#শেষটা_সুন্দর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৫২।
সাদরাজকে অনেক বুঝিয়ে, রিতা রাবীর আর মেহুলকে কল দিয়ে সেখানে আসতে বলে। সাদরাজ তখনো বিষন্ন হয়ে বসে আছে কেবল। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। মনের অস্থিরতা তার এইটুকুও কমেনি। রিতা তাকে কিছুক্ষণ বুঝিয়েছে। কিন্তু, সাদরাজের ভঙ্গিমাতে রিতা কিছুই আন্দাজ করতে পারছে না। ভাবছে, আদৌ সাদরাজ তার কথা বিশ্বাস করছে তো?
তখন রাত নয়টা বাজে। বাইরে আজ দমকা হাওয়া বইছে। প্রকৃতি হঠাৎ কেন যেন খুব অস্থির হয়ে উঠেছে। এই ঝড়ো বাতাস বয়েই রাবীর মেহুলকে নিয়ে সাদরাজের বাড়িতে এল।
রিতা দুজনকে গেইটের সামনে থেকে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। সাদরাজ তার রুমে। রিতা তাদের সেই রুমেই নিয়ে যায়। রুমে গিয়ে সাদরাজকে দেখে চমকে যায় রাবীর। সেদিনের মতো আজও সাদরাজকে এলোমেলো লাগছে। যেন মনে মনে তীব্র যন্ত্রণায় ফেটে যাচ্ছে সে। রাবীর তার দিকে এগিয়ে যায়। হতাশ চোখে চেয়ে থাকে কিছুক্ষণ। সাদরাজ চোখে তুলে। আকুতি ভরা কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
‘তুই মা’কে মারিসনি?’
রাবীর কী বলবে? সাদরাজের চোখ মুখ দেখে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তার। সে কী করে বলবে, তার জন্মদাতা বাবা তার সাথে এত অন্যায় করে আসছে। কীভাবে এই ছেলেটাকে এত কষ্ট পেতে দেখবে সে?
সাদরাজ উত্তরের আশায় চেয়ে আছে। রাবীর জিভ দিয়ে শুকনো ঠোঁট ভিজিয়ে বলে,
‘না।’
‘আমার বাবা আমার মা’কে মেরেছেন?’
রাবীর মাথা নাড়ায়। সাদরাজ জোরে জোরে নিশ্বাস নেয়। বুঝতে পারে, বুকের ব্যথাটা ক্রমে ক্রমে তীব্র হচ্ছে। সে কী বলবে। রিতা ভিডিও টা যখন আবার রিভার্স করে দেখাল, তখনই সে বুঝতে পারল ব্যাপারটা। তাও, মনকে বোঝাতে পারছে না। সে কীভাবে তার বাবার বিরুদ্ধে যাবে? বাবা ছাড়া আছে কে তার?
সাদরাজের চোখ জোড়া ভেজা। সে নতমস্তকে বসে আছে। কোনো কথা বলছে না। বাইরে খুব ঝড় হচ্ছে। খালা এসে সব জানলা দরজা বন্ধ করে দিয়ে গেলেন। মেহুল রিতার কাছে এসে জিজ্ঞেস করে,
‘খালা কি পুলিশকে এসব বলবেন?’
রিতা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ায়। বলে,
‘অবশ্যই বলবেন।’
তারপর সে রাবীরের দিকে চেয়ে ফিচেল স্বরে বলে,
‘ভাইয়া, পুলিশ ডাকবেন? এবার তো সব সত্যি সামনে আনার দরকার।’
রাবীর সাদরাজের দিকে ঘুরে তাকায়। জিজ্ঞেস করে,
‘তোর কী মত, সাদরাজ?’
সাদরাজ অনেকক্ষণ নিশ্চুপ থেকে জবাব দেয়,
‘আমার মায়ের খু নি’কে তো শাস্তি পেতেই হবে। নয়তো আমার মাও কষ্ট পাবেন।’
‘তাহলে কি পুলিশকে জানাব?’
রাবীর প্রশ্ন তুলল। সাদরাজ তার দিকে চাইল। তার চোখে মুখে ভীষণ অসহায়ত্ব। রাবীর বুঝতে পারছে। একবার মা’কে হারানোর কষ্ট, এখন আবার বাবা। ছেলেটা ভেতরে ভেতরে শেষ হয়ে যাচ্ছে। সাদরাজ রাবীরের দিকে নিষ্পলক কিছুক্ষণ চেয়ে রইল। মৌনতা ভেঙে বলল,
‘আমি একবার ঐ লোকটার সাথে কথা বলতে চাই। জানতে চাই, উনি কেন এসব করেছেন। এসব করে উনি কী পেয়েছেন? উনাকে আজ আমার এই প্রশ্নের উত্তর দিতেই হবে।’
সাদরাজ উঠে দাঁড়ায়। দু কদম এগুতেই রাবীর তার হাত ধরে। জিজ্ঞেস করে,
‘কোথায় যাচ্ছিস?’
‘শাহাদাত আহমেদের কাছে।’
শক্ত গলায় সাদরাজের জবাব। রাবীর বলে,
‘একা যাস না। আমিও যাব।’
‘না। আমি একা ঐ লোকের সাথে কথা বলব। তোদের কাউকে যেতে হবে না।’
সে আবার এগুতেই রিতা এসে সামনে দাঁড়ায়। বিমূঢ় সুরে বলে,
‘যে মানুষটা নিজের স্বার্থের জন্য নিজের অসুস্থ স্ত্রীকে মারতেও দুবার ভাবে না, সে যে তার ছেলেরও কোনো ক্ষতি করবে না তার কী নিশ্চয়তা আছে? একা যাবেন না, প্লিজ। রাবীর ভাইয়া যাক আপনার সাথে।’
সাদরাজ চোখ মুখ খিঁচে বলে,
‘বললাম তো, আমি এই ব্যাপারে একা উনার সাথে কথা বলব। এই মুহূর্তে আমার কাউকে প্রয়োজন নেই।’
এই বলেই সে হনহন করে বেরিয়ে গেল। রিতা চিন্তিত কন্ঠে রাবীরকে বলল,
‘ভাইয়া, ঐ লোকটা যদি সাদরাজের কোনো ক্ষতি করে দেয়।’
‘না, সাদরাজ এতটাও দূর্বল না। ওকে আমি চিনি। প্রয়োজন পড়লে ও হিংস্র হয়ে উঠে। ওকে নিয়ে তুমি ভয় পেও না। ও সব সামলে নিতে পারবে। আমাদের বরং এখন এই ভিডিও আর খালাকে নিয়ে থানায় যেতে হবে। ঐ শাহাদাত আহমেদকে আর ছেড়ে দিলে চলবে না। এবার একে শাস্তি পেতেই হবে।’
_________
রাস্তায় যেতে যেতে প্রচুর বৃষ্টি নামল। সেই বৃষ্টি উপেক্ষা করেই থানায় গিয়ে পৌঁছাল সবাই। এত রাতে রাবীরকে দেখে অফিসার ইনচার্জ বেশ অবাক হোন। রাবীরকে সাদরে গ্রহন করে জিজ্ঞেস করেন, কোনো সমস্যা কিনা। রাবীর উনাকে সবকিছু খুলে বলেন। যদিও সেই সময় উনি এই থানায় ছিলেন না। তবুও এই ব্যাপারগুলো তার অজানা নয়। রাবীরের কথায় তিনি পুরোনো সেই মামলার ফাইল খুলে বসলেন। এই মামলা তখন সাদরাজের বাবা’ই দায়ের করেছিলেন। যেখানে তিনি পুরো দোষ রাবীরের উপর দিয়েছেন, এই একটা ছোট্ট ভিডিও’র ভিত্তিতে। ইনচার্জ তখন সেই ভিডিও টা আবার দেখতে চাইলেন। রাবীর তাকে ভিডিও টা ভালোভাবে দেখাল। এবং ইনচার্জকে বুঝাল, কীভাবে ভিডিওটাকে ইডিট করে, রিভার্স করে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ, ভিডিও তে মূলত রাবীর সাদরাজের মায়ের মুখে মাস্কটা লাগিয়ে দিচ্ছিল। যেটাকে রিভার্স করা হয়েছে বলে বোঝা যাচ্ছে যে, সে মাস্কটা খুলে ফেলেছে। আর ভিডিওটাকেই সত্যি করার জন্য তার আগে পিছে আর কোনো ক্লিপ রাখা হয়নি। আর সেই জন্যই ভিডিওর ইডিট’টা তখন ধরা যায়নি। তবে এই ভিডিও উপর ভিত্তি করে আদালত তাকে শাস্তি দিতে পারেনি। রাবীর মুক্তি পেলে, শাহাদাত আহমেদ তখন আরো ক্ষেপে যান। তখন তিনি তার ছেলেকেও রাবীরের বিরুদ্ধে আরো ক্ষেপিয়ে তুলেন। তাকে রাজনীতিতে আনেন। রাবীরের সবচেয়ে বড়ো শত্রু বানিয়ে তুলেন।
সব বলে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে রাবীর। পরে বলে,
‘এই যে খালা, উনিও সব সত্য জানেন। খালা, আপনি বলুন সব।’
খালা আর ভয় না পেয়ে যা জানেন, সব বললেন। সব শুনে ইনচার্জ বললেন,
‘এ তো মারাত্মক ব্যাপার। এই ছোট্ট একটা নির্বাচনে জয়ের জন্য মানুষ এতকিছু করতে পারে? নিজের ওয়াইফকে মেরে ফেলে? ভাবা যায়!’
‘জি অফিসার, এই একটা ব্যাপার আমাদেরও খুব কষ্ট দিচ্ছে। ঐ খারাপ লোকটার খুব কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।’
মেহুল কথাগুলো বলে দম নেয়। অফিসার খানিক ভেবে বলেন,
‘হ্যাঁ, তা তো অবশ্যই। আপনারা তার আগে একটা মামলা লিখে যান। আমরা কালই যাব উনাকে এরেস্ট করতে।’
‘কাল না, আজই।’
কারোর গলার শব্দে সবাই গেইটের দিকে তাকায়। দেখে সাদরাজ এসেছে, তার বাবাকে নিয়ে। তার রক্তিম চোখ। বাবার মিইয়ে যাওয়া চোখ মুখ। হুয়িল চেয়ারে ধাক্কা দিয়ে বাবাকে সামনে এনে সাদরাজ কাঁপতে কাঁপতে বলে,
‘উনাকে এক্ষুনি জেলে ঢুকান, অফিসার।’
সবাই অবাক হয়ে সাদরাজকে দেখছে। ইনচার্জ জিজ্ঞেস করেন,
‘উনি কি উনার সব অন্যায় স্বীকার করেছেন?’
সাদরাজ জোরে নিশ্বাস ছাড়ে। বাবার সামনে পা ভাঁজ করে বসে। শক্ত গলায় বলে,
‘বলো তুমি কী কী করেছো? সবার সামনে আজ তুমি সবকিছু স্বীকার করবে।’
শাহাদাত আহমেদের সমস্ত ক্ষমতা যেন নিমিষেই ফুরিয়ে গিয়েছে। তিনি যেন শক্ত পাথর খন্ড। জমে বসে আছেন। সাদরাজ তার হুয়িল চেয়ারে শক্ত করে চাপড় মারে। চেঁচিয়ে বলে,
‘শাহাদাত আহমেদ, আপনাকে কিছু বলতে বলেছি। বলুন, চুপ থাকলেও আজ আপনি বাঁচতে পারবেন না।’
শাহাদাত আহমেদ ভয়ে ভয়ে ছেলের দিকে তাকান। ছেলের ঐ চোখ জোড়া দিয়ে যেন আগুন ঝরছে। তিনি ভয়ে চোখ নামিয়ে ফেলেন। তবে কি আজ সত্যিই উনার বিনাসের পালা? এত তাড়াতাড়ি উনার সব ক্ষমতা শেষ হয়ে গেল? আজই কি জীবনের শেষ দিনে উনার?
কথাগুলো মনে মনে ভেবেই কেঁদে ফেলেন উনি। বলেন….
চলবে…..