#ফানাহ্ 🖤
#পর্বসংখ্যা_২৯(শেষাংশ)
#হুমাইরা_হাসান
ছুটে ঘরে এসে ধপ করে বিছানার উপরে বসে পড়লো মোহর৷ হৃদপিণ্ড বিদ্যুতের গতিতে দৌড়াচ্ছে। মাইল খানেক দৌড়ে এলেও হয়তো এতটা অস্থির লাগবে নাহ। প্রবল উন্মত্ততায় শিরশিরানি টা হৃদপিণ্ড ভেদ করে ক্রমশ সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে। অসম্ভব বেগে ছুটন্ত যন্ত্রটার ধুকপুকানির শব্দ কানের নরম পর্দাটাও ভেদ করে ফেলছে। ধুকপুক ধুকপুক করে বুকের কাঁপুনি বেড়ে গেছে। বেতাল,বেসামাল, বেগতিক হারে ছুটছে ক্রমশ বেড়েই চলেছে। বিতৃষ্ণা ধরে যাচ্ছে মোহরের, নিঃশ্বাসের পাল্লা অচিরেই ভারীই হচ্ছে।
ও ঘর থেকে পালিয়ে এলেও বুকের মাঝের জ্বালাতন, বুদবুদ অবস্থাটা এক লহমার জন্যেও কমেনি। সেই দম বন্ধ হয়ে আসা পরিস্থিটা এখানো গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। বায়োস্কোপের স্লাইডের মতো চোখের সামনে ভেসে উঠছে মুহূর্ত খানেক আগের দৃশ্য
…লজ্জার সমস্ত সীমা পেরিয়ে নিজেকে আড়াল করতে, অসমীচীন সন্ধিক্ষণটুকুতে নিজেকে সামলাতে না পেরে মেহরাজের বুকটার মধ্যে ঝাপিয়ে পড়া টা কতখানি অপ্রিতিকর ছিল তা যতক্ষণে মোহর ঠাওর করতে পেরেছে ততক্ষণে শক্তপোক্ত বাহুডোরের কারাগারে অসহায়রূপে বন্দিনী হয়ে গেছে নরম শরীরটা। একচুল নড়া তো দূর মেহরাজ পারেনি ওকে চামড়া ভেদ করে নরম মাংসল ধুকপুকানির যন্ত্রটার সাথে মিশিয়ে নিতে। মোহর নির্বাক,নিস্তব্ধ, অনড় হয়ে পড়ে ছিল উষ্ণ স্পর্শের শীতলতার মাঝে। যেন চেতনাশূন্য এক নির্জীব পাখি।
মেহরাজ হয়তো বুঝতে পেরেছিল এটা তাণ্ডব শুরু হওয়ার পূর্ব মুহুর্তের নীরবতা। নিগূঢ় নিস্তব্ধতায় বিরাজ করা মোহরের অন্তর্ভেদী বেসামাল প্রক্রিয়া টুকু হয়তো নিঃশ্বাসের ফিসফিসানির শব্দেই ও আঁচ করে ফেলেছিলো।
কয়েক লহমা বুদ্ধিবৃত্তিহীনায় মেহরাজের বুকের মধ্যিখানে মিশে থাকলে, অবশেষে ওর দুই বাহু ধরে সোজা করলো মেহরাজ। ডান হাতটা এগিয়ে নিয়ে চারটা আঙুল ওর গালে বসিয়ে বৃদ্ধাঙ্গুলিটা ওর ঠোঁটের আশেপাশে গালের বুলিয়ে দিতে দিতে তাকিয়ে রইলো মোহরের লঘুমস্তিষ্কের অসাড়,টকটকে মুখটার দিকে।
গায়ের আঁচলটা সরে গিয়ে এলোমেলো অবস্থা, কাজলখানি যেন আরেকটু লেপ্টে গেছে ঠিক যেমনটা মেহরাজের সাধ করেছিল।
গাল, থুতনি আর ওষ্ঠের আশেপাশে মেহরাজের আঙ্গুলের এমন অবাধ্য বিচরণে কেঁপে কেঁপে উঠছে সমস্ত মোহর নিজেই।
অসামঞ্জস্য ভাবে হৃদবক্ষটার ধড়াস-ধড়াস শব্দ ভীষণ বেকায়দায় চলতে লাগলো। নিঃশ্বাসের প্রখরতার ফিসফিসানি এমন বেয়ারা ভাবে ছুটছে যেন তা পরিবেশে অন্যকিছুরই উন্মাদনা ছড়িয়ে দিচ্ছে। মেহরাজ নিজের মুখটা আরও কাছে এগিয়ে আনলো মোহরের, ওর নরম গালে হাত বুলাতে বুলাতে চোখ দু’টো আঁটকে রইলো পাপড়ির ন্যায় অর্ধভেজা ওষ্ঠভাঁজের দিকে।
ওর উন্মত্ত, বেপরোয়া, অস্থির করা নিঃশ্বাস প্রশ্বাস গুলো হড়বড়িয়ে আঁছড়ে পড়ছে মোহরের মুখে। ক্ষান্ত চোখের দূর্বল চাহনিতে তাকালো মোহর মেহরাজের মুখের দিকে।
এবার আর চোখ ফিরিয়ে নিতে পারলোনা মোহর,নাইবা পারলো চোখ দু’টো সজোরে খিঁচিয়ে ধরতে। বরং তাকিয়েই রইলো। মেহরাজের ওই সমুদ্রের ন্যায় শান্ত আঁখিদুটি আজ ওকে বড্ড টানছে, বাকচিন্তার খেঁই হারিয়ে ফেলেছে নিজের। পুরুষালী তপ্ত শ্বাসের প্রখরতা ক্ষণে ক্ষণে দামামা তুলছে শরীর মনের ভাঁজে ভাঁজে।
মেহরাজের গায়ের ওই ফুল চন্দন মিশ্রিত নির্যাসের ন্যায় সুগন্ধিটা পুরোপুরি সম্মোহন করে ফেলেছে ওকে। তীব্র ভাবে নাসারন্ধ্র ভেদ করছে মেহরাজের গায়ের সুমিষ্ট ঘ্রাণ টা।
উষ্ণ-শীতল স্পর্শের মাঝে মোহর পুরোপুরি বশীভূত। খুব নিকটে মেহরাজের মুখ খানা এগিয়ে আসলেও মোহরের ঠোঁটে নিজের ভেজা স্পর্শটুকু মেখে দিলো না, দীর্ঘসময় নিঃশ্বাসের সাথে নিঃশ্বাসের প্রবল সন্ধি ঘটলেও মোহরের অধর জোড়াকে উন্মাদের মতো আঁকড়ে ধরলো না মেহরাজ। বরং খোঁচা খোঁচা দাঁড়িবৃত গালটা এগিয়ে বার দুয়েক ঘঁষে দিল মোহরের গালে, কানের লতিতে ওর কোমল ঠোঁট দুটি ছুঁয়ে ফিসফিসিয়ে বলল
– আপনাকে পুরোপুরি নিজের ভেতর মিশিয়ে নিতে না পারলে শান্তি পাচ্ছিনা মোহ!
ঝনঝনিয়ে উঠলো মোহরের সমস্ত চিত্ত,কায়া। উদ্দীপিত ক্রোড় সামলাতে না পেরে হাতের নখ সজোরে বিঁধিয়ে দিলো মেহরাজের ঘাড়ে।
চোখা নখ মাংস ভেদ করে ঢুকে গেলো ফর্সা চামড়ায়।
মেহরাজ মুখ তুলে তাকালো মোহরের মুখে, বাঁ কাধ থেকে আঁচলটা অনেকখানি নেমে গেছে, সেদিকে তাকিয়ে হাত বাড়ালো মেহরাজ। অযাচিত ভয়ে ঘাবড়ে মোহর আতঙ্কিত হয়ে উঠলেও ওর সমস্ত দুর্ভাবনাকে শাই করে উড়িয়ে দিয়ে মেহরাজ ওর আঁচল টা টেনে কাঁধে তুলে দিলো।
এক লহমা আর ব্যয় না করে মেহরাজ সরে এলো মোহরের কাছ থেকে। ওকে নিজের বাহুবন্ধনী থেকে মুক্ত করে দিয়ে চরম নিষ্ঠুরতা দেখিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। মোহর ধপ করে বুজে যাওয়া আগুনের ছায়ের মতো অধজলন্ত নিভু নিভু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলে মেহরাজ ওর জলদগম্ভীর গলায় বলল
– চলে যান মোহ। সাময়িক আবেগের বশীভূত হয়ে আমি এমন কিছুই করতে চাইনা যাতে রাত পোহালে আমার দিকে তাকাতে আপনার অস্বস্তি হয়। শরীরের জন্য পুরোটা জীবন পরে আছে, আপনার নরম মনটাতে আমি এখনি আমার পুরুষোচিত আঁচড় কা’টতে চাইনা। সঠিক সময় আসেনি, চলে যান
এতো গুলো কথা সম্পূর্ণ নিস্তেজ, নিস্তব্ধ বাকরুদ্ধ অবস্থায় শুনে এক মুহূর্তও সময় নিলো না মোহর। কোনো রকমে ছুটে পালিয়ে এলো ছোট্ট ঘরটা থেকে।
ধপ করে চোখ খুলে তাকালো মোহর। সেই ঘটনা টুকু ঘরে আসার পরেও মন,মস্তিষ্ক কোনো টাই ভুলতে পারছে না। নাক,মুখ,বুক সব রুদ্ধশ্বাসে প্রাণশক্তিহীন হয়ে আসছে। অস্ফুটস্বরে বার দুয়েক উচ্চারণ করলো
– র্ রুদ্ধ…রুদ্ধ!
যেন নামটা তার চরিত্রের সাথে একেবারে খাপখাওয়াতে মিলিয়েই রেখেছিল তার আম্মা। একটা মানুষের স্পর্শ, কণ্ঠ, ঘ্রাণ, চাহনি বারংবার মোহরের রুদ্ধশ্বাস তুলে দেয়। এতটা অস্থিরতা, উন্মত্ততা আর কিছুতেই নেই কিচ্ছুতেই নাহ।
__________________________
– ভাবী? ও ভাবী? আর কতো ঘুমাবে ওঠো না
বেশ কিছুক্ষণ ধরেই মেয়েলী একটা ডাক মোহরের কানে আসছে। কিন্তু ঘুমের চোটে আঁখিদুটি মেলে তাকাতে পারছে না।
– ভাবী শুনছো??
এবারের ডাকটা তুলনামূলক বেশ জোরে হওয়াই চোখ খুলে হুড়মুড়িয়ে উঠে বসলো মোহর। আশপাশ তাকিয়ে ধাতস্থ হতে বেশ সময় লেগে গেল। পাশে সাঞ্জে দাঁড়িয়ে হাস্যজ্বল মুখে। মোহর বিচলিত চেহারার অস্থির নজরে তাকালে সাঞ্জে বলল
– ইশ,তুমি কতো ঘুমকাতুরে গো ভাবী। পাঁচ মিনিট ধরে ডাকছি। একটা বার হুহা শব্দও করোনি। নাকি রাতভর ঘুম হয়নি হু?
সাঞ্জের কথায় যতটা না অপ্রস্তুত হলো তার চেয়ে বেশি অবাক হলো ঘড়ির কাটার দিকে তাকিয়ে। নয়টা বেজে বিশ ত্রিশ মিনিট, এতক্ষণ ঘুমালো কি করে!
– হায় খোদা, কত বেজে গেছে আমার ক্লাস আছে দশটায়।
বলেই হুড়মুড়িয়ে উঠতে গেলে সাঞ্জে ওকে শান্ত করে বলল
– আস্তে আস্তে, তুমি আগেই হাইপার হচ্ছো কেন। এখনো আধঘন্টা সময় আছে তো। তুমি ওয়াশরুমে গিয়ে চট করে ফ্রেশ হয়ে আসো শুধু। দাভাই এখনো যায়নি। তুমি রেডি হয়ে আসো তিনজনে একসাথেই বেরোবো।
মোহর সাঞ্জের কথা শুনে কিছুটা স্বস্তি পেলেও অস্বস্তি ঘিরে ধরলো মেহরাজের কথা মনে পড়ে। কাল প্রায় ভোর চারটা পর্যন্ত মোহর দুচোখের পাতা এক করতে পারেনি।
প্রাণপণে ফরিয়াদ করছিল যাতে মেহরাজ কিছুতেই এ ঘরে না ফেরে। ওর মুখামুখি হওয়ার মতো মনোবল যেন এতটুকুও নেই মোহরের মাঝে। তবে মোহরের খুব করে চাওয়াটা মেহরাজ বিফলে দেয়নি। ওর চাওয়াটা পরিপূর্ণ করে ও সারাটা রাত ওই স্টাডিরুমেই পার করে দিয়েছে। ভোর ভোর হয়ে এলেই মোহরের চোখ দু’টো লেগেছে, তাই ঘুম ভাঙতে এতো দেরী।
এক প্রকার পারাপারী করেই মোহর মিনিট দশেকের মধ্যে গোসল সেরে ফ্রেশ হয়ে বেরোলো। ওয়াশরুমে আগে থেকেই তোয়ালে আর একটা সবুজ রঙের লঙ ড্রেস রাখা ছিল। মোহর ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে দেখলো সাঞ্জে তখনও বসে, ম্যাগাজিন জাতীয় কিছু একটা পড়ছে। মেয়েটার পরনে মেরুন রঙের কুর্তি আর সাদা রঙের গ্যাবাডিন প্যান্ট।
তৈরি হয়েছে আজ সকাল করে, একটু আগে যেন বলল কোথাও বেরোবে। তবে সেদিকে মাথা না দিয়ে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে সাঞ্জেকে উদ্দেশ্য করে বলল
– ওয়াশরুমে কি তুমি আমার জামা কাপড় রেখেছিলে সাঞ্জে?
ম্যাগাজিন থেকে ব্যস্ত মুখটা তুলে তাকালো সাঞ্জে। ভ্রুকুটি করে বলল
– কই না তো।
মোহর চিরুনি নামিয়ে পেছনে ঘুরে বলল
– আমিও তো রাখিনি। তোয়ালে, ড্রেস দুটোই রাখা ছিল তো!
– ওহ, দাভাই রেখেছে মনে হয়। আমাকেই তো বলল তোমার নাকি ঘুম ভাঙতে দেরী হবে হয়তো তাই ডেকে দিতে।
বলে আবারও পত্রিকার ন্যায় কাগজের পৃষ্ঠাগুলোতে মুখ গুঁজলো। মোহর খানিক থম মেরে দাঁড়িয়ে রইলো সাঞ্জের কথা শুনে, একরাশ হীম হাওয়া বইয়ে দিল ঘাড়, পিঠ জুড়ে।
মানুষটা সকালে এসে প্রস্তুত হয়ে বেরিয়ে গেছে, মোহরের উঠতে দেরী হবে বলে জামা কাপড় টাও নিজ দ্বায়িত্বে ওয়াশরুমে রেখে গেছে, ঘুম ভাঙাতেও সাঞ্জেকে পাঠিয়েছে। সব গুলো কাজই খুব নিখুঁত ভাবে নিজেকে আড়ালে রেখে পরোক্ষপদ্ধতিতে সেরেছে,অথচ কতটা যত্ন দিয়ে। শুধুমাত্র মোহরকে অস্বস্তিতে ফেলতে চাইনা বলে!
মোহরের বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো, শ্রীতমার বলা কিছু কথা এখন স্ফুলিঙ্গের ন্যায় কানের পর্দায় ঝনঝনিয়ে বাজছে, অবচেতন মস্তিষ্কে কিছু একটা নিমিষেই ছেয়ে যাচ্ছে।
.
তিয়াসা বেশ কিছুক্ষণ ধরে থ মেরে বসে আছে। হাতের শুকনো টোস্ট আঙুলের চাপে মুচড়ে চুরচুর করে প্লেটের উপরে ঝরে পড়ছে। অথচ সেদিকে কোনো ধ্যান ই নেই ওর। জলন্ত চোখের ক্ষুব্ধ হিংসাত্মক দৃষ্টিতে আড়চোখে তাকিয়ে আছে শুধু মেহরাজের দিকে।
– তিয়াসা, খাচ্ছো না কেন? সেই কখন থেকে একটা টোস্ট হাতে বসে আছো, খাবার ভালো লাগেনি? অন্যকিছু করে দেবো?
আম্বি খাতুন কাজ করতে করতে ব্যস্ত স্বরে কথা গুলো বলল, তিয়াসা সম্বিত ফিরে পেয়েও যেন পেলো নাহ, আধো ধ্যানে আনমনা হয়ে বলল
– না না, আন্টি। সব ঠিকাছে, খাচ্ছি আমি।
আম্বি খাতুন সরে গেলেও সরলো না তিয়াসার নজর। বেহায়ার মতো চেয়ে আছে জলপাই সবুজ রঙের একটা শার্টের সাথে পিচ ব্ল্যকের মিশ্রনের ফরমাল স্যুট পরিহিত সুপুরুষটির দিকে।
প্রায় আধঘন্টা ধরে টেবিলে বসে আছে, অথচ একটা বারও তিয়াসার দিকে তাকাইনি,যেখানে তিয়াসা এক মুহুর্তের জন্যেও চোখ সরাতে পারতে নাহ।
আপাদমস্তক আকর্ষণীয় একটা পুরুষ,যার কথাবার্তা অঙ্গভঙ্গি, দৃষ্টি, চোখ, মুখ,ঠোঁট সবকিছুই মারাত্নক।এর থেকে চোখ ফেরানো দায়। তিয়াসা আরো একবার ঘড়ির দিকে তাকালো,ঠিকঠাক নয়টা বিয়াল্লিশ বাজে অথচ মেহরাজের বেরোতে নয়টা ছাড়িয়ে নয়টা পাঁচে যায়না ঘড়ির কাটা।
– তুমি কি কারো জন্যে অপেক্ষা করছো রাজ? অনেক বেজে গেছে এখনো অফিসে যাচ্ছো না যে!
– হ্যাঁ
ছোট্ট একটা জবাব,অথচ দৃষ্টির নড়চড় হলো নাহ। তিয়াসা আরও কিছু বলতে যাবে তখনি মেহরাজ সিড়ির দিকে তাকানোর জন্য বাঁ দিকে ঘাড় কাৎ করলে দুটো লালাভ রেখার ন্যায় দাগ দেখতে পেলো ঘাড়ে। তৎক্ষনাৎ ভ্রুদ্বয় কুচকে এলো তিয়াসার ব্যপকভাবে।
স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে দুটো নখের আঁচ’ড়। ফর্সা ঘাড়ে দগদগে ক্ষতের ন্যায় স্পষ্ট নজর কাড়াচ্ছে দাগ দুটো। স্ফুলিঙ্গের ন্যায় জ্বলে উঠলো চোখ দু’টো। কোনো ঘটনার কাঠকাঠ লক্ষণ দেখে জ্বলে উঠলো ওর শরীর। বেশ কঠোর গলায় জিজ্ঞাসা করলো
– তোমার গলায় আঁচড়ের দাগ কিসের রাজ?
মেহরাজ খানিকের জন্য স্থিত হলো যেন, তবে তার স্থায়িত্ব নিতান্তই ক্ষণকাল। তিয়াসা জবাবের অপেক্ষা না করেই আবারও বলল
– বউ পেয়ে এতো কিছু? এখন তার দেওয়া আঁচড়ের দাগ ও ঘাড়ে করে বয়ে বেড়াচ্ছো? কই আমাকে তো কখনো ধরতে দাওনি, যেন আমি ছুঁয়ে দিলে তোমার ফোসকা পরে যায়!
বেশ জোরেসোরেই বলল তিয়াসা কথাগুলো। মেহরাজ চোখ তুলে ভীষণ শান্ত নজরে তাকালো তিয়াসার দিকে। মোহর সবেমাত্র সিড়িতে পা দিয়েছে নামতে, তখনি কানে এলো মেহরাজের অতীব শান্তস্বরের স্বীকারোক্তি
– বউটা যেহেতু আমার, তাই তার দেওয়া আঁচর,ঘা সবটাই আমার। একে আমি ঘাড়ে করে কেন আমার ব্যক্তিত্ব জুড়েও বয়ে বেড়াতে পারি। এর কৈফিয়ত কাওকে দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করছিনা। আর কারো ব্যক্তিগত ব্যাপারে প্রশ্ন করার আগে যে পারমিশন বা ম্যানারস্ দরকার এতটুকুও জানো না অথচ তুমি কি না ডক্টর হয়েছো?
জলন্ত অগ্নির ন্যায় জ্বলে উঠলো দুচোখ তিয়াসার। মেহরাজের শরীরে অন্য কারো স্পর্শের দাগ, আর বউকে ঘিরে ওকে অপমান সূচক কথাগুলোতে ওর দেমাগে লাগলো। খিটখিট করে বলে উঠলো
– দুদিন বিয়ে করে এতো বউ বউ করো কেন? আমার সাথে যে চার বছর ছিলে? তোমার জন্যে যে সারাটা জীবন অপেক্ষা করে গেলাম সে বেলায়? নাকি এখন আমাকে পছন্দ হয়না নতুন কাওকে পেয়ে, স্বাদ মিটে গেছে!
মেহরাজ শান্ত চোখে তাকিয়েও হিংস্রাত্মক হয়ে উঠলো। পেপারটা হাতের করপুটে মুচড়ে ধরে বলল
– আমি ভদ্রভাবে আছি বলে ভেবোনা এভাবেই থাকবো। আমাকে ঠিক চেনা আছে তোমার। মুখ খুলতে বাধ্য করো না তিয়াসা, তুমি কি করেছো আর কি করছো কোনো টাই কিন্তু আমার অজানা নয়। আর লাস্ট বারের মতো বলছি তোমার ওই নোংরা মুখটার ব্যবহার আমার সামনে করবে না, আমায় এমন কিছু করতে বাধ্য কোরো না যাতে পরবর্তীতে ওই মুখের ব্যবহার করতেও তিনবার ভাবতে হয়।
বলেই চট করে উঠে দাঁড়ালো। মোহর থ মেরে দাঁড়িয়ে থেকেই চারিপাশে চোখ বুলালো। আপাতত ড্রয়িং রুমে কেও নেই। ভাগ্যিই সাঞ্জে ওর ফোনটা আনতে ঘরে গেছিলো। তা না হলে হয়তো এসব..
– ভাবী এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন চলো?
সাঞ্জের উচ্চবাক্যে উপস্থিত তিনজনেই ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। মোহর অপ্রস্তুত চিত্তে কিছু বলবে তার আগেই মেহরাজ পকেটে হাত ঢুকিয়ে বাইরের দিকে যেতে যেতে বলল
– তাড়াতাড়ি আই সাঞ্জে, দেরী হচ্ছে আমার।
সাঞ্জেও আর অপেক্ষা করলো নাহ। মোহরের হাত ধরে নেমে এসে দ্রুতপায়ে দরজার দিকে হাঁটা দিলো। মোহর নিশ্চুপ ভাবে ড্রয়িং রুমটা পেরিয়ে এসে দরজার সামনে যাওয়ার সময় সন্তপর্ণে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো তিয়াসার দিকে, মোহরের সরু চোখের চাহনি তিয়াসার ভেতরের আগুনে যেন ঘি ঢেলে দিলো, ধপধপ করে জ্বলে উঠলো ওর হিংসাত্মক চাহনি।
_____________________
মেডিক্যাল থেকে বেরিয়ে গেইট পেরোতেই থমকে গেলো মোহরের পা দুটো। শ্রীতমা মোহরের হুট করে দাঁড়িয়ে পড়া দেখে বলল
– কি হলো দাঁড়িয়ে পড়লি যে!
মোহর মুখে কিছু না বললেও ভ্রুদুটো কিঞ্চিৎ উঁচু করে সামনে ইশারা করে তাকালে শ্রীতমা সেদিকে তাকিয়ে চুপ বনে গেলো। কুচকুচে কালো দামী গাড়িটায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা কালো চশমা আর মাস্ক আবৃত চোখ মুখ দু’টো স্পষ্ট দেখতে না পেলেও যে সেটা ব্যগ্র হয়ে মোহরের অপেক্ষায় ওর দিকেই আঁটকে আছে সেটা বুঝতে অসুবিধা হলো নাহ।
আর সে চাহনিটাই কোনো শব্দহীনা বুঝিয়ে দিলো ভীষণ লম্বা চওড়া, সৌষ্ঠব, গৌড় বর্ণের লোকটি তার বান্ধবীর স্বামী। শ্রী আড়চোখে মোহরের দিকে তাকিয়ে ইশারা করে যেতে বলল, মোহর ভ্রু কুচকালে ও ফিসফিসিয়ে বলল
– একদম উতপাত করবিনা, যাহ চুপচাপ। এমনিতেও অরুনাভ আসবে আমি গেলাম
বলে পাশের গলির ফাঁক দিয়ে সুরুত করে ঢুকে গেলো। মোহর জড়তা, আড়ষ্টতা নিয়েই গুটি গুটি পা ফেলে এগিয়ে দাঁড়ালো মানুষটার সামনে। এক’হাতে কাঁধের ব্যগটি মুঠিতে শক্ত করে ধরলো। অবিলম্বেই গাড়ির দরজা টা খুলে দিয়ে ভেতরে বসতে ইশারা করলো মেহরাজ, মোহর মাথাভর্তি দ্বিধাদ্বন্দ নিয়েই ঢুকে বসলো ফ্রন্ট সীটে।
এতদিন শুধু ড্রপ করে দিয়ে যেত, ফেরার পথে হয় বাড়ির ড্রাইভার এসেছে নয় অভিমন্যু নিয়ে গেছে। আজ মেহরাজের এভাবে তোড়জোড় করে আসার হেতু বোধগম্য হলো নাহ। তবুও সকৌতূহলে জর্জরিত মনটা স্থির রাখার চেষ্টায় চুপচাপ বসে রইল। মেহরাজ এসে গাড়িতে বসেই উইন্ডো গ্লাস তুলে দিয়ে মুখের মাস্কটা খুলে ফেলল। মোহর জিহ্বা ঠেলে ধীর গলায় বলল
– মাস্ক পড়েছিলেন কেনো?
মেহরাজ স্কেলেটরে পায়ের চাপ দিয়ে স্টিয়ারিং ঘুরাতে ঘুরাতে ঘাড় কাৎ করে মুহুর্তের জন্যে মোহরের দিকে তাকালো, আবারও চশমায় ঢাকা চোখ দু’টো ফিরিয়ে নিয়ে সামনে তাকিয়ে বলল
– কারণ আপনি বাদে পুরো শহরটাই চেনে আপনার স্বামীকে।
মোহর চুপ করে গেলো। এ বিষয়টা নিয়ে ও নিজেও লজ্জায় পড়েছে বার কয়েক। যেখানে মেহরাজের ব্যবসায়ীক খ্যাতি আর পারিবারিক পরিচয়ে পুরো শহর ওকে চেনে সেখানে মোহর কখনো ওর নামটাই শোনেনি।
বেশ কিয়ৎকাল চুপ থাকলেও বাইরের অচেনা দৃশ্যে ললাটে ভাঁজ পরলো।
মোহর ভেবেছিল মেহরাজ হয়তো ওকে বাড়িতে ফিরিয়ে নিতে এসেছিল। কিন্তু এটা সম্পূর্ণই অজানা অচেনা একটা রাস্তা। এদিকে কেনো নিয়ে যাচ্ছে ওকে মেহরাজ, বিচলিত মনে বিব্রত গলায় বলল
– এটা কোন রাস্তা? কোথায় যাচ্ছি?
মেহরাজের মুখাবয়বের কোনো পরিবর্তন হলো না। যেন আগে থেকেই অবগত ছিলো এরূপ প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে বলে।
– ভয় পাচ্ছেন মোহ?
মেহরাজের দায়সারা ভাবটা বেশ চাঞ্চল্য সৃষ্টি করলো মোহরের মনে। এভাবে উত্তরটা এড়িয়ে কেনো যাচ্ছে লোকটা!
কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল
– কোথায় যাচ্ছি জানতে পারিনা?
– নাহ, ইট’স সারপ্রাইজ।
.
.
.
চলমান
©Humu_❤️