#একমুঠো_বসন্ত
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব_১৫
চেরি ব্লসম!জাপানিরা অপেক্ষায় থাকেন এই বসন্তের জন্য। কারণ হাজারো চেরি ফুলের কুঁড়ির প্রস্ফুটনে আগমন ঘটে এ সময়ে। জাপানের বসন্তের প্রধান আকর্ষণ হলো চেরি ফুল।
সাধারণত গোলাপি, সাদা ও লাল রঙের ফুলের প্রাধান্য বেশি দৃষ্টিগোচর হয় চেরিতে। এক বিচিত্র গড়নের পাপড়ি দেখা যায় ফুলগুলোতে। সেই সঙ্গে গাছে গাছে আনন্দে মেতে ওঠে পাখপাখালি ও হরেক প্রজাতির রঙিন প্রজাপতি। এ সময়ে কেরিয়ার প্রতিটি প্রান্তে হয়ে ওঠে চেরি ফুলের স্বর্গরাজ্য। হাজার বছর ধরে এই ফুলকে নিয়ে কোরিয়ানরা রচনা করে চলেছে চিত্রকর্ম, সাহিত্যকর্ম, গানসহ অনেক কিছুই। চেরি যেমন বসন্তের আগমনী গান শোনায়, তেমনি চেরি ফুলের মাধুর্য কোরিয়ানদের চিন্তাচেতনা ও সৌন্দর্যবোধের জোগান দেয়।
নিহিলা গাড়ি থেকে নেমেই উৎফুল্ল হয়ে গেল। কী সুন্দর! এতদিন শুধু ভিডিও, ছবি এসবে দেখে মনের তৃষ্ণা মিটাতো আর আজ পুরোপুরি সামনে! চারদিকে মানুষে গিজগিজ করছে। এটি মূলত ব্লসম ফেস্টিভ্যাল হানামি নামে পরিচিত। যেটির অর্থ ফুল দেখা। এটি জাপানের একটি ঐতিহ্য এর মতো হয়ে গিয়েছে। প্রায় সব মানুষই তাদের পরিবার-পরিজন, বন্ধু বান্ধব নিয়ে নিয়ে ফুল ফোটানো উপভোগ করতে আসেন অথবা প্রিয়জনদের সাথে সময় কাটাতে আসেন। নিহিলা তাকিয়ে দেখলো পাশেই একটি সরু নদী বয়ে গেছে। নদীর পাশেই চেরি ফুলের গাছের বিশিষ্ট লাইন। আর সেই গাছে সাদা গোলাপী চেরির সমাহার। নিহিলা আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো। চারপাশে অনেক মানুষের দল। একেক দলে একেক আড্ডা। কোনো দল কথা বলতে বলতে উচ্চস্বরে হেসে সময়টা ভালোভাবেই উপভোগ করছে আবার কোনো দল চুপচাপ বসে থেকে সময় উপভোগ করছে। নিহিলা অদূরে তাকিয়ে দেখলো এক বৃদ্ধ আর বৃদ্ধা নদীর কিনারায় বসে সময়টা উপভোগ করছে। তার ভালো লাগলো ভীষণ। তাদেরকে ক্যামেরাবন্দী করে নিয়ে সে আবারো পরিবেশ দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। নিহিলা একটু অদূরে গিয়ে দাঁড়ালো। প্রায় অনেক মানুষ এখানে। সবাই এই স্থানটাকে বেছে নেয়ার কারণ সে খুঁজে পেল। এইতো এই স্থানটা হয়ত বেশিই মনকারা। কারণ পাশেই একটি নীরব নদী বয়ে গিয়েছে। এক পাশে নদী আর নদীর পাশে সালা গোলাপী মিশ্রনের চেরি ব্লসম গাছের বিশিষ্ট লম্বা লাইন। যেগুলোতে ফুলের সমাহারে ভরে গেছে। নিহিলা আশেপাশে তাকিয়ে বুঝতে পারলো সবাই এই সময়টাকেই হয়ত বেশি উপভোগ করে। তাই হয়ত রাহান ভাইও এই জায়গাটিতে নিয়ে এসেছে। রাহানের কথা মনে পড়তেই সে চোখ ঘুরিয়ে আশেপাশে তাকালো। প্রতিটা জায়গায় গোল টেবিল ঘিরে ঘিরে মানুষ বসে আছে। নিহিলা সামনে তাকাতে নিতেই দেখলো তার একটু দূরেই রাহান পকেটে হাত গুটিয়ে নদীর দিকে তাকিয়ে আছে। নিহিলা আর ঘাটলো না। সে এগিয়ে গিয়ে অরিন আর আহানের সাথে বসলো। অরিন আর আহান তাদের বাবা মায়ের ছবি তুলে দিচ্ছে। আহান একেক অঙ্গভঙ্গি শিখিয়ে দিচ্ছে আর রিনা আহমেদ লজ্জায় গুটিয়ে যাচ্ছে।
“আরে মা? এই ভঙ্গিমাটা করো।” বলেই আহান নিহিলার কাঁধের উপর হাত দিয়ে দেখিয়ে দিল।
“তোদের এমন ভঙ্গিমা আমি পারবো না।”
“আরে মা, একটু আধুনিক হও।”
“দেখছো না, বাবা কত আধুনিক হয়ে যাচ্ছে।” বলেই আহান বাবাকে চোখ মারলো।
ছেলের কথায় শফিক আহমেদ ভাব নেয়ার ভঙ্গিমা করে দাঁড়ালো। তা দেখে দূরে থাকা নিহিলা হেসে দিল।
“তোরা ছেলেমেয়েরা এতো বে’হা’য়া কবে থেকে হলি?বলেই রিনা আহমেদ স্বামীর দিকে চোখ পাকিয়ে তাকালেন,
“তুমিও এদেরকে আশকারা দিচ্ছ?”
স্ত্রীর কথায় শফিক আহমেদ আরেকটু ভাব নেয়ার ভঙ্গিমা করে দাঁড়ালেন,
“ওরা সত্যিটাই তো বলছে।” বলেই তিনি বুঁকের উপর দুহাত রাখলেন,
“দেখছো না? তোমার স্বামী দিন দিন কত সুন্দর হচ্ছে? তোমার তো গর্ব করা উচিত। তা না করে তুমি ছেলেমেয়েদের ধমকাচ্ছ! এটা কিন্তু ঠিক না রিনা।”
স্বামীর কথায় রিনা আহমেদ তোয়াক্কা না করে আহানের দিকে রাগী চোখে তাকালো,
“একটু হেঁসেছি তাই বলে মাথায় উঠে যাবি! এতো নি’র্ল’জ্জ কবে হলি?”
“মা, ভাইয়ার এসবে অভ্যাস আছে। আর তুমি এতো ছোট বিষয়ে এতো গুটিয়ে যাচ্ছ!” বলতেই অরিনের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালেন রিনা আহমেদ,
“অভ্যাস আছে মানে?”
অরিনের দিকে আহান র’ক্ত’চক্ষু নিয়ে তাকাতেই অরিন দমে গেল।
“আচ্ছা আচ্ছা অনেক বকেছো। চল আমরা একটু পরিবারের ছবি নিই।” বলেই আহান মা বাবার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো।
“রাহানকে ডাক।”
অরিন গিয়ে ভাইকে বলে আবার ফিরে আসলো।
“ভাই কোনোদিনও ছবি তুলবে?এমনিও অনেকবছর পরে নিজে থেকে এসেছে এই অনেক। এর চেয়ে বেশি আশা করলে হিতে বিপরীত হবে।”
রিনা আহমেদ অরিনকে চুপ করিয়ে ডাক দিতেই রাহান আসলো,
“তোমরা তুলো, আমি ছবি তুলে দিই।”
“না, তুই সহ আয়।” বলতেই রাহান এগিয়ে গেল।
রাহান গিয়ে দাঁড়াতেই নিহিলাকে অদূরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো।
“নিহিলা, তুমিও আসো।” রাহানের বলা কথা শুনে সবার নিহিলার কথা খেয়াল হলো।
“আরে হ্যাঁ, নিহিলা আসো।” বলেই রিনা আহমেদ ডাক দিতেই অরিন টেনে নিয়ে আসলো।
“আমার তুলতে ইচ্ছে করছে না। তোমরা তুলো।”
“এমন বললে তো চলবে না। ” বলেই আহান নিহিলাকে টেনে দাঁড় করিয়ে দিল।
ছবি তোলা শেষেই আহানের ফোন আসায় সে ফোন নিয়ে একটু দূরে সরে গেল। নিহিলা সবার মুখের দিকে তাকালো। এমন হাসিখুশি পরিবার! কারোর নজর না লাগুক কোনো।
নিহিলা একটু দূরে সরে নদীর পাশে এগিয়ে গেল। সে খেয়াল করলো তার জামাটার সাথে এই জায়গাটার বেশ মিল। মানে চেরি ব্লসম ফুলগুলো সাদা গোলাপী মিশ্রনের আর তার জামাটাও সাদা গোলাপী মিশ্রনের। মনে কিছু একটু ভাবনা আসতেই নিহিলা অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা রাহানের দিকে তাকালো। এটাও কী কাকতালীয়!
অদূরে অরিন আর তার বাবা একসাথে উৎফুল্ল হয়ে দাঁড়িয়েছে। অরিন আর শফিক আহমেদ একসাথে দাঁড়ালো আর রিনা আহমেদ ছবি তুলে দিচ্ছেন। পৃথিবীতে এর চেয়ে সুন্দর মুহূর্ত বোধহয় আর নেই কিন্তু সে নিজে এমন অভাগা যে মা বাবার এমন কোনো স্মৃতি সে দেখবে তো দূরের কথা একসাথে ছোঁয়াও পেল না। নিহিলা একটু দূরে সরে দাঁড়ালো। তার চোখে পানি টলমল করছে। মনে হচ্ছে যেন পলক ফেললেই টুপ্ করে ঝর্ণার মতো ঝরে পড়বে অশ্রুগুলো। তার চোখ ঝাপসা হয়ে এলো।
“মুছে ফেলো।” পাশ থেকে রাহানের কণ্ঠস্বর পেতেই নিহিলা তাকালো।
রাহান নদীর দিকে দৃষ্টি রেখেই একটা সাদা হাল্কা নীলের সংমিশ্রনের রোমাল বাড়িয়ে দিলো।
নিহিলা দ্রুত পাশ ফিরে হাত দিয়ে চোখ মুছতে নিতেই রাহান সেদিকেই রুমালটা ধরলো।
নিহিলা চোখ মুছে নিল। সে তার হাতের মুঠোয় রোমালটা রেখেই নদীর দিকে তাকালো। সে এই গম্ভীর মানুষটাকে চিনে উঠতে পারছে না।
“রুমালটা?” নিহিলার এতো খারাপ সময়েও কোথ থেকে যেন হাসি পেয়ে যাচ্ছে। সে ভেবেছিল মানুষটা রুমালটা আর নিবে না কিন্তু পানি মুছার সাথে সাথেই রুমালটার জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়েছে! নিহিলা আবারো ভাবলো, আসলেই এমন অদ্ভুত মানুষ এখনো পৃথিবীতে আছে!
#চলবে ইন শা আল্লাহ।
(আসসালামু আলাইকুম। রি চেক করা হয়নি। ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ।)