চারবছর পর বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখলাম। শরীরের সব লোম দাড়িয়ে উঠলো। এই বাংলাদেশ আমার জন্মভূমি হলেও, এর সাথে রয়েছে জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতা। ভালোই যাচ্ছিলো কানাডাতে দিনগুলি। কিন্তু আজকে ঘন্টাখানেক আগে শুনলাম আমার দাদু নাকি খুব অসুস্থ তাই তাকে দেখতে আসলাম। এয়ারপোর্টে আমার জন্য গাড়ি আসিনি কারণ দাদুকে নিয়ে বাড়ির সকলেই ব্যস্ত। আসার কিছুক্ষণ আগে শুধু আমার আম্মাকে ফোন করেছিলাম। হয়তো তিনি বলার সুযোগ পান নাই আমি আসছি বাংলাদেশে। একটা টেক্সি ভাড়া করে সোজা দাদুকে দেখতে গেলাম ধানমন্ডি ল্যাবএইড হসপিটালে। আম্মুর কাছে শুনেছিলাম দাদুকে নাকি ৬ তলার ৬১৭ নম্বর কেবিনে রাখা হয়েছে তাই লিফট ব্যবহার করে উপরে উঠতে হবে। কারণ আমার সিড়ি বেয়ে চলার অভ্যাস টা কমে গেছে। লিফটে ঢুকলাম। লিফট বন্ধ করতেই কেউ একজন লিফটের দরজায় হাত দিয়ে দরজা ওপেন করে দিলো। আমি তার চেহেরা দেখতেই ঘামতে শুরু করলাম।
” এইযে বৃষ্টি বাবুকে নিয়ে তাড়াতাড়ি আসো। ”
” হ্যা যাচ্ছি আকাশ! ”
বৃষ্টি আর বৃষ্টির মেয়েকে ভিতরে ঢুকিয়ে দিলো আকাশ। এরপরে নিজে ভিতরে ঢুকে লিফটের দরজা বন্ধ করলো। দরজা বন্ধ করে আকাশ ডানে বামে মানুষ দেখছিলো। হঠাৎ করে নীলার মুখ দেখে আকাশের মুখ পান্ডুর হয়ে গেলো। হঠাৎ করে বিদ্যুৎ চলে যায়। আকাশরা ৩ তলায় যেয়ে আটকে যায়।লিফটের ভিতরে সবাই ঘামা শুরু করছিলো। নীলার আবার অ্যাজমা আছে। নীলা হাসপাস করতে লাগলো। মাংশপেশিতে টান অনুভব করতে লাগলো তাই সে লিফটের ওয়াল ঘেষে বসে পড়লো।
” কি হয়েছে নীলা তোমার। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। তোমার ব্যাগে ইনহেলার নাই। ”
নীলা কোনো কথা বলছে না শুধু হাসপাস করতে লাগলো।
” বৃষ্টি দ্রুত বাবাকে ফোন করো। আমরা এইখানে আর কিছুক্ষণ থাকলে দমবন্ধ হয়ে মারা যাবো। ”
” হুম করছি আপনি ওয়েট করুন। ”
” আকাশ দেখলো নীলার অবস্থা খুব খারাপ হয়ে যাচ্ছে। নিজের প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে ইনহেলার বের নীলার কাছে গিয়ে ধরলো। আকাশের আঙুলের স্পর্শ মুখে লেগে শিহরণ উঠলো নীলার। নীলা দ্রুত টান মারলো ফুসফুসে যেই ওষুধ গেলো ওমনি শ্বাসকষ্ট দূর হলো। ”
লিফট অন হয়ে গেলো। কারণ বৃষ্টি এতক্ষণে আমজাদ আহমেদকে ফোন করে আইপিএস অন করে লিফট চালু করে দিছে।
” বাবা তুমি কি এই আন্টিকে চিনো? ”
” সাফা মামুনি আমরা চলে আসছি। অন্যকথা পরে হবে চলো যাই। ”
বৃষ্টি ও সাফা লিফট থেকে বের হয়ে সোজা কেবিনে চলে গেলো।
আকাশ লিফট থেকে বের হয়ে জিজ্ঞেস করলো ___
” কেমন আছো নীলা? ”
” প্রাক্তনের মুখে এই কথা শুনে নীলা আড়চোখে আকাশের দিকে তাকায়। এরপরে বলে ভালো আছি আকাশ। আপনি কেমন আছেন?”
” আমাকে তো দেখতেই পাচ্ছো লাইফে কতোটা এগিয়ে গেছি। ”
” হুম! বাই দ্যা ওয়ে আপনার মেয়েটা অনেক কিউট কিন্তু? আমার দেওয়া নামটাই রেখেছেন দেখছি। কতবছর বয়স হলো আপনার রাজকন্যার। ”
” প্রিয় মানুষের স্মৃতি কিছুটা থাকুক আমার সাথে। সাফার বয়স তিনবছর। ”
নীলা এবার চোখটা বন্ধ করে ফেললো। কিছু একটা অনুভব করে বললো, আমি আশা করি নাই চারবছর পর আমাদের এইভাবে দেখা হবে।
” আমিয়ো ভাবতে পারিনাই তুমি আসবা বাংলাদেশে। ”
” ধন্যবাদ আকাশ আপনাকে। এখনো ইনহেলার পকেটে নিয়ে ঘোড়েন দেখি। বউয়ের শ্বাসকষ্ট আছে নাকি? ”
” নীলার এই প্রশ্নে আকাশের নিঃশ্বাস বুকের সাথে টান অনুভব করলো। এরপরে বললো এটার স্মৃতি ভোলার নয়। হ্যা বৃষ্টিরো অ্যাজমা আছে। ”
সাফা দৌড়ে আসলো কেবিন থেকে।
” বাবা ত ত তুমি এখনো এইখানে দা দা দাড়িয়ে আছো। আমি চি চি চিপস খাবো নিচে নিয়ে চলো। ”
” আকাশ আলতোভাবে সাফার গাল টেনে বললো হ্যা মামুনি চিপস দিবো তো। আন্টিকে হাই বলো। ”
” না আগে চিপস তারপরে হাই বলবো। ”
আকাশ নীলাকে বললো —
” আসি নীলা! ”
নীলা কিছু বলতে পারলো না। শুধু আকাশের দিকে চেয়ে রইলো। আকাশ সাফাকে কোলে নিয়ে আবার নিচে গেলো।
নীলার দম বন্ধ বন্ধ লাগছে। হঠাৎ করে প্রিয় মানুষটার সাথে চারবছর এভাবে দেখা হবে ভাবতে পারে নাই। যারজন্য কানাডায় এতোদিন থেকে থাকলো। বাংলাদেশে আসতে না আসতেই তার সাথে প্রথম দেখা। নীলা মনে মনে বললো খুব ভালো থেকো আকাশ। এখন কেবিনে আত্নীয় দিয়ে ভরপুর। শুনেছি দাদুকে আজকেই বাড়িতে শিফট করবে। সবার সামনে আমি এভাবে যেতে পারবো না। দাদুকে বাড়িতে সবার চোখের আড়ালে দেখবো। নীলা দ্রুত হসপিটাল ত্যাগ করলো। সোজাসাপটা ওইখান থেকে বাড়িতে চলে আসলো।
দিলারা খান নীলাকে দেখে মা মা বলে চিৎকার দিয়ে দৌড়ে ধরলো।
এরপরে দিলারা খান বললো ___
” এতদিন পর আম্মা, বাবা ও দাদুকে মনে পড়লো। ”
” বাবার সাথে প্রায় দেখা হয় আম্মা। তোমাকে তো কানাডা আসতে বলতাম তুমি যাইতা না। তুমিতো ভালো করেই জানো আমি ক্যানো বাংলাদেশে আসিনা? কিন্তু আসতে না আসতেই সেই প্রতারকের সঙ্গেই আগে দেখা হলো। ”
” দিলারা খান মন খারাপ করে বললো, সব তোর বাবা ও ফুফি আম্মুর দোষরে মা। আকাশের কোনো দোষ নেই? ”
” মা আমি এই টপিকে কথা বলতে চাইনা। দাদুকে বাসায় আনলে জানাইয়ো। আমি নিজের রুমে একা থাকতে চাই কিছুক্ষণ? ”
” হ্যা যাও তুমি। ”
” আকাশ সাফাকে নিয়ে কেবিনে ঢুকে দেখলো নীলা নেই। নীলাকে চারদিকে দেখতে লাগলো একজোড়া চাতক পাখির চোখ দিয়ে। আকাশ রুমে তার মা রেহেনা ও বাবা আমজাদ নীলার বাবা আশফাকুল ও বৃষ্টিকে ছাড়া কাউকে দেখতে পেলোনা। ”
বৃষ্টি বললো ___
” কাউকে খুঁজছেন আকাশ। ”
” না! ”
এরপরে হসপিটালের সব ফর্মালিটি মেইনটেইন করে আশফাকুল খান ও রেহেনা তার বাবাকে নিয়ে বাসায় রওনা হলো।
আশফাকুলের বাবা ও নীলার দাদা বললো ___
” তোরা এখনো দুই ভাই বোন কথা বলবি না! ”
” এই কথা শোনে আশফাকুল ও রেহেনা দুজনের দিকে চাওয়াচাওয়ি করে। কিন্তু কোনো কথা বলেনা? ”
” আমি মরে গেলে তোদের শান্তি তাইনা। অতীত টাকে ভূলে এই বৃদ্ধ বাবার মুখ চেয়ে তোরা কি পারিস না আবার একত্রে হতে। ”
আশফাকুল খান বললো ___
” বাবা আমি ওর বড় ভাই হয়ে সেদিন ওর ছেলেকে আমার মেয়ের জামাই হিসাবে অফার করেছিলাম। কিন্তু ও ছিলো সুযোগসন্ধানী মহিলা আমার মেয়ের জীবনটাকে নষ্ট করেছে। ওর কারণে আমার একমাত্র মেয়ে বছরের পর বছর কানাডায় পড়ে থাকে। ”
” ভাইয়া আমার মুখ খোলাবে না কিন্তু। কেনো আমি এইরকম করেছি ভালো করে জানো । বোন হই তোমার বারবার মহিলা বলছো কাকে। ভালোবাসাকে না পাওয়ার যন্ত্রণা যে কতটুকু সেটাই তোমাদের বুঝাতে চাইছিলাম। সেই দহন তোমাকে অনুভব না করালে কিসের আমি খান বংশের মেয়ে। ”
” চুপ কর তুই। অনেকদিন পর তোর সাথে কথা বলছি মানে এই না যে আমার দাম্ভিকতা কমে গেছে। কোনো কিছু হয়নাই আমার মেয়ের। আমার মেয়ে কানাডা থেকে বাংলাদেশ আসছে। দাওয়াত দিবো ধুমধাম করে এসে বিয়ে খাস। আর হ্যা তোর ছেলে আকাশকেও নিয়ে আসিস। প্রতারক একটা। ”
” খবরদার আমার ছেলেকে প্রতারক বলবি না। ও আমার বাধ্যগত সন্তান। যাই বলি তাই শোনে। এরকম ছেলে পাওয়া সৌভাগ্যের ব্যাপার। যেটা তোমার মেয়ে না। ”
” এইবার আশফাকুলের বাবা ধমক দেয় তোরা থামবি। এতদিন পর কথা বলছিস দুটো ভালো কথা বলতে পারিস না। ”
” বাবা তোমার ছেলেকে বলো অতীতকে না টানতে সে ভালো করেই জানে। যেই দহনে আমি পুড়েছি সেই দহনে ওদের সবাইকে জ্বালাইছি। ”
” নির্লজ্জ! তোর ছেলে এমন কাকে বিয়ে করলো। এই তোর বাধ্যগত সন্তান। বাচ্চা সহকারে বউ নিয়ে আসলো তোর ঘরে। তোর ছেলে এইটাই ডির্জাভ করে জানিস। ”
” খবরদার! আমার ছেলেকে নিয়ে কথা বলবা না। সে এক বিধবা মেয়ের সমাজে থাকার গতি করে দিছে। যা জানো না তা নিয়ে কথা বলবা না। কজন ছেলে পারে এমন কাজ করতে। ”
” চুনকালি মেখে দিলে সবাই এভাবে বলে। প্রথম প্রথম যে ভালোই নাটক করছিলি। এ বউ মানবো না, হঠাৎ করে তোর কি হলো। হাহা মেয়ে বাংলাদেশে আসছে কবজি ডুবিয়ে খেতে আসিস। নিজের ছেলের বিয়ে তো খেতে পারিস নাই। আমার মেয়ের বিয়ে খেয়ে এই আফসোস টা মিটাস। ”
” তোরা দুজন বুড়া-বুড়ি হয়ে গেলি তবুও জ্ঞান হবেনা তোদের। আমায় গাড়ি থেকে নামা। ”
চলবে,,,,
#দহন
#রিয়া_জান্নাত
#সূচনাপর্ব