#স্মৃতির_শেষ_অধ্যায়ে_তুমি
#পর্ব_২৬
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu
এ যেন নিস্তব্ধতার মেলা বসে গিয়েছে। থমথমে পরিবেশ মারিশার স্বামীর এক কথায় মুহুর্তের মধ্যে পরিবেশ শীতল হয়ে উঠলো। আরাভ যেদিন হোটেল থেকে বের হয়নি বরঞ্চ মারিশা হোটেলের নিচে আরাভের জন্য অপেক্ষা করছিল। বৃষ্টির জন্য আরাভের আসতে দেরি হয়। দু’জন গুরুত্বপূর্ণ কাজে যাবে, সেজন্য নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছিল। এমন সময় কেউ ছবি তুলে বাজে ক্যাপশন লিখে সোসাল মিডিয়ায় পোস্ট করে দেয়। সবাই স্মৃতির দিকে আঙুল তুলছে। আরাভ স্পষ্ট ভাবে সবাইকে জানিয়ে দিয়েছে। স্মৃতি এর সাথে জড়িত নেই। কেউ ইচ্ছে করে স্মৃতিকে ফাঁসিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। আরাভ সবাইকে যথাযথ প্রমাণ দেখালো প্রমান দেখে সবার কণ্ঠস্বর নিচু হয়ে গেল। পরিবেশ শীতল হয়ে উঠলো। আরাভ চাকরি ছেড়ে দিবে কথা টা কর্ণকুহরে আসতেই গুঞ্জন শুরু হয়ে গেল। ছেলেরা আরাভের কাছে এসে বলল,
–স্যার প্লিজ আপনি চলে যাবেন না। আমাদের ভুল হয়েছে সত্যি মিথ্যা যাচাই না করে, আমরা আপনাকে কটু কথা শুনিয়েছি। আপনি চলে গেলে আমাদের কি হবে? আপনি আমাদের অনুপ্রেরণা আপনাকে অনুসরণ করে, আমরা নিজেদের লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। শিক্ষক হচ্ছে পিতার মতো পিতা যেমন বটগাছের ছায়া হয়ে, আমাদের মাথায় ওপরে দাঁড়িয়ে থাকে, ঠিক তেমনই পিতার পরে শিক্ষক আমাদের মাথার ওপরে বটগাছের ছায়া দেয়। এখন যদি সেই বটগাছের ছায়া মাথার ওপরে থেকে সরে যায়। তাহলে আমাদের পরিনতি কি হবে? আমরা তো মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে যাব। আমরা ছোট মানুষ স্যার আমরা ভুল করেছি। দয়া করে আমাদের মাফ করে দিন। আপনি আমাদের গুরু আমরা আপনার শিষ্য। গুরু না থাকলে শিষ্যদের কি অবস্থা হবে, আপনি বুঝতে পারছেন স্যার? ছেলেটির কথার প্রতি উত্তরে আরাভ গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
–যে শহর আমাকে অসন্মানিত করেছে, আমার নামে মিথ্যা অপবাদ দিয়েছে, আমার রজনীর নিদ্রা হারাম করে দিয়েছে, আমার অস্থিরতার কারণ হয়েছে, আমি সেই শহরে থাকতে চাই না। আগামী সাত দিনের মধ্যে আমি শহর ছেড়ে চলে যাব। কথা গুলো বলেই আরাভ বিলম্ব করল না। দ্রুত পায়ে মঞ্চ ত্যাগ করে কলেজ থেকে বেড়িয়ে আসলো।
বিষন্ন মন নিয়ে স্মৃতি কলেজে প্রবেশ করল। তিক্ততা সম্পূর্ণ রুমে গ্রাস করে ফেলছে স্মৃতিকে। স্মৃতি নির্জন গাছের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। উত্তপ্ত রোদ্র এসে স্মৃতির মুখশ্রীতে আঁচড়ে পড়ছে। মৃদু বাসাতে স্মৃতির সামনের কেশগুলো উড়ছে। মুখশ্রী বেয়ে ঘাম গড়িয়ে পড়ছে। তখনই স্মৃতির বন্ধু মহল স্মৃতির দিকে এগিয়ে আসলো। স্মৃতিকে বিষন্ন দেখে মেঘ বলে উঠলো,
–তোর কি জামাই ম’র’ছে? তুই এভাবে ছন্নছাড়া হয়ে আসছি কেনো? আজকে কলেজে আসতে এত দেরি করলি কেনো? তোকে কতবার ফোন দিয়েছি! আরাভ স্যারকে নিয়ে তুই যে পোস্ট দিয়েছিস৷ ওটা মিথ্যা আরাভ স্যার সবার সামনে সেটা প্রমাণ করে দিয়েছে। মেঘের কথায় স্মৃতির মুখশ্রীতে তাচ্ছিল্য ফুটে উঠলো। ভেতরে অজানা হাহাকারে ভরে উঠলো। মানুষটার নাম কর্ণকুহরে বাজতেই ঘৃণায় মস্তিষ্ক রি রি করে উঠছে। স্মৃতিকে আবার অন্যমনষ্ক হতে দেখে তোহা বলে উঠলো,
–আজকাল তোকে একটু বেশিই ছন্নছাড়া দেখায়। তোর কি হয়েছে স্মৃতি আমাদের সাথে শেয়ার কর, দেখনি মনটা অনেক হালকা হয়ে গিয়েছে। তোর মুখশ্রীতে হাসি মানায় বিষন্নতা নয়। তোর ভেতরে কিসের এত দুঃখ যেটা আমাদের বলতে পারছিস না। একটা বার আমাদের বলেই দেখ, আমরা সবাই মিলে তোকে ভালো রাখার চেষ্টা করব। স্মৃতি অন্য দিকে আঁখি জোড়া স্থির রেখে মলিন কণ্ঠে বলল,
–যারা আমাকে প্রয়োজনে প্রিয়জন বানায় তাদের কাছে আর কি বলবো। আজকে তাদের কাছে নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করব। কালকে সুযোগ বুঝে ঠিক তারা দুর্বল জায়গায় আঘাত করবে। খামাখা কি দরকার একটু শান্তির আশায় নিজের দুঃখ গুলোকে প্রকাশ করার। একটু দুঃখ প্রকাশ করতে গিয়ে আমি আরো দিগুণ দুঃখ টেনে নিয়ে আসতে পারবো না। মনের কথা গুলো মনের গহীনে জমা থাক। কোনো এক স্মৃতির শেষ বেলায় এসে, কারো কাঁধে মাথা রেখে কষ্ট গুলো উড়িয়ে দিব। কথা গুলো বলে স্মৃতি থামলো। সবাই অবাক নয়নে স্মৃতির দিকে তাকিয়ে আছে। স্মৃতি তো এমন ছিল না। তাহলে হঠাৎ করে মেয়েটার কি এমন হলো যে, মেয়েটা বদলে যেতে বাধ্য হলো। কিছু দুঃখ একান্তই আমাদের ব্যক্তিগত যা কাউকে বলা যায় না। ভেতরে ভেতরে দুমড়ে মুচড়ে শেষ হয়ে যেতে হয়। সহ্য করতে না পারলে ও সহ্য করে নিতে হয়। কিছু দুঃখের কথা ভাবলেই আমাদের দম বন্ধ হয়ে আসে, শ্বাস নিতে ভিষণ কষ্ট হয়। মনে হয় এমনটা তো হবার কথা ছিল না। তবে এমনটা কেনো আমার সাথে হলো। কথা গুলো স্মরণে আসতেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসলো স্মৃতির। স্মৃতির ভাবনার মাঝেই মেঘলা বলে উঠলো,
–স্মৃতি জানিস আমরা এবার কলেজে শান্তি মতো থাকতে পারবো। আমাদের অশান্তির কারণ চলে যাচ্ছে। যদি ও একটু মন খারাপ হচ্ছে, তিনি ছাড়া আমাদের কলেজে পদার্থ বিজ্ঞানের ভালো কোনো শিক্ষক নেই। তারপরে ও শান্তি লাগছে এটা ভেবে যে আমাদের কলেজ থেকে একটা আজাব চলে যাবে। মানুষের মানসিক চাপ দেওয়ার একটা সীমা থাকে, আরাভ স্যার সেই সীমা অতিক্রম করে ফেলছে। মেঘলার কথা শুনে স্মৃতি বিস্ময় নয়নে মেঘলার দিকে দৃষ্টিপাত করল। আঁখি জোড়া স্থির পানির ন্যায় থমকে আছে। গভীর ভাবে মেঘলাকে পর্যবেক্ষণ করছে। স্মৃতিকে এভাবে শান্ত হয়ে যেতে দেখে পরিবেশ শীতল হয়ে উঠলো। কথায় কথায় রেগে যাওয়া মেয়েটা হঠাৎ করে এতটা শান্ত হয়ে গেল কিভাবে সেটাই কারো মস্তিষ্কে বিচরণ করছে না। রোহান মেঘলাকে কপট রাগ দেখিয়ে বলল,
–তুই যে এভাবে বলছিস আরাভ স্যার কি আমাদের খারাপের জন্য আমাদের ওপরে মানসিক অত্যাচার করেছে! তিনি সব সময় আমাদের ভালো চেয়েছে। সবথেকে ভালো শিক্ষাটা উনি আমাদের মধ্যে চালনা করছে চেয়েছেন। আরাভ স্যার যদি কলেজ থেকে চলে যায়। কলেজের অবস্থা কি হবে বুঝতে পারছিস? আবেগে গা ভাসিয়ে দিস না মেঘলা বিবেক দিয়ে ভেবে দেখ, তাহলে বুঝতে পারবি। আমাদের কলেজ থেকে একটা মহামূল্যবান রত্ন হারিয়ে যাচ্ছে। এভাবে হারিয়ে যেতে দিস না। রোহানের কথা কেঁড়ে নিয়ে মারিয়া কটাক্ষ করে বলল,
–তোর জ্ঞানের বাণী তোর কাছেই রাখ, ফ্রিতে পেলে বাঙালি কোনোদিনই ছাড়বে না। তোর হয়েছে সেই হাল ফ্রিতে জ্ঞান দিতে শুরু করছিস। পৃথিবীতে কি স্যারের অভাব আছে নাকি আরাভ স্যার ছাড়া আর কোনো স্যার নেই? তোদের শরীর জ্ব’লা’নো কথা শুনলে মে’জা’জ এমনিতেই খারাপ হয়ে যায়। তোরা এখানে বসে শোক পালন করবি নাকি ক্লাস রুমে যাবি। আমার আজকে ভালো লাগছে না। আমি আকাশের সাথে ঘুরতে যাব। তোরা এখানে বসে বসে আঁখি জোড়া থেকে অশ্রু ঝরা যেন আরাভ স্যার তোদের রেখে না যায়। কথা গুলো বলেই মারিয়া হাসতে হাসতে চলে গেল।
স্মৃতি গিয়ে গাছের নিচে বসলো আজকে ক্লাস করতে ইচ্ছে করছে না। মনটা বিষন্নতায় ছেয়ে গিয়েছে। মস্তিষ্কে একদল বিষাদ এসে হানা দিয়েছে। তিক্ততা সম্পূর্ণ রুপে পুরো মনকে ঘিরে ধরেছে। এসব আর নিতে পারছে না স্মৃতি। মেঘলা স্মৃতির পাশে বসে বলল,
–আজকে ক্লাস করবি না স্মৃতি? স্মৃতি শান্ত কণ্ঠে জবাব দেয়,
–আজকে আমার ভালো লাগছে না। শরীরটা ভিষণ খারাপ লাগছে। আজকে আমি বাসায় চলে যাই। তোরা সবাই মিলে ক্লাসে যা আমার জন্য নিজেদের পড়াশোনার ক্ষতি করিস না। কথা গুলো বলেই স্মৃতি উঠে চলে গেল। শান্তি জিনিসটা তার জীবনে থেকে উঠে গিয়েছে। কোথাও গিয়ে সে শান্তি পায় না। স্মৃতির যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে সবাই দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।
চলবে…..