#বৃষ্টি_শেষে_রোদ (পর্ব ১৮)
#মেহেদী_হাসান_রিয়াদ
কেটে গেলো আরো অনেকদিন। ফাইনালি দেশে ফিরেছে রিদ। ছেলে এত বছর পর ফিরে আসছে দেখে বাড়িতে উৎসবের কমতি নেই যেন। মাঈমুনা চৌধুরি নিজ হাতে ছেলের জন্য তার পছন্দের সব খাবার রান্না করেছে সকাল থেকে। আরশিকে বলেছিল রিদের ঘরটা যেন পরিষ্কার করে সুন্দর করে গুছিয়ে রাখে। কারণ তার ধারণা ফ্যামিলির পর রিদ সবার থেকে বেশি যাকে পছন্দ করে সে হলো আরশি। কেউ একটা না বুঝলেও মা হয়ে সে এটা খুব ভালোভাবেই বুঝে।
তাই আরশি সব কিছু গোছগাছ করে রেখেছে শুনলে নিশ্চয়ই সবচেয়ে বেশি খুশি হবে সে। মা তো আর জানে না আরশির প্রতি তার ছেলের মাঝে তীব্র অভিমান জমেছিল অনেক আগেই।
গাড়ির আওয়াজ শুনেই ঘর থেকে বেড়িয়ে আশে সবাই। গাড়ি গেট পেড়িয়ে বাড়ির সামনে এসে থামলো। রিদ গাড়ি থেকে নামতেই মাঈমুনা চৌধুরি এগিয়ে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলেন। বাবার সাথে আগেই কথা হয়েছে। কারণ বাবা আর রোহান মিলে তাকে এয়ারপোর্ট থেকে রিসিভ করেছে।
রুমকিও এগিয়ে আসে ভাইয়ার সামনে। উপস্থিত সবাইকে দেখলেও কয়েক সেকেন্ড অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিল রিদ। সবার আড়ালে দাড়িয়ে থাকা আরশি ভালোই বুঝতে পারলো রিদের এই অনুসন্ধানী দৃষ্টির মানে। নিজেকে সে দৃষ্টি থেকে লুকাতে চেয়েও ব্যর্থ হলো সে। রিদের চোখাচোখি হতেই যেন অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো তার। বুকের ভেতর যেন বয়ে গেলো এক তীব্র ঝড়ো হাওয়া।
এতক্ষণ লুকানো দৃষ্টিতে সকলের পেছনে নিজেকে আড়াল করে দাড়িয়ে নিশ্চুপ হয়ে চেয়ে ছিল আরশি। প্রথম দু’বছর সুন্দর ভাবে চললেও একটা ঝড়ের পর মানুষটার সাথে একটু কথা বলারও সুজুগ পায়নি সে। দুরুত্ব টা বেড়ে গেলো আকাশ সমান।
এত বছর পর রিদ ভাইয়ের মুখটা সামনে আসতেই বুকটা ধুকপুক করছে তার। ইচ্ছে করছে সবার মতো সেও ছুটে গিয়ে রিদ ভাইয়ার সামনে দাড়াতে। অতিতের মতো কোনো দ্বিধাহীন ভাবে হাস্যজ্জল মুখে মুগ্ধ নয়নে তার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে।
কিন্তু সেই সাহস যে একটুও অবশিষ্ট নেই তার। কোন মুখে মানুষটার সামনে দাড়াবে সে? এত কিছুর পর নিশ্চয়ই রিদ ভাই তার মুখও দেখতে চাইবে না।
আরশির দিকে চোখ পড়তেই এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল রিদ। আরশির পাশে ঠিক পেছনটাই দাড়িয়ে আছে ফারুক। ছেলেটাকে আজও আরশির পাশে সহ্য হচ্ছে না রিদের। এই মুহুর্তে ইচ্ছে করছে আশে-পাশের সব কিছু এলোমেলো করে ফেলতে। তবুও নিজের পুরো ক্রোধকে সামলে নিল সে। দু’য়েক সেকেন্ড তাদের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে অতঃপর একটা শ্বাস নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে ঘরের দিকে হাটা ধরলো চুপচাপ।
চোখ বুঁজে নিল আরশি। স্থির হয়ে দাড়িয়ে রইল ওভাবেই। বুকের ভেতর শুরু হলো বিষাদের তীব্র ঝড়। আজ মানুষটা তার দিকে ভালো করে তাকাচ্ছেও না পর্যন্ত। অথচ এক সময় প্রেয়সীকে এক নজর দেখার জন্য হলেও কোনো অজুহাত সাজিয়ে তাদের বাসায় গিয়ে হাজির হয়ে যেতো। এখন যেন একটা ঝড়েই বদলে গেলো সব কিছু।
পেছনে কারো উপস্থিতি টের পেয়েই ছলছল করা চোখ দুটি হাত দিয়ে মুছে নিল আরশি। অতঃপর পেছন ফিরে তাকাতেই ফারুক কিছুটা আফসোস ভঙ্গি করে আরশিকে উদ্দেশ্য করে বলে,
” চচচচচচ,,,,, ইশ,,,,, পাত্তাই দিল না আজ। অবশ্য দেওয়ার কথাও না। বাইরের দেশে এত বছর চারপাশে ফরেনার মেয়ে দেখে এখন তোমাকে ভালো না লাগাটা অস্বাভাবিক কিছু না। ফরেনারদের স্বাদ পেলে তোমাকেই বা মনে রাখবে কেন? বরং তুমিই বোকার মতো তার অপেক্ষায় নিজেকে কষ্ট দিয়ে যাচ্ছো। যার কোনো ভিত্তি নেই। সো সেড মাই ডিয়ার,,,,,”
ফারুক’কে পেছনে দেখে ক্ষনিকটা চমকালো আরশি। একটা মানুষ কতটা নির্লজ্জ হলে এতকিছুর পরও পেছনে ঘুরঘুর করে। ফারুকের এমন কথায় রাগে গা জ্বলে উঠলো আরশির। পরপর কয়েকটা শ্বাস নিয়ে নিজের ক্রোধকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে বলে,
“সবাইকে নিজের মতো মনে করেন আপনি? যে নিজের গার্লফ্রেন্ড থাকা স্বত্বেও অন্যের সুন্দর সম্পর্কটা শেষ করে দিয়েছেন একটু একটু করে। তাছাড়া চরিত্রহীন শব্দটাতো আপনার নামের পেছনেই ভালো মানায়।”
আরশি খুব রাগ থেকে অপমান করতে চাইলেও ফারুকের মাঝে কোনো অপমানিত হওয়ার ভাব দেখা গেলো না। বরং মুখে হাসি টেনে বলে,
“তা তো দেখতেই পাচ্ছি। আজ এত বছর পর এসেও তোমার দিকে ভালো করে ফিরেও তাকাচ্ছে না।”
আরশি নিজের রাগ ধরে রাখতে না পেরে অগ্নি দৃষ্টিতে চেয়ে বলে,
“এটাই তো চেয়েছিলেন আপনি। আর সফলও হয়েছেন। এত কিছু করেও শান্তি হয়নি আপনার? আমার জীবনটা নরক করে তুলেছেন। রুহি আপুর দেবর না হলে এখনই আপনাকে সবার সামনে জু’তা পেটা করে এ বাড়ি থেকে বের করতাম।”
ফারুক অপমানিত হওয়ার বিপরীতে আবারও হেসে দিল। তার এমন বেহায়াপনা দেখে অসহ্য চহুনিতে ফোঁস ফোঁস করে কয়েকটা শ্বাস নিয়ে ঘরের দিকে চলে গেলো আরশি। জীবনে এমন বাজে বিহেব সে কারো সাথে করেনি। আর না দেখেছে এমন বেহায়া মানুষ। লোকটাকে দেখলেই তীব্র ঘৃণা থেকে চলে আসে এসব। তবুও তার যেন একটুও লাজ লজ্জা নেই। এত অপমানের পরও ফারুক বেহায়ার মতো হেসে পেছন থেকে বলে,
“কেউ একজন কিন্তু এক বুক ভালোবাসা নিয়ে এখনো তোমার অপেক্ষায় প্রহর গুনছে।”
“””””””””””””””””””””””””””””””
রিদ আসবে বলে আজ লাল রঙের একটা শাড়ি পরেছিল আরশি। সাথে ম্যাচিং করে হাতে লাল কাচের চুড়ি। রুহি আপুর বিয়ের সময় রিদ বলেছিল, লাল শাড়িতে আরশিকে খুব বেশিই মানায়। দেখতে একদম বউ বউ লাগে।
রিদ মুখে হাসি রেখে এসব বললেও সেদিন খুব লজ্জা পেয়েছিল আরশি।
আজ এত বছর পর ফিরেও সারা দিনে আর একবারের জন্যও আরশির দিকে তাকায়নি রিদ। অথচ অন্য সবার সাথেই হাসি মুখে কথা বলেছে।
বিষণ্ন মনে রুমে বসে আছে আরশি। দরজা খোলার আওয়াজ পেয়ে পেছন ফিরে তাকায় সে। দেখে আরিশা আপু তার ছেলে রামিমকে কোলে নিয়ে রুমে প্রবেশ করে।
আরশির বিষণ্নতা যেন প্রকাশ না পায়, তাই স্বাভাবিক ভাব করে হাস্যজ্জল মুখে আরিশা আপুর দিকে এগিয়ে গেলো সে। দু’হাত বাড়িয়ে রামিমকে কোলে নিতে চাইলে আরিশা আপু শান্ত গলায় বলে,
“পরে নিস, আগে রিদ তোকে কেন ডেকেছে দেখে আয়।”
বুকটা যেন ধুক করে উঠলো আরশির। রিদ ভাইয়া তাকে ডেকেছে, এটা যেন এক মুহুর্তের জন্য বিশ্বাস হতে চাইছে না তার। ভুল শুনেছে ভেবে পূনরায় আরিশা আপুর দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করে,
“কে ডেকেছে আপু?”
“বুঝেও না বোঝার ঢং করবি না একদম।”
আপুর এমন সোজাসুজি কথায় চুপ হয়ে গেলো আরশি। হার্ট যেন তীব্র গতিতে বিট করছে এটা ভেবে, রিদ তাকে কেন ডাকলো হুট করে? কি বলবে সে? এত কিছুর পর সে মানুষটার সামনে দাড়ানোর সাহস টুকু অবশিষ্ট নেই তার। চিন্তার ছাপ ও অসহায়ত্ব স্পষ্ট ফুটে উঠেছে তার মাঝে। তীব্র কৌতুহল নিয়ে আরিশা আপুর দিকে চেয়ে কাঁপা স্বরে বলে,
“সে কেন ডেকেছে আপু?”
আরিশা আপু রামিমকে খাটে শুইয়ে দিয়ে এক পাশে বসে বলে,
“বলেনি আমাকে। শুধু এতটুকুই বললো, তোকে যেন বলি দু’মিনিটের মধ্যে তার সামনে যেতে।”
চোখ দুটো বুঁজে নিল আরশি। অজানা এক ভয়ে শরির যেন অবশ হয়ে আসছে। এক সময় নিজের ভাবা মানুষটার সামনে আজ কেন নিজেকে এতটা অসহায় মনে হচ্ছে বোঝার ক্ষমতা নেই তার। শুধু এতটুকুই বুঝতে পারছে, মানুষটার সামনে কিছুতেই স্থির হয়ে দাড়াতে পারবে না সে। কিছুতেই না।
To be continue,,,,,,,,,,,,,,,,