বৃষ্টি_শেষে_রোদ (পর্ব ১৯) #মেহেদী_হাসান_রিয়াদ

0
274

#বৃষ্টি_শেষে_রোদ (পর্ব ১৯)
#মেহেদী_হাসান_রিয়াদ

ধীর পায়ে রিদের রুমের সামনে আসতেই থমকে গেলো আরশি। বুকের ভেতর ধুকপুক বেড়েই চলছে ক্রমশ। ভেতরে ঢোকার সাহস পাচ্ছে না কিছুতেই। অথচ রিদ ভাই আসার আগে সকালেও এই রুম গোছগাছ করার সময় একটুও ভয় কাজ করেনি তার। আর এখন মনে হচ্ছে এই রুমে প্রবেশ করাটাই পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজ। এক মুহুর্তের জন্য ইচ্ছে হচ্ছে সময়টা এখানেই থামিয়ে দিতে। কিন্তু আফসোস, সেই ক্ষমতা কারোরই নেই।

চোখ বন্ধ করে কয়েকটা শ্বাস নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলো আরশি। নিজের মাঝে কিছুটা সাহস জুগিয়ে মনে মনে ভেবে নিল, যা হওয়ার হোক। ওড়না দিয়ে কপালে জমে থাকা ঘাম মুছে পর্দা সড়িয়ে চুপচাপ ভেতরে প্রবেশ করলো সে।

রুম পুরাই ফাঁকা। কাউকেই চোখে পড়ছে না তার। এবার যেন হাফ ছেড়ে বাচলো আরশি। আর যাই হোক, লোকটার সামনে পড়তে হয়নি। পরে জিজ্ঞেস করলেও একটা অজুহাত সাজানো যাবে, আমি গিয়েছিলাম আপনি রুমে ছিলেন না।

কয়েক সেকেন্ড ওভাবে দাড়িয়ে থেকে পুনরায় ফিরে যাওয়ার জন্য দরজার দিকে পা বাড়ালো আরশি। তখনই পেছন থেকে আরশি নামটা শুনে থমকে দাড়ালো সে। কয়েক সেকেন্ডের জন্য চোখ বুঁজে নিল অজানা ভয়ে।

অতঃপর পেছন ফিরে দেখে কপির মগ হাতে বেলকনি থেকে রুমে প্রবেশ করলো রিদ। তার শান্ত চাহুনিতেই যেন অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো আরশির। দৃষ্টি সরিয়ে মাথা নিচু করে চুপচাপ দাড়িয়ে রইল সে।

রিদ কপির মগটা এক পাশে রেখে শান্ত গলায় বলে,
“পুরোনো ক্ষত জাগিয়ে দিতে তুই একা আসলেই যথেষ্ট হতো। ফারুককে পাশে নিয়ে দাড়িয়ে থাকার প্রয়োজন ছিল না।”

বলেই কিছুক্ষণ নিশ্চুপ রইল রিদ। অসহায় দৃষ্টিতে তার দিকে তাকায় আরশি। সেদিকে তেমন একটা গুরুত্ব দিল না রিদ। বিছানায় রাখা দুইটা পেকেট হাতে নিয়ে বলে,
“যাই হোক, ওসবে তোর বা আমার কারোরই কিছু আসে যায় না।”

যেন খুব কঠিন স্বরে কথটা বলে রিদ। আরশি মাথা তুলে তার দিকে চেয়ে দাড়িয়ে আছে চুপচাপ। রিদ পেকেট দুটু তার হাতে দিয়ে বলে,
“তোর পছন্দের ওয়াচ, চকলেট, আরো যা যা বলেছিলি সবই এখানে আছে।”

এবার ক্ষনিকটা অবাক হলো আরশি। সে একবার কথার কথায় রিদকে বলেছিল দেশে ফেরার সময় যেন এগুলো নিয়ে আসে তার জন্য। তখন ছোট ছিল দেখে ইচ্ছে গুলোও ছিল বাচ্চামোয় ভরা। প্রায় চার-পাঁচ বছর আগের কথা। যা আরশির নিজেরও মনে ছিল না।
পূনরায় নিতে বললে কিছুটা কাঁপা হাতে রিদের বাড়িয়ে রাখা হাত থেকে সেগুলো নিয়ে অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে বলে,
“সেই ছোট কালে কি সব বলেছিলাম, তা এখনো মনে আছে আপনার!”

উত্তরের আশার রিদের দিকে তাকালো সে। কিছুক্ষণ নিশ্চুপ রইল রিদ। অতঃপর শান্ত গলায় বলে,
“আমি অন্য কারো মতো এতটা স্বার্থপর নই যে, সামান্য দুরুত্বে নিজ স্বার্থে অতিত ভুলে যাবো। আমি কারো প্রিয় না হতে পারলেও আমার প্রিয় মানুষ গুলো আমার কাছে খুবই মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ। তাই তাদের ইচ্ছে গুলোও অন্য সব কিছুর উর্ধে।”

এবার যেন ভেতরটায় সব কিছু দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে আরশির। কাঁন্না যেন দলা পাকিয়ে গলায় এসে আটকে যাচ্ছে। রিদ একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে অন্য দিলে তাকিয়ে পূূনরায় বলে,
“চলে যা আরশি। আমার দেওয়া শেষ উপহার গুলো ইচ্ছে হলে রাখবি, নাহয় ফেলে দিবি ওটা তোর ব্যাপার। তবে তুই আর কখনো আমার সামনে না আসলেই খুঁশি হবো। আমি কখনো মরে গেলেও যেন তোর মুখটা আমার সামনে না আসে।”

বলেই চুপচাপ বেলকনির দিকে হাটা ধরলো রিদ। স্থির হয়ে দাড়িয়ে রইল আরশি। যে মানুষটা এক সময় হালকা কষ্ট দিলেও মুহুর্তেই গালে আলতো করে হাত রেখে আহত দৃষ্টিতে চেয়ে স্যরি বলতো, সে মানুষটা আজ চোখের দিকে চেয়ে কত কঠিন কথা বলে দিল কোনো দ্বিধাহীন ভাবে।
চোখে জমে থাকা জল গড়িয়ে পড়লো গাল বেয়ে। পেকেট দুটু বুকে জড়িয়ে নিরবে কেঁদে উঠে সে। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে আজ। দৌড়ে গিয়ে মানুষটার বুকে আছড়ে পড়ে বলতে ইচ্ছে হচ্ছে,
‘আমি স্বার্থপর নই। সব কিছু মিথ্যে ছিল। আমি বেঈমানি করিনি আপনার সাথে। আমার স্বার্থের চেয়ে আপনি মানুষটা আমার কাছে সবচেয়ে দামি। আমি আজও আপনাকে সেই আগের মতো ভালোবাসি বলেই আজও আপনার অপেক্ষায় আছি।’

“””””””””””””””””””””””””””””””””

রিদ আসার পর সেদিন ও তার পরদিন মোট দু’দিন ছিল আরশি’রা। যেন খুব যন্ত্রণাময় দু’টো দিন ছিল আরশির জন্য। সে যতবারই রিদের কাছে যেতে চেয়েছে, ততবারই তাকে এড়িয়ে গেছে রিদ।

আসলেই উটতি বয়স টা খুব ভয়ঙ্কর একটা বয়স। তখন চারপাশের সব কিছুই মানুষকে মুগ্ধ করে। নিজের একান্ত পছন্দ কি, সেটা খুঁজে পাওয়াটাও খুব টাপ। তখন কল্পনার রাজ্যে থাকে মানুষ। মনে হয় এটাই জীবন। বাস্তবতাকে বুঝতে চায় কম। নিজেকে তখন উড়ে বেড়ানো কোনো রঙিন প্রজাপতি মনে হয়। কিন্তু এই বয়সটা পার হতেই মানুষ বুঝতে শুরু করে বাস্তবতা।
আরশির ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম নয়। সেই বয়সটা পেরিয়ে এখন বুঝতে শুরু করেছে তার লাইফে কোনটা ভালো ছিল। কোনটা তার ভুল ছিল।

পার হলো আরো কিছু দিন। বাসায় বাবা-মায়ের মুখে বিয়ের কথাবার্তা শুনতেই যেন অন্তরাত্মা কেঁপে উঠে আরশির। ইন্টার শেষ হওয়ার পর থেকেই অনেক প্রস্তাব এসেছে তার জন্য। বিয়ের অনেক কথা উঠেছিল বাসায়। কিন্তু এবারের ব্যাপারটা পুরোপুরি ভিন্ন।

মায়ের কাছে ছেলে সম্পর্কে ব্যাপক প্রশংসা করছে বাবা। মাও খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছিল। অতঃপর বাবা বলে,
“এত ভালো সম্বন্ধ এবার আর না করতে পারিনি। বলেছিলাম, বাসায় এসে মেয়েকে দেখে যেতে। কিন্তু ছেলে নাকি মেয়েকে আগেই দেখেছে কলেজে। তাই আর বাসায় আসতে চাইছে না তারা। বিয়ের কথাবার্তা পাকা করে ফেলতে চাইছে। তুমি কি বলো?”

আরশির মা নিরব রইল কিছুক্ষণ। অতঃপর ভেবে বলেন,
“তোমার যেহেতু ভালো লেগেছে আমি আর কি বলবো? ছেলে সম্পর্কে যা বললে তাতে অমত করার কোনো কারণ দেখছি না আমি। আশা করি মেয়ে আমাদের অনেক সুখি হবে।”

কাঁন্না আসতে চাইলে নিজের মুখ চেপে ধরে আরশি। রুমের দরজা বন্ধ করে ফ্লোরে বসে পড়ে সে। এতোদিন অনেক সম্বন্ধ মাকে বলে কোনো মতে এড়িয়ে গেলো আরশি। রিদ ফিরলে সবকিছু ঠিকঠাক করে নিবে এই আশায়। কিন্তু সে ফিরেছে ঠিকই। সাথে সোজাসাপটা জানিয়ে দিয়েছে তার মুখও দেখতে চায় না সে।

এখন কথাবার্তা অনেক এগিয়েছে। বাবা কথাও দিয়ে ফেলেছে তাদের। বাবার সিদ্ধান্তের উপর কথা বলার সাহস নেই তার। আর বলবেও বা কিভাবে? বলতে গেলেও কারণ জানতে চাইবে বাবা। তখন কি বলবে সে? যে রিদ ভাইকে ছাড়া অন্য কাউকে তার লাইফে সহ্য করা অসম্ভব?
আর এটা বলবেও কোন ভরসায়? ভালোবাসাটা যে এখন একপক্ষীক। বিপরিত মানুষটার মনে তার জন্য তীব্র অভিমান জমে আছে। এক হতে দুজনের মতামতই তো প্রয়োজন। ভাবতেই যেন বুকটা হাহাকার করে উঠছে তার।

“”””””””””””””””””””””””””””””””””

গিটার হাতে ছাঁদে বসে আছে রিদ। অনেক দিন পর আজ গিটার হাতে বসা। পড়াশোনার চাপে সময় হয়ে উঠেনি অনেকদিন। সন্ধার পর এই নিস্তব্ধ পরিবেশে নিজের প্রিয় গানের শুর যেন মনকে ভালো করে দেয় মুহুর্তেই। হটাৎই পেছন থেকে কারো আগমনের শব্দ শুনে সেদিকে ফিরে তাকায় সে।
আরশিকে দেখেই পূনরায় আগের ভঙ্গিতে বসে রইলো রিদ। পেছনে এসে দাড়িয়ে আছে আরশি। রিদ গিটারের তার ও আঙুলের দিকে দৃষ্টি রেখে বলে,
“কেন এসেছিস?”

কিছু বললো না আরশি। চুপচাপ দাড়িয়ে রইল। কিছু সময় চুপ রইল রিদও। অতঃপর উঠে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই আরশি হাত চেপে ধরে তার। রিদ তার দিকে ফিরে তাকালেই দেখে মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে আছে অনেকটা। চোখের নিচে কালো দাগ পড়তে শুরু করেছে একটু একটু করে। বোঝাই যাচ্ছে অনেক মানসিক যন্ত্রনায় দিন পার করছে সে।

আচমকাই রিদকে ঝাপটে ধরে কাঁন্নায় ভেঙে পরলো আরশি। খুব কাঁদছে আজ। সেদিন বিদায় দেওয়ার সময়ের চেয়েও বেশি। সেদিন বিদায় দেওয়ার সময়ও ঠিক এই জায়গাটাতেই জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিল সে। কথা দিয়েছিল রিদের অপেক্ষায় থাকবে। কিন্তু কথা রাখতে পারেনি সে। সময়ের সাথে পাল্টে গিয়েছিল খুব। মানুষ ভুল করলে ক্ষমা করা যায়। কিন্তু বিশ্বাস ভেঙে অনুভূতি গুলোকে টুকরো টুকরো করে ফেলা অপরাধের কি কোনো ক্ষমা আছে?

আরশি কাঁদতে কাঁদতে বলে,
“আমার বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে বাবা।”
“হুম শুনেছি।”
শান্ত গলায় কথাটা বলে রিদ। আরশি আহত চোখে তার দিকে চেয়ে বলে,
“কিছু করবেন না আপনি?”
“প্রয়োজন মনে করছি না।”
আরশি কাঁন্নার মাত্রা বাড়িয়ে বলে,
“আমি আর পারছি না। আমি খুব অপরাধ করে ফেলেছিলাম। প্লিজ হয়তো ক্ষমা করে দিন, নয়তো মে’রে ফেলে এই বিষাক্ত জীবন থেকে মুক্তি দিন। আপনার জায়গায় অন্য কাউকে কল্পনা করাটা আমার কাছে মৃত্যুর চেয়েও কঠিন। আমার ভালোবাসাকে মা’রার চেয়ে বরং আমাকেই মে’রে ফেলুন।”

কিছুক্ষণ নিশ্চুপ রইল সে। অতঃপর শান্ত গলায় বলে,
“আমার অনুভূতির মৃ’ত্যু অনেক আগেই হয়ে গেছে। আমার আবেগকেও অনেক আগেই মাটিচাপা দিয়ে দিয়েছি আমি। এখন আর ওসব কিছু নিয়ে ভাবার ইচ্ছে নেই আমার। নিজের ক্যারিয়ার জীবন স্ট্রং করাটাই এখন আমার কাছে অন্য সবকিছুর চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।”

এতটুকু বলেই নিজের থেকে দুরে সরিয়ে দাড় করালো আরশিকে। পূর্বের মতোই গালে আলতো করে হাত রাখলো আজ। কিছুটা আশার আলোয় যেন কাঁন্না ভেজা চোখ দুটো চিকচিক করে উঠে তার। রিদ তার চোখে দৃষ্টি রেখে পূনরায় শান্ত স্বরে বলে,
“দোয়া করি, সংসার জীবন সুখের হোক। নতুন জীবনের জন্য শুভকামনা পিচ্চি। ওহ্ স্যরি,, মানুষ তো সারাজীবন পিচ্চি থাকে না। ভুলে গিয়েছিলাম। ভালো থাকিস। বেষ্ট অফ লাক।”

বলেই নিরবে হেটে চলে যাচ্ছে রিদ। অশ্রুসিক্ত দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে আছে আরশি। হয়তো অনেক আশা নিয়ে এসেছিল সে। এক সময় ছোট ইচ্ছে গুলোও অপূর্ণ রাখতো না তার। অথচ আজ কাঁন্নামাখা আকুল আবেদন ফিরিয়ে দিল চোখের দিকে চেয়ে। যেন বিশ্বাসই হতে চাইছে না, কোমল হৃদয়ের মানুষটা এত এতটা পাথর হবে গেলো কিভাবে?

To be continue………………..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here