হৃদয়জুড়ে_প্রেয়সীর_আভাস #পর্ব_১৪ #মোহনা_হক

0
634

#হৃদয়জুড়ে_প্রেয়সীর_আভাস
#পর্ব_১৪
#মোহনা_হক

স্টেজে বসা লোকটির দিকে অপলক ভাবে তাকিয়ে রুয়াত। হঠাৎ কিভাবে যেনো এই বিরক্তিকর লোককে ভালোবেসে ফেলে তার জানা নেই। রুয়াতের এহেন চাহনি দেখে নিমি না হেসে পারলো না। হুঁশ ফিরে আসে রুয়াতের। চোখ মুখ কুচকে তাকায় নিমির দিকে।

-‘এভাবে অহেতুক কারণে হেসে বেড়াচ্ছিস কেনো?’

হাসি বন্ধ হয়ে গেলো নিমির।
-‘তুই যে ওনার প্রেমে পড়ে পাগল হয়েছিস সে খেয়াল আছে কি?’

বিরক্ত হয়ে রুয়াত বলে-
-‘বাদ দে না। আমারটা আমি বুঝবো। আর এসব বিষয় নিয়ে একটা কথাও শুনতে চাই না নিমি।’

চুপ হয়ে রইলো নিমি। রুয়াতের কথা মতোন আর কথা বাড়াতে চাইলো না। দু’জনের দৃষ্টি সামনের দিকে। অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করলো সে মেয়েগুলো। এক পর্যায়ে আয়াজ কে বলা হলো পরিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে কিছু বলতে। আয়াজ অনেক কথা বললো পরিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে। কলেজের অনেক স্যার মিলে আয়াজ কে কিছু উপহার দেয়। হাসিমুখে গ্রহণ করে সবকিছু। আজ আয়াজ তার সাথে বডিগার্ড ও এনেছে সাথে করে। এতো মানুষের ভিড়ে থাকবে কখন কি হয়ে যায় বলা তো যায় না। ইকরামুল কে ও বলা হয়েছে। আজ অনেক নেতারাই এখানে উপস্থিত রয়েছে। সবার সাথে আয়াজের ভালো সম্পর্ক থাকলেও বরাবরের মতোই ইকরামুল আর আয়াজের সম্পর্কের কোনো রকম উন্নতি নেই। পাশাপাশি বসে আছে দু’জন। ইকরামুল সবার সামনে আয়াজ কে ছোট করেছে আজ। সে অনেক আগেই এখানে এসেছিলো। যখন এমপির আগমন ঘটে বা স্টেজে ওঠে তখন ইকরামুল তার জায়গায় বসে ছিলো। আয়াজ স্টেজে ওঠার সময় সকলে দাঁড়িয়ে সম্মান প্রদর্শন করেছে কিন্তু ইকরামুল বসেছিলো যা সবার কাছেই দৃষ্টিকটু লেগেছে। সবাই আয়াজের সাথে কথা বলার জন্য প্রায় অধীর আগ্রহে বসেছিলো আর সেখানে পাশে একজন এমপি বসে থাকার পর ও কোনো হেলদোল নেই ইকরামুলের।

আয়াজ সেসব কথা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে তার প্রেয়সীর দিকে তাকিয়ে আছে। এতো মানুষের ভিড়ে বোঝার উপায় নেই যে আয়াজ কার দিকে তাকিয়ে আছে। প্রেয়সীর যেনো আজ নতুন রূপের সুচনা হয়েছে। মায়াময়ীরূপ জন্মেছে। অধর প্রসারিত হলো আয়াজের। শুধুমাত্র নিজের পেশার কাছে হেরে গিয়ে আজ রুয়াতের পাশে বসার সুযোগটুকু হলো না। মানুষ তাকে নিয়ে নানান কথা রটাবে। চরিত্রহীন ভাববে তাকে। দু’দিন রুয়াতের সাথে কথা বলতে না পেরে তার হৃদয়টুকু আবার অশান্ত হয়ে ওঠেছে। নজর সরিয়ে আয়াজ অনুষ্ঠানে মনোযোগ দিলো।

সাহেদ এগিয়ে এসে আয়াজের কানে বলে-
-‘স্যার ইকরামুল কার সাথে কথা বলার জন্য ওঠে গিয়েছে। ও আজ আপনাকে অসম্মান করেছে এবারও চুপ করে থাকবেন স্যার?’

ইকরামুলের ব্যবহারের কথা স্মরণ করতেই চোয়াল শক্ত হয়ে এলো আয়াজের। শুধুমাত্র এটা একটা অনুষ্ঠান দেখে কোনো রকম সিনক্রিয়েট না করে মানবতার খাতিরে বসে আছে। যদি আয়াজ সেরকম কিছু করতো তাহলে যুদ্ধের ময়দান বেঁধে যেতো এখানে।

-‘সাহেদ শান্ত থাকো। এভাবে হুটহাট মাথা গরম করলে চলবে না। ওর করা প্রত্যেকটা অপমানের হিসেব তুলবো।’

সাহেদের শরীর রাগে রীতিমতো যেনো ফেঁটে যাওয়ার উপক্রম। কোনোমতেই সে আয়াজের অসম্মান হোক সেটা চায় না। সাহেদ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো আয়াজের পিছন বরাবর। ইকরামুল এখানে নেই কেউ কল দিয়েছে তাই কথা বলার জন্য ওঠে গিয়েছে। এই ফাঁকে আয়াজ একজন কে বলে দিয়েছে ইকরামুলের যতো দোকান আছে সবগুলো যেনো বন্ধ করে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। বেশ কিছু প্রমাণ তার হাতে এসেছে শুধু অনুষ্ঠান শেষ হবার পালা। এরপর আয়াজ বুঝিয়ে দিবে ইকরামুলের জায়গা আসলে ঠিক কোঁথায় হওয়া দরকার।

.

অনুষ্ঠান প্রায় শেষের দিকে। সবার মন্তব্য শেষ হয়ে গিয়েছে। আধঘন্টা পর অনুষ্ঠানের পরিসমাপ্তি ঘটে। এর মাঝ থেকে ইকরামুল আগেই বিদায় নেয় তার সব দোকান বন্ধ হয়ে গিয়েছে শুনে মাথা ঠিক ছিলো না। আশেপাশের দোকানের মালিকেরা খবর দিয়েছে পুলিশ এসে নাকি দোকানগুলো বন্ধ করে দিয়েছে।এমন খবর শুনে ইকরামুল চলে যায়।
অনুষ্ঠান শেষে যে যার মতো বাসায় চলে যায়। রুয়াত নিমি কে আটকে রেখেছে শুধু আয়াজের সাথে কথা বলার জন্য। কিন্তু এতো ছেলেরা তাকে ঘিরে আছে যার কারণে সাহস পাচ্ছেনা। এক সময় নিমি চলে যায় ওর ভাইয়া কল দিয়েছিলো। অনেক্ক্ষণ যাবত আয়াজ দূর থেকে খেয়াল করেছে রুয়াত ঠায় দাঁড়িয়ে আছে মাঠের মধ্যে। যেখানে মানুষের সমাগম খুবই কম। প্রায় বেশিরভাগ মেয়েরা চলে গিয়েছে। আরও কিছু কিছু রয়েছে যারা কেউ কেউ ছবি তুলছে, এক জায়গায় বসে কথা বলছে। কিন্তু রুয়াতের সাথে কেউই নেই। আর না রুয়াত বসে কারও জন্য অপেক্ষা করছে। এই জায়গা বর্তমানে তার প্রেয়সীর জন্য নিরাপদ নয়। আয়াজ হেডস্যারের লাইব্রেরী থেকে রুয়াত কে দেখেই যাচ্ছে।

সাহেদ কে ডাক দিয়ে বললো-
-‘তোমার ম্যাডাম কে বলো বাসায় চলে যেতে।’

আয়াজের কথামতো সাহেদ রুয়াতের কাছে গেলো। সাহেদ কে আসতে রুয়াত অবাক হয়। হঠাৎ আয়াজের সাথের লোক কেনো রুয়াতের দিকে আসছে? সাহেদ ভদ্রতা বজায় রেখে প্রথমে রুয়াত কে সালাম দিলো।

-‘আসসালামু আলাইকুম ম্যাডাম। স্যার আপনাকে বলেছে বাসায় চলে যেতে।’

জিহ্বা দ্বারা অধর ভেজালো মেয়েটা। যার জন্য বসে অপেক্ষা করছে সে এখন বলছে বাসায় চলে যেতে।

-‘আপনার স্যারের কাজ শেষ হবে কখন? তিনি কখন বাসায় যাবেন?’

সাহেদ সৌজন্যবোধক হাসি দিয়ে বললো-‘
-‘ম্যাডাম স্যারের কাজ শেষ হতে সময় লাগবে। এখানের কাজ শেষ হলে আবার অন্য কোথাও যাবেন। স্যারের আজ গুরুত্বপূর্ণ মিটিং আছে ম্যাডাম।’

রুয়াত ছোট্ট করে উত্তর দিলো।
-‘ওহ্।’

তৎক্ষনাত কল আসে সাহেদের মোবাইলে। পকেট থেকে মোবাইল বের করে দেখে আয়াজ কল দিয়েছে। তড়িঘড়ি করে কল রিসিভ করে সাহেদ। রিসিভ করতেই আয়াজের কন্ঠস্বর ভেসে ওঠে।

-‘তোমার ম্যাডাম কে রিকশায় তুলে দিয়ে এখানে আসো।’

-‘জ্বী স্যার।’

কল কেটে দেওয়ার পর সাহেদ মোবাইল আবার পকেটে ঢুকাতে ঢুকাতে বলে-
-‘ম্যাডাম স্যার বলেছে আপনাকে রিকশায় তুলে দিতে। এরপর আমায় যেতে হবে স্যারের কাছে। চলুন ম্যাডাম আপনাকে রিকশায় তুলে দিয়ে আসি।’

চারপাশে তাকালো রুয়াত। কিছু ছেলে মেয়েরাও চলে গিয়েছে যারা এতক্ষণ এখানে ছিলো। কোনো মেয়েরা নেই। যা আছে সব ছেলেরা যারা আয়াজের কাছে। রুয়াত আর থাকতে চাচ্ছে না এখানে।

-‘ভাইয়া আমি চলে যেতে পারবো। আপনার আসার দরকার নেই। ‘

-‘না না ম্যাডাম। চলুন আমিই দিয়ে আসি আপনাকে।’

রুয়াত আর মানা করলো না। সাহেদ রুয়াত কে রিকশায় তুলে দেয়। বাসায় চলে আসে সে। আজও সেই মানুষটার সাথে কথা হলো না। ভালো লাগছে না তার। বাসায় এসেই দেখে জাফরি দৌড় দিচ্ছে একা একা। রুয়াত কে দেখেই স্থির হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু সে কি শান্তশিষ্ট মেয়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়েই থাকবে? রুয়াত কে দেখেই একদম দৌড়ে ঝাপিয়ে পড়ে তার কোলে। শাড়ি উল্টো পাল্টা হয়ে গেলো তার। একটু আধটু গলার স্বর কঠিন করে বললো-

-‘জাফরি তুমি বড় হয়েছো না? আর এভাবে দৌড়ে আসবে না কারও কোলে। কেউ বাহির থেকে আসলে তার শরীরে ময়লা থাকে সে ফ্রেশ হওয়ার পর তারপর তুমি তার কোলে উঠবে। ঠিক আছে?’

ছোট অবুঝ মেয়েটা মাথা নাড়লো তার মিম্মিমের কথায়। রুয়াতের কন্ঠস্বর শুনে ইনিমা তার রুম থেকে বেরিয়ে আসে। দিনকে দিন তার শরীর ও একদম দূর্বল হয়ে যাচ্ছে। তাই বেশি একটা রুম থেকে বের হয় না সে।

ইনিমা হেসে বলে-
-‘আমার মেয়ে হলেও মিম্মিমের মতো নম্র, ভদ্র হয়েছে।’

রুয়াত মৃদু হাসলো বোনের কথায়। জাফরি কে কোল থেকে নামিয়ে উপরে চলে যায়। দীর্ঘ কয়েক ঘন্টা শাড়ি পড়ে প্রায় অধৈর্য্য হয়ে গিয়েছে। ফ্রেশ হয়ে একটা কম্ফোর্ট ড্রেস পড়ে নেয়। সারাদিনের ক্লান্তিতে এক সময়ে ঘুম এসে পড়ে রুয়াতের।

(*)

আজ যে গুরুত্বপূর্ণ মিটিং ছিলো সেটা ক্যান্সেল করা হয়েছে। ইকরামুলের দোকানের সামনে মেয়র আরও অন্যান্য অনেক নেতা এসে ভির জমিয়েছে। পুলিশের সাথে ক্রমাগত তর্ক করে যাচ্ছে ইকরামুল। আয়াজ কে খবর দেওয়া হয়েছিলো কিন্তু সে এখনো এসে উপস্থিত হয়নি। আয়াজ নিজেও জানে সে এখানে না এলে কক্ষনো কেউ সমাধান করতে পারবে না তাই একটু ভাবসাব নিয়ে নিজের অফিসে বসে আছে। এদিকে ইকরামুলের মাথা প্রায় পাগল হয়ে গিয়েছে। পুলিশ কোনোমতেই তার দোকানগুলো ছাড়ছে না। এমনকি দোকানের ভিতরেও প্রবেশ করতে দিচ্ছে না। এক প্রকার না পেরে আয়াজ কে অনুরোধ করে এখানে আসার জন্য। ইকরামুলের অনুরোধের কথা শুনে বিদ্রুপ হাসি দেয়। যে মুভির মজা নেই সে মুভি কখনো আয়াজের ভালো লাগে না। গাড়ি, গার্ড আর তার দলের কিছু লোক নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখে সবাই প্রায় একদম জোট পাকিয়ে আছে। আয়াজের প্ল্যান মতোই সব এগুচ্ছে। ধীর পায়ে আগায় সেখানে। আয়াজ আগেই পুলিশ প্রশাসকের সাথে বৈঠক করে। সব জানায় প্রমাণ ও দেখায়। আর পুলিশ প্রশাসককে বলা হয়েছে যেনো আয়াজ সেখানে উপস্থিত হলেই যেনো সব ঘটনা মানুষ কে জানাবে। তারাও সেরকম কাজ করেছে। কিন্তু কারণের ভিত্তিতে চার মাস ইকরামুলের দোকাল টোটালি বন্ধ রাখার ঘোষণা জানায়।

মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে ইকরামুল। অনেকে ইকরামুল কে বুঝিয়েছে। কিন্তু তার মাথা ঠিক নেই সব কিছুর জন্য মনে মনে আয়াজ কে দোষারোপ করছে। সবাই চলে গেলো। আয়াজ আর সাহেদ থেকে গেলো সেখানে। ইকরামুলের কাঁধে হাত দিয়ে বললো-

-‘তোমাকে আমি বুঝিয়েছিলাম ইকরামুল কিন্তু তুমি বুঝোনি। এসব অনৈতিক কাজ করলে চলে বলো?’

রক্তিম চোখে তাকায় ইকরামুল আয়াজের দিকে। এ যেনো কাঁটা গায়ে নুনের ছিঁটা। পিছনে দাঁড়ানো সাহেদ পৈশাচিক আনন্দ পাচ্ছে। কাঁধ থেকে ঝাড়া দিয়ে হাত সরিয়ে দিলো আয়াজের।

-‘সব কিছুর পিছনে আপনি ছিলেন তাইনা!’

হাসে আয়াজ।
-‘তোমার কি আমাকে আজাইরা থাকার মানুষ মনেহয় ইকরামুল?’

ইকরামুল কটমট করে তাকায় আয়াজের দিকে।
-‘যারা আমাকে আজ এমন দুদর্শা পরিস্থিতিতে এনেছে তাদের কাউকে ছাড় দিবো না আমি।’

আয়াজ হাসতে হাসতে চলে আসলো। এটা তো কিছুই না আরও কত কাহিনী বাকি আছে। আয়াজ সেখান থেকে চলে আসলো। এখনো তার কাজ শেষ হয়নি আরও অনেক কাজ বাকি আছে। সে কাজের উদ্দেশ্যে রওনা দিলো অন্য জায়গায়।
ইকরামুল ফোন করে জানিয়ে দিলো যেভাবেই হোক আজ যেনো আয়াজ কোনো মতেই বাড়ি ফিরতে দেওয়া না হয়। ইকরামুলের দলের লোকেরা তাকে বোঝালো আয়াজের সাথে এখন কিছু করলে তারা ফেঁসে যাবে। কিন্তু প্রতিশোধের তাড়নায় পাগল ইকরামুল। তাদের কথা মানতে রাজি হলো না। আর তারা ইকরামুলের জন্য বাধ্য হয়েই কথাটি মানতে রাজি হলো।

(*)

সন্ধ্যায় পড়ার টেবিলে বসে পড়ছে রুয়াত। তার রুমেই ইনিমা আর জাফরি মায়া চৌধুরীর সাথে কথা বলছে। হঠাৎ আরহামের কল আসায় মায়া চৌধুরীর কল কেটে দেয় ইনিমা। কল রিসিভ করতেই আরহাম ভাঙা গলায় কিছু একটা বললো। যা শুনে রীতিমতো ইনিমার শরীর কাঁপছে। রুয়াত কে ডাক দিলো। রুয়াত ইনিমার এমন কান্ডে ছুঁটে এলো বোনের কাছে। ইনিমার গালের দু’পাশে হাত রেখে জানতে চাইলো কি হয়েছে। কিন্তু সে নিশ্চুপ। অনেক জিগ্যেস করার পর ইনিমা বললো-‘

-‘আয়াজের এক্সিডেন্ট হয়েছে।’

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here