#মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া
#লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৮
মীরা বুঝতে পারলো তার আফসোস হচ্ছে। ছেলেদের মিঠে কথায় গ*লে যাওয়া উচিত হয়নি। বর্ণের বেলায় ঠকে গিয়ে আবারও উচিত হয়নি। কথায় আছে না? অতিভক্তি চো*রের লক্ষণ! কেন যে বুঝলো না রাদিবের এই অতিভক্তি ও যত্ন দেখানো! আবার নিজের সিদ্ধান্তের প্রতি সম্মানটাও বেড়ে গেছে। ভাগ্যিস আকদ ও এইনগেজমেন্টের কথা সে রিজেক্ট করে এসেছিল। কিছুটা শান্তিও লাগছে মনে। ফোনের অপরপাশের মেয়েটার ডাকে মীরা ভাবনার জগৎ থেকে ফিরলো। মেয়েটা রাদিবের ফোন থেকে হোয়াটসঅ্যাপে কল করেছিল তাই রিসিভ করা মাত্রই সেটাকে ভিডিও কলে পরিবর্তন করে নিয়েছিল। মেয়েটা বলল,
“রাদিবকে আমি অনেক কষ্টে রাজি করিয়ে আজকে এই হোটেলে এনেছি। তারপর ওকে ইনট*ক্সিকে*টেড করে ফোনের লক খুলিয়ে আপনাকে কল করেছি। কিছুদিন যাবত সে আমাকে ইগনোর করছিল। ফোন করলে ব্যস্ততা দেখাতো। আমি ওর এক বন্ধুর থেকে সবটা জেনে ওর বন্ধুর সহায়তায় এই কাজ করেছি। এক মাস আগে আমাকে ও জোর করে এবর্শনও করিয়েছে। তারপর থেকেই ওর কেয়ারিং ভাবটা কমতে থাকলো। তখনও ততটা ভাবিনি। কারণ নতুন নতুন প্রমোশোন হয়েছে। কিন্তু এখন! সে আমাকে ছুড়ে ফেলে দিতেও দুইবার ভাবেনি।”
মীরা ঢোক গিলে ঈষৎ পলক ঝাপটালো। তারপর এক নিঃশ্বাসে বলল,
“ধন্যবাদ আপু। ভালো থাকবেন।”
এটা বলে মীরা কল কাটতে নিয়েও কিছু একটা ভেবে একটা স্ক্রিনশট নিয়ে রাখলো। মেয়েটাকে যে রাদিব কোমড় পেঁচিয়ে ধরে আছে তা স্পষ্ট। তারপর কল কেটে হতাশ নিঃশ্বাস ছেড়ে বিছানায় ধপ করে মাথা নিচু করে বসলো। প্রচণ্ড অস্বস্তি হচ্ছে তার। মাথার শিরায় শিরায় সূক্ষ্ণ ব্যাথার উদ্ভব হচ্ছে। রাইমা, মীরাকে ডাকতে এসে এভাবে বসে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকালো। পাশে গিয়র বসে, পিঠে হাত রেখে ডাকলো,
“মীরু? কী হয়েছে?”
মীরা মাথা তুলল। তার চোখ রক্তবর্ণ ধারণ করেছে। রাইমা উৎকণ্ঠা নিয়ে শুধালো,
“তোর চোখ লাল কেন? মাথাব্যথা না-কি?”
মীরা ইশারায় হ্যাঁ বুঝালে রাইমা ড্রয়ার খুলে প্যা*রাসিটে*মল বের করে মীরার হাতে দেয়। তারপর ডাইনিং থেকে পানি ও প্লেটে করে একটু চিকেন সবজি ও তান্দুরি রুটি এনে দিয়ে বলে,
“একটু খেয়ে মেডিসিন খা।”
“না খাব না। খেতে ইচ্ছে করছে না।”
অতঃপর সে ঔষুধের স্ট্রিপ থেকে ঔষুধ বের করতে নিলে, রাইমা হাত ধরে শা*সনের সুরে বলল,
“না খেয়ে তোকে আমি মেডিসিন নিতে দিব না। খেতে তো হবেই। হুট করে মাথাব্যথা শুরু হলো কেন? তুই না জিজুর সাথে কথা বলছিলি?”
মীরা ঔষুধের স্ট্রিপটাই ছুড়ে ফেলল! অতঃপর শক্ত কণ্ঠে বলল,
“বিয়ের আগে কীসের জিজু? বিয়ে হয়েছে আমার? নাকি আমার অনামিকায় কোনো আংটি দেখতে পাচ্ছিস? তাহলে কানের মা*থা খাচ্ছিস কেন?”
মীরার এই হুট করে রেগে যাওয়ার কারণটা রাইমা বুঝলো না। এমন কী বলেছে যে মীরা আ*হত বা*ঘি*নীর মতো অ*গ্নিশর্মা হয়ে গেছে! রাইমা নরম কণ্ঠে শুধালো,
“এতো রেগে যাচ্ছিস কেন? জিজুর সাথে ঝ*গড়া হয়েছে?”
“ফের জিজু বলছিস? মানা করেছি না আমি?”
মীরার কণ্ঠের তীব্রতায় ভড়কে গেল রাইমা। সন্দিগ্ধ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,
“আচ্ছা বলব না। কিন্তু হয়েছেটা কী? ঝ-গড়া করেছিস?”
“না! মানুষ ঝ*গড়া করে তার নিজের মানুষের সাথে। রাদিব আমার কেউ না। ভবিষ্যতেও কেউ হবে না।”
মীরার উত্তরেও কেমন হেয়ালী! রাইমা বুঝল না কিছুই। ফের প্রশ্ন করে,
“আরে ইয়ার! ক্লিয়ারলি বল। আমি এমন আধা-ভাঙা কথা বুঝি না।”
“হি ইজ অ্যা চি*টা*র। হি ট্রাইড টু চি*ট অন মি।”
“কীভাবে চি*ট করলো?”
“সে একটা মেয়েকে চি*ট করে আমাকে বিয়ে করতে এসেছিল। মেয়েটার এ*বর্শনও করিয়েছে। আমার সাথে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে নিজের ভেতরের নোংরামো হাইড করতে চেয়েছিল। বাট ফাইনালি, আমি বেঁচে গেছি। সময় থাকলে সব সত্য জেনে গেছি।”
রাইমা হতবাক হয়ে চেয়ে রইলো। মীরা ফুঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে চোখ বন্ধ করে নিজেকে শান্ত করে। মাথাব্যথায় টনটন করছে। পানিভর্তি গ্লাস এক নিঃশ্বাসে শেষ করে দিলো। তারপর ক্লান্ত কণ্ঠে বলল,
“একটু ঘুমাব। ভালো লাগছে না।”
রাইমার হুঁশ ফিরলো। সে অসন্তোষ স্বরে বলল,
“তুই না খেয়ে ঘুমাতে পারবি না। একটু হলেও খাবি। তারপর ঔষুধ খেয়ে ঘুমা। আমি না শুনব না।”
মীরার মাঝে খাওয়ার কোনো লক্ষণ নেই। অতঃপর রাইমা নিজে জোর করে রুটি ছিড়ে মীরার মুখে ঢুকিয়ে দিলো। মীরা বিরক্ত হয়ে বাধ্য হয়ে খাচ্ছে। ইতোমধ্যে রাইমার টেপরেকর্ডার চালু! রাদিবকে যা নয় তাই বলে সাবান ছাড়া ধুয়ে দিচ্ছে। মীরা অতিষ্ঠ হয়ে বলে,
“কুঞ্জদা তোকে সহ্য করে কীভাবে? বেচারার কানের পো-কা তো মনে হয় একটাও বেঁচে নেই।”
রাইমা বাঁকা হেসে বলে,
“তোর কুঞ্জদা, তার কাকা মানে আমার পিসোকে খুব ভালোবাসে তো। তাই পিসো যা বলেছে চোখ বন্ধ করে মেনে নিয়েছে। এমনিতেও সে আমাকে পছন্দ করতো।”
“হয়েছে থাম। আমি ঘুমাব। তুই তো এখন ঘুমাবি না।”
রাইমা ফুরফুরে মেজাজে প্লেট নিয়ে উঠে বলে,
“নোপ। আমি এখন নে*টফ্লিক্সে মুভি দেখব। কাল রবিবার ইয়ার। এতো জলদি ঘুমাব না।”
মীরা প্যা*রাসিটে*মল ও একটা স্লি*পিংপি-ল পানি দিয়ে গিলে হালকা মাথা নেড়ে শুয়ে পড়ে। রাইমাও আলো বন্ধ করে দরজা ভিড়িয়ে চলে যায়। মীরা চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ শুয়ে থেকে ভাবলো, এখনি ব্যাপারটা শুধরে নেওয়া উচিত। তাই তার বড়ো ভাইয়ার হোয়াটসএপে সেই স্ক্রিণশটটা পাঠিয়ে লিখলো,
“মুখে মধু, অন্তরে বি*ষ কাউকে আমি নিজের লাইফে চাই না। বাকিটা তোমরা বুঝে নিও।”
অতঃপর ফোন বন্ধ করে রেখে তন্দ্রায় ডুবে যায়।
_______
মীরার ঘুম ভাঙে খুব ভোরে। ঘুম ভাঙার পর পাশে রাইমাকে না দেখে বুঝে যায় যে মেয়েটা ছোটো ম্যাট্রেসটাতেই ঘুমিয়ে পড়েছে। মীরা উঠে ফ্রেশ হয়ে অজু করে নামাজ পড়ে নেয়। অতঃপর কফি বানায়। কফি খেতে খেতে ব্যালকনিতে যায়। খোলা হাওয়ার স্নিগ্ধতায় মন মোহনায় মুগ্ধতা ঝড়ে পড়ে। সেখানে টবে লাগানো শুভ্র ও গোলাপি কাঠগেলাপের মিষ্টি সুঘ্রাণ অনুভব করে। সাদা কাঠগেলাপ তিনটে ফুটে আছে আর গোলাপিটার দুটো। রাতে মনে হয় বৃষ্টি হয়েছিল। গাছের পাতা ভেজা। ব্যালকনির রেলিংও ভেজা। তা স্বত্বেও সেখানে কনুই ভর দিয়ে দাঁড়ায়। কফি পান করতে করতে সম্মুখের অনন্ত গগনে দৃষ্টি স্থির রেখে সময়টা উপভোগ করে। এখানে দাঁড়িয়েই বেশ অনেকটা সময় পেরোলো। তারপর রান্নাঘরে গিয়ে ডিম ও সবজি দিয়ে ফ্রাইড রাইস তৈরি করে তার সাথে কিনে আনা ফ্রোজেন করক কাবাব বের করে চারটা ভেজে নিলো। তারপর রাইমাকে টেনে তুলে ফ্রেশ হতে পাঠালো।
খাওয়া-দাওয়া শেষে মীরা ফোন অন করে দেখে তার দুই ভাই, ভাবিদের ও রাদিবের নাম্বার থেকেও সব মিলিয়ে প্রায় শ খানেক মেসেজ ও মিসডকল। লম্বা নিঃশ্বাস ছেড়ে সে কল ব্যাক করে। মীরার ছোটো ভাবি কল রিসিভ করে প্রথমেই বলে,
“রাদিব সম্পর্কে তুমি এসব কীভাবে জানলে? রাদিব তো এসব অস্বিকার করছে।”
মীরা জবাবে তাচ্ছিল্য করে বলে,
“সে অস্বিকার করলেই বুঝি সত্যটা মিথ্যে হয়ে যাবে? আমি ভিডওকলে সব দেখেছি এবং শুনেছিও। মানুষ নে*শার ঘোরে সত্যি কথা বলে। সে বলছিল সে ওই জুলি মেয়েটাকে ভালোবাসে, আবার আমাকেও! আমার এত বড়ো মনের ছেলেকে বিয়ে করার ইচ্ছে নেই। যে দুটো মেয়েকে বিয়ে নক করেই ভালোবাসে!”
“তুমি বাবার সাথে কথা বলো। কাল রাতে তোমাকে কত কল দিলাম। ধরলে না।”
“মাথাব্যথা করছিল তাই ঘুমিয়ে ছিলাম।”
“আচ্ছা। বাবার সাথে কথা বলো।”
মিস্টার রফিক তালুকদার ফোন কানে নিয়ে গম্ভীর স্বরে বললেন,
“তুমি শিউর তো? রাদিব বলছে ওই মেয়ে নাকি তাকে খাবারের সাথে কিছু মিশিয়ে তারপর নিয়ে গেছে।”
“হ্যাঁ। মেয়েটা তাই করেছে। তাছাড়া আর কী করবে? নিজে ঠকেছে বলে কি আরেকটা মেয়েকেও ঠ*ক-তে দিবে? কথোপকথন তো আমি শুনেছি। দেখেছিও।”
মীরার জবাব শুনে মিস্টার রফিক তালুকদার হতাশ নিঃশ্বাস ফেললেন। কথা না বাড়িয়ে বললেন,
“ঠিক আছে।”
অতঃপর কল ডিসকানেক্ট করে দিলেন। মীরা শান্তির নিঃশ্বাস ফেলে কেবল উঠবে তখন আবারও ফোন বেজে ওঠে। দেখে রাদিব কল করেছে। মীরা বিরক্ত হয়ে কে*টে দিতে চেয়েও রিসিভ করলো। কানে ধরে বসে রইল। রাদিব বলছে,
“মীরা, ওসব মিথ্যা। জুলি আমাকে ফাঁসাচ্ছে। ওর সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। ওই মেয়েটা আমাকে ডিস্ট্রাভ করে। বিশ্বাস করো, আমার সাথে ওর কোনো সম্পর্কই নেই। আমি তোমাকে ভালোবাসি।”
মীরার ভীষণ রাগ হলো। কিন্তু তা প্রকাশ না করে ভাবলেশহীন জবাব দিলো,
“তো আমি কী করব? আপনার মন যত ইচ্ছা, যাকে ইচ্ছা ভালোবাসেন। এক মনে দুটো কেন? হাজার জনকে জায়গা দিন। তাতে আমার কিছু যায় আসে না।”
“মীরা বুঝার চেষ্টা করো।”
“কী বুঝব? আর আপনি আমার কাছে এত সাফাই গাচ্ছেন কেন? আপনার সাথে আমার এইনগেজমেন্টও হয়নি। অযথা সময় নষ্ট করছেন। তার থেকে ভালো, জুলিকে বিয়ে করে সুখী হোন।”
রাদিব ডেস্পারেট হয়ে জবাব দেয়,
“তোমার সাধারণতায় আমি প্রেমে পড়ে গেছি। আমি ভালোবেসে ফেলেছি। জুলি প্রতিহিং*সা থেকে এসব করছে।”
“থামেন প্লিজ। আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই না। আপনাকে বিয়ে করার থেকে এক বিপত্নীক, এক বাচ্চার বাবাকেও বিয়ে করা ভালো! অন্তত তার মনে কারও জন্য ভালোবাসা থাকলে সেটা তার মৃত স্ত্রীর জন্যই থাকবে। পবিত্র সেটা।”
কথাটা বলে মীরা নিজেই চমকে ওঠে। কথায় কথায় সে কী বলে ফেলল! অস্বস্তিতে আর কথা বলার জোর নেই। জলদি করে কল কে*টে নাম্বার ব্লক করে দিলো। ফের মাথা নিচু করে, মুখে হাত চেপে নিজের বলা শেষোক্ত কথাগুলো ভাবতে লাগলো।
চলবে ইনশাআল্লাহ,
এখন থেকে “ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায়” গল্পের নাম “মন মোহনায় ফাগুন হাওয়া”। পাঠকদের বিভ্রান্তির জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করছি।
রিচেক করা হয়নি। ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। কপি নিষিদ্ধ।