#হিমাংশুর_জলপদ্ম [৪]
#সাদিয়া_আক্তার_জ্যোতি
হিমাংশু ও তার দিদি মুখমুখি বসে আছে।দিদি সুপ্রিয়া সবকিছু শুনে বিস্ময় চোখ নিয়ে কুমুদের দিকে তাকালো।কুমুদ তাদের থেকে একটু দূরে দরজার ধারে দাঁড়িয়ে আছে।সুপ্রিয়া হাতের ইশারায় কুমুদকে ডাকলো।কুমুদ দীর পায়ে সুপ্রিয়ার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই সে হাত টেনে কুমুদকে তার পাশে বসিয়ে দিয়ে গালে হাত দিয়ে বললো,
– এতো সুন্দর মায়াবী মেয়েটাকে কিনা ওরা চিতায় তুলে দিচ্ছিল?তুই যা করেছিস খুব ভালো করেছিস ভাই।
– দিদি আমাকে তো পড়ালেখার জন্য শহরে যেতে হবে। ও তোমার কাছে থাক।
– সে থাক তাতে কোনো সমস্যা নেই।কিন্তু তুই কোথায় থাকবি রে ভাই?
– আমি কোনো এক বন্ধুর সাথে থেকে নেব।
– খাবি কি তুই?টাকা আছে?
– কোনো এক ছাত্র ছাত্রী খুঁজে নেব।সেখান থেকে যা পাবো তাই দিয়েই খাবো।তুমি এতো চিন্তা করো না তো।
সুপ্রিয়া কিছুক্ষণ ভেবে আমতা আমতা করে বললো,
– শোন ভাই একটা কথা বলি?
হিমাংশু ভ্রুযুগল কুঁচকে তাকালো তার দিদির চোখের দিকে।তার দিদির চোখে দেখতে পেল এক রাশ দ্বিধা দ্বন্দ্ব। তাই সে তার দিদিকে আশ্বাস দিয়ে বললো,
– হ্যা রে দিদি বল না এতো আমতা আমতা করছিস কেন?
– বলছি এভাবে মানে বিয়ে তো এভাবে হয় না।তাই আরকি বলছিলাম কি করবি?সামনে কি করার চিন্তা ভাবনা আছে?
কুমুদ চুপচাপ মাথা নত করে দাঁড়িয়ে হিমাংশু ও তার দিদি সুপ্রিয়ার কথোপকথন শুনছে।হিমাংশু মাথা তুলে নিশ্চুপ দাড়িয়ে থাকা কুমুদের দিকে তাকিয়ে একপলক দেখলো।অতঃপর একবুক আত্মবিশ্বাস নিয়ে বললো,
– একবার যখন ওর দায়িত্ব নিয়েছে হিমাংশু।ওকে মাঝপথে ছেড়ে দিবে না এ আশা তুমি রাখতে পারো দিদি।
অবাক চোখে হিমাংশুর দিকে তাকিয়ে আছে কুমুদ। এই ছেলেটি কেন তার জন্য এতো করে?কি লাভ তার?সে কেনই বা তাকে বাঁচালো। কেনই বা তার দায়িত্ব নিজের এই ছোট ছোট দুটো কাঁধে তুলে নিল?তার দায়িত্ব তো সে যাদেরকে আপন ভেবেছিল তারাও নেয়নি।তাহলে এই জাতপরিচয়হীন মেয়ের দায়িত্ব এই অপরিচিত ছেলেটি কেন নিচ্ছে?ছেলেটি কি একটু বেশিই পরোপকারী? নাকি শুধু মাত্র সে বলেই এতো কিছু করছে?
সুপ্রিয়া ভাইয়ের থেকে এমন একটা কথায় শুনতে চেয়েছিল।আশানুরূপ উত্তর পেয়ে সে মুখে মিষ্টি হাসি ঝুলিয়ে হিমাংশুর উদ্দেশ্যে বললো,
– আচ্ছা বেশ তাহলে তুই যখন পরের বার আসবি তখন আমি তোদের সব রীতিনীতি মেনে বিয়ে দেব।এখন বল কি খাবি?
– কিছু খাবো না দিদি আমাকে তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে।
– কি বলছিস?একদিন থাকবি না?
কুমুদ এখানে হিমাংশু ছাড়া কাউকে চিনে না।সুপ্রিয়াকে তার ভালো লেগেছে তবে সে এই মুহুর্তে হিমাংশুকে ছাড়া কাউকে ভরসা করতে পারছে না।তাই এখন হিমাংশুর যাওয়ার কথায় সে একটু ভীত হলো।ভীত স্বরেই বললো,
– একদিন থেকে যান না।
বলেই মুখটা দু’হাতে চেপে ধরলোক।সুপ্রিয়া দুষ্টু হেসে একবার হিমাংশুকে দেখছে তো একবার তার পাশে লাল শাড়িতে দাড়িয়ে থাকা কুমুদকে।শাড়িটা সেই দিয়েছে পরতে।লাল শাড়ি কুমুদের ফর্সা শরীরে বেশ মানিয়েছে।হিমাংশু কুমুদের দিকে একদপলক দেখে তার দিদিকে আমতা আমতা করে বললো,
– তুমি এতো করে যখন বলছো তখন একদিন থাকি।
সুপ্রিয়া শব্দ করে হেসে দিলো।তার ভাইয়ের ডান গাল টেনে বললো,
– এতোবার কই বললাম?একবারই তো বললাম।
হিমাংশু ঠোঁট উল্টিয়ে বললো,
– তাহলে চলে যায়?
– থাক আর ঠোঁট উল্টানো লাগবে না।থাক একটা দিন বউয়ের সাথে।আমার সমস্যা নেই।
সুপ্রিয়ার বলা কথায় লজ্জায় মাথা নত করে ফেললো কুমুদ। হিমাংশুও লজ্জা পেল।প্রসঙ্গ পাল্টাতে বললো,
– দিদি খুব খিদে পেয়েছে।জানো কতটা পথ হেটে এসেছি?কিছু খেতে দাও না।
সুপ্রিয়া ভাইয়ের এমন কাতর কন্ঠ শুনে কেঁপে উঠলেন।তড়িঘড়ি পাক ঘরে চলে গেলেন ভাইয়ের জন্য কিছু রান্না করতে।একটু পর তার স্বামীও চলে আসবেন।তার জন্যও খাবার তৈরি করতে হবে।সুপ্রিয়া চলে যেতেই কুমুদও তার পিছন পিছন এসে পাকঘরের দরজায় দাঁড়ালো। সুপ্রিয়া অবাক কন্ঠে বললো,
– এমা তুমি এখানে কেন?হিমাংশুর কাছে গিয়ে বসো।
কুমুদ ইতস্তত করে বললো,
– না থাক আমি এখানে দাঁড়ায়।
– যেমন তোমার ইচ্ছে।
কুমুদ চুপচাপ দাঁড়িয়ে চারিপাশে চোখ বুলাচ্ছে।বাড়িটা খুব ছোট।গ্রামে এমন দালান বাড়ি খুব কমই দেখা যায়।দুই কক্ষের একটা বাড়ি সাথে সামনে একটা খোলা বারান্দা।পয়ঃনিষ্কাশনের ব্যবস্থা বাড়ির পিছনে দুকদম হেঁটে।কুমুদ অবশ্য সেদিকে এখন যায়নি।তবে প্রয়োজন হলে যাতে খোঁজার দরকার না হয় তাই সুপ্রিয়া আগে থেকেই বলে রেখে।এখনও পর্যন্ত সুপ্রিয়াকে একাই দেখেছে বাড়িতে।আর কেউ নেই।তবে কিছুক্ষণের মধ্যে হয়তো তার স্বামী এসে উপস্থিত হবে।
বারান্দায় মেঝে তে আসন করে বসে আছে হিমাংশু।বাড়িতে ঢুকেই হিমাংশুকে দেখে ভ্রু কুঁচকায় দ্বীপ।কাছে এসে জিজ্ঞেস করে,
– কি গো শ্যালক? মার সাথে আবার ঝগড়া করেছো বুঝি?
দ্বীপের কন্ঠে হিমাংশু মাথা তুলে দ্বীপকে উদ্দেশ্য করে বললো,
– না গো জামাইবাবু।বউ নিয়ে দিদির বাড়ি এলাম বেড়াতে।
দ্বীপের চক্ষু চড়কগাছ। বিষ্ময় কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
– কি কও?বউ?
– হ্যাঁ গো জামাইবাবু।তবে বিয়ে করে একটা দুঃখে আছি।
– কি দুঃখ?
– বিয়ে করেছি তো বটে তবে বউকে বউ করতে পারলাম না।
দ্বীপের মাথা গুলিয়ে গেল।সে মাথা চুলকে বললো,
– মানে?
– এখন থাক পরে একসময় বেশ সময় নিয়ে ব্যাপারটা বুঝাবো তোমায়।এখন বলো তোমার কি অবস্থা?
– আমার?এই তো চলছে বেশ।
– যাক ভালো।
কথাটা শেষ করতেই হিমাংশুর সামনে এক থালা ভাত আর আলুর তরকারি রাখলো কুমুদ। হিমাংশু একবার কুমুদের হাতে দিকে চেয়ে তারপর থালার দিকে চায়লো।কুমুদ দ্বীপকে দেখে তড়িঘড়ি মাথায় ঘোমটা দিলো।দ্বীপ কুমুদকে ভালো করে পরখ করে দেখে বললো,
– তা এই বুঝি আমার শ্যালকের বউ?
হিমাংশু ভাত মেখে একদলা মুখে তুললো।মুখে ভাত নিয়েই বললো,
– ওর নাম কুমুদ।
– বেশ ভালো নাম।
কুমুদ দ্বীপকে প্রণাম করলো।দ্বীপ হিমাংশুকে পেট পুরে খাওয়ার কথা বলে সুপ্রিয়ার উদ্দেশ্যে গলা উঁচিয়ে বললো,
– কই গো প্রিয়া তাড়াতাড়ি ভাত বারো আমি একটু তাল পুকুর থেকে ডুব দিয়ে আসি।ঘামে ভিজে গেছে যে সারা শরীর।
সুপ্রিয়া গামছা হাতে দৌড়ে বেড়িয়ে এসে গামছাটা দ্বীপের হাতে দিলো।দ্বীপও চলে গেল তাল পুকুরের উদ্দেশ্যে।
জোছনা রাতে রাতের অন্ধকারে বারান্দায় শুয়ে আছে হিমাংশু।ইদানীং মশার উৎপাত হয়েছে বেশ।ঝিঁঝি পোকারা প্রকৃতিকে তাদের প্রতিভা প্রমানে ব্যস্ত।হিমাংশু ঝিঁঝি পোকার ডাক বেশ পছন্দ করে।তবে আজ যেন আরও ভালো লাগছে তার।একটি ছোট্ট ঠোঙা থেকে এক থোকা লাল কাঁচের চুড়ি বের করলো সে সাথে একজোড়া শাখা পলা।তখন ভাত দেওয়ার সময় কুমুদের খালি হাত হিমাংশুর হৃদয়ে বিষের মতো লেগেছে।তাই আজ পাশের গ্রামের বসা হাট থেকে এগুলো কিনেছে সে।কাল যাওয়ার সময় কুমুদের হাতে চুড়িগুলো আর শাখা পলাটি পরিয়ে দিবে।বাতাসে এক অদ্ভুত ঘ্রাণ ছোটাছুটি করছে।সম্ভবত এটি মাধবী লতা ফুলের ঘ্রাণ। বেশ লাগছে ঘ্রাণটা হিমাংশুর কাছে।আজ অন্য দিনগুলোর তুলনায় রাতে শীত নেই বরং ভ্যাবসা গরম অনুভূত হচ্ছে। কাঁচের চুড়িগুলো বা হাতের তর্জনির সাহায্যে কয়েকবার নাড়িয়ে বেশ এক সুন্দর শব্দ সৃষ্টি করলো হিমাংশু। অতঃপর চুড়িগুলো বাঁলিশের পাশে রেখে।আোখ বন্ধ করলো নিদ্রার অপেক্ষায়।
সকাল সকাল হিমাংশুর শহরে যাওয়া তড়ঝোড় চলছে।সুপ্রিয়া কয়েকটা ছোট বাক্সে করে হিমাংশুর আজকের খাবার দিয়ে দিলো।দরজার পাশে দাঁড়িয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে হিমাংশুর যাওয়ার প্রস্তুতি দেখছে কুমুদ। সবকিছু গুছিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে উঠে দাঁড়ালো হিমাংশু।কুমুদ কেমন করুণ চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে।হয়তো চোখের দৃষ্টিতে বোঝাতে চায়ছে আমাকে একা রেখে যাবেন না দয়া করে।হিমাংশুর সে চাহনিতে মায়া হলো।সে হাতের ইশারায় কুমুদকে নিজের কাছে ডাকলো।কুমুদ গুটি গুটি পয়ে হেঁটে তার সামনে গিয়ে দাড়াতেই সে তার পাঞ্জাবির পকেটে থেকে একজোড়া শাখাপলা নিয়ে প্রথমে ডান হাত তারপর বাম হাতে পরিয়ে দিলো।অতঃপর রক্ত জবা লাল টুকটুকে একগুচ্ছ চুড়ি পরিয়ে দিলো কুমুদের হাতে।কুমুদ অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নিজের হাতে দিকে।হিমাংশু গম্ভীর কন্ঠে বললো,
– কাল ভাতের থালা দেওয়ার সময় দেখলাম হাত খালি।তাই হাট থেকে চুড়িগুলো খুললাম।তোমার হাত খালি আমার ভালো লাগেনি।
কুমুদের মুখে কোনো কথা নেই সে শুধু অবাক চোখে হিমাংশুর দিকে চেয়ে আছে।হিমাংশু পুঁটলি হাতে নিল যাওয়ার উদ্দেশ্যে।বাড়ির দরজা পেরিয়ে কয়েক কদম যেতেই পিছন থেকে সহসা কুমুদ বলে উঠলো,
– সাবধানে যাবেন।
হিমাংশুর পা থেমে গেল।তবে সে ঘাড় ঘুরিয়ে পিছন ফিরে কুমুদের চোখে চোখ রাখলো না।বরং পায়ের গতি দ্বিগুণ করে রওনা হলো নিজের গন্তব্যের উদ্দেশ্যে।
চলবে…
(রিচেক করিনি ভুল হলে ক্ষমা করবেন।)