#বৃষ্টি_শেষে_রোদ (পর্ব ২)
#মেহেদী_হাসান_রিয়াদ
‘ভাইয়া তোকে নিয়ে জেলাস’ রুমকির কথাটা যেন আরশির কিশোরী মনে জেগে উঠছে নানান কৌতুহলী প্রশ্ন। তখন রিদের শান্ত দৃষ্টিও কি একই কথার ঈঙ্গিত দিচ্ছিল? নাকি এটা পুরোটাই একটা স্বাভাবিক ব্যাপার।
রুমকির রুমে এসে চিন্তিত ভঙ্গিতে বিছানার এক পাশে বসে রইল আরশি। হটাৎ রিদ রুমে আসতেই নিজেকে স্বাভাবিক করে নিল সে। বিছানা থেকে উঠে দাড়াতেই রিদ তার এক হাত চেপে ধরে বেলকনিতে নিয়ে গেলো চুপচাপ।
আরশির দিকে রাগান্বিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সে। মুঠো হাতের এক আঙুল দিয়ে তাকে শাসিয়ে তীব্র অধিকারী কন্ঠে বলে,
“এই ফারুক নামের ছেলেটার থেকে দুরে থাকবি। তোকে যেন তার আশে পাশেও দ্বিতীয় বার না দেখি।”
রিদের এমন ব্যবহারে মনে কিছুটা ভয় জন্ম নিলেও কৌতুহল বসত আরশি বলে উঠে,
“কেন ভাইয়া?”
আরশির পাল্টা প্রশ্ন শুনে রিদ কিছুটা ধমকের স্বরে বলে,
“আমি বলেছি তাই।”
এই মুহুর্তে পাল্টা প্রশ্ন করার সাহস হলো না আরশির। নত মাথা হালকা নাড়িয়ে ছোট করে বলে,
“আচ্ছা।”
আরশির এমন ইনোসেন্ট ভাব দেখে আর কিছু বলতে পারলো না রিদ। চোখ বুঁজে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাড়িয়ে রইল সেখানে। আরশিও পাশে দাড়িয়ে আছে চুপচাপ।
কিছু সময় নিরবতায় পার হলে আরশির মুখের সামনে আসা পাতলা চুল গুলো কানের পেছনে গুঁজে দিল রিদ। আরশির মায়াবী মুখশ্রীতে দৃষ্টি রেখে এবার পুরোপুরি শান্ত গলায় বলে,
“ভয় পেয়েছিস? স্যরি, এভাবে বলার জন্য। জানিস তো, আমার অসহ্যকর এমন কিছু ঘটলে চারপাশে সব কিছু এলেমেলে মনে হয়। খুব রাগ হয় আমার, খুব।”
বলেই চুপচাপ চলে গেলো সে। আরশি দাড়িয়ে রইল ওভাবেই। রিদের চলে যাওয়ার দিকে দৃষ্টি রাখলো সে। বুকের ভেতর ধুকপুক করা অনুভুতি নিয়ে গ্রিল ধরে বাইরের দিকে তাকলো।
অসহ্যকর বলতে কি বোঝালেন তিনি? রুহি আপুর দেবরের সাথে কথা বলাটা অসহ্যকর, নাকি সে হাত ধরতে চাওয়াটা অসহ্যকর মনে হলো আপনার কাছে? তাছাড়া যাই হোক, তাতে আপনার এত অসহ্যকর মনে হবে কেন? আজব!
আনমনে কিছুক্ষণ ওভাবে দাড়িয়ে থাকলো আরশি। রুমি পাশে এসে দাড়ালে স্বাভাবিক হয়ে সেদিকে তাকায় সে।
রুমকি ক্ষনিকটা চিন্তিত ভঙ্গিতে বলে,
“আরশি দেখ, আমরা রুহি আপুকে কত আবুল ভাবতাম। অথচ সে কতক্ষণ ধরে ফাহিম ভাইয়ার সাথে কথা বলছে। এতক্ষণ কি কথা বলছে ওটা ভেবেই অবাক হচ্ছি আমি।”
আরশির মনে এমনিতেও অন্য বিষয় ঘুরপাক খাচ্ছিল। অন্য কিছু নিয়ে খুব একটা ভাবতে ইচ্ছে হচ্ছে না আপাতত। তাই স্বাভাবিক গলায় বলে,
“তো আপু তার হবু বরের সাথে কথা বলবে না তো কার সাথে বলবে?”
রুমকি চেহারায় এখনও সেই চিন্তার ছাপ রেখে পূনরায় বলে,
“তাই বলে এই আবুল মেয়েটা এতক্ষণ কিভাবে কথা বলছে? বিষ্ময়কর!”
,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,
কিছুক্ষণ কুশলাদি বিনিময়ের পর মোটমুটি লজ্জা ভাঙলো দুজনেরই। ফাহিম স্বাভাবিক গলায় রুহিকে বলে,
“আচ্ছা তোমাকে সরাসরি কিছু প্রশ্ন করি? একদম নিশ্চিন্তে উত্তর দিবে। ভয় পাওয়া বা নার্ভাস হওয়ার কোনো কারণ নেই।”
রুহি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিল। ফাহিম পূনরায় বলে,
“বিয়েটা কি তোমার ইচ্ছায় হচ্ছে? আই মিন ফ্যামিলি প্রেশারে তুমি বিয়ে করছো না তো? এমন কিছু হলে আমার নিশ্চিন্তে বলতে পারো।”
রুহি মাথা নিচু অবস্থায় জবাব দেয়,
“কেউ জোর করেনি আমাকে।”
ফাহিম এবার বুকে দু’হাত গুঁজে দুষ্টু হেসে বলে,
“আমাকে পছন্দ হয়েছে?”
ক্ষনিকটা লজ্জা পেলো রুহি। ফাহিম পুনরায় বলে,
“বিয়ের কথাবার্তা চলছে অলরেডি। তোমাকে নিজের মানুষ ভেবেই সরাসরি এসব বলছি। তাই আমার কাছে কোনো রকম লজ্জা পাওয়া বা নার্ভাস হওয়ার কারন নেই।”
লজ্জা জনক ভাবে হ্যাঁ সূচক হালকা মাথা নাড়ালো রুহি। অতঃপর লজ্জায় মুখ নিচু করে নিল সে। ফাহিম কিছুটা হেসে বলে,
“কিছু মনে করো না। আমি এমনই। কখনো মনে কৌতুহল বা কোনো কিছু লুকিয়ে রাখতে পারি না। তাই যেই মানুষটার হাত ধরে আমি সারা জীবন পার করার স্বপ্ন দেখবো, যে মানুষটার সাথে বাকি জীবনটা পাড়ি দিবো, সে মানুষটার সম্মতিটাও আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ একটা সম্পর্কে দুজনের মতামতই সবার উর্ধে। তাই সরাসরিই জেনে নিলাম। যাই হোক, কনগ্রেচুলেশন টু ইউ এন্ড মি।”
অভিনন্দন জানানোয় রুহি কিছুটা কৌতুহলী হয়ে বলে,
“কেন?”
“তুমি আমাকে পাচ্ছো, আর আমি তোমাকে,,,, তাই।”
বলেই মুচকি হাসলো ফাহিম। বিপরীতে হেসে দিল রুহিও। মানুষটা কেমন হবে এই কৌতুহলে বুকের ভেতর উম্মাদ হওয়া হৃদপিণ্ডের ধুক ধুক শব্দটা যেন হালকা হতে শুরু করেছে একটু একটু করে।
,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,
আরশি ও রুমকির পাশে এসে বসে হাফ ছেড়ে নিশ্বাস নিলো রুহি। রুমকি হাস্যজ্জল চহুনিতে তীব্র কৌতুহল নিয়ে প্রশ্ন করে,
“দুলাভাইয়ের সাথে কি কথা হয়েছে আপু?”
রুহি শ্বাস নিয়ে নিজেকে হালকা করে বলে,
“তোর এত জানার আগ্রহ কেন?”
“বলো, আমরাও শুনি। অভিজ্ঞতার প্রয়োজন আছে না?”
এর মাঝেই রোহান উপস্থিত হয় সেখানে। রুমকির দিকে চেয়ে বলে,
“রুহিরে, এই বাতি লেবুটাকে তোর আগে বিয়ে দেওয়া উচিৎ ছিল।”
পাশ থেকে রোহানের কথায় মুখ চেপে হেসে উঠলো রুহি-আরশি দুজনই। শুধু হাসেনি রুমকি। কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে রাগী দৃষ্টিতে রোহানের দিকে চেয়ে বলে,
“আপনি বাতি লেবু কাকে বললেন?”
রোহান স্বাভাবিক ভাবে আরশি ও রুহির দিকে চেয়ে বলে,
“আমি কি কারো নাম ধরে বলছি?”
আরশি রুহি দুজনই মাথা নেড়ে বলল,
“না তো।”
রোহান এবার একটু ভাব নিয়ে বলে,
“তাহলে তার গায়ে লাগলো কেন? নিশ্চই চোরের মনে পুলিশ পুলিশ।”
আবারও হাসলো সবাই। সবার মাঝে হাসির পাত্র হয়ে রুমকি এবার রোহানের দিকে চেয়ে ক্ষুদার্থ বাহিনীর ন্যয় ফোঁসফোঁস করে কয়েকটা শ্বাস নিল। ইচ্ছে হচ্ছে রোহানকে ধরে কাপড় কাঁচার মতো করে কয়েকটা আছাড় দিতে। কিন্তু এত বড়ো দামড়া ছেলেকে তুলে আছাড় দেওয়ার শক্তি ও সাহস কোনোটাই নেই তার। তাই নিজের রাগ কমাতে কয়েকটা কড়া কথার বিকল্প নেই। তবে কি বলা উচিৎ তা এই মুহুর্তে খুঁজে না পেয়ে বলে উঠে,
“অভিশাপ দিলাম, আপনার জীবনেও বিয়ে হবে না।”
,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,
পাত্র পক্ষ চলে গেছে অনেক আগেই। এখন রাত প্রায় একটা ছুঁই ছুঁই। ব্যস্ততা শেষে ঘুমাতে গেলো বাড়ির সবাই।
মাঈমুনা চৌধুরী চোখে মুখে এক রাশ চিন্তার ছাপ নিয়ে রোহানকে ডেকে বলে,
“রিদ কোথায়রে রোহান। সেই সন্ধার পর থেকে এখনো কোনো খবর নেই। ফোন দিচ্ছি।, ফোনও বন্ধ। কোথায় গেলো ছেলেটা? তোকে কিছু বলেছিল?”
ফোন হাতে শুয়ে ছিল রোহান। শোয়া থেকে উঠে লাইট অন করে চাচির দিকে চেয়ে বলে,
“কই না তো চাচি। আমি তো ভেবেছি, আপনারাই কোনো জরুরি কাজে কোথাও পাঠিয়েছেন তাকে।”
রুমকির পাশে চুপচাপ শুয়ে ছিল আরশি। অজানা কোনো কারণে বা অকারণে ঘুম আসছিলো না তার। হটাৎ পাশের রুম থেকে এমন কিছু শুনেই বিছানায় উঠে বসে গেলো সে। বুকটা টিপটিপ করতে শুরু করেছে। নানান প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে তার মনে। এত রাতে বাইরে কি করছে রিদ ভাই? কেন এখনো ঘরে ফিরেনি? নাকি রুমকির কথাই সত্যি। আমার উপর রাগ করে বাইরে পরে আছে না তো? যদি এমনটাই হয়, তাহলে এত রাগ কেন তার? এমন পাগলামির কোনো মানে আছে?
ভাবতে ভাবতে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল সে। রুমের বাইরে সবার শব্দ শোনা যাচ্ছে। সেখানে যাওয়ার সাহস হচ্ছে না তার। যদি মা জেনে যায়, আরশির উপর রাগ করে রিদ এখনো ঘরে ফিরেনি, তাহলে নিশ্চই মায়ের অনেক বকাঝকা শুনতে হবে তাকে।
হটাৎই কথাবার্তার পরিবর্তন দেখে হেটে দরজার সামনে এসে দাড়ায় আরশি। পর্দা সরিয়ে রিদকে দেখে একটা স্বস্থির নিশ্বাস নিল সে। তার মানে রাগ কমেছে তার? তাছাড়া সামান্য একটা বিষয় নিয়ে এমন রাগ করার কি আছে? আজব মানুষ!
এত রাত বাইরে থাকার কারণ জানতে চেয়ে রুদ্র চৌধুরী বলে,
“কোথায় ছিলে এতক্ষণ?”
রিদ অনেকটাই ক্লান্ত গলায় বলে,
“হসপিটালে।”
পাশ থেকে মাঈমুনা চৌধুরি বলে,
“হসপিটাল! সব ঠিক আছে তো?”
রিদ একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলে,
“হুম সব ঠিকঠাক। রাফিকে(রিদের বন্ধু) ছিনতাইকারী ধরেছিল। মাথায় আ’ঘাত করায় হসপিটালে নিয়ে ছয় সেলাই দিতে হয়েছে। তারপর বাসায় পৌছে দিয়ে আসতে হয়েছে তাকে।”
পূনরায় খাটে এসে শুয়ে পড়লো আরশি। এতক্ষণ কতকিছুই না মাথায় এসেছিল, তার উপর রাগ করে রিদ বাইরে পড়েছিল। রিদ ভাই তাকে নিয়ে জেলাস দেখে রাগ করে ছিল। এখন দেখছে এমন কিছুই না। ধুর ছাই!!!
যাই হোক বাসায় ফিরেছে, চিন্তা কমেছে। এটাই অনেক। ভেবেই চোখ বন্ধ করলে পাশ থেকে রুমকি বলে,
“ভাইয়া ফিরে এসেছে ভাবি। এখন আর টেনশন করতে হবে না। নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ো।”
আরশি মুহুর্তেই তার দিকে দৃষ্টি দিয়ে বলে,
“তুই ঘুমাস নি?”
রুমকি ঘুমো ঘুমো চোখে বলে,
“ঘুমিয়েছিলাম। কিন্তু সবাই যা শুরু করে দিয়েছিল, তাতে মরা মানুষও লাফ দিয়ে উঠবে। আচ্ছা যাই হোক, আর দুশ্চিন্তা করতে হবে না, ঘুমা।”
আরশি ক্ষনিকটা ভাব নেওয়ার চেষ্টা করে বলে,
“তোর ভাইয়ের জন্য আমি কেন চিন্তা করতে যাবো?”
রুমি একটা হাই দিয়ে উল্টো দিকে কাত হয়ে চোখ বুঁজে নিয়ে বলে,
“বুঝি বুঝি।”
আরশি কি বলবে ভেবে না পেয়ে ক্ষনিকটা ব্যঙ্গ করে বলে,
“বুঝি বুঝি,,, বেশি বুঝিস তুই, ঘুমা।”
,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,
দু’দিন পর আরশির এক্সাম থাকায় পরদিন সকালে বাসায় ফিরে যায় তারা। এমনিতেও গতকাল ক্লাস মিস হয়েছে। বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে স্কুলে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছিল সে। বেলকনিতে যেতেই ছোট একটা ঢিলের মতো মোড়ানো কাগজ দেখতে পায় সে। হাতে নিয়ে খুলে দেখে ছোট একটা লেখা,,
প্রিয়ন্তি,,,,
‘আমার অনুভবে সৃষ্টি হওয়া সেই সৌন্দর্যের আবছায়াটাই হয়তো তুমি। তাই তো লুকিয়ে তোমার মন রাজ্যে ঘুরে ঘুরে তোমারই অনুভূতির ডানায় চড়ে বেড়ানোর স্বপ্ন দেখি। শুনো, সেই রাজ্যে আমার রাজত্ব চিরধার্য। শুধু আমার।’
লেখাটা কয়েকবার পড়লো আরশি। কারো নাম উল্লেখ না থাকায় বাইরের দিকে দৃষ্টি রেখে নিজের মাঝে বিড়বিড় করে বলে,
“কে আপনি?”
To be continue………….