বৃষ্টিভেজা_আলাপন (৪৩)

0
392

#বৃষ্টিভেজা_আলাপন (৪৩)

“কি পেলেন এই জীবনে?”

“একটি সুন্দর ভালোবাসার স্বাক্ষী হয়ে থাকার সৌরভ।”

“তারপর?”

“একটি ব্যক্তিগত উৎসর্গ।”

“আর তারপর?”

“সামনে এগিয়ে যাওয়ার মাধ্যম।”

“মাধ্যম!”

“হুম।”

“কি সেটা?”

“যদি বলি আপনি? খুব অবাক হবেন বুঝি?”

“একটুও না। তবে ভেঙে যাওয়া হৃদয় কি জোরা লাগানো যায়?”

“নতুন করে গড়ে নিবেন না হয়।”

স্মিত হাসল নাফিস। ওপাশ থেকে লাবণ্য’র মিষ্টি একটা নিশ্বাস ভেসে এল। মেয়েটা কথা গুলো নিছকই মজার ছলে বলেছে। তবে এই মজাটা যদি কখনো সত্যি হয় খুব কি ক্ষতি হবে? নাফিস ভেবে পায় না। তার তপ্ত হৃদয়ে এত কঠিন অনুভূতি ধরা দেয় না। শুধু মনে হলো সামনেটা মন্দ নয়।

লাবণ্য ফ্লাইটের টিকেট বুক করেছে। নানান ঝামেলায় পার হলো সাতটা দিন। উষশী এখনো সুস্থ নয়। সুস্থ নয় কোকো ও। তাদের দুজনেরই চিকিৎসা প্রয়োজন। অভি স্যুপের বাটি নিয়ে যাচ্ছিল। লাবণ্য বাঁধা দিয়ে বলল,
“আমি নিয়ে যাচ্ছি। যাওয়ার পূর্বে উষশী’র সাথে কিছু কথা বলে যাই।”

“ঠিক আছে।”

উষশী আধ শোয়া হয়ে ছিল। হাতে রিমোর্ট। টিভিতে নিউজ চলছে। বার দূর্ঘটনায় শতাধিক মানুষের মৃ ত্যু ঘটেছে। এখনো উদ্ধার কাজ শেষ হয় নি। ধারণা করা হয় মৃতের সংখ্যাটা দেড়শ ছাড়িয়ে যাবে। উষ্ণ শ্বাস বের হলো উষশী’র হৃদয় থেকে। সে টিভি অফ করে দিল।
“আজ চলে যাচ্ছি উষশী।”

“আবার কবে আসবে আপু?”

“হয়ত আর আসা হবে না।”

“কেন?”

“ফিরে গিয়ে হসপিটালে জয়েন করব। বিজনেস এর বিষয়টা অভি আর ঈশান ই দেখে নিবে।”

“ঈশানের কি খবর এখন?”

“বাড়ি ফিরেছে। তবে ধকলটা কাটিয়ে উঠতে পারে নি।”

লাবণ্য স্যুপের বাটিটা এগিয়ে দিয়ে ন্যাপকিন বিছিয়ে দিল। এক চামচ স্যুপ মুখে দিয়ে উষশী বলল,”জীবনের দীর্ঘ সময় একজনকে স্বার্থ নিয়েও ভালোবেসে যাওয়াটা সহজ নয়। সেখানে তোমার ভালোবাসাটা খাদহীন। মিস্টার রাগির প্রতি তোমার ভালোবাসার কোনো প্রতিদান হয় না আপু।”

লাবণ্য ঠোঁট প্রসারিত করল। তারপর ব্যাগ থেকে একটা পেন্ডেন্ট বের করে বলল,”এটা রেখে এসেছিলে। যত্ন করে কুড়িয়ে রেখেছি আমি। তোমাকে দেওয়া অভি’র প্রথম উপহার।”

এবার উষশী’র চোখে জল নেমে এল। সত্যি বলতে লাবণ্য’র প্রতি কখনোই ক্ষোভ ছিল না ওর। এমনকি লাবণ্য যখন মেকাপের বিষয়টা ঘটাল তখনো বিষয়টা পুরোপুরি গোপন করে রেখেছিল। মেয়েটির প্রতি ওর ভালোবাসাটা আসলেই মিথ্যে নয়। উষশী’র খুব ইচ্ছে হলো লাবণ্যকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরার। তেমনটাই করল সে। লাবণ্য হেসে উঠল। পিঠে হাত বুলিয়ে বলল,
“জীবনে সুখী হও। ভালোবাসায় ভালো থাকো। তোমাদের জীবনে প্রতিটা দিনে বৃষ্টি নামুক। আর সেই বৃষ্টিতে রাঙিয়ে যাক প্রহর।”

উষশী কথা বলতে পারল না। তার চোখ ভেঙে জল নামতে চাইছে। লাবণ্য ফের বলল,”তোমার প্রতি আমার করা অন্যায়টা অভিকে না বলার জন্য সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকব উষশী। আমার একত্রিশ বছর বয়সে এসে আমি তোমায় বিজয়ী ঘোষণা করলাম। হার মেনে নিলাম তোমাদের প্রণয়ে।”

লাবণ্যকে এয়ারপোর্টে ছাড়তে এসেছিল অভিরাজ। মেয়েটা ওর জন্যে অনেক করল। এই ভালোবাসাটা অভি ভুলবে না। শেষবেলা তে এসে কান্নায় ভেঙে পড়ল লাবণ্য। অভি’র দু হাত জড়িয়ে বলল,”তোর ভালোবাসাটা অন্তত পূর্ণ হোক অভি। এত গুলো বিচ্ছেদের যন্ত্রণা আসলেই নিতে পারছি না। একটা কেউ অন্তত ভালো থাকুক।”

অভি প্রসারিত হীন হাসল। লাবণ্য’র মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,”সাবধানে যাস।”

“খুব দ্রুত তোদের দেখতে চাই।”

“দেখবি।”

“নিজেদের যত্ন নিস।”

“নিব।”

“কোকো’র খেয়াল রাখিস।”

“রাখব।”

লাবণ্য’র কথা ফুরিয়ে গেল। অভিরাজ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। মেয়েটিকে যতক্ষণ দেখা গেল তাকিয়ে রইল সে। লাবণ্য এমন এক চরিত্র যে চরিত্রের পূর্ণতা নেই। নেই কোনো প্রাপ্তি। নেই কোনো বিশেষ অবস্থান। এত নেই এর মাঝেও মেয়েটি যেন অনেক কিছু হয়ে রইল অভি’র জীবনে।

উষশীকে ধীর স্থির ভাবে উঠাল অভিরাজ। ক্লান্ত তার শরীর। পা ফেলার মতো শক্তি নেই শরীরে। অভি ধরে ধরে চলতে সাহায্য করছে।
“লাবণ্য আপু ফ্লাইটে উঠে গিয়েছে তাই না?”

ঘড়ির দিকে তাকিয়ে অভি বলল,”হুম।”

“এখন নিশ্চয়ই ডেনমার্ক পেরিয়ে গেছে।”

“যেতে পারে।”

“কয়েক মুহূর্তেই কত দূরে চলে গেল।”

“হুম।”

পূর্ণ নজরে তাকাল উষশী। অভি’র মনটা বিশেষ ভালো দেখাচ্ছে না। যুবতী তার নরম তুলতুলে হাতে ছেলেটার গালে স্পর্শ করল।
“লাবণ্য আপুর জন্য কষ্ট হচ্ছে তাই না?”

“হুম।”

“এত গুলো বছর ধরে আপনার পাশে ছিল। ভরসা হয়ে ছিল। খারাপ লাগাটাই তো স্বাভাবিক অভিরাজ।”

“নিজেকে ক্ষমা করতে পারছি না উষশী। মনে হচ্ছে কোথাও একটা ভুল করে ফেলেছি।”

“ভুল করেন নি আপনি। আমার দিকে তাকান তো।”

অভি তাকাল। উষশী’র ঘোলাটে দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে সব যেন ভুলে বসল পুরুষটি। উষশী একটু কাছিয়ে এসে বলল,”লাবণ্য আপু এবার ভালো থাকবে। আপনি সর্বদা চেয়েছেন সে নিজের জীবন গুছিয়ে নিক। কিন্তু সে চেয়েছে আগে আপনার জীবনটা গুছিয়ে যাক। এবার সব ঠিক হবে অভিরাজ।”

মেয়েটার নরম তুলতুলে হাতে চুমু খেল অভিরাজ। তারপর বলল,”তেমনটাই যেন হয় উষশী।”

নিজের মা বাবা’র ছবিতে হাত বুলাচ্ছে উষশী। এখন মধ্যরাত কিংবা তার ও বেশি। মেয়েটি একদমই শূণ্য হয়ে গেল। তার ঘোলাটে চোখ আরো বেশি ঘোলাটে হতে শুরু করেছে। ওর ঠিক বরাবর বসে আছে অভিরাজ। ছেলেটা এতদিনেও মেয়েটিকে কোনো প্রশ্ন করে নি। কখনো করবে না বলেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। উষশী’র অতীত নিয়ে বিশেষ কোনো মাথা ব্যথা নেই। তবে উষশীই তাকে ডেকেছে। মেয়েটি কেন ডেকেছে এখনো পরিষ্কার নয়। অভি অনেকটা সময় চুপ থেকে বলল,
“উষশী,ভেঙে পড়লে চলবে? তুমি তো খুব স্ট্রং গার্ল তাই না?”

“ভেঙে পড়ছি না অভিরাজ।”

“বারান্দায় যাবে? বৃষ্টি হচ্ছে।”

উষশী তাকিয়ে দেখল আসলেই বৃষ্টি হচ্ছে। আকাশ থেকে থেকে চমকাচ্ছে। চারপাশ থেকে কেমন ভেজা গন্ধ আসছে। তবু মন ভালো হলো না মেয়েটির। অভি ধীর স্থির ভাবে মেয়েটিকে উঠাল। ছেলেটার হাতে ভর করে পথ চলতে চলতে উষশী বলল,”এই জীবনে আবার আপনার হাত ছুঁতে পারব কখনোই কল্পণা করি নি। একটা সময় পর মনে হয়েছিল এ জীবনটাকে শেষ করে দেই।”

মেয়েটার মুখে প্রাণ না শের কথা শুনে কম্পন ধরে গেল অভি’র শরীরে। সে বিশেষ কোনো কথা না বলে গিলে নিল অনুভূতি।
“বৃষ্টিটা সুন্দর।”

“হুম।”

“মনে আছে আপনার, বৃষ্টির দিন গুলো আমাদের জন্য কতটা সুন্দর ছিল।”

“সব সময় মনে থাকে উষশী।”

“ডেনমার্কের বৃষ্টি আমার জীবনের সব থেকে খারাপ সময় ছিল।”

উষশী’র শরীর থেকে অদ্ভুত একটা উষ্ণতা বাইরে ছেঁয়ে গেল। অভি অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। সে খুব একটা মন দিতে পারছে না। মন চাইছে সেই দিন গুলোতে ফিরে যেতে। এত সময় উষশীই কথা বলেছে। এখন অভি বলল,
“তোমাকে হারিয়ে আমার জীবন থেমে গিয়েছিল রেইন। আমিই বলতাম কারো জন্য জীবন থেমে থাকে না। অদ্ভুত ভাবে এই অভিরাজের জীবনটাই থেমে গিয়েছিল।”

উষশী তাকাল না। সে চোখ বন্ধ করে নিচু হয়ে আছে। বৃষ্টির পরিমাণ বেড়ে গেল। কিছু পানি হাতে মেখে নিল অভিরাজ। তারপর ধীর স্থির ভাবে মেয়েটির মুখ উঁচু করল। উষশী’র দু চোখে কান্না নেমেছে। অভি’র চোখেও জল। একে অপরকে পেয়ে যাওয়ার পরেও বুকটা অশান্ত হয়ে আছে। কেন এত ব্যথা? এর উত্তর ছিল না। অভিরাজ মেয়েটার নরম কোমল হাত মুঠোয় নিয়ে বৃষ্টির জল লাগাল।
“ভালো লাগছে?”

“হুম।”

একটু থেমে রইল উষশী। তারপর বলল,”বুকে মাথা রাখি?”

মেয়েটির কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথে নিজেই কাছে টেনে নিল অভিরাজ। ওর শরীরের গন্ধটা পেয়ে যেন একরাশ স্বস্তি পেল উষশী। তারপর অনেকক্ষণ ওভাবেই থেমে রইল। খানিক বাদে বৃষ্টিও থেমে গেল। চারপাশে সদ্য ঝরে যাওয়া ফুলের ঘ্রাণ ভেসে বেড়াচ্ছে। পাখির কলতান আর ভেজা মাটির সৌরভ। সব কেমন সুন্দর লাগছে। অভি মেয়েটির মুখটা উঁচু করে দু হাতে আবদ্ধ করে নিল। বেশ সময় নিয়ে দেখে নিচ্ছে নিজ প্রিয়তমাকে। পাঁচ বছরের তৃষ্ণা এক রাতের দর্শনে কি শেষ হয়?

চলবে…
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি

| আমি এইচ এস সি পরীক্ষার্থী। কতটা প্রেসারে আছি বলে বোঝানো যাবে না। যাই হোক আর মাত্র দুটি পর্ব হবে।|

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here