#আমি_মায়াবতী
#পর্ব_৯
#লেখনীতে_তাহমিনা_মিনা
°আজ আমাদের বিয়ে সম্পন্ন হলো। কত স্বপ্ন ছিল আমার বিয়ে নিয়ে। তার কোনো কিছুই পূরণ হলো না। সে কিছুক্ষণের জন্য এসে সাইন করে দিয়েই চলে গেল। আমরা কেউ কবুল বললাম না। কেউ আলহামদুলিল্লাহ বললো না। কেউ আমাদের জন্য দোয়াও করলো না। ছোট বোন বলেছে আমরা নাকি অন্য জায়গায় গিয়ে থাকবো। আমার সাথে নাকি মা থাকবে। ওরা কেউ থাকবে না। আমাকে এক রুম ভাড়া করে রাখবে। সে সাইন করেই চলে গেল। যাওয়ার আগে বলে গেল, সে সবচাইতে খুশি হতো যদি বাচ্চাটাকে এবোর্শন করতাম আমি। কিন্তু আমি সেটা করবো না। বাচ্চার জন্য নয়। ওকে নিজের করে পাওয়ার জন্য আমি বাচ্চাটাকে রাখছি।সবই তো হারালাম। এইবার শেষ একটা চেষ্টা করে তো দেখি। তার চোখে মুখে অপরাধীর ছাপ। কিভাবে সে তার স্ত্রীর সামনে গিয়ে দাঁড়াবে সেই ভয়। সে নাকি খুব ভালোবাসে তার স্ত্রীকে৷ বাবার সাথে কি কথা হয়েছে আমি জানি না। বাবা নাকি আমার মুখও দেখতে চায় না। আমি জানি, বাচ্চার মুখ দেখলে পাষাণ এর মনও নরম হয়৷ এখন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাচ্চাটা হলেই ভালো। তার মনও পরিবর্তন হবে। আর ঐ মেয়েটার তো এখনও কোনো বেবি হয়নি। হলেও আমার পরে হবে৷ আমার বাচ্চাটা হয়ে গেলেই আমি ঐ মেয়ের কাছে গিয়ে আমার সন্তানের একটা সুন্দর পরিবেশে বেড়ে উঠার জন্য ঐ মানুষটাকে চাইবো। মেয়েটা হয়তো ওনাকে ভুল বুঝবে। আর চলে যাবে। হ্যাঁ, আমি সেটাই করবো। আমার ভালোবাসার মানুষটাকে পাওয়ার জন্য আমি সবকিছুই করবো।°
°বিয়ের ১ মাস হয়ে গেছে। আমি আলাদা আছি। এখন শুধু মা আমার সাথে থাকে। পরিবারের বাকি সবাই চলে গেছে। কেউ আমার জন্য থাকে নি এখানে। তাদের নিজেদের জীবন নিয়ে তারা চিন্তিত। আমি কে তাদের? কেউ না। কেউ ভালোবাসে না আমায়। আমার গর্ভের বাচ্চাটা বেড়ে উঠছে। আমি তাকে অনুভব করতে পারি।একমাত্র সেই আমার হাতিয়ার। আমার সংসার টিকানোর জন্য। যদিও এখনও আমার কোনো সংসার নেই। যেখানে এসেছি, সেখানে আমাদের পরিচিত কেউ নেই। সবাই জিজ্ঞেস করে আমার সন্তানের বাবা কোথায়। মা বলেছে দূরে কাজ করে৷ আমাকে জোর করে বোরকা পড়ায়। বাইরে যাওয়াও বারণ এখন। আমার এভাবে থাকতে ভালো লাগেনা। আমি এই সবকিছু মেনে নিতাম, যদি আমার সন্তানের বাবা আমার কাছে থাকতো। কিন্তু সে তো আসে না। একবারও আসেনি। আমার জন্য না হলেও নিজের সন্তানের জন্য হলেও তো আসতে পারে। তাইনা? আমি না হয় খারাপ মা, খারাপ মেয়ে। কিন্তু সে তো দায়িত্বশীল। সে একজন ভালো স্বামী। তার স্ত্রীর জন্য সে সবকিছুই করতে পারে। আমার কথা না ভাবলো, তার নিজের সন্তানের জন্য কি তার মায়া হয় না? অবশ্য তাকে দোষ দিয়ে কি লাভ? সে তো এখনও বিশ্বাসই করতে পারে না যে আমার গর্ভের বাচ্চাটা তার৷ আমাকে দুশ্চরিত্রা ভাবে। তবে, তাকে দোষ দেব কেন? তারও তো দোষ নেই।°
°আজ সে এসেছিল। সাথে করে আমার জন্য ফলমূলও নিয়ে এসেছিল। আমি ভীষণ খুশি হয়েছি। আমার বাবাও এসেছিল। আমার শরীরের অবস্থা নিয়ে বাবা একবার কথা বলতে চেয়েছিল।হাসপাতালে নিতে চেয়েছিল। কিন্তু সে সাফসাফ জানান দিয়েছে, তার স্ত্রী হিসেবে আমাকে কোথাও পরিচয় করাতে পারবে না। যেহেতু হাসপাতালে নিলে তাকেও মাঝেমধ্যে যেতে হবে। বাবার মুখের দিকে তাকাতে পারছিলাম না। তার চোখেমুখে অসহায়ত্ব। তারও যে কিছুই করার নেই। তবে এইটুকু বুঝলাম, সন্তান হাজারো অন্যায় করলেও বাবা-মা একসময় সব ভুলে যায়।কিন্তু তার রেশ রয়ে যায় যুগের পর যুগ। আমার পাপের শাস্তি আমার বাবা-মা পাচ্ছে। হয়তো আমার সন্তানও পাবে। হয়তো তার সন্তানরাও। সে আজ আসলো, বাবার সাথে কিছু কথা বললো। তারপর চলে গেল। আমার সাথে কিছুই বললো না। আমি জানি আমি অন্যায় করেছি। কিন্তু তার সন্তানের জন্য হলেও তো তার আমার খোঁজ নেওয়া উচিত ছিল। তা না করে শুধু কয়েকটা ফলমূল আনলেই কি দায়িত্ব শেষ? অবশ্য যে দায়িত্ব তার ঘাড়ে জোর করে চাপিয়ে দিয়েছে, সেটা তার পালন করা কি আর না করাই কি?°
°আমার গর্ভের সন্তানটি এখন নাড়াচাড়া করে৷ পেটে লাথি দেয়। মেয়েদের কাছে গল্প শুনেছি এই সময়ে নাকি স্বামীরা মেয়েদের পেটে মাথা পেতে তার অনাগত সন্তানের সাথে কথা বলার চেষ্টা করে। আমার পেটে ভীষণ ব্যথা হয় ইদানীং। মুখ বুজে বিছানার চাদর খামচে ধরে আমি ব্যথা সহ্য করি। এই ব্যথাটা আমি আনন্দের সাথে সহ্য করতাম, যদি মানুষটা আমার সাথে থাকতো।°
°নাহ, আর পারছি না। এইভাবে জীবন চলে না। ধর্মীয়ভাবে না হোক, কাগজে কলমে আমি তার বউ। আর আমার সবচেয়ে বড় হাতিয়ার আমার গর্ভের সন্তান। তার সন্তান। আমাদের সন্তান। আমার অধিকার বেশি। সে তার বউকে নিয়ে ফুর্তি করে বেড়াবে আর আমি এইখানে পঁচে মরবো? প্রেগন্যান্সির ৮ মাস চলছে। সে হাতে গোনা কয়েকবার এসেছে মাত্র। আমি আর নিতে পারছি না। এইবার যা করার আমাকেই করতে হবে। নিজের অধিকার নিজেকেই আদায় করতে হবে। এর জন্য আমাকে যা যা করতে হয় আমি করবো।°
°আজ সে আমার গায়ে হাত তুলেছে। সে ভুলে গেছে যে আমার গর্ভে তার সন্তান। আমি তার বউয়ের চরিত্রে দাগ লাগাতে চেয়েছিলাম। তাদের ঘরে ছেলে মানুষ পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু সে কোনোভাবে জেনে গেছে যে আমিই করেছি এইসব। তাদের সম্পর্কের বিশ্বাস অনেক বেশি জোরালো। সে আজ আমাকে কঠিন কঠিন কিছু কথা বলেছে। আমি তার এই রুপের সাথে পরিচিত ছিলাম না। সে বলেছে আমার গর্ভে যদি মেয়ে সন্তান থাকে, আর সেই মেয়ের সংসারও যদি আমার মতোই কোনো কালনাগিনী এসে ভেঙে দিয়ে যায়, তাহলে আমার কেমন লাগবে? আমার ভীষণ ভয় হচ্ছে। আল্লাহর কাছে আকুল আবেদন করছি আমার যেন ছেলে সন্তান হয়। আমার মেয়ে হলে যদি সত্যিই আমার পাপের ভাগীদার আমার মেয়ে হয়? যদি আমারই মতো কোনো কালনাগিনী এসে আমার মেয়ের সংসার ভেঙে দিয়ে যায়? কেমন লাগবে আমার তখন। অহ আমার আল্লাহ, আমাকে মেয়ে সন্তান দিও না।°
সাগরিকা ডায়েরিটা বন্ধ করে দেয়। তার মনে পড়ে বহু বছর আগের কথা। সেইরাতে সে আধঘুমে ছিল। রিজভী রাতের বেলায় ২ জায়গায় কোচিং করাতো। তাই বেশ রাত করেই বাড়ি ফিরতো। তাকে ঘুমুতে বললেও সে ঘুমাতো না। রিজভীর জন্য অপেক্ষা করতো। সে নিজেও কয়েকটি বাচ্চাকে পড়াতো। বাড়িতে ফিরে সে বুঝতে পারেনি যে রুমে কেউ ঢুকেছে। সে নিশ্চিন্ত মনে ছিল। রিজভীর ফেরার অপেক্ষায় ছিল। কিন্তু মেয়েদের ইন্দ্রিয় বেশ প্রখর হয়। সে যখন বুঝতে পারে তখন ফোন নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ে। রিজভীকে কল দিলে সে দ্রুতই বাসায় চলে আসে। আর সেই ছেলেটিকে হাতেনাতে ধরে। পরে রিজভী ছেলেটিকে নিয়ে বাইরে চলে যায় আর বেশ কিছুক্ষন পরেই ফিরে আসে। মূলত সেদিন রিজভীর মার খেয়েই ছেলেটি সব স্বীকার করেছিল। মায়ার মা যে তাকে এখানে পাঠিয়েছিল। সে চেয়েছিল সাগরিকা ঘুমিয়ে গেলে তার পাশে শুয়ে থাকতে। যাতে রিজভী এসে তাকে ভুল বুঝে। যেইগুলোর কিছুই সাগরিকা জানে না। রিজভী সাগরিকাকে বলেছিল ছেলেটি চুরি করার উদ্দেশ্যে এসেছিল। সেইরাতে আর ঘুমুতে পারেনি সাগরিকা বা রিজভী কেউই। ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে স্বামীর বুকে মাথা রেখে শুয়েছিল সে।
এখন ডায়েরিটা পড়ে মায়ার প্রতি অন্যরকম ধারণা হচ্ছে তার৷ মায়ার মা ই যেহেতু এতোটা খারাপ ছিল, মায়া তার সন্তানদের জন্য কতটা নিরাপদ? যতোই হোক, মায়ার শরীরে তো তার মায়ের রক্তই রয়েছে। সাগরিকার আর সাহস হলো না ডায়েরিটা পড়ার। যেটুকু বোঝার সে বুঝে নিয়েছে। রিজভীর সাথে এখন খোলামেলা আলোচনা করতে হবে তার। নিজেদের মধ্যে আর কোনো দূরত্ব রাখবে না সে।বাইরের একটা মানুষের জন্য সে কেন নিজের সংসারটাকে উপেক্ষা করবে। সে ঠিক করলো আজই সে মায়া আর রিজভীকে তাদের চিঠিগুলো দিয়ে দিবে। অন্যের আমানত তাদের কাছে বুঝিয়ে না দেওয়া পর্যন্ত তার শান্তি নেই।
★★★
খাবার টেবিলে পিনপতন নিরবতা। আজ আমি সবার সাথে খাচ্ছি। কেমন একটা অস্বস্তি লাগছে। সবাই নিজেদের মতো খাচ্ছে। আম্মার কড়া নির্দেশ খাবার মুখে নিয়ে কেউ কোনো কথা বলতে পারবে না। খাবার শেষ করে সর্বপ্রথম আম্মাই বললো,” মায়া, তুমি ভবিষ্যতে ডাক্তার হতে চাও?”
আমি অবাক হয়ে গেলাম। উনি আমার কথা কিভাবে জানেন। তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম,” হ্যাঁ, হ্যাঁ আম্মা।”
” তাহলে, তুমি বলছো না কেন যে তোমার আলাদা প্রাইভেট বা কোচিং লাগবে।”
” না…মানে…আসলে…এতোদিন তো…”
“কালকে থেকে বাসায় প্রাইভেট টিউটর আসবে। আর তুমি তোমার স্কুলের বন্ধুদের থেকে জেনে নিও ওরা কোথাও পড়ছে কি-না। ভালো টিচার থাকলে তুমিও পড়বে।”
আমি কিছু বললাম না। শুধু মাথা নাড়লাম। আমার মুখ দেখে আম্মা আবারও জিজ্ঞেস করলো,” কি হয়েছে? আজ মুখ এতো শুকনো লাগছে কেন? কেউ কিছু বলেছে?”
” নাহ, কেউ তো কিছু বলেনি।”
“মায়া, তুমি আর তোমার বাবা একটু পর আমার রুমে এসো। তোমাদের সাথে কথা আছে। ”
আমি আর বাবা হতভম্ব হয়ে গেলাম। কি বলবে আম্মা? আমাকে কি বের করে দিবে? চলে যেতে বলবে? আমি তো যেতে চাইনা। এখানেই থাকতে চাই। আমার বাবার সাথে। ভাই-বোনদের সাথে৷ ছলছল চোখে আমি খাবার ঘর থেকে চলে এলাম।
কিছুক্ষণ পর আম্মার ঘরের সামনে গেলাম। এই ঘরে এর আগে আসিনি আমি। দরজায় নক করতেই ভিতর থেকে উত্তর এলো,” এসো মায়া।”
আমি ভেতরে প্রবেশ করতেই দেখলাম বাবা আর আম্মা দুজনেই খাটে বসে আছে। আমি যেতেই আম্মা উঠে এসে আমার হাতে একটা চিঠি ধরিয়ে দিল। আমি বাবার হাতের দিকে লক্ষ্য করলে দেখলাম, বাবার হাতেও একই রকম চিঠি। আমি কিছু বুঝলাম না। আম্মার দিকে তাকালাম। আম্মা বোধহয় আমার প্রশ্ন বুঝলো। আমাকে বললো,” তোমার মায়ের ডায়েরিটা আমি পড়েছি। শেষ হয়নি। তোমার মা তোমার বাবা আর তোমাকে এই চিঠি দুটো দিতে বলেছে। দিয়ে দিলাম। এখন আমি দায়মুক্ত।” আম্মা একটু দম নিলেন। তারপর বললেন,” দেখো মায়া, তোমার এখানে আগমনটা অনেকটা উড়ে এসে জুড়ে বসার মতো। তোমার মা আমাদের সাথে কি করেছে আমি তোমাকে বলবো না। সেটা তুমি নিজেই একসময় জানবে।কিন্তু আমি ভাবছি তোমার এখানে থাকা নিয়ে। তোমার বাবা আমাদের কিছু না জানিয়েই তোমাকে এখানে এনে রেখেছে। আমাদের পক্ষে তোমাকে মেনে নিতে সময় লাগবে। আশা করি তুমি বুঝতে পারছো।”
“হুমম, আমি বুঝেছি আম্মা।”
“বেশ ভালো এখন যাও। পড়তে বসো।”
আমি মাথা নিচু করে চলে আসলাম আমার রুমে। দুরুদুরু বুকে খুলতে লাগলাম চিঠিটি। আমার ভয় হচ্ছে। আমার মায়ের লেখা শেষ চিঠি আমার জন্য। কি আছে ঐ চিঠিতে? খুব ইচ্ছে হচ্ছে পড়ার। আবার ভয়ও হচ্ছে। যদি মাকে ভুল বুঝি সত্যি সত্যিই!
চলবে….