#হিমাংশুর_জলপদ্ম [২]
#সাদিয়া_আক্তার_জ্যোতি
হিমাংশুর প্রশ্নের উত্তর দিলো না কুমুদ।শুধু বিড়বিড় করে আওড়াতে থাকলো,
– দিদি সাঁতার জানে না।দিদিকে বাঁচাও।
কুমুদের দিকে তাকিয়ে হিমাংশু একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললো।আশেপাশে তাকিয়ে নিকষ কালো অন্ধকারে স্পষ্টভাবে কিছু দেখতে না পেয়ে আবারও কুমুদের দিকে দৃষ্টিপাত করলো।ঘন কালো আঁধারে ভুতুড়ে নিস্তব্ধতায় ঝিঝি পোকার ডাক আর কুমুদের বিড়বিড়ানি সব মিলিয়ে গা শিরশির পরিবেশ।হিমাংশুর গায়ের লোমকূপগুলো আলগা হয়ে গেল। সে ধীর কন্ঠে বললো,
– চুপ করো মেয়ে।শান্ত হও।
হিমাংশুর ধীর কন্ঠে বলা কথাটা কুমুদের মস্তিষ্ক শীতল করে দিল।সে বিস্ফোরিত চোখে তাকালো হিমাংশুর দিকে।তবে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটাকে দেখতে সক্ষম হলো না।দেখবে কেমন করে আজ যে আকাশে চাঁদেরও দেখা নেই।একদম ঘুটঘুটে অন্ধকার বিরাজ করছে সারা জগৎময়।আশেপাশে তাকিয়ে নিজের অবস্থান সম্পর্কে জ্ঞাত হতে না পেরে অস্ফুট স্বরে উচ্চারণ করলো,
– এটা কোথায়?
হিমাংশু নিজের দাঁড়িয়ে থাকা জায়গায় পা ছড়িয়ে বসে পড়লো।হতাশ কন্ঠে বললো,
– সেটা তো আমিও জানি না।কিছু দেখাও যাচ্ছে না ঠিকভাবে।একটু অপেক্ষা করি আলো ফুটলেই বুঝতে পারবো কোথায় আছি।
কুমুদও একটু দুরত্ব রেখে মাটিতে বসে পড়লো। এখন আবহাওয়াটা এমন যে দিনের বেলা দাবদাহে গায়ের মাংস পুড়ে কাবাব এবং রাতে শীতল হাওয়া। ঘাসে জমা শিশির পানিগুলো অদ্ভুত এক নরম অনুভূতি দিচ্ছে। হিমাংশু কুমুদের উদ্দেশ্যে উৎসাহী কন্ঠে বললো,
– উনি তোমার দিদি ছিলেন?
কুমুদ উপর নিচ মাথা নাড়ালো তবে অন্ধকারে তা দেখা গেল না।তাই হিমাংশু আবারও জিজ্ঞেস করলো,
– উনি তোমার আপন দিদি ছিলেন?
কুমুদ এবার কন্ঠ নালি থেকে স্বল্প আওয়াজে উত্তর দিলো,
– জ্বী।
– ওরা সবাই তোমাকে রাক্ষসী বলছিল।
– ভয় পাচ্ছেন নাকি?
হিমাংশু হাসি দিলো এ যেন এক বিরাট মজার কথা বলে ফেলেছে কুমুদ।হিমাংশু বিগলিত হেসে কুমুদের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে বললো,
– হিমাংশু ভয় পেলে তুমি এতক্ষণে স্বর্গে থাকতে।
নিশ্চুপ রইলো কুমুদ। হিমাংশুর মনে এখন হাজারো প্রশ্ন ঘোরাফেরা করছে।তবে কুমুদের এমন অসুস্থ অবস্থায় প্রশ্নগুলো করা ঠিক হবে কিনা তা তাকে বারবার ভাবাচ্ছে। হিমাংশু প্রশ্নগুলো নিজের মধ্যে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছে তবু যেন প্রশ্নগুলো ঠেলে বের হতে চায়ছে।কুমুদ একদৃষ্টিতে নিচে মাটির দিকে চেয়ে আছে।সব প্রশ্ন একপাশে রেখে হিমাংশু কুমুদকে আবারও তার নাম জিজ্ঞেস করলো,
– নাম বললে না এখনও।তাহলে কি আমিও ওদের মতো তোমাকে রাক্ষসী আর কাল নাগিনী বলে ডাকবো?
– কুমুদ।
– পদবি?
– তখন শোনেন নি আমি জাত পরিচয়হীন আমার কোনো পদবি নেই।শুধুই কুমুদ।
হিমাংশু একটু বিব্রত হলো। হঠাৎই তার মাথায় এলো সে কুমুদকে নিয়ে কোথায় যাবে?বাড়িতে গেলে তার বাবা মা কেউ মেনে নিবে না।একে তো কোনো পরিচয় নেই তারউপর বিধবা।একা রাস্তায় রেখে গেলও তো সেই জ্বলন্ত চিতায় নিক্ষেপের সমকক্ষ হবে।তাহলে কি করবে সে?কুমুদের শাশুড়িও কি এখানে থেমে থাকবে?নাকি কুমুদকে খুঁজে বের করে আবারও চিতায় ওঠাতে উদ্ধত হবে?হাজারো চিন্তায় মস্তিষ্ক বিকল হয়ে যাওয়ার উপক্রম হিমাংশুর। এতো শত চিন্তার মাঝে হঠাৎ কুমুদ বলে উঠলো,
– আমাকে দিয়ে আপনার জুতো পরিষ্কার করাবেন?
চমকে উঠলো হিমাংশু।বড় বড় চোখে কুমুদের দিকে মুখ বাঁকালো অতঃপর অবিশ্বাস্য কন্ঠে বললো,
– কিহ্?
– ঐ যে আমার কোনো পদবি নেই তাই আমাকে দিয়ে জুতো পরিষ্কার করাবেন কি?
– শিক্ষিত মানুষরা এসব মানে না।
– আপনি বুঝি খুব শিক্ষিত?
– খুব শিক্ষিত কিনা জানি না তবে এখন সবে স্নাতকে ঢুকেছি।
– গাঁয়ের মাস্টার মশাইয়ের বাড়ির বারান্দায় থাকতাম আমি আর দিদি তখন একটু আধটু পড়ালেখা শিখেছি বটে তবে এতো কঠিন শব্দ বুঝি না।
হিমাংশু কিছুক্ষণ চুপ থেকে হঠাৎ কুমুদকে জিজ্ঞেস করলো,
– তোমার স্বামী কিভাবে মারা গেল?
সারা শরীর কেঁপে উঠলো কুমুদের।ঘুটঘুটে অন্ধকার আর পিনপতন নীরবতার মাঝে এই প্রশ্নটি যেন কুমুদের কাছে জ্বলন্ত চিতার সমান লাগছে।শুঁকনো ঢোক গিলে স্বাভাবিক কন্ঠে উত্তর দিলো,
– তার বিষয়ে আমি কিছুই জানি না।
হিমাংশুর এবার নিজের মাথায় বারি দিতে মনে চায়ছে। এতো চেষ্টা করলো নিজেকে দমাবার তবু প্রশ্নটা ঠেলে বেরিয়ে এলো।এবার আর কোনো কথায় বলবে না সে।হিমাংশু চুপচাপ নিজের পাঞ্জাবি থেকে ছোট্ট একটা খাতা বের করলো। খাতাটা এতই ছোট যেন হিমাংশুর একহাতের মুঠোয় আবদ্ধ করা সম্ভব।আবারও পকেটে হাত ঢুকিয়ে হিমাংশু এবার একটি কলম বের করলো।তারপর টপাটপ খাতায় কলম চালিয়ে কিছু একটা লিখলো সে।কুমুদ তার দিকে তাকিয়ে আছে অনুভূতিশূণ্য চাহনিতে।হিমাংশু লিখতে লিখতে আচমকা মাথা তুলে কুমুদের দিকে তাকাতেই কুমুদ কেঁপে নিজের জায়গা থেকে দুকদম সরে বসলো।বুকে হাত দিয়ে জরে জরে শ্বাস নিল।হিমাংশু কুমুদকে এমন ভয় পেতে দেখে নিজেও ভয় পেল।কুমুদকে আশ্বাস্ত দিতে বললো,
– আরে ভয় পেলে নাকি?
কুমুদ কোনো উত্তর দিলো না। নিজের বুকে তিনবার ফুঁ দিয়ে বড় এক শ্বাস ছাড়লো।হিমাংশু আবারও বললো,
– শোনো ওরা যদি তোমাকে খুঁজে বের করে ফেলে তখন কি করবে?
– ওরা গ্রামের বাইরে আসে না আর আমার মতে এখন আমরা গ্রামের থেকে অনেক দূরে আছি।
স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো হিমাংশু।আর কোনো শব্দ ব্যয় না করে নিজের খাতায় আবারও কিছু লিখতে শুরু করলো সে।
————
– কি কইলি?ওগো খুঁইজা পাসনি?ওগো কি পাংখা আছে যে উইড়া আরেক দেশে চইলা গেছে?
কোমরে হাত দিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে কথাটা বললো লতা।হরি তার সামনে কাঁচুমাচু মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে।পাশে তার একমাত্র জা অপরাধী মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে।লতা হরির থেকে দৃষ্টি সরিয়ে তার জায়ের দিকে রক্ত চক্ষু নিয়ে তাকালো।লতার জায়ের বুকটা ধকধক করে কাঁপতে শুরু করলো।লতা দাঁত কিড়মিড় করে তার জায়ের চুলের মুঠি ধরে টেনে বললেন,
– তুই তো দেখি ঘরের শত্তুর বিবিশন।তরে আইজকা খাইছি।তর জন্যে এতোকিছু হয়ছে।
লতার জা একহাতে লতাকে ছাড়াতে ছাড়াতে এবং অন্য হাতে মাথায় হাত দিয়ে ব্যাথায় আর্তনাদ করতে করতে বললেন,
– ও দিদি ছেড়ে দাও গো দিদি।আমি কি এতো কিছু বুঝছি কও?আমি তো ভাবিছি ঐ ছেলে লেজ গুটিয়ে পালাবে। কিন্তু ও তো নায়কের মতো নাগিনীটাকে নিয়ে পালালো।
– অহন যদি ঐ ছোকরা ইংজিরি পুলিশ লইয়া আসে তখন কি করমু আমরা?আমাগো বাকি জীবনডা ঐ ইংজিরি জেলে বইসা জেলের ভাত খাওন লাগবো।
বলেই ঝটকা দিয়ে চুলের মুঠিটা চেড়ে দিলেন লতা পাল।অতঃপর হরির দিকে তাকিয়ে বললেন,
– আমার কাশি যাওনের ব্যবস্থা কর হরি।আমি এই শেষ বয়সে ইংজিরি জেলের ভাত খাইতে চাই নে।
– ও দিদি…তাইলে আমাগো কি হবে গো দিদি?
ন্যাকা কান্না করে কথাটা বললেন লতার জা।লতা মুখ ভেঙচি দিয়ে বললেন,
– চুলোই যা তোরা।
বলেই নিজের আধপাকা ঘরটাতে চলে গেলেন নিজের সকল প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গোছাতে।
———
– শোন কুমুদ তোকে যদি কেউ কিছু জিজ্ঞেস করে তবে তুই বলবি তুই কিছু জানিস না।ভুলেও যেন মুখ খুলবি না বোন। তাহলে কিন্তু তোকে কেউ বাঁচতে দিবে না।
কামিনী হন্তদন্ত হয়ে কথাটা বলতে বলতে নিজের হাত থেকে একজোড়া সোনার বালা খুলে কুমুদের হাতে পরিয়ে দিলো।কুমুদ অঝরে কেঁদে যাচ্ছে। কামিনী নিজের বোনের কপালে চুম্বন করে মুখে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,
– পালা বোন।বাঁচতে চায়লে পালা।
কান্নারত কুমুদ কাঁপা কাঁপা কন্ঠে শুধু একটা কথায় বলতে পারলো,
– দিদি তোমাকে এখানে একা রেখে আমি যাবো না।
কথাটা শেষ না করতেই কেউ তার চুলের মুঠি ধরে টানতে টানতে ঘুটঘুটে অন্ধকারে নিয়ে যেতে লাগলো।ধপ করে চোখ খুলে ফেললো কুমুদ।শেষ রাতের দিকে চোখটা লেগে এসেছিল কুমুদের।তাই বিনাদ্বিধায় গা এলিয়ে দিয়েছিল শিশির ভেজা নরম ঘাসে।ঘামে জবজবে শরীরটা মাটিতে ঘাসের উপর মেলানো।চোখের সামনে সাদা আকাশ।একদলা মেঘ ভেসে একপাশ থেকে অন্য পাশে যাচ্ছে।শ্বাস নিতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে কুমুদকে। উঠে বসলো কুমুদ।জটা পাকানো ঘন কালো চুলগুলো হাত খোঁপা করে নিল। সামনে দৃষ্টিপাত করতেই চোখে পড়লো তার সামনে কিছুটা দূরে হিমাংশু দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে ডান হাতের তর্জনি তুলে কিছু একটা বলছে।আবছা আবছা কানে এলো কুমুদের,
– এদিক দিয়ে সূর্য উটেছে তার মানে এটা পূর্ব তার বিপরীতে এটা পশ্চিম। ডান দিকে উত্তর এবং বাম দিকে দক্ষিণ। তাহলে এখন আমাদের উত্তর দিকে যাওয়া উচিত। দেখি প্রধান সড়ক পাওয়া যায় কিনা।
বিচার বিশ্লেষণ শেষে হিমাংশু কুমুদের দিকে ফিরলো।কুমুদ তার দিকে ভ্রু কুটি করে তাকিয়ে আছে।হিমাংশু কুমুদকে উপলক্ষ করে একটি মিষ্টি হাসি দিলো।উৎফুল্ল কন্ঠে বললো,
– উঠে পড়েছো? চলো তাহলে এবার হাঁটা শুরু করি।আমাদের উত্তর দিকে যেতে হবে।
কুমুদ উঠে দাঁড়ালো। হিমাংশু আগে আগে হাঁটছে কুমুদ তার পিছন পিছন যাচ্ছে। হিমাংশু পিছন ফিরে কুমুদের দিকে তাকিয়ে বললো,
– কি যেন নাম?ও হ্যাঁ কুমুদ।কু…মুদ।অর্থ জানো?
– মাস্টার মশাইয় বলেছিল একদিন।কুমুদ অর্থ নাকি পদ্ম।
– তোমার কথাবার্তায় বোঝা যায় অল্পকিছু হলেও জানো।
– আচ্ছা তোমার বোন নদীতে ঝাপ দিলো কেন?
কথাটা বলে জিজ্ঞেসু দৃষ্টিতে কুমুদের দিকে তাকালো কুমুদ।কুমুদ সাদা শাড়ির আঁচল খামচে বড় একটা শ্বাস নিয়ে আঁটকে রাখলো নিজের ভিতর।কঠিন স্বরে বললো,
– আমি জানি না।আমাকে কোনো প্রশ্ন করবেন না।
চলবে…
(সহজ শব্দে সাবলীল ভাষায় গল্পটি লিখতে চাইছি।যারা কঠিন শব্দের গল্প পছন্দ করেন তারা গল্পটা এড়িয়ে যেতে পারেন।ধন্যবাদ।)