#বৃষ্টি_শেষে_রোদ (পর্ব ৪)
#মেহেদী_হাসান_রিয়াদ
আজ শুক্রবার। অগন্তুক আজও চিরেকুট রেখে গেছে। চিরেকুট টা হাতে তুলে নিয়ে আশে পাশে চোখ বুলিয়ে নিল আরশি। জানে কাউকে চোখে পড়বে না। তবুও চোখ বুলিয়ে নিল। কাউকে না দেখে অতঃপর চিরেকুট টা খুলে পড়তে শুরু করলো সে।
স্বপ্নচারিনী
‘ইদানিং স্বপ্নে এসে জ্বালাচ্ছো খুব। মনে হয় এই তো তুমি। আমার সামনে। খোলা চুলে মায়াবী দৃষ্টিতে আহত করছো বার বার। জানো, তোমার এই মায়াবী দৃষ্টিতে আহত হওয়ার অনুভূতি টা আমাকে কতটা প্রশান্তি দেয়? মনে হয় এই অনুভূতি নিয়েই আমার মৃত্যু হোক। তাহলে মরে গিয়েও বলতে পারবো, পৃথিবীতে থাকা কালিন সবচেয়ে সুখি মানুষটা আমি ছিলাম।’
লেখাটুকু পড়ে নিচের ঠোঁট উল্টানোর মতো করে ভঙ্গি করলো আরশি। এমন অদ্ভুত কাজকর্মের মানে কি! আর এসব উদ্ভট লেখারই বা কি মানে! কতমাস ধরে প্রতি সাপ্তাহে নিয়ম করে লুকিয়ে চিরেকুট রেখে যায়। অথচ সামনে আসার সাহস নেই তার। আচ্ছা, তার কি বিরক্ত লাগে না? চিরেকুটের নিচে নামটা পর্যন্ত লিখে না। তাহলে বুঝবো কিভাবে সে কে? আজব লোক।
আচ্ছা সত্যিই রিদ ভাই নয়তো? তিনিই তো সব আজব আজব কাজ গুলো করে। কিন্তু তিনি তো আমার সাথে খুব ফ্রি-লি মিশে ও কথা বলে। তাহলে তিনি এমন লুকোচুরি খেলবে কেন?
আচ্ছা তাকে সরাসরি চিঠির ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে কেমন হয়? যে চিঠি গুলো সে রেখে যাচ্ছে কি না? তিনি তো একদিন বলেছিল, আমার দিকে চেয়ে মিথ্যে বলার শক্তি নেই তার।
অনেক দিন আগে কোনো এক বিষয় নিয়ে আরশি বলেছিল, মিথ্যে বলছেন না তো? রিদ তার দিকে চেয়ে থাকা অবস্থায় কথার পিঠে বলে,
“তোর চোখে দৃষ্টি রেখে মিথ্যা বলার শক্তি নেই আমার।”
আরশি কিছু না বলে অবুজের মতো তাকিয়েছিল রিদের দিকে। পরক্ষনে রিদ স্বাভাবিক দৃষ্টি রেখে ক্ষনিকটা বিব্রতকর ভাব করে বলে,
“মানে মিথ্যা বলবো কেন? মিথ্যা বলা চরম পাপ জানিস না তুই?”
আরশি কিছু বলেনি। কিছুক্ষন নিরব থেকে হেসে দিয়েছিল শুধু।
যদি রিদ ভাইয়াই চিঠি গুলো দিয়ে থাকে, এখন তাকে চিঠির কথা জিজ্ঞেস করলে কি তিনি সরাসরি মিথ্যা বলতে পারবে? আচ্ছা, যদি চিঠি গুলো তার না হয়? তাহলে তো আরো ঝামেলা হয়ে যাবে। তিনি নিশ্চই চিঠির মালিকের পেছনে পরবে। না না,,, তাকে জিজ্ঞেস করা যাবে না। তার চেয়ে ভালো যেমন চলছে চলতে থাকুক। তাতে আমার কি?
,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,
বিকেলে ছাদে ছোট একটা ছেলের সাথে ফুটবল নিয়ে মজা করছিল আরশি। এখন বল ধরার জন্য হাতের গ্লাব্স আনতে আবার নিচে দৌড় দিয়েছে সে। ছেলেটার নাম ফুয়াদ। এই বিল্ডিংয়েরই অন্য ভাড়াটিয়ার ছেলে। বয়স ছয় কি সাত হবে। তার অপেক্ষায় বল নিচে ড্রপ দিচ্ছে ও হাত দিয়ে ধরছে আরশি।
ছাদে কারো আগমন ঘটতেই ফুয়াদ ভেবে বলটা ড্রপ দেওয়া অবস্থায় পা দিয়ে লাথি মারে আরশি। শক্ত বলটা সোজা ছুটে দিয়ে হিট করে রিদের মাথায়। ফোন হাতে ব্যস্ত ছিল সে। এমন কিছুর জন্য প্রস্তুত ছিল না হয়তো। বল মাথায় আঘাত করতেই অজ্ঞান হওয়ার মতো করে ছাদেই শুয়ে পড়ে রিদ।
কয়েক সেকেন্ড সেদিকে তাকিয়ে থেকে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করে আরশি। রিদকে অজ্ঞান হয়ে পরে থাকতে দেখেই আচমকাই দু’হাত মুখে চলে যায় তার। চোখে মুখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট। কয়েক সেকেন্ড স্থির থেকে দৌড়ে রিদের সামনে গিয়ে বসে পরে সে।
ছোট বেলায় দাদির কাছে শুনেছিল, অপ্রস্তুত ভাবে পড়লে নাকি একটা ছোট পাথরের কনার আ’ঘাতও একজন মানুষের জীবন নিয়ে নিতে পারে। আর এটা তো আস্ত ফুটবল।
চিন্তিত চেহারায় রিদের পাশে বসে গালে হাত রেখে নাড়াচাড়া করে। কিন্তু রিদের কোনো সাড়াশব্দ মিলল না। ভয় আরো গাড় হলো আরশির। পা ভাজ করে বসে রিদের মাথাটা নিজের কোলে তুলে নিয়ে আবারও গাল ধরে নাড়াচাড়া করে কয়েক বার ডাক দিল আরশি। এখনও রিদের কোনো সারা শব্দ নেই। অস্থির ভঙ্গিতে চার পাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিল সে।
কয়েক সেকেন্ড অস্থিরতায় কাটিয়ে এখনো নিশ্বাস চলছে কিনা বোঝার জন্য কিছুটা ঝুঁকে রিদের মুখের খুব কাছাকাছি নিজের কানটা নিয়ে আশে আরশি। তখনই রিদ তার কানে ফিসফিস করে বলে,
“একটা কাছে আসলে আমি হার্ট অ্যাটাক করে সত্যিই মরে যাব কিন্তু।”
অবাক ভঙ্গিতে মুহুর্তেই উঠে গিয়ে চোখ বড়ো বড়ো করে রিদের দিকে তাকায় আরশি। তার মানে, ভয় পাইয়ে দেওয়ার জন্য এতক্ষন ধরে তিনি অজ্ঞান হওয়ার ভান ধরে ছিল সে? আর এদিকে সত্যি ভেবে চোখে জল পর্যন্ত চলে এসেছে আরশির।
এবার রাগ হলো খুব। রিদের মাথাটা ধাক্কা দিয়ে কোল থেকে নামিয়ে উঠে দাড়িয়ে গেলো সে। এভাবে ফেলে দেওয়ায় ছাদের ফ্লোরের সাথে টুস করে বাড়ি খেলে বেদনাদায়ক ভাবে ‘উহ্’ করে মাথায় হাত দিয়ে উঠে বসে রিদ। আরশির দিকে চেয়ে বলে,
“এবার কি সত্যি সত্যি মেরে ফেলার প্ল্যান করছিস নাকি পিচ্চি?”
আরশি কিছুটা রাগি ভাব নিয়ে বলে,
“মেরে ফেলতেই ইচ্ছে হচ্ছে।”
রিদ একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,
“এই প্রথম কোনো রমনীর দেখা মিলল, যার অল্প বয়সে বিধবা হওয়ার শখ জাগে।”
না বোঝায় মতো করে প্রতি উত্তরে কিছু বললো না আরশি। চুপচাপ রইল সে। রিদ বুঝতে পারে আরশির এখন রসিকতা বোঝার বা তা নিয়ে ভাবার একটুও মুড নেই। তাই সেও দাড়িয়ে আরশির মুখের দিকে চেয়ে দেখে টলমলে পানিতে চোক্ষুজুগল চিকচিক করছে তার। হয়তো সত্যিই ভয় পেয়ে গিয়েছিল সে।
রিদ এবার ক্ষনিকটা হেসে বলে,
“পিচ্চির দেখি অল্পতেই কেঁদে ফেলার অভ্যেস আছে।”
“আমি মোটেও অল্পতে কেঁদে ফেলার মেয়ে না। ভয় পেয়েছিলাম সত্যিই আপনার কিছু হয়ে গেলো কিনা।”
রিদ এবার আদুরে ভাব নিয়ে আরশির দুই গালে আলতো করে হাত ছুইয়ে বলে,
“আচ্ছা স্যরি এমন ভয় দেখানোর জন্য।”
আরশি চুপ করে দাড়িয়ে রইল। রিদ এবার বাচ্চাদের মতো করে নিজের দুই কান চিমটি দিয়ে ধরে বলে,
“এই যে কান ধরলাম। এবার তো একটু হাস’রে পিচ্চি।”
রিদের এমন বাচ্চামো ভাব দেখে এবার আর চুপ থাকতে পারলো না আরশি। চোখে চিকচিক জল নিয়েও আচমকাই হেসে দিল সে। রিদ মুগ্ধ নয়নে তাকালো তার দিকে। তাকাবেই না কেন? এই হাসি যে কাউকে আবদ্ধ করে রাখার মতোই হাসি।
,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,
রিদ ও রোহানকে ডিনারের আমন্ত্রণ জানিয়েছিল আরশির মা। কারণ টা হলো বড়ো একটা রাজ হাস পেয়েছে যার মাংস হয়েছে প্রায় পাঁচ কেজির মতো। এত বড়ো রাজ হাস খুব কমই পাওয়া যায়। তাই রান্না করে নিজের দুই ভাইয়ের ছেলেকে রেখে নাকি খেতে পারছে না সে।
রোহান অফিসের ব্যস্ততার জন্য আসতে পারেনি তার তার জন্য ফুফির কাছে ফোন করে ক্ষমাও চেয়ে নিয়েছে। তাই রিদ একাই এসেছে নিজের ব্যস্ততা রেখে। হয়তো ফুফির দাওয়াত গ্রহন করতে নয়তো তার প্রেয়সিকে কাছ থেকে এক নজর দেখার জন্য হলেও।
আরশির টেস্ট এক্সাম শেষ হয়েছিল এক দিন আগে। তাই সন্ধার পর আরশিকে নিয়ে পড়ার টেবিলে বসলো রিদ। আরশির প্রশ্ন পত্র গুলো চাইলে আরশি স্বাভাবিক ভাবে বলে,
“ওগুলো পরিক্ষা শেষে ফেলে দিয়েছি।”
রিদ কিছুটা রাগী দৃষ্টিতে চেয়ে বলে,
“আমার সাথে মিথ্যা বলছিস? আমার চোখের দিকে চেয়ে আবার মিথ্যা বল দেখি।”
আরশি এবার ক্ষনিকটা ঠোঁট উল্টানোর মতো করে বাধ্য মেয়ের ন্যায় প্রশ্ন গুলো রিদের হাতে দিল। কারণ সে ভালোই বুঝতে পারছে এখন এখানেই তার জন্য আরেকটা পরিক্ষাকেন্দ্র তৈরি হয়ে গেছে।
রাত তখন প্রায় প্রায় নয় টা। পাক্কা দুই ঘন্টা ধরে একে একে সব প্রশ্নপত্র থেকে প্রশ্ন করেছে রিদ।
অতঃপর অপরাধীর ন্যান মাথা নিচু করে আছে আরশি। রিদ তার দিকে চেয়ে বলে,
“এমন পড়াশুনা হলে এ+ কেন? এ তুলতেও কষ্ট হবে তোর। এখন পিএইচডির প্রস্তুতি নিয়ে ব্যস্ত থাকায় তেমন আসতে পারিনা দেখে পড়ায় ফাঁকিবাজি শুরু করেছিস নিশ্চই? মন কই থাকে সারাদিন?”
চোখেমুখে ভয়ের ছাপ রেখে চুপচাপ রইল আরশি। এই মুহুর্তে এই ব্যাটাকে কয়েকটা কথা শুনাতে ইচ্ছে হচ্ছে তার। ব্যাটা বজ্জাত। দাওয়াতে আসলি নাকি শিক্ষকতা করতে আসলি?
তবে কথা গুলো মনের ভেতরেই জমা রইল তার। বলার সাহস হয়ে উঠেনি।
অতঃপর রিদ প্রশ্ন গুলো একপাশে রেখে বলে,
“বুঝতে পেরেছি। ব্যস্ততা থাকলেও আগের মতো আবার তোকে পড়াতে আসতে হবে আমার।”
আচমকাই আরশি দু’দিকে মাথা নাড়িয়ে বলে,
“না না,,, এবার থেকে সত্যিই পড়াশোনায় মনোযোগী হবো, প্রমিস।”
রিদ গম্ভির ভাবে তার দিকে তাকালে আরশি ক্ষনিকটা চুপশে গিয়ে বলে,
“না মানে,,,,, আসলেও সমস্যা নেই।
,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,
ফুপি এসে ডেকে গেলো খাওয়ার জন্য। রাতের খাবার শেষে চলে যাওয়ার আগ মুহুর্তে আরশির পাশে এসে বসলো রিদ। আরশির দিকে চেয়ে শান্ত গলায় বলে,
“পা দুটো উপরে তোল।”
আরশি ক্ষনিকটা অবাক হলে বলে,
“কেন?”
“আমি বলেছি তাই।”
আরশি আর প্রশ্ন না করে চুপচাপ পা দুটো উপরে তুলে নিল। রিদ চুপচাপ পকেট থেকে নপুর জোড়া বের করে খুব যত্ন করে পায়ে পরিয়ে দিতে দিতে বলে,
“আসার সময় একটা দোকানে দেখে ভালো লেগেছিল। মনে হয়েছিল তোর পায়ে মানাবে খুব। তাই নিয়ে নিলাম।”
আরশি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে রিদের দিকে। একটু আগেও পড়া নিয়ে কত কঠিন ভাবে কথা বলছিল সে। আর এখন যেন মোমের মতোই গলে নরম হয়ে গেছে সে। মানুষটা সত্যিই খুব আজব। বোঝা খুবই কঠিন।
রিদ চলে গেলো। আরশি এখনো চেয়ে রইলো পায়ে জড়ানো নপুর জোড়ার দিকে। হয়তো আজ এগুলো পায়ে রেখে অনেক্ষন রুমে হাটাহাটি করবে সে। প্রিয় মানুষের দেওয়া জিনিস টা যতই সামান্য হোক, সেই মুহুর্তে মনে হয় এটা পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান কিছু। হয়তো আজ এই রিনঝিন শব্দ বারংবার কানে আসতেই মনে হবে যেন মানুষটা তার সাথেই আছে।
To be continue……………….