#শেষটা_সুন্দর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৫০।
রিতা নিজেকে কিছুটা ধাতস্ত করে বলে,
‘খালা বলেছেন।’
সাদরাজ আরেক দফা অবাক হয়। চোয়াল শক্ত হয়ে উঠে তার। সে চেঁচিয়ে ডেকে উঠে,
‘খালা, খালা, এখানে আসো।’
খালা সাদরাজের চিৎকার শুনে ভয়ে তার সামনে এসে দাঁড়ায়। কাঁপাকাঁপা স্বরে জিজ্ঞেস করে,
‘কী হইছে, সাহেব?’
সাদরাজ উনার দিকে চেয়ে কর্কশ গলায় জিজ্ঞেস করে,
‘তুমি রিতাকে কী বলেছো?’
খালা এবার আরো ভয় পান। ভীত চোখে রিতার দিকে তাকান। রিতা উঠে দাঁড়ায়। নরম গলায় বলে,
‘খালা, ভয় পাবেন না। আপনি আমাকে যা যা বলেছেন, সাদরাজকে তা সব বলুন। উনাকে সব সত্যি জানাতে হবে। উনার মনের ভুল ধারণাকে পাল্টাতে হবে। বলুন, খালা।’
খালার ঠোঁট কাঁপছে। তিনি ক্রমাগত ঢোক গিলছেন। কী বলবেন বুঝতে পারছেন না। সাদরাজ দাঁতে দাঁত চেপে উনাকে আবারও একই প্রশ্ন করে। খালা ভয় পাচ্ছেন খুব। তিনি কম্পিত সুরে বলেন,
‘আমি কাউরে কিছু কই নাই। আমি কিছু জানি না।’
রিতা অবাক হয়ে খালার এক হাত জড়িয়ে ধরে। উনাকে অনুরোধ করে বলে,
‘খালা, প্লিজ ভয় পাবেন না। সত্যিটা বলুন। প্লিজ, খালা।’
খালা তার হাত ছাড়িয়ে বলল,
‘কইলাম তো, আমি কিছু জানি না। আমারে মাফ করবেন। আমি কাজে যাই।’
এই বলে তিনি দ্রুত সেখান থেকে চলে যান। রিতা বিস্মিত হয়ে খালার যাওয়া দেখে। সাদরাজ তখন ক্ষিপ্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
‘কেন মিথ্যে বললে?’
রিতা সাদরাজের দিকে তাকায়। মিইয়ে যাওয়া সুরে বলে,
‘আমি কোনো মিথ্যে বলিনি। সত্যিই এসব কিছু আমাকে খালা বলেছেন। আর খালা এখন আপনার সামনে ভয় পাচ্ছেন। আপনার মা’কে রাবীর ভাইয়া মারেননি। উনাকে মেরেছেন…’
‘শাট আপ। আর একটাও বাজে কথা বলবে না। দিনকে দিন তোমার সাহস বেড়েই চলছে। এইসব ব্যাপারে কথা বলার সাহস হয় কী করে তোমার? তুমি কি ভেবেছ, আমি কিছু বলিনা বলে তুমি যা খুশি তাই করবে আর আমি সবকিছু মেনে নিব? তোমাকে এবার এর শাস্তি পেতে হবে। চলো..’
সাদরাজ এই বলে রিতার হাত ধরে টেনে তাকে উপরে নিয়ে যায়। রিতা বুঝতে পারছে না, তার সাথে কী হতে চলেছে। সে সাদরাজকে বারবার অনুরোধ করে বলছে, একবার তাকে বিশ্বাস করার জন্য। কিন্তু, সাদরাজ এখন আর হুঁশে নেই। মাথা রাগে ফেটে যাচ্ছে তার। সে রিতাকে সেই স্টোর রুমটার ভেতরে নিয়ে গিয়ে রাগি গলায় বলে,
‘তুমি আজ থেকে এখানেই থাকবে। আর আমি না চাওয়া অবধি এই রুম থেকে তোমাকে কেউ বের করতে পারবে না।’
এই বলেই সাদরাজ বাইরে এসে দরজা লক করে দেয়। রিতা ভেতর থেকে চেঁচাতে থাকে। কিন্তু, তার কান্না ভেজা স্বর সাদরাজের কান অবধি আর পৌঁছায় না। সাদরাজ তার রুমে চলে যায়।
এখনো রাগ কমছে না তার। রিতা তাকে কেন এসব বলল? ও কেন এসব নিয়ে কথা বলবে? তার এসব নিয়ে কথা বলার কোনো অধিকার নেই। সাদরাজ রাগে ফোঁস ফোঁস করতে করতে রাবীরকে কল দেয়। রাবীর কল রিসিভ করে। সে তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই বলতে থাকে,
‘তুই কি ভেবেছিস, রিতার মুখ দিয়ে এসব বলালেই আমি সব বিশ্বাস করে নিব? কখনোই না। তোকে আমি আর বিশ্বাস করি না। আর কখনো করবও না। তুই আমার মা’কে মেরেছিস। তুই আমার মায়ের খু নি। আমি তোকে এর জন্য কখনো ক্ষমা করব না। কখনো না।’
সাদরাজের যেন দম আটকে আসছে। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে তার। ওপাশে রাবীর নিরব। সাদরাজ জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলে বলে,
‘পুরো দুনিয়া তোকে বিশ্বাস করলেও আমি তোকে বিশ্বাস করব না। তুই খুব খারাপ, রাবীর। তুই আমাকে খুব কষ্ট দিয়েছিস। এর জন্য আমি তোকে শাস্তি দিব’ই। খুব কঠিন শাস্তি দিব।’
‘আমাকে শাস্তি দেওয়ার নামে যে তুই তোর নিজেকে কষ্ট দিচ্ছিস, সেটা বুঝতে পারছিস? পারছিস না। কারণ, কিছু বোঝার জন্য যে নূন্যতম বিবেকের প্রয়োজন হয়, সেই বিবেকটাই তোর নেই। তুই বিবেকহীন হয়ে পড়েছিস। নিজে কিছু ভাবতে পারিস না। মানুষ যা বলে তাই করিস। তোর মধ্যে এখন আর কোনো বোধ বুদ্ধি নেই। অন্যের বুদ্ধি ধার নিয়ে চলছিস তুই। কিন্তু, এভাবে আর কতদিন? এবার তো একটু চোখ খুল। তোর আশেপাশে ভালোভাবে দেখ। দেখবি তোর শত্রুরা কীভাবে তোকে তাদের অস্ত্র বানিয়েছে। তখন বুঝতে পারবি, আসল অন্যায়গুলো কে করছে, আমি না অন্যকেউ।’
সাদরাজ দম নেয়। বলে,
‘কেন সব স্বীকার করছিস না? আমার মা’কে তুই মারিসনি?’
রাবীর শক্ত গলায় জবাব দেয়,
‘না, মারিনি। তোর মা’কে আমি মারতে পারি না। উনি আমারও মা ছিলেন। এই একটা কথা আমি গত পাঁচ বছর যাবত তোকে বুঝিয়ে আসছি। তুই কেন বুঝতে চাইছিস না, বলতো?’
‘কী করে বুঝব? তুই তো কিছু প্রমাণ করতে পারছিস না। প্রমাণ কর, তুই খু নি না। তাহলেই আমি সব বিশ্বাস করব।’
রাবীর তখন তাচ্ছিল্যের স্বরে বলে,
‘প্রমাণ? তুই যদি আমাকে কোনোদিন বন্ধু হিসেবে একটুও বিশ্বাস করতি, তাহলে আজ আর প্রমাণ চাইতি না। তুই এত বোকা কেন? তোর বাবার সব কথা তুই বিশ্বাস করলি, অথচ আমাকে তুই কিছু বলার সুযোগই দিলি না। আজ আর এসব প্রমাণ করে কী হবে? সেই হারিয়ে যাওয়া পাঁচ বছর কি ফিরে আসবে? আমাদের বন্ধুত্ব কি ঠিক হবে? হবে না। তবুও আমি প্রমাণ করব। কারণ, আমি নিজেও এখন সব সত্যি জেনে গিয়েছি। আসল অপরাধীকে চিনেছি। এবার তার শাস্তি পাওয়ার পালা। তবে তোকে লাস্ট একটাই অনুরোধ করব, তুই আমাদের এসব ঝামেলার জন্য রিতাকে কোনো কষ্ট দিস না। ঐ মেয়েটার কোনো দোষ নেই। এসবের মাঝে ওকে টানিস না, প্লিজ।’
‘সেটা আমি পরে ভেবে নিব। আগে তুই সবকিছু প্রমাণ কর, তারপর আমার সামনে আসিস।’
‘ঠিক আছে। আমি সব প্রমাণ নিয়েই তোর সামনে দাঁড়াব।’
সাদরাজ কল কেটে ভাবতে থাকে, রাবীরের এখনো এত আত্মবিশ্বাস কোথ থেকে আসছে। এতকিছুর পরও তার মাঝে এইটুকুও দূর্বলতা নেই। তার এত এত সাহস আজ তাকে আবার ভাবাচ্ছে। সত্যিই কি রাবীর কিছু করেনি? তবে কি ঐ ভিডিও টা মিথ্যে? কিন্তু, সেটাই বা কীভাবে সম্ভব?
_________________
সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। সারাদিন সাদরাজ আর রুম থেকে বের হয়নি। ঐদিকে রিতারও কোনো খবর নেই। খালা এবার ভয়ে ভয়ে সাদরাজের রুমে আসেন। সাদরাজ বিছানায় হেলান দিয়ে চোখ বুজে আছে। খালা এসে বলেন,
‘সাহেব, কিছু খাইতেন না?’
সাদরাজ চোখ বুজা অবস্থাতেই জবাব দেয়,
‘না, যাও।’
খালা গেলেন না। আবারও সাহস করে বললেন,
‘খালাও তো কিছু খায় নাই। খালারে একটু খাবার দেই?’
সাদরাজ উঠে বসে। ধমক দিয়ে বলে,
‘আমি তোমাকে বলেছি? আগ বাড়িয়ে কিছু করতে এসো না।’
খালা ভয় পেয়ে যান। সেখান থেকে চলে যেতে নিলেই সাদরাজ উনাকে আবার ডাকে। খালা ফিরে চেয়ে ভীত সুরে জিজ্ঞেস করেন,
‘কিছু কইবেন?’
সাদরাজ জিজ্ঞেস করে,
‘তুমি কি সত্যিই রিতাকে কিছু বলোনি?’
খালা মাথা নুইয়ে ফেলেন। ভয়ে সত্যি কথাটা বলতে পারছেন না তিনি। সাদরাজ এবার নরম গলায় বলে,
‘ভয় পেও না, খালা। কিছু জেনে থাকলে, বলো।’
খালা মৃদু সুরে বলেন,
‘হ, আমিই খালারে সব কইছি।’
সাদরাজ কপালে ভাঁজ ফেলে জিজ্ঞেস করে,
‘কী বলেছো?’
খালা একটু সময় নিয়ে বলেন,
‘বলছি যে, আপনার মা’রে রাবীর খান খু ন করেন নাই। অন্য কেউ খু ন করছে।’
সাদরাজের কপালের ভাঁজ আরো চওড়া হয়। শক্ত গলায় জিজ্ঞেস করে,
‘কে খু ন করেছে?’
চলবে….