শেষটা_সুন্দর #জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা ৫৩।

0
666

#শেষটা_সুন্দর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৫৩।

সাদরাজ আর অফিসারের তোপের মুখে পড়ে শাহাদাত আহমেদ সবকিছু স্বীকার করলেন। তিনি কীভাবে তার স্ত্রীকে মেরেছেন, কীভাবে রাবীরকে ফাঁসিয়েছেন, সবকিছু। সব শুনে সাদরাজ উঠে দাঁড়াল। শক্ত গলায় বলল,

‘অফিসার, উনাকে এবার জেলে নিয়ে যান।’

শাহাদাত আহমেদ ছেলেকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন। অনেক ভাবে বললেন, তিনি অসুস্থ। তাকে যেন ক্ষমা করে দেওয়া হয়। সাদরাজ তখন নিমিষ তার দিকে চেয়ে ছিল। বলেছিল,

‘আমার মাও অসুস্থ ছিলেন। আপনি সেই অসুস্থ মানুষটাকেও বাঁচতে দিলেন না। এত নিষ্ঠুর একটা মানুষকে আজ কী করে ক্ষমা করে দেই, বলুন। মায়ের সাথে এত বড়ো অন্যায় আমি করতে পারব না।’

ছেলের মুখের এমন কথায় ভীষণ আহত হোন শাহাদাত আহমেদ। আজ কি তবে সবকিছু শেষ? শাহাদাত আহমেদ নিষ্পলক চেয়ে রইলেন। অফিসার কনস্টেবলকে ডেকে তাকে জেলে পাঠালেন। সাদরাজ তখন বলল,

‘শাহাদাত আহমেদের সাথে যারা কাজ করেছেন, তাদেরও গ্রেফতার করবেন অফিসার।’

অফিসার বললেন,

‘ঠিক আছে। কালই আমরা আপনার বাবার কাছ থেকে সমস্ত জবানবন্দী নিয়ে সেই লোকগুলোকে গ্রেফতার করব।’

সাদরাজ এবার রাবীরের দিকে চাইল। মৃদু সুরে বলল,

‘তুই চাইলে আমার নামে মামলা করতে পারিস। আমিও তো কম অন্যায় করিনি। শাহাদাত আহমেদের কথায় অনেক অনেক ভুল করেছি। এর জন্য তো আমারও শাস্তির প্রয়োজন।’

কথা বলে সাদরাজ তপ্ত শ্বাস ছাড়ল। রাবীর তার দিকে এগিয়ে আসে। সাদরাজের কাঁধে হাত রেখে বলে,

‘আমি এই দিনটার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। খুব করে চাইতাম, একদিন সব সত্যি তোর সামনে আসুক। তোর আর আমার মাঝের দূরত্ব কমুক। আজ সেই দিন এসেছে। সব সত্যি তুই জানতে পেরেছিস। নিজের ভুল বুঝতে পেরেছিস। এখন আর আমার কিছু চাই না। আর না তোর উপর আমার কোনো অভিযোগ আছে। শুধু চাইব, তুই আগের মতো হয়ে যা। আমার প্রিয় বন্ধু, সাদ হয়ে যা। এইটুকুই।’

সাদরাজ বিমূঢ় দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। কী বলবে আজ? এত অন্যায়ের পর আজ আর কিছু বলতে পারছে না। নিজের উপরও যথেষ্ট রাগ আর ঘৃণা হচ্ছে। এত বিবেকহীন একটা মানুষ কী করে হতে পারে? কেন সেদিন রাবীরের কথা বিশ্বাস করল না? কেন সবকিছু ভালোভাবে খুঁটিয়ে দেখল না? কেন বোকার মতো বাবার কথা মানল সে, কেন? তাকে যে এই আফসোস নিয়েই সারাজীবন পার করতে হবে। তার জেদের কারণে, কত মানুষের কত ক্ষতি হয়েছে। রিতার মতো একটা ভালো মেয়ের জীবন নষ্ট হয়েছে। এতকিছুর পরেও কি তাকে ক্ষমা করে দেওয়া যায়?

নিজের মনেই প্রশ্ন করে থমকে যায় সাদরাজ। রিতার দিকে এগিয়ে যায়। গম্ভীর মুখে বলে,

‘আমি তোমার সাথে অন্যায় করেছি, রিতা। জানি এর ক্ষমা হয় না। তবে আমি তোমাকে এই অন্যায় সম্পর্ক থেকে মুক্ত করে দিয়ে নিজের প্রায়শ্চিত্ত করব। চিন্তা করো না, আমি খুব তাড়াতাড়িই আমাদের ডিভোর্সের ব্যবস্থা করছি।’

রিতা হতভম্ব। কী বলবে সে? এই কথায় সে খুশি হবে, নাকি কষ্ট পাবে? চিন্তায় পড়ে রিতা। কী করবে সে? সাদরাজ রাবীরের দিকে চেয়ে বলে,

‘রিতা আপাতত তোদের কাছে থাক। ডিভোর্সের পর ওকে ওর বাড়িতে দিয়ে আসব।’

এই বলেই সাদরাজ বাইরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়। পেছন থেকে রিতা অস্পষ্ট স্বরে বলে উঠে,

‘আমি কি বলেছি, আমার ডিভোর্স লাগবে?’

সাদরাজ চমকে তাকায়। রিতা এগিয়ে যায় তার দিকে। সাদরাজ এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। রিতা কী বলতে চাইছে?
রিতা নিজেকে শক্ত করে বলল,

‘সবকিছু কি আপনার মর্জিতে হবে নাকি? ইচ্ছে হলে, বিয়ে করবেন; আবার ইচ্ছে হলে, ডিভোর্স দিয়ে দিবেন। আমার মত অমতের কি কোনো মূল্য নেই?’

সাদরাজ অবাক হয়। জিজ্ঞেস করে,

‘তুমি কি ডিভোর্স চাও না?’

রিতা স্পষ্ট স্বরে বলে,

‘না। আমি এই কুৎসিত সমাজে ডিভোর্সের খেতাব নিয়ে বাঁচতে চাই না।’

সাদরাজ নরম গলায় জিজ্ঞেস করল,

‘এতকিছুর পরও তুমি আমার সাথে থাকতে চাও?’

‘হ্যাঁ।’

সাদরাজ তখন এক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলল,

‘তুমি তো অন্য কাউকে ভালোবাসতে।’

‘সে আমাকে ভালোবাসে কিনা জানি না। এখন ডিভোর্সের পর তার কাছে গেলে সে যদি আমাকে ফিরিয়ে দেয়? যদি বলে, কোনো ডিভোর্সি মেয়েকে সে বিয়ে করতে চাই না, তখন? আমি তখন আর এতকিছু সহ্য করতে পারব না। আমি একটা সুন্দর স্বাভাবিক জীবন চাই, সাদরাজ। আর সেই জীবনটা আপনি আমাকে দিবেন।’

রিতার কথা শুনে সাদরাজ নির্বাক। তার এখন কী করা উচিত বুঝতে পারছে না। কিছুক্ষণ সময় নিয়ে ভেবে সে বলল,

‘এত অন্যায়ের পর আমি নিজেই ভালো থাকতে পারব না, সেখানে তোমাকে আমি কীভাবে ভালো রাখব বলো? আমার সাথে থাকলে তুমি সুখী হতে পারবে না, রিতা।’

রিতা ভ্রু কুঁচকাল। বলল,

‘আমি ডিভোর্স দিতে না চাইলে, আপনি কি আমার থেকে জোর করে ডিভোর্স নিবেন? আমি আপনার সাথেই থাকব। এবার আপনি ভেবে দেখুন, আপনি কী করবেন।’

সাদরাজ নিরব। রাবীর এগিয়ে এসে বলল,

‘বিয়ে কোনো ভুল সিদ্ধান্ত না। হয়তো তখন তোর উদ্দেশ্য ভিন্ন ছিল। কিন্তু, এখন তো তুই সব বুঝতে পেরেছিস। তাহলে এখন কেন রিতাকে ফিরিয়ে দিচ্ছিস? তুই জানিস না এই সমাজ কেমন? সমাজ এই মেয়েটার জীবনকে নরক করে তুলবে। তাই এখন সবকিছু ভুলে, আবার নতুন করে শুরু কর। রিতাকে নিয়ে একটা ছোট্ট সুখের সংসার সাজা। দেখবি, আস্তে আস্তে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।’

সাদরাজের মাঝে আর কোনো অনুভূতি নেই। এসবের পরে এখন সে বড্ড ক্লান্ত। সম্পর্কের মায়াজালে যেন আর নিজেকে আটকাতে চাইছে না। তবুও এই মেয়েটাকে নিয়ে ভাবতে হবে। ওর সাথে আর কত অন্যায় করবে। সত্যিই তো, সমাজটা তো ভীষণ নিষ্ঠুর। এই সমাজে রিতার মতো অসহায় মেয়ের জায়গা হবে না।

সাদরাজ দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বলে,

‘ঠিক আছে। রিতা আমার সাথেই থাকবে। চলো।’

সাদরাজ ধীর পায়ে বাইরে বেরিয়ে যায়। মেহুল তখন রিতার কাছে এসে বলে,

‘আমি জানি, তুই ভাইয়াকে বদলাতে পারবি। উনি এখন মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছেন। উনার এখন একটা শক্ত হাতের প্রয়োজন, যেটা ধরে আবার উঠে দাঁড়াতে পারবেন। সবকিছু ভুলে, সুখী হো। দোয়া করি, তোদের জীবনে অনেক সুখ নামুক।’

মেহুলকে জড়িয়ে ধরে রিতা সাদরাজের গাড়িতে উঠে বসে। সাদরাজ তার গন্তব্যের দিকে বেরিয়ে যায়। তারা চলে যাওয়ার পর মেহুল আর রাবীরও তাদের বাড়িতে ফিরে আসে।

_______

রাতে খাবার টেবিলে মা’কে রাবীর সব বলে। সব শুনে তিনি বললেন,

‘আমার আগেই ঐ শাহাদাত আহমেদকে সন্দেহ হয়েছিল। কতটা জঘন্য ঐ লোকটা, ভাবতেই গা ঘিন ঘিন করে উঠছে।’

এত বছর পর তিনিও মনে মনে বেশ খুশি হলেন। সাদরাজ আর রাবীরের সম্পর্ক ঠিক হয়েছে। আর কোনো ঝামেলা হবে না। এই ভেবেই তিনি এখন নিশ্চিত।

.

রাতে বারান্দায় দাঁড়ান মেহুল। আকাশের দিকে চেয়ে কী যেন ভাবছে। হঠাৎ কোমরে উষ্ণ স্পর্শ পেয়ে খানিক নড়ে উঠে। উপস্থিত মানুষটাকে চিনতে পেরে কিছু বলে না। রাবীর তার ঘাড়ে থুতনি ঠেকায়। বড়ো নিশ্বাস ছেড়ে বলে,

‘জানেন মেহুল, আজ আমার ভীষণ শান্তি লাগছে। সবকিছু খুব সুন্দর লাগছে। মনে হচ্ছে বুকের ভেতর থেকে খুব বড়ো একটা পাহাড় নেমে গিয়েছে। আজ অনেকদিন পর আমি একটু শান্তিতে ঘুমাতে পারব।’

রাবীরের কথা শুনে মেহুল মৃদু হাসে। তার ঘাড়ের উপর রাবীর ওষ্ঠাধরের স্পর্শ পেয়ে কিঞ্চিত কেঁপে উঠে। রাবীর মেহুলকে আরো কাছে আগলে নেয়। মেহুল কম্পিত নরম সুরে বলে,

‘আপনাকে শান্তি পেতে দেখলে, আমারও বড্ড শান্তি লাগে।’

মেহুল রাবীরের বুকে মাথা এলিয়ে দেয়। রাবীরের স্পর্শ আরো গভীর হয়। মেহুল চোখ বুজে অনুভব করে। মনে মনে খুব করে দোয়া করে, রিতাও যেন তার মতো করে এত এত ভালোবাসা পায়।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here