে পাশ থেকে পিটার ডেকে বলে,,
” এই ছেলে শুনো।
ছেলেটা পিটারের দিকে তাকিয়ে বলে,,
” আমাকে বলছেন?
” হ্যাঁ তোমাকে।
ছেলেটা এগিয়ে এসে পিটার সামনে দাঁড়াতেই পিটার বলে,,
” বসো এখানে তোমার সাথে কথা আছে।
ছেলেটা পিটারের পাশে বসে বলে,,
” জ্বি বলুন।
” তোমাদের সব কথপোকথন আমি শুনে ফেলেছি। তুমি এই মেয়েটাকে ভালোবাসো না?
” না এই মেয়েকে বাসা থেকে দেখেছে আমার সাথে বিয়ে দেওয়ার জন্য।
” তোমার বয়স তো তেমন বিয়ের উপযুক্ত হয় নি।
” হ্যাঁ কিন্তু আমি যাকে ভালোবাসি তাকে আমার মায়ের পছন্দ না। কারন মেয়েটা মুসলিম।
” তাহলে তুমি এখন কি করবে?
” আমি মেয়েটাকে বিয়ে করবো।
” পরিবারের অমতে।
” হ্যাঁ।
” তোমাদের ধর্ম যে ভিন্ন।
” তাতে কি সে তার ধর্ম পালন করবে আর আমি আমার ধর্ম। এখন যেভাবে চলছে সেভাবেই চলবে।
” সেটা হয় নাকি?
” কেনো হবে না। সবাই যার যার ধর্ম মনে প্রানে মানে আর বিশ্বাস ও করে। কারোর পক্ষেই সম্ভব না তার ধর্ম পাল্টানো। আর আমি তো ধর্মের দোহাই দিয়ে তার হাত ছেড়ে দিতে পারবো না। মেয়েটাকে আমায় ভালেবাসতে রাজি করিয়েছি আমি। এখন যদি তার হাত ছেড়ে দেই তাহলে তার সাথে সেটা অন্যায় করা হবে না?
” হুমম বেস্ট অফ লাক। নতুন জীবনের জন্য অগ্রীম শুভেচ্ছা।
” ধন্যবাদ। বলে ছেলেটা উঠে চলে যায়। পিটার ছেলেটার যাওয়ার দিকে তাকায়। পকেট থেকে ফোনটা বের গ্যালারি তে গিয়ে একটা রিপোর্টের পিক দেখে। রিপোর্ট টা দেখে বুকটা দুমড়ে মুচড়ে উঠলো। এই একটা রিপোর্ট যা তার সব হাসি খুশি গুলোকে মা’টি চে’পে হ’ত্যা করেছে। আর পাঁচটা মানুষের মতে স্বাভাবিক থাকলে এতেদিনে নিশ্চয়ই তার আর এনার একটা সুন্দর সংসার হতো।
মূহুর্তেই আকাশের বুক চিঁড়ে বৃষ্টি নামলে। সব লোক ছোটাছুটি করে এদিক ওদিক ছোটাছুটি করে বৃষ্টির নাগালের বাহিরে যেতে চাচ্ছে। পিটার নিরালয়ে বসে থাকে বেঞ্চে। হয়তো প্রকৃতিও বুঝতে পেরেছে পিটারের মনের অবস্থা। পিটার বসা থেকে উঠে নির্জন জায়গায় গিয়ে হাঁটু গেঁড়ে বসে পড়ে। এতোক্ষণ আটকে থাকা কান্না এবার উপচে পড়ছে। ছেলেরা তো কম কষ্টে কাঁদে না। ছেলেরা তো পারে না যখন তখন মেয়েদের মতো কেঁদে ফেলতে। ছেলেদের তো কাঁদতে মানা। যতোই কষ্ট হোক তা নিরবে সহ্য করা। পিটার এবার চিৎকার দিয়ে বলে উঠে,, সবাই ভাবছে ধর্মের জন্য এনাকে ঠকিয়েছি আমি। কিন্তু আমি তো জানি আমি কেনো এনাকে নিজের সাথে জুড়তে চাই না। যেখানে আমার জীবনেরই নিশ্চয়তা নেই সেখানে এনাকে কি করে আমার জীবনে জড়াই। আজ ছয়টা বছর ধরে মরণব্যাধি রোগে আক্রান্ত আমি। কোন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে আমি যাচ্ছি তা কেবল আমিই জানি। ভালোবাসা যে এত কষ্ট তা আগে জানা ছিল না, তোমার প্রতি ভালবাসা ও মোহ আজকে আমায় এতটা বিষন্ন করে তুলেছে যে নিজেকে আজ বড় অসহায় লাগছে।
কথাগুলো বলে পিটার বসা থেকে উঠতেই পকেটে থাকা ফোনটা বের করে দেখে ডক্টর জেলেক্স ফোন দিয়েছে পিটার ফোন কল রিসিভ করে কানে দিয়ে হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে ডক্টরের কথা শুনে আমাবস্যা ঘন কালো মেঘের মধ্যে একফালি আলোর দেখা মিললো পিটারের।
#চলবে?
(ভুলত্রুটি ধরিয়ে দিবেন হ্যাপি রিডিং)