#অন্যরকম_ভালোবাসা
পর্ব ১৪ ( শেষপর্ব)
#মৌমিতা_শবনাম
রাদ আর তন্নি বেলকনিতে বসে আছে। তন্নি রাগী ভাব নিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে আর রাদ তার দিকে অসহায়ের মতো তাকিয়ে আছে। তন্নি আর রাদ একে অপরের দিকে তাকিয়ে উচ্চস্বরে হেসে দেয়। রাদ হাসতে হাসতে বলল,–” যা অভিনয়টা করলে মিসেস তন্নি।”
তন্নি একটা ভাব নিয়ে বলে,–” সিনেমার নায়কারা হার মানবে তাই নাহ।”
রাদ হেসে বলে,–” ইয়াহ।”
তন্নি নিজেকে স্বাভাবিক করে বলে,–” ভাগ্যিস আপনি ঐদিন ক্যান্টিনে গিয়ে সব বলেছিলেন। ”
বিয়ের আগে যখন তন্নি গিয়ে রাদকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল তখন রাদ ওকে কিছু কথা বলবে বলে তন্নিকে নিয়ে ক্যান্টিনে গিয়েছিল। সেখানে বসেই রাদ তন্নিকে তার জীবনের সব সত্যি বলে দিয়েছিল। রাইদা ওর সন্তান নয় বরং ওর বড় ভাইয়ের। মনির ব্যাপারেও বলেছিল সে। সব জানিয়ে সে তন্নিকে জিজ্ঞেস করে, –” মিস তন্নি আপনি কি আমার মিসেস তন্নি হবেন?
সেদিন তন্নি রাদের হাত ধরে হ্যা উত্তর দিয়েছিল। তন্নি হাসতে হাসতে বলে,–” আপনার এক্স মনি আস্ত একটা বলদ।”
রাদ হেসে দিয়ে বলল,–” হ্যা নয়তো বুঝে যাওয়ার কথা আমার রিয়েকশনে।”
তন্নি হালকা মায়া দেখিয়ে বলে,–” না থাক নাহ বেচারি এতো কষ্ট করে ঘটনা গুলো সাজিয়েছে কি করে আমি এগুলো ব্যস্তে দেই।”
রাদ কিছু বলতে নিবে তখনই কারো পায়ের শব্দ শুনতে পায়। রাদ তন্নির সাথে ঝগড়ার অভিনয় করতে থাকে। এমন যে তন্নি রাগ দেখাচ্ছে সে তার রাগ কমানোর চেষ্টা করছে। ওদের সন্দেহ সত্যি ছিল মনি এসেছে। রাদ মনিকে দেখে বিরক্ত হয়ে বলে,–” কি এখানে কি চায়? গেট লোস্ট।”
মনি ন্যাকা ন্যাকা ভাব নিয়ে কান্না করার মতো অবস্থা নিয়ে রাদকে গিয়ে জড়িয়ে ধরে। এবার তন্নির সহ্য হলো নাহ এই নিয়ে ৩ বার জড়িয়ে ধরেছে তার বরকে। মনিকে টেনে এক থাপ্পড় লাগায়। মনি গালে হাত দিয়ে চোখ পাকিয়ে তন্নির দিকে তাকায় তন্নি দাঁতে দাঁত চিপে বলে,–” তুই রাইদার মা তাই নাহ রাদের বউ। মানে তুই যা বলবি তা বিশ্বাস করে নিবো আর আমার বরকে ছেড়ে দিব ভাবলি কি করে?”
মনি অবাক হয়ে বলল,– মানে?”
যেই আকাশের কাছ থেকে ছবি গুলো বানিয়ে এনেছিস সে আমাকে বলেছে আর যেদিন তুই বাংলাদেশে এসেছিস সেদিনই তোর আসার খবর পেয়ে গেছি আর তোর আর রাইদার ব্যাপারে আমাকে আগেই বলে দিয়েছে রাদ। বিকেল অব্দি সময় দিলাম বেরিয়ে যা এই বাসা আর আমাদের জীবন থেকে। ”
মনি তন্নির কথাকে পাত্তা না দিয়ে রাদকে বলে,–” প্লিজ রাদ আমাকে গ্রহণ করে নাও আমি আর কখনো ছেড়ে যাবো না।”
রাদ নিজেকে কন্ট্রোল করে বলে, –” মনি চলে যাও তোমার মতো মেয়ের মুখটাও দেখতে চাই নাহ আমি। যদি এরপরও জ্বালাতে আসো তাহলে আইনি পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হবো।”
মনি আর কিছু বলে না সে বুঝে যায় তার রাদকে পাওয়া হবে না। এখানে কারো দোষ নেই সে নিজের দোষে রাদকে হারিয়েছে। মনি গেস্টরুমে চলে যায় নিজের ব্যাগ গুছাতে থাকে। মনির পিছনে রাদ তন্নিও আসে। মনি ব্যাগ গুছিয়ে এসে রাদের সামনে দাড়িয়ে বলে, –“ক্ষমা করে দিও তোমার সাথে অন্যায় করার জন্য তোমাকে মিথ্যে অপবাদ দেওয়াই তুমি খুব লাকি রাদ তন্নির মতো মেয়ে পেয়েছো। আমি চাইলে ঝামেলা করতে পারতাম কিন্তু এতে না তোমরা সুখে থাকতে পারবে না আমি এর থেকে ভালো বরং নিজের জীবনটা আবার শুরু করে।”
তন্নি নিজেকে সামলে নিয়ে মনির কাছে গিয়ে বলে,–” সরি নিজের খেয়াল রেখো আর কখনো অন্যের ক্ষতি করতে যেও না।”
মনি রাদ আর তন্নির দিকে তাকিয়ে বলে– ” ভালো থেকো আসি আমি।”
মনি চলে যায়। যাওয়ার আগে রাদকে আবার দেখে যায় পিছন ঘুরে তারপর আর পিছন ঘুরে না। মনি চলে যেতেই রিধি এসে নাচতে নাচতে বলে,—” ইয়াহু আপদ বিদায় হয়েছে। ”
পরক্ষণেই আবার মন খারাপ করে বলে,–” দূর ভাবছিলাম কয়েকদিন মনিকে নাকানিচুবানি খাওয়াবো এতো দেখি ৫ ঘন্টায় বিদায় নিল।”
তন্নি রিধির কথায় হালকা হাসলো। রিধির কাধে হাত দিয়ে বলে,–” ডিয়ার ননদিনী নিধি তো ইচ্ছে করে যায় নি বাধ্য হয়েছে। ফাঁদে পড়ে সে নিজের ভুলটা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে। ”
রিধি বুঝতে না পেরে বলল,–” কিভাবে? ”
তারপর তন্নি তাকে পুরোটা বলতে শুরু করলো।কিছুক্ষণ আগে মনি যখন গেস্টরুমে যায় তখন তন্নি ওর পিছনে পিছনে যায়। মনি রুমে ঢুকে দরজা লক করে দেয়। তখন তন্নি জানালার সাইডে গিয়ে দাঁড়ায়। মনি ফোন বের করে নিরবকে ফোন দেয় কিন্তু নিরব ফোন ধরে না। মনি বিরক্ত হয়ে বলে, –“এই ছেলে কোথায় হারিয়ে গেছে উফ বিরক্তিকর। ”
তখন আবার ফোন দেয় মনি নিরবকে। এবার সাথে ফোন ধরে। আর অপর পাশের লোকটার কথায় জানতে পারে যে নিরবকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে।
—————-
বৃষ্টি এখনও হাসপাতালে বসে আছে। হাতে হাসপাতালের ছাড়পত্র। কিছুক্ষণ আগেই নিরব আর তার মাকে পুলিশ নিয়ে গেছে। বৃষ্টি এবার কি করবে ভাবছে মা বাবার কাছে সে কখনো যাবে না। কোন মুখেই বা যাবে সে। কতই মা বড় মুখ করে বলেছিল সে যে নিরব তাকে ভালোবাসে।
বৃষ্টি উঠে দাড়ায় এখানে বসে থাকলে কিছু হবে না। হাসপাতাল থেকে বের হয়ে যায়। কি করবে সে কোথায় কাজ খুজবে। দীর্ঘ শ্বাস ফেলে সে তখন ফোনটা বেজে ওঠে। ফোন হাতে নিয়ে দেখে মিশমি কল দিয়েছে। বৃষ্টি ফোনটা রিসিভ করে বলে,–” আসসালামু আলাইকুম আন্টি।”
মিশমি সালাম নিয়ে বললেন, –” কোথায় তুই তন্নি ফোন দিয়ে বলল তুই আসছিস তাই তো তোর প্রিয় খাবার বানিয়ে রাখলাম। ”
বৃষ্টি কিছু না বলে চুপ করে থাকে। মিশমি ধমকে বলেন,–” তোর আঙ্কেল না খেয়ে বসে আছে তুই আসলে তবে খাবে জলদি আয় বাসায়।”
বৃষ্টি বলল,–” আমি আসছি কিছুক্ষণের মধ্যে তুমি আঙ্কেলকে খেতে দাও।”
মিশমি আর কিছু বলে না ফোন কেটে দেয়। বৃষ্টি অন্যায় করলেও তার শাস্তি সে পেয়েছে মেয়েটা এখন যে পরিস্থিতিতে আছে তার মানসিক সাপোর্ট প্রয়োজন। তাই তারা বৃষ্টিকে ক্ষমা করে দিয়েছে।
বৃষ্টি কিছুক্ষণের মধ্যেই বাসায় ফিরে। বৃষ্টিকে বাসায় ফিরতে দেখেই মিশমি উঠে রান্না ঘরে চলে যায় খাবার আনতে। তুষার সাহেব গিয়ে বৃষ্টির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে– ” যাহ ফ্রেশ হয়ে আয়। “.
বৃষ্টি আর কিছু না বলে মাথা নাড়িয়ে চলে যায় তন্নির রুমে। তন্নির একটা জামা নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে। বৃষ্টির মনে অপরাধ বোধ কাজ করছে। যাদের সাথে এতো অন্যায় করেছে তারাই তাকে আবার আপন করে নিয়েছে। আর তার মা বাবা তো এ কয়দিনে একটা বার ফোন ও দেয় নি। বৃষ্টি হাসে নিজের ওপর।
—–
খাবার খেতে বসেছে বৃষ্টি, মিশমি আর তুষার সাহেব। বৃষ্টির গলা দিয়ে খাবার নামছে না বিষয়টা তুষার সাহেব খেয়াল করে বলেন,–” কিরে মা খাচ্ছিস নাহ যে?”
বৃষ্টি কান্না করতে করতে বলে,–” প্লিজ আঙ্কেল আমাকে মা ডেকো না এই ডাকের যোগ্য নই।”
তুষার সাহেব বললেন, –” দুর পাগলি মেয়ে তুই তো তোর ভুল বুঝতে পেরেছিস। তোর সব অন্যায় ক্ষমা করে দিয়েছি সেই কবে।”
মিশমি বললেন, –” মা বাবা কি সন্তানের প্রতি রাগ করে থাকতে পারে। ”
বৃষ্টির চোখে পানি চলে আসলো কাঁদতে কাঁদতে বলল,–” আমায় ক্ষমা করে দাও তোমরা।”
তুষার সাহেব মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে– ” হয়েছে তো অনেক কেঁদেছিস এবার খেয়ে নে।”
বৃষ্টিকে মুখে তুলে খাইয়ে দেয় তুষার সাহেব। যখন থেকে বৃষ্টিকে চিনে নিজের সন্তানের মতোই তো আগলে রেখেছে তাকে। তন্নিকে আর তাকে কখনো আলাদা মনে করে নি তারা।
——————-
রুমে তন্নি আর রাদ বসে আছে। রাইদা অনেক আগেই ঘুমিয়ে গেছে। তন্নি কিছু একটা বলতে চাইছে রাদকে কিন্তু বলতে পারছে নাহ
রাদ বুঝতে পেরে বলে,–” মিসেস তন্নি আমাকে কি কিছু বলবে তুমি?”
তন্নি হাত মুচড়াতে মুচড়াতে বলে,–” ইয়ে মানে আসলে…”
রাদ হেসে বলল,–” তুমি এতো নার্ভাস হচ্ছো কেন?”
তন্নি অসহায় গলায় বলে, –” আমি কিছু বলতে চাই আপনাকে।”
রাদ বলে,–” বলো কি বলবে? ”
তন্নি পাশে থাকা গ্লাসের পানি পুরোটা এক ঢুকে খেয়ে ফেলে। তার গলা শুকিয়ে আসছে মনের কথা বলতে চাই সে রাদকে। বলতে চায় এ কয়দিনে রাদের সাথে থেকে তাকে ভালোবেসে ফেলেছে। তন্নি নিজেকে কিছুটা স্বাভাবিক করে বলে,–” ভালোবাসি রাদ সাহেব ”
রাদ অবাক হয়ে তাকায় তন্নির দিকে। তন্নি লজ্জায় মুখ লুকায় রাদের বুকে।
১১ মাস পর
হসপিটালে ওটির সামনে দাড়িয়ে দাড়িয়ে আছে রাদ,মিশমি, রিধি, রাইদা, তুষার সাহেব, বৃষ্টি আর বৃষ্টির হাসবেন্ড সয়ন। বৃষ্টিকে আবার বিয়ে দেয় মিশমি আর তুষার। সয়ন ছেলেটা ভীষণ ভালো এবং ভদ্র একটা ছেলে। আজ তন্নির ডেলিভারি তাই সবাই হাসপাতালে। রাদ এদিক ওদিক পায়চারী করছে আর পাগলামো করছে চুল গুলো এলোমেলো হয়ে গেছে চোখ গুলো লাল হয়ে আছে সে ভয় পাচ্ছে তন।নিকে হারিয়ে ফেলার। কিছু ক্ষণ পরে একজন নার্স বাচ্চাকে কোলে নিয়ে ভিতর থেকে বেরিয়ে আসে। সাথে ডাক্তার ও আসে। ডাক্তার রাদকে বলে,–” কংগ্রেস মিস্টার রাদ আপনার ছেলে হয়েছে। ”
রাদ খুশি হয়ে যায়। রিধি গিয়ে বাচ্চাকে নার্সের কোলে নেয়। রাদ ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করে, –” আমার ওয়াইফ কেমন আছে? ”
ডাক্তার বলল,-” ভালো আছে একটু পর কেবিনে দেওয়া হবে।”
——–
তন্নি চোখ বন্ধ করে বসে আছে। তার পাশেই দোলনায় বাবুকে শুইয়ে রাখা হয়েছে। রাদ এসে তন্নি আর বেবির মাঝখানের ফাঁকা জায়গাটায় বসে। রাদ এসেছে বুঝতে পেরে তন্নি চোখ খুলে। রাদ বলে,–” এখন কেমন লাগছে।?”
তন্নি বলল,–” ভালো বেবিকে দেখেছো?”
রাদ মাথা নাড়িয়ে বলে হ্যা। তন্নি বলল,–” একদম তোমার মতো হয়েছে তাই নাহ।”
রাদ মাথা নাড়িয়ে বলল,–” নাহ একদম আমাদের মতো।”
তন্নি হাসলো রাদ মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকলো। তন্নি বলল,–” পাগলামি করছিলে কেন?”
রাদ বলল,–” তুমি যে আমার খুশি ভয় হচ্ছিল হারিয়ে না ফেলি।”
তন্নি বলল,–” পাগল। ”
রাদ শক্ত করে তন্নির হাতটা নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে ধরল। তন্নি রাদের দিকে তাকালো এই লোকটা ছাড়া সে অসম্পূর্ণ। ওকে আকড়ে বাঁচতে চায় সারাজীবন। রাদ তন্নির দিকে তাকিয়ে কপালে আর ঠোঁটে চুমু খেলো। সে যেন তার প্রাণকে ফিরে পেয়েছে।
সমাপ্ত
গল্পটা বেশি বড় কারা ইচ্ছে আমার ছিল নাহ। আগে থেকেই ভেবে রেখেছিলাম গল্পটা ১৪ কি ১৫ পর্বই শেষ করে দিব। যাক গল্পটা হয়তো শেষের দিকে এলোমেলো করে ফেলেছি তারপরও যারা পাশে ছিলেন তাদের অসংখ্য ধন্যবাদ। গল্পটা কেমন লেগেছে জানাবেন। নতুন গল্প নিয়ে খুব শিঘ্রই ফিরবো।