#ফানাহ্ 🖤
#পর্বসংখ্যা_৩৩(একাংশ)
#হুমাইরা_হাসান
– সারাদিন কোথায় ছিলেন মোহ
অকস্মাৎ কথাটি কর্ণগোচর হতেই ঘুরে দাঁড়াতে নিলেও শক্তপোক্ত বুকের ধাক্কায় পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়াতে ব্যর্থ হলো মোহর । তবে ভরাট কণ্ঠস্বর যুক্ত মায়াভরা গলার প্রশ্নকারীকে চিনতে অসুবিধা হলো না চোখ ঘুরিয়ে না তাকালেও। হাতে রাখা কাপড়ের টুকরো অংশ টা সজোরে মুচড়ে ধরলো মোহর, অপ্রস্তুত স্বরের প্রত্যুত্তরের সুযোগ টুকু দেওয়ার ধৈর্য হয়তো মেহরাজের ছিলো নাহ, কণ্ঠের ভাঁজে নিগূঢ় ব্যকুলতা মিশিয়ে বলল
– নিজের স্বামীর প্রতি কেও এতটাও নিষ্ঠুর হতে পারে মোহ? এই যে সারাটা দিন পর এলাম, কোথায় ঘরে ঢুকে বউয়ের চাঁদমুখখানি দেখে প্রাণ জুড়াবো তা না উল্টো এ ঘরে ও ঘরে খুঁজে রান্নাঘরে দেখা মিললো বিবিজানের।
ইশ! মেহরাজের প্রতিটি কথা,শব্দ,বাক্যে যেনো অঢেল অধিকারবোধ,অধীরতা, উদ্বেগ মেশানো। মেহরাজের মুখ হতে নিঃসৃত ‘বিবিজান’ শব্দটি শ্রবণযন্ত্র ভেদ করে সারা মস্তিষ্ক, শরীরে আবেশ সঞ্চারিত করে দিলো যেনো, ফলস্বরূপ অবিলম্বেই টকটকে আভায় ছেয়ে গেলো মেদুর গালের আস্তরণ। তবুও জিহ্ব ঠেলে আড়ষ্ট শব্দগুলোতে মোহর বলল
– আ আমি একটু কাজ করছিলাম
মেহরাজ মোহরের কথার ফাঁকে নিজের মুখটা এগিয়ে এনে মোহরের ঘাড়ের পাশ দিয়ে চুলাটায় চোখ বুলালো। মৃদু আত্মম্ভরী স্বরে বলল
– বাড়ির সকলের জন্য চা বানানোর চিন্তা মাথায় আসে, অথচ নিজের বর এসেছে কি না সেই খোঁজ টুকুও রাখেন না আপনি
মোহর ইতস্তত ভাবে বলল
– আসলে আমি খেয়াল করিনি আপনি এসেছেন।
– আপনি কি জানেন না আমি কখন আসি?
মেহরাজের প্রশ্নের সাথে সাথে মোহর ও ঘুরে দাঁড়ালো। এক পলক চাইলো আপাদমস্তক মেহরাজকে। অফিসের ফরমাল পোশাক টা এখনো খোলেনি, ইনের ভাঁজে শার্টটার বুকের দিকের দুটো বোতাম হাট করে খোলা। এলোমেলো চুল আর ক্লান্ত শরীরে হাত দুটো মাজায় রেখে দাঁড়িয়ে মেহরাজ
– কি জানেন নাহ?
একই প্রশ্নের পুনরাবৃত্তিতে মোহর ঘাড় নাড়িয়ে হ্যাঁ সূচক জবাব দিলো। মেহরাজ অবিলম্বেই বলল
– তাহলে আমি বাসায় ফেরার সময়টাতে ঘরেই থাকবেন। ঘরে ঢুকেই যেনো আপনাকে দেখতে পাই।
মোহরের নিরুত্তর প্রতিক্রিয়াতে সূক্ষ্ম চাহনি মেলে মেহরাজ এগিয়ে এলো। কেবিনেটের সাথে মোহরের ঘেঁষে দাঁড়ানো শরীরের দুপাশে দুহাত রেখে মুখের সামনে ঝুঁকে এসে বলল
– মনে থাকবে?
এবারও মোহর ঘাড় নাড়ালো দুবার। মেহরাজ চেয়ে রয় নিষ্পলক। মেয়েটা বেশ শান্তস্বভাবের। তার চেয়েও বেশি লজ্জাবতী। যেনো মেহরাজের প্রতিটি কথাতেই মিইয়ে যায়। মেহরাজের মাঝে মধ্যেই মোহরকে লজ্জাবতী ডাকতে ইচ্ছে করে, তার লজ্জাবিবিকে । তার চোখের দিকে তাকাতে অব্দি পারেনা বউটা ঠিকঠাক। সারাক্ষণ নজর ঝুকিয়ে রাখে।
এই মেয়েটার মাঝে কি এমন আছে? যা মেহরাজকে ক্ষণে ক্ষণে মায়াডোরে আঁটকে ফেলে। একবার তাকালে ফেরানোর ইচ্ছে হয়না। শক্ত করে বুকের মাঝে জড়িয়ে রাখতে ইচ্ছে করে।
পকেট থেকে শুভ্র রুমাল টা বের করলো মেহরাজ। প্রিয়তমার সরু ললাটেজমে থাকা বিন্দু বিন্দু ঘাম নিজ হাতে সন্তপর্ণে মুছিয়ে দিতে দিতে বলল
– বাড়ির সবার জন্য চা করছেন, আমি কি এক কাপ কফি এক্সপেক্ট করতে পারিনা বিবিজান?
মোহর কি বলবে ভেবে পাইনা। মেহরাজের এই যত্নপূর্ণ স্পর্শটা ওর অন্তরখানিও ছুঁয়ে দিচ্ছে যেনো। একরাশ ক্লেশে সিক্ত হয় হলুদাভ গালদুটি। লজ্জাবিবির প্রচন্ডরকম লজ্জাময়ী মুখখানা প্রাণ ভরে দেখে চোখ জিরিয়ে নিলো মেহরাজ। মোহরকে মুক্ত করে সরে দাঁড়ালো। সুদীর্ঘ প্রশ্বাস ফেলে বলল
– গোসল করতে যাচ্ছি, বেরিয়ে যেনো আমার বউকে চোখের সামনে পাই।
মোহর হতবুদ্ধির মতো ঘনঘন ঘাড় নাড়ালো। মেহরাজ লজ্জায় আদ্র মুখখানা দেখে মনের বেপরোয়া প্রশান্তি মিটিয়ে বেরিয়ে গেলো রান্নাঘর থেকে। মেহরাজ বেরোতেই ফোঁস করে দম ছাড়লো মোহর, গ্লাসে পানি ঢেলে ঢকঢক করে এক নিঃশ্বাসে সাবার করে দিলো পুরো গ্লাসের পানি। হৃদক্রিয়াটা বেগতিক হারে বেড়ে যায় লোকটার সংস্পর্শে। তবুও কেনো যে লোকটা দিনদিন এমন বেশরম হয়ে উঠছে!
.
চা নাস্তার প্লেট সাজিয়ে মোহর ডাইনিং এ এনে রাখলো। আজকে বসার ঘরটা জুড়ে মানুষের ভীড়। দিদা, আজহার, আরহাম, কাকলি, আম্বিসহ সাঞ্জে, তাথই ও বসেছে। বাড়ির সকলের বৈঠকের কেন্দবিন্দু হলো সাঞ্জের বার্থডে পার্টির আলোচনা।
এইটা পার্টিটাতে বার্থডে টা হলো একটা মাধ্যম বা অছিলা। কাল অতিথিদের তালিকায় আত্মীয়ের চেয়ে বিজনেস সার্কেল টাই যে বেশি থাকবে তা বয়স্কদের আলোচনায় স্পষ্ট। তাদের ভাষ্যানুযায়ী কোম্পানিতে এবার নতুন টেন্ডারসহ নতুন শাখাও যুক্ত হয়েছে রিয়েল এস্টেট নামক। এই উদ্দেশ্যে সকল শুভাকাঙ্ক্ষীদের ও তালিকাভুক্ত রাখতে চাই।
পরিবারের সকলের বিশদ আলোচনার মাঝে মোহর ট্রে তে করে চায়ের কাপ, আর নাস্তা এনে রাখলো। কোনো দ্বিমত হীনা সকলে হাতে তুলে নিলে, আজহার মুর্তজা বললেন
– মোহর, তুমিও বোসো মা, আর একা একা এতসব করতে গেলে কেনো। নাজমা, মালা এরা আছে তো
– না তেমন কোনো ব্যাপার না আংকেল। এইটুকুই তো। আমি সামলে নেবো।
উপস্তিত মধ্যবয়স্ক ছিমছাম গড়নের লোকটি এবার গলা খাকারি দিলেন। চায়ের কাপটা হাত থেকে নামিয়ে সুপ্রসন্ন দৃষ্টিতে মোহরের দিকে চেয়ে বললেন
– তুমি বোধহয় আমাদের পরিবার টাকে এখনো আপন করে নিতে পারোনি তাই না মোহর।
মোহর আঁচলে ঢাকা মাথাটার আরও কিছুটা আবৃত করে নিলো ওড়না দিয়ে । মাথা নামিয়ে রেখেই ভদ্রতা বোধক জবাব দিলো
– নাহ, তেমন কেনো হবে। যা কিছু আছে এখন এইখানেই তো।
আরহাম মুর্তজা হয়তো প্রসন্ন হলো নাহ এরূপ জবাবে। একই স্বরে পুনরায় বললেন
– তাহলে এখনো আংকেল আন্টিতে কেনো আঁটকে আছো মা। মেহরাজের বাবা মা তো তোমারও তাই-ই। এর মানে তো এমনটাই হয়।
মোহর প্রত্যুত্তরের শব্দ খুঁজে পেলো নাহ। তবে মোহরের হয়ে জবাব টা পৌঢ়া কণ্ঠে এলো
– বাবা মা সুলভ আচরণ পেলে তো বাবা মা বলবে। ওকে সামনে পেলেই তো কথা শোনাতে ছাড়েনা আমার বউয়েরা। ওর আর কি দোষ। কই আমাদের তো ওভাবে ডাকে না।
ভ্রু কুচকে এলো কাকলির। কাপে চুমুক দিয়ে থপ করে রেখে দিলেন টি-টেবিলে। যেনো তিতকুটে স্বাদ পড়েছে মুখে। তেঁতো স্বাদটা যে চায়ে নয় বরং কথায় লেগেছে এটা বুঝতে উপস্থিত কারোই অসুবিধে হলো নাহ।কিন্তু আম্বি বেগমের মুখাবয়বের তেমন কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেলো নাহ। বরাবরের মতোই তিনি এবারেও শান্ত।
আলোচনা পুনরায় শুরু হলো। মোহর উঠে আসতে নিলে তিয়াসা ফোন থেকে মুখ তুলে বলল
– মোহর, সবাইকেই যখন চা দিচ্ছো আমাকে একটু কফি বানিয়ে দিতে পারবে? আসলে আমি এসব চা নাস্তা খাইনা।
মোহর জবাব দেওয়ার আগেই তাথই বলল
– মোহর তোমাকে মনে হয় ভাই খুঁজছিলো। তুমি বরং সেখানেই যাও তিয়াসার কফি মালা করে দিচ্ছে।
– মালা কেনো দেবে সবাইকে ও দিলো তিয়াসাকে দিতে সমস্যা কি।
কাকলির রূঢ় গলার কথাটির উত্তরে তাথইকে প্রত্যুত্তর করতে না দিয়েই মোহর বলল
– আমি এমনিতেও এখন কফি বানাতে যাচ্ছিলাম। সমস্যা নেই, করে দিচ্ছি।
বলে আর এক মুহূর্ত দাঁড়ালো না। রান্নাঘরে এসে কফি বানিয়ে তিয়াসার হাতে এক কাপ ধরিয়ে দিয়ে আরেকটা কাপ নিয়ে উপরে উঠে এলো।
.
মেহরাজ গোসল সেরে বেড়িয়ে পুরো রুম জুড়ে চোখ বুলালো। ভ্রুদ্বয় ব্যাপকভাবে কুঞ্চিত হলো। তপ্ত নিঃশ্বাস ফেললো, মন মস্তিষ্ক কেমন তিক্ত ঠেকলো। হতাশা ভর করলো চোখ মুখ জুড়ে, মেয়েটা তার এই কথাটাও শুনলো নাহ। সারা ঘরেও মোহর নেই। চুলের ডগা হতে টুপটাপ পানি বিন্দু কলি ঘেঁষে চুইয়ে পড়তেই বিরক্ততে তোয়ালে দিয়ে মুছে নিলো।
বিছানায় বসলো তিক্ত মেজাজে, সামনেই কফির কাপটা ঢেকে রাখা। কফিটা দিয়েই চলে গেলো? অনুরোধ করা সত্ত্বেও সুড়সুড় করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো মেয়েটা। কণ্ঠে অসন্তোষের ক্ষীণ অস্তিত্ব নিয়ে উঁচুস্বরে ডাকলো
– মোহ?
স্লাইডিং ডোরটা ঘেঁষেই কাছটাতে দাঁড়িয়ে ছিলো মোহর। নভস্থলের বিশালাকার চাঁদের আলোতে ফুলগুলোর মিঠা সুবাস বুক ভরে নিতে বেশ লাগছিলো। দৈবাৎ স্বভাব বিপরীত রাশভারি কণ্ঠে চমকিত হলো, ব্যস্ত পায়ে দরজা পেরিয়ে ঘরের ভেতর প্রবেশ করলো, মেহরাজ এক দৃষ্টিতে ফ্লোরে তাকিয়ে আছে, চেহারাভাব অপ্রসন্ন। অবিলম্বেই মোহর এগিয়ে এলো
– ডাকছিলেন আমায়?
মেহরাজ পেছন দিক থেকে আগমনী স্বরে না চমকালো নাইবা তাকালো, বরং ভারী কণ্ঠে বলল
– আপনাকে আমি চোখের সামনে থাকতে বলেছিলাম, গোসল সেরে বেড়িয়েই আমাকে ফাঁকা ঘরটা কেনো দেখতে হলো মোহ?
গম্ভীর প্রশ্নের বিপরীতে নিরুত্তর রইলো মোহর। এই মানুষটার যত্নে আদরে যতটা না মিইয়ে যায় মোহর তার চেয়েও বেশি ভীত হয় তার গম্ভীর প্রশ্ন আর শাসনে।
নতমস্তকে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় মেহরাজ ঝুকিয়ে রাখা ঘাড়টা কাৎ করে তাকালো, চোখের ইশারায় মোহরকে নিজের কাছে ডাকলো। বাধ্যগত বাচ্চার মতো গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে এলো মোহর। কাছাকাছি আসতেই হাতের তোয়ালেটা ছুড়ে সামনের ডিভানে ফেলে দিলো মেহরাজ। আচানক মোহরের কবজিতে টান দিয়ে নিজের কোলের উপর বসালো।
ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব মোহর কোনো কিছু সম্পূর্ণভাবে উপলব্ধি করার আগেই কোমরে উপস্তিত চওড়া হাতের থাবা টা দৃঢ়তর হয়ে উঠলো। পাতলা কোমরটাতে পেশিবহুল হাতের চাপের কিঞ্চিৎ ব্যথা অনুভূত হলো মোহরের, তবুও টু পরিমাণ শব্দের অস্তিত্ব বেরোলো না মুখ থেকে।
মেহরাজ হাতের থাবায় চিকন শরীরটাকে নিজের বুকের একেবারে কাছাকাছি এনে অধৈর্য গলায় অতৃপ্ততার সহিত বলল
– আপনি আমাকে উন্মাদ করে ফেলছেন মোহ, নিজের উপরে নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছি আমি।
সমস্ত কম্পনযুক্ত উদ্দাম অনুভূতি গুলোকে চোয়াল শক্ত রেখে সামাল দেওয়ার প্রচেষ্টা করলো মোহর। চোখ দুটো নামিয়ে রাখলো দৃঢ়ভাবে। মেহরাজ, মেহরাজের দৃষ্টি আর তার কণ্ঠস্বর সবটা জুড়ে মা’দকতা নে’শাক্ততা।
মোহরের থুতনিতে তর্জনী ঠেকিয়ে নতজানু মুখটা নিজের মুখের কাছাকাছি ফেরালো মেহরাজ। কিছুক্ষণ আগের মতোই চেয়ে গাঢ় গলায় বলল
– আপনার কি আমাকে একটুও ভালোবাসতে ইচ্ছে করে না মোহমায়া?
মোহর উত্তর খুঁজে পাইনা। কিছুদিন আগ অব্দি হলেও হয়তো হাসফাস করা সত্ত্বেও না বলে দিতো। কিন্তু এখন! এখন কি বলবে সে?
মনখানা যে খুব করে বলে উঠছে ‘ আপনাকে ভালো না বেসে থাকার মতো সাধ্য বা নিষ্ঠুরতা কোনোটাই যে আমার নেই আব্রাহাম সাহেব ‘
কিন্তু বলা হলো নাহ, ধূসরময় চোখের গাঢ়ত্বের সামনে মোহর সদা সর্বদা নির্জীব, নাজুক। ও চোখে তাকিয়ে শব্দের দারিদ্র্যে পড়ে যাই সমস্ত চিত্ত।
বার দুয়েক পলক ঝাপটে মাথা নুইয়ে বলল
– আপনি নিচে যাবেন নাহ?
– উঁহু, আপনার সাথেই থাকতে চাই
নিস্তব্ধতায় মোহরের ফোঁসফাঁস নিঃশ্বাসের শব্দটা খুব মনোযোগ দিয়ে মুখস্থ করলো মেহরাজ। অতঃপর প্রগাঢ় গলায় আদেশসুলভ বলল
– যতো লজ্জা আসে সবটা জিইয়ে রাখুন মোহ, সব লজ্জার আব্রু আমি নিজ হাতে খুলবো। খুব ভালোবেসে, যতনে দুজনের মাঝের একটা একটা পর্দা উন্মুক্ত করবো। এইরকম ছোট খাটো স্পর্শের অভ্যাস করে নিন, ধৈর্যের বাধ আর খুব বেশি দীর্ঘায়িত করতে পারবো না মোহ।
যেনো নিঃসঙ্কোচ, সুপ্ত বাসনাটা অবলীলায় বলে দিলো মেহরাজ। মোহরকে আরও লজ্জা, আড়ষ্টতায় মিইয়ে দিয়ে খুব নির্লিপ্ততার সাথেই চেয়ে রইলো জবাবের অপেক্ষায়।
বলি এর জবাবে মোহরের কি বিন্দুমাত্র কথা সাজে? এর প্রত্যুত্তর কি হয় তাও জানা নেই মোহরের। মেহরাজের গাঢ় চাহনি, আর ভ্রমের সুযোগ নিয়ে হুট করে এক ঝটকায় নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে সরে দাঁড়ালো মোহর, মেহরাজ হাসলো অল্প বিস্তর। টকটকে ঠোঁট দুটি অবলীলায় প্রসারিত হলো ভাঁজ খুলে,
খানিকের নিস্তব্ধতা ভেঙে কালো টি-শার্ট পরিহিত শুভ্র পুরুষটি নির্লজ্জের ন্যায় বলে উঠলো
– আপনি দূরে দূরে পালিয়ে বেড়ান বলেই আমার আপনাকে বারবার ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করে মোহমায়া।
.
মাঝরাত গড়িয়ে রজনী এগিয়েছে নিগূঢ়ত্বের আরও গভীরে। তখন কোনো মতে মেহরাজের কথা থেকে পালিয়েছে মোহর, মেহরাজও আর বিরক্ত করেনি ওকে, বেশ কিছুক্ষণ আগে বই নিয়ে বসেছিলো। লাস্ট কয়েকটা অ্যাসাইনমেন্ট এখনও বাদ আছে। কিছুদিন পর হতেই ইন্টার্নশিপ শুরু হবে। কোনো প্রকার গাফিলতি চাইনা মোহর।
প্রচুর মনোযোগে বইয়ে ডুবে থাকা অবস্থায় হঠাৎই মেহরাজ ল্যাপটপ ছেড়ে কৌতূহলী গলায় বলল
– আপনার বুবুর উপহারটা তো এখনো খুলে দেখলেন না মোহ?
তড়িৎ সচকিত হয়ে তাকালো মোহর। তাই তো! সেদিন এসে রেখেছিলো রাতে ঘুম আর আজ সারাদিন ব্যস্ততার দরুন একটুও খেয়াল আসেনি মোহরের। মেহরাজের কথাটা শুনেই মনে পড়ে গেলো।
বই ছেড়ে তড়িঘড়ি করে উঠে কাবার্ড থেকে পেপারে মোড়ানো বর্গাকৃতির চওড়া বস্তুটা বের করলো। প্রচণ্ড উচ্ছ্বসিত হয়ে এলোমেলো হাতে কাগজ গুলো খুলতে গিয়ে আরও গুলিয়ে ফেললো মোহর
– এভাবে পারবেন নাহ। আপত্তি না থাকলে আমাকে দিন, খুলে দেই?
বলে মেহরাজ হাতটা বাড়িয়ে দিলো। মোহর ও দ্বিধাহীন মেহরাজের হাতে ধরিয়ে দিলো। কাগজ গুলো খুব দক্ষভাবে কয়েক সেকেন্ডের ভেতর খুলে উন্মুক্ত করলো, বেশ ছয় ইঞ্চিখানেকের আকৃতির ছবিম্যাট। তাতে জ্বলজ্বল করছে চারটি হাসিমুখ। নির্মল হাসি, আর চেহারাটুকুই বুঝিয়ে দিচ্ছে ছোট্ট পরিবারের অটুট বন্ধনটা।
কয়েক লহমা স্থিরনেত্র চেয়ে তাকালো মোহরের উৎসুক মুখের দিকে। ধৈর্যটুকু বোধহয় সহ্য হলো না মোহরের, মেহরাজের হাত থেকে খপ করে ফ্রেমটা নিলো।
ঠিক যতটা উচ্ছ্বাস, প্রাণবন্ততা, আর আগ্রহের সাথে জিনিসটা হাতে নিয়েছিলোম তার দ্বিগুণ হারে চুপসে গেলো হাস্যজ্বল মুখখানা। চোখের সামনে ভেসে উঠলো চারটি প্রাণের হাসিভরা অকৃত্রিম দৃশ্য। বাবা মা বুবু আর তাদের মাঝে গলা ধরে দাঁড়িয়ে থাকা মোহর। বাবা মায়ের সেই তখনকার হাসিটা যেনো হুট করেই প্রতিধ্বনিত হয়ে কানে বেজে উঠলো মোহরের, থপ করে হাত থেকে পড়ে গেলো ফ্রেমটা। দুহাত মুখে চেপে ধরলো উদ্ভ্রান্তের মতো। চোখ বয়ে গড়িয়ে পড়লো বিরামহীন ধারা। হাসফাস করতে করতে হুট করেই সশব্দে কেঁদে উঠলো মোহর। বাবা মা বুবুকে নিয়ে সেই সুখের পরিবারের স্মৃতি গুলো দগদগে ঘাঁয়ের মতো তাজা হয়ে উঠলো। কান্নার হিড়িকে কেঁপে উঠলো মোহর।
মেহরাজ একটুও সময় ব্যয় না করে এগিয়ে এলো মোহরের কাছে। দুহাতে ওর মুখে চেপে রাখা হাতটা সরিয়ে দিতে দিতে বলল
– মোহ? মোহ কাঁদে নাহ! দেখি আমাকে দেখেন আমার কথাটা শুনুন
একটা শব্দ অব্দি মোহরের কান অব্দি পৌঁছাতে পারলো নাহ। ও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেই চলেছে। মেহরাজের বক্ষে প্রচন্ডভাবে যন্ত্রণা শুরু হলো মোহরের বিধ্বস্তী অবস্থা দেখে। দুহাতে সজোরে ঝাপটে ধরলো মোহরকে বুকের মাঝে, প্রচন্ড ভারাক্রান্ত অবস্থায় একটু খানি ঠাঁই পেয়ে মোহরের আবেগ গুলো আশকারা পেয়ে মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো।
মেহরাজের পিঠ দু’হাতে খামচে ধরে কেঁদে উঠলো। কি করে সামলাবে নিজেকে ও, এই ছবিটা মোহরের বাবা মা’রা যাওয়ার দিন কয়েক আগেই তোলা। বাবার ফোনে চারজন তুলেছিলো একসাথে। মোহরের জন্মদিনে বাবার উপহার স্বরূপ ফ্রেমবন্দী করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো ওর বাবা। ফ্রেমবন্দী তো করেছিলো ছবিটা কিন্তু উপহার টা আর মোহরের হাতে তুলে দিতে পারেনি। তার আগেই তো…
আর ভাবতে পারলো না মোহর, মেহরাজের বুকে মুখ গুঁজে চিৎকার, আহাজারি করে কেঁদে উঠলো। নিজেকে সামলে নেওয়ার ভীত টা তড়তড় করে নড়ে উঠলো। এতদিনে তিলে তিলে নিজেকে বুঝিয়ে নেওয়া সত্তাটাও মেহরাজের বুকে ঠাঁই পেয়ে উন্মত্ত হলো অনুভূতির জোয়ারে দুচোখ সিক্ত করতে।
.
.
.
চলমান
©Humu_❤️