#তুমি_অপরূপা (১৬)
গিটারের টুংটাং শব্দ আর ধূমায়িত চায়ের কাপের সাথে সমুদ্রের আজকের দিনটি কাটছে।আজকের দিনটা কেমন মন খারাপ করা দিন,কেমন উদাসী হয়ে বসে থাকতে ইচ্ছে করে।
কাপের চা শেষ হতেই সমুদ্র উঠে দাঁড়ালো আরেক কাপ চা আনার জন্য। ঘন ঘন চা খেতে হয় বলে নিজেই নিজের চা বানায়। একটু আগে যদিও মায়ের দেওয়া চা পান করেছে এবার আর মা’কে চা’য়ের কথা বলার মতো রিক্স নিলো না।কেননা সমুদ্র জানে এবার চা চাইলে চায়ের সাথে জুতা ও ফ্রী দিবে মা।
নিজেই দুই কাপ চা বানিয়ে মায়ের রুমে গেলো। তারপর এক কাপ মা’কে দিয়ে নিজে জানালার পাশে বসলো।
রেখা ছেলের গতিবিধি তীক্ষ্ণ নজরে লক্ষ্য করছেন সারাদিন ধরে। ছেলেটা আজ ভীষণ আনমনা হয়ে আছে। চা’য়ের কাপে চুমুক দিয়ে রেখা বললো, “চা তো ভীষণ ভালো হয়েছে রে সমুদ্র।”
সমুদ্র হেসে বললো, “ধন্যবাদ মা।”
রেখা কিছুক্ষণ চুপ থেকে জিজ্ঞেস করলেন, “মন খারাপ বাবা?”
সমুদ্র চমকে তাকালো মায়ের দিকে। মা কিভাবে জানলো তার মন খারাপ যে!
মুচকি হেসে বললো, “না মা,মন খারাপ না।”
“আমার সাথে মিথ্যে বলছিস,ভুলে যাস না আমি তোর মা।তুই আমার পেট থেকে হয়েছিস,আমি তোর পেটে না।”
মায়ের কথা শুনে সমুদ্র হাসতে লাগলো। রেখা অবাক হয়ে দেখছে ছেলের ঠোঁটে হাসি অথচ দুই চোখ দিয়ে অঝোরে জল ঝড়ছে।
হাসতে হাসতে সমুদ্র বিদায় নিলো মায়ের রুম থেকে ।
রুমে গিয়ে ল্যাপটপ অন করে কয়েকটা পিকচার দেখতে লাগলো। বুকের ভেতর থেকে থেকে কেমন একটা ব্যথা উঠছে।যেই ব্যথা মনে করিয়ে দিচ্ছে প্রচন্ড কষ্টের কথা।
আলমারি থেকে ছবির এলবাম বের করতে গিয়ে সমুদ্র থমকে দাঁড়ালো আলমারিতে রাখা একটা ওড়না দেখে । অস্ফুটস্বরে বললো,
“কপালকুন্ডলা!
মাই গুডনেস! কপালকুন্ডলা ঢাকায় এসেছে, অথচ এতো খুঁজেছি আমি তাকে গ্রামে,কিন্তু পাই নি।
শিট!
এখন আমি তাকে আবার কোথায় খুঁজে পাবো! ”
————–
শাহেদকে বিদায় দিলো অনামিকা এক বুক ব্যথা নিয়ে। এতো দিন ধরে শাহেদের সাথে থাকতে থাকতে বাবা মায়ের খবর নেওয়ার কথা তেমন একটা মনে পড়ে নি।কিন্তু গতকাল মা’কে যে অবস্থায় দেখেছে তার পর থেকে অনামিকা নিজেকে নিজে কিছুতেই ক্ষমা করতে পারছে না।
নিজেকে ভীষণ অপরাধী লাগছে তার।
গতকালের কথা মনে পড়তেই অনামিকার হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেলো ।
সিরাজ হায়দার মেয়ে আর মেয়ের জামাইয়ের সালাম নিয়ে ঘরে চলে গেলেন।অনিতা ও বাবাকে দেখে বোনের পাশ থেকে সরে চলে গেলো বাবার কাছে । বাবা মেয়ে মিলে রান্নাবান্নার কাজে লেগে গেলেন শাহেদ আর অনামিকাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে। যেনো উঠোনে কেউ নেই।
বাবার রাগ সম্পর্কে অনামিকার ধারণা আছে, তাই ভয়ে সামনে এগিয়ে যেতে পারছে না।লজ্জায়,অননুতাপে ম্রিয়মাণ অনামিকার সাহসে দিচ্ছে না বাবার সামনে যেতে আর।
সিরাজ হায়দার ঘরে গিয়ে সালমা কে নিয়ে এলো। বারান্দায় একটা টুলে এনে বসালো পরম যত্নে।সিরাজ হায়দার ছাড়া আর কাউকে চিনে না সালমা।ভুলে যায় সবার কথা বারবার।
অনামিকা মা’কে দেখে শোকে মুহ্যমান হয়ে গেলো। বুকের ভেতর থেকে কান্না দলা পাকিয়ে গলায় এসে আটকে গেছে। ইচ্ছে করছে আকাশ বাতাস ফাটিয়ে চিৎকার করে কান্না করতে।কিন্তু পারছে না কিছুতেই।সারা শরীর যেনো জমে বরফ হয়ে গেছে,চাইলেও নড়াচড়া করতে পারছে না।
শাহেদ পরিস্থিতি থমথমে দেখে প্রথমে চুপ ছিলো। শাশুড়ীকে দেখে শাহেদের নিজের ও বুক কেঁপে উঠলো। এতটা মানসিক আঘাত দিয়েছে সে!
ভেবে পাচ্ছে না কি করবে শাহেদ।তবুও সাহস করে সামনে এগিয়ে গেলো শাহেদ।সিরাজ হায়দার শাহেদ কে এগিয়ে আসতে দেখে রান্নাঘর থেকে ধারালো দা** নিয়ে এসে বসলো বারান্দায়। তারপর বজ্রকণ্ঠে বললো, “আর এক পা ও আগাইবেন না আপনেরা দুইজনে। তাইলে কইলাম আইজ এইখানে র**ক্তের বন্যা বহাই দিমু আমি। আমি কাউরে চিনি না,আমার শুধু দুইটা মাইয়া।বড় দুই মাইয়ারে আমি মনে মনে অনেক আগেই কুরবানি দিয়া দিছি। ”
গতকালের কথা ভাবতে ভাবতে অনামিকা ডুকরে কেঁদে উঠলো। কেনো এমন হলো তার ভাগ্য! কেনো এরকম করলো সে!
আজ কিভাবে নিজেকে নিজে সামলাবে?
রুমে অনামিকা এসব ভেবে কাঁদছিলো,সেই মুহূর্তে রোজিনা রুমে এলো। অনামিকার হাত ধরে টেনে বাহিরে নিয়ে বললো, “নবাবজাদি হইছস তুই?ঘরে বইসা বইসা কান্দনের নাটক দেখাস?দুনিয়ার কাজ বাহিরে,কাজ করবো কে?”
।অনামিকা শাশুড়ীর এরকম ব্যবহার দেখে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।
রোজিনা থামলো না,অনামিকার হাত ধরে পুকুর ঘাটে নিয়ে বললো, “এই সব কাপড় ধুইবি, তারপর সব শুকাতে দিবি।ধোয়া হইলে রান্দন বসাইবি ”
অনামিকা তখনও হতভম্ব হয়ে আছে। পুকুর ঘাটে জমে আছে অনেক গুলো কাপড়। রোজিনা আলমারি থেকে তোলা সব কাপড়, ঘরের আনাচে কানাচে থাকা সব কাপড় বের করে এনেছে অনামিকাকে দিয়ে ধোয়ানোর জন্য।
চোখের জল মুছে অনামিকা কাজে লেগে গেলো। নিজের হাতে নিজের বিপদ নিজে যখন ডেকে এনেছে তখন তার মূল্য তো দিতেই হবে।
————–
গতকাল রেশমা এসে চলে যাওয়ার পর অন্তরা কিছুটা স্বস্তি পেলো । কিন্তু সেই স্বস্তিকে আতংকে রূপ দিতেই পরদিন অন্তরা আবারও এসে হাজির সাতসকালে।
জুয়েল অফিসে যাওয়ার আগ মুহূর্তে রেশমা এসে হাজির হলো।
অন্তরা তখন জুয়েলের জন্য ভাত বাড়ছে।
কলিং বেল বাজতেই জুয়েল দরজা খুলে দিলো। জুয়েলকে দেখে রেশমা জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলো। পলকহীনভাবে অন্তরা সেই দৃশ্য দেখতে লাগলো। বুকের ভেতর তখন কেমন কালবৈশাখী ঝড় উঠেছিলো তা কেউ জানতে পারে নি।
জুয়েল রেশমাকে এক ঝটকায় সরিয়ে দিয়ে সরে দাঁড়ালো। তারপর ক্রদ্ধস্বরে জিজ্ঞেস করলো, “তুমি! কেনো এসেছ এখানে?”
রেশমা আগে থেকেই চিন্তাভাবনা পরিকল্পনা করে এসেছে।সেদিন চিড়িয়াখানায় জুয়েলদের দেখেই পিছু নিয়ে এসেছে এখানে।যার হাত ধরে সাজানো সংসার ছেড়ে গিয়েছিলো,তার কাছে টিকতে পারে নি।
নেশাখোরের সাথে তো জীবন কাটানো যায় না।
রেশমা সহজভাবে জবাব দিলো, “আমি আমার ছেলেকে ছেড়ে কোথাও যাবো না। আমার ছেলেরে নিয়াই যাবো। ”
“ছেলেকে ছেড়ে যেদিন অন্য পুরুষের সাথে পালাইছিলা,সেদিন মনে ছিলো না ছেলের কথা? ”
“এতো কথা বুঝি না আমি, আমি রানারে ছাইড়া যাবো না। তাছাড়া আমাদের এখনো ডিভোর্স হয় নাই।তুমি আমারে ডিভোর্স দিলেও আমি সই করমু না। আর যদি সই করতেই হয় তাইলে দেনমোহরের ৪ লাখ টাকা আর রানা দুইটাই দিতে হবে আমারে।”
জুয়েল থমকে দাঁড়ালো রেশমার কথা শুনে। তারপর হঠাৎ করেই রেশমার গলা টিপে ধরে দাঁত কিড়মিড় করে বললো, “আর যদি তোরে এইখানেই এখন মাই**রা ফালাই তাইলে তো কোনো কিছুই দিতে হইবো না।আমারে জিন্দা লাশ বানাইয়া চইলা গেছস আবার ফিরলি ক্যান?আমি সংসার করতাছি দেইখা কি গায়ে জ্বালা ধইরা গেছে? ”
রানা ছুটে এসে মা’কে জড়িয়ে ধরে মা মা করে কেঁদে উঠলো, অন্তরা টেনে জুয়েলকে ছাড়িয়ে দিলো।
কাশতে কাশতে রেশমা ফ্লোরে বসে পড়লো গলা চেপে ধরে। এরকম অনেক কিছুই হবে সব রেশমা আগেই ভেবে রেখেছে। সব কিছু সহ্য করার মানসিকতা নিয়েই রেশমা এই খেলায় নেমেছে। সাজানো সংসার আবারও ফিরে পেতেই হবে তার।
যেভাবেই হোক তা!
চলবে……
রাজিয়া রহমান
(টাইপিং মিস্টেক থাকতে পারে অনেক,দয়া করে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।)