মুঠোভরা_চোরাবালি #আলিশা_আঞ্জুম #পর্ব_১৪

0
500

#মুঠোভরা_চোরাবালি
#আলিশা_আঞ্জুম
#পর্ব_১৪

পাঁচ মিনিটের পথ হাটার পর বাড়ির সম্মুখে এসে পা থামিয়ে দিলো তাসরিফ। ফাইজার দিকে ফিরে বলল

— যাও।

ফাইাজ মাটির বুকে দৃষ্টি রেখে ভারি অনিচ্ছা নিয়ে পা বাড়ালো সামনের দিকে। তাসরিফের বুকটা হুহু করে উঠলো। ফোনের ফ্লাশ জ্বালিয়ে সে ফাইজার পথের আধার কাটছে।

— ফাইজা!

হুট করে কেন যেন ডেকে উঠলো তাসরিফ। ফাইজা তড়িৎ বেগে পিছু ফিরলো। চোখ চকচক করে উঠলো যেন তার। তাসরিফ থতমত খেয়ে গেলো। কেন ডাকলো ফাইজাকে? ইচ্ছেরা ভেতর হতে যেন উত্তর দিলো সব কথা জানিয়ে ফাইজাকে নিজের কাছেই রেখে দিতে। যে ক’দিন সময় আছে হাতে সে ক’দিন একসাথে থাকতে।

— ওষুধ গুলো ঠিক ভাবে খেয়ো।

ফাইজা রেগে গেলো ভীষণ । সামনের দিকে ফিরে সে ছুটলো আগের চাইতে দ্রুত গতিতে। অজান্তে ফেলে রেখে গেলো কেবল তাসরিফের অসহায় মুখটা। ছটফট করা হৃদয়টা। তাসরিফ দাড়িয়ে রইলো ফাইজা ঘর অব্দি পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত। কে যেন দরজা খুলে দিলে ফাইজা ভেতরে প্রবেশ করে। তারপর আঁধার ফারি দিয়ে ফাইজা ক্ষণকাল তাকিয়ে দেখে তাসরিফ কে। তাসরিফ ফোনের ফ্লাশ বন্ধ করে নেয়। গাঢ় অন্ধকার জেঁকে ধরে তাকে। ফাইজা তখনই বন্ধ করে দেয় দরজা। শব্দ করে, কষ্টে ভার হওয়া বুক নিয়ে।

.

— পায়ে ব্যান্ডেজ কেন? কি হয়েছে তোমার?

বাড়ির ভেতরের লম্বা বারান্দা পেরিয়ে নিজের ঘরে পৌছানো কালেই প্রশ্নের সম্মুখীন হলো ফাইজা। কাব্য অস্থির, তোলপাড় হওয়ার অন্তর নিয়ে উৎসুক হয়ে দেখছে ফাইজার পা। শাড়ির পাড়ে রক্তের ছিটেফোঁটা!

— কি হয়েছে? আর ফুফু আসে নি? তুমি একাই এলে রাতে?

— না ভাইয়া। ফুফু ওখানেই আছে। আমার ভালো লাগছিল না বলে আমি চলে এসেছি।

— আমাকে বা সাদ কে ফোন করতে পারতে।

— নাহ! ঠিক আছি আমি।

— হ্যা দেখছি। পায়ে রক্ত নিয়ে তুমি একদম পারফেক্ট আছো।

ফাইাজ না চাইতেও ঠোঁট প্রসারিত করে ফেলল। দারুণ একটা সম্পর্ক তৈরি হয়ে যাচ্ছে কাব্যর সাথে। বড্ড ভালো লাগে তার কাব্যকে। ট্রেনে একটু কেমন কেমন মনে হলেও এখন অপূর্বজন অপূর্ব জন মনে হয়।

— আমি যাই ভাইয়া। ফ্রেশ হবো।

কাব্য হ্যা সূচক মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দেয়। সেদিনও জানতো না গাল ফুলিয়ে ট্রেনে ঝাঁঝ দেখানো মেয়টা তার ফুফু মণির মেয়ে। একদিন ভোরে জল ছুয়ে দেওয়া কণ্যাটা তার একমাত্র ফুফাতো বোন। অবাক হয়েছিল কাব্য সেদিন। আবার মনে হয়েছিল মেঘ না চাইতে সে জল পেয়েছে। যার জন্য এই গ্রামে ফিরে আসা। সে দূরের কেউ নয়।

কাব্য দীর্ঘশ্বাস ফেলল। দু’দিন হলো সে ফাইজাদের বাড়ির অতিথি। ফুফু মণির মৃত্যুর সময় তার আসা হয়নি। কেন যেন আসা হয়নি। তাকে কেউ জানায়নি তার ফুফুমণি আর নেই। এক বিড়াট ক্ষোভ নিয়ে বসবাস করা কাব্যর পরিবার ফাইজার মায়ের ভালোমন্দ নিয়ে কখনো আলোচনা করেনি। মৃত্যুর সময় শুধুই এসেছিল কাব্যর বাবা আর মা। দু’টো মাত্র ভাই বোন ছিলো কাব্যর বাবা-ফুফু। কাব্যর বুক ভেঙে কান্না আসে ফাইজার মায়ের কথা মনে পরলে। তার ফুপিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করে ফুফু মণির জন্য।

.
হাঁটতে হাঁটতে একটা রিকশা নিয়ে গহীন রাতে চার ঘন্টার পথ পারি দিয়ে বাসায় ফেরার সাহস করে উঠতে পারলো না তাসরিফ। মাথা ভনভন করছে। তন্দ্রাঘোরে একত্র হতে চাইছে চোখের পাতা। উপান্তর খুঁজে তাসরিফ আজ হাজির হলো তৃতীয় বারের মতো বোনের বাসায়। পালিয়ে বিয়ে করার দরুন মেয়ের সাথে তাসরিফের মা বাবার যোগাযোগ ঝাপসা। কেবল তাসরিফ যোগাযোগ রেখেছে গোপনে।

— তুই? এতো রাতে?

দরজা খুলেই অবাক বাঁকে চেঁচিয়ে উঠলো সাফা। ডেকে উঠলো ভেতর হতে স্বামীকে। চঞ্চল আচরণ, অহেতুক চেঁচামেচি, বাচ্চামি শুরু হলো সাফার ভাইয়ের আগমনে। তাসরিফ কে বলতেও ভুলে গেলো ভেতরে আসার কথা। তাসরিফ একাই পা বাড়িয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো। পাঁচ বছরের এক ছোট মেয়ে দৌড়ে এসে জাপ্টে ধরলো তাসরিফ কে। বুলি ফুটলো তার ‘ মামআ মামআা’। তাসরিফ কোলে তুলে নিলো পিচ্চিকে। তখনই আগমন ঘটলো অয়নের। কুশল বিনিময় করলো তাসরিফ। সাফা অস্থির হয়ে পরলো। তাসরিফের মাঝে মাঝে অবিশ্বাস্য লাগে। সে বড় নাকি সাফা বড় একথা ভাবতে গিয়ে সে তালগোল পাকিয়ে বসে। কিভাবে সম্ভব! বড়রা কখনো এতো চঞ্চল হয়? এতো ছটফটে হয়? যেখানে তাসরিফ পরিবারের ছোট সন্তান হয়েও বরফের মতো শীতল। ভাবনার মাঝেই হঠাৎ ঠাস করে শব্দ হলো। চমকে তাকালো তাসরিফ। দু পা এগিয়ে উঁকি দিলো রান্নাঘরে। চূর্ণ বিচূর্ণ হওয়া এক প্লেটের অসহায় দশা! তাসরিফ ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ছাড়লো। অয়ন দৌড়ে গেলো সাফার কাছে। চিন্তিত সুরে বলল

— তুমি ঠিক আছো?

তাসরিফ ফোঁড়ন কেটে বলল

— প্রতি মাসে আপনার কয়টা প্লেট, গ্লাস ভাঙ্গে অয়ন ভাই?

অয়ন হো হো করে হেঁসে জবাব দিলো

— বেশি না ডজন খানেক। সবসময় তো ভাঙে না তোমার বোন। এই রাগ উঠলে, হঠাৎ কাজ করতে গিয়ে, প্লেট ধুতে গিয়ে ইত্যাদি সময়ে।

তাসরিফ হেঁসে উঠলো গা কাপিয়ে। সাফা প্রচুর ক্ষেপলো। নাক মুখ কুঁচকে সে মন দিলো কাজে। তাসরিফ হাসি থামিয়ে ক্ষনিক বোনের ঘরটায় চোখ বুলিয়ে নিলো। একটা ছোট সংসার। কিন্তু সুখ এখানে অনেক। জীবনে ভুল করেনি সাফা। নিজের মেন্টালিটির একজন মানুষ কে বেছে নিয়ে সে জিতে গেছে। যে মানুষটা দিনের পর দিন সহ্য করে যাচ্ছে সাফার এলোমেলো চলন।

.

— তাসরিফ একটা কথা বলতাম।

খাওয়া দাওয়ার পাঠ চুকিয়ে তাসরিফ বসে ছিলো সাফার মেয়ের সঙ্গে। ঘুম নেই যেন মামা ভাগ্নির চোখে। অয়ন ঘুমানোর উদ্দেশ্যে চলে গেছে। সাফা বসে ছিলো ভাইয়ের পাশে।

— বলো।

তাসরিফ সহজ কন্ঠে বলল। সাফা সরু চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো

— ফাইজার সাথে তোর ডিভোর্স হচ্ছে? তুই ফাইজাকে বাসা থেকে বের করে দিয়েছিস?

তাসরিফ থমকে গেলো। সময় নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করে বলল

— হুম।

— মিথ্যাটা অনন্ত আমার কাছে বলবি না ভাই৷ একটা থাপ্পড় দেবো কান বারবার। বাচ্চা না হওয়ার জন্য তুই ফাইজাকে ডিভোর্স দিবি? তুই? এটা আমার বিশ্বাস করতে হবে? যে ছেলে বউয়ের অপারেশনের সময় আমার হাত ধরে হাউমাউ করে কেদে বলে ‘ আপু আমি বাবা ডাক না শুনে জীবন পার করতে পারবো কিন্তু ফাইজাকে ছাড়া জীবন পার করতে পারবো না’ সেই ছেলে ফাইজাকে ডিভোর্স দেবে, ছেড়ে দেবে?

— আমি আজ বাদে কাল মা*রা যাবো। আমি ফাইজার কাছাকাছি থাকতে চাই না। আমার থ্যালাসেমিয়া মেজর হয়ে গেছে।

সাফা চমকে উঠলো ভাইয়ের গোপন তথ্য শুনে। থরথর করে কেঁপে উঠলো তার দেহ। তাসরিফ উঠে দাড়িয়ে চলে গেলো গেস্ট রুমের দিকে। সাফা বিনাবাক্যে বসে রইলো। হঠাৎ হুঁশ ফিরিলে সে বলল

— তাই বলে ফাইজাকে কেন দূরে রাখছিস তুই? এটা কি বোকামি না?

— হয়তোবা। কিন্তু আমি ওর কান্না, আকুলতা দেখতে পারবো না। দেখতে চাই না।

— এখন ওর কষ্ট দেখতে তোর ভালো লাগে? ও নিশ্চয়ই এখন অনেক কষ্ট পাচ্ছে? আশপাশ থেকে শুনি তুই পাত্রীও দেখছিস। ফাইজা এগুলো শুনে ঠিক থাকবে?

— এই দুঃখ গুলো তো সামান্য। যখন শুনবে আমি আর থাকবো না তখন কি করবে? আমি নীরবে চলে যেতে চাই।

সাফা এপর্যায়ে চেচিয়ে উঠলো। কান্নাভেজা কন্ঠে আক্রোশ করে বলল

— তুই বেশি বকছিস তাসরিফ। আমি মারবো তোকে। কে বলেছে তুই….. থ্যালাসেমিয়া কি মরণঘাতী রোগ নাকি? ঠিকঠাক ওষুধ নিলে ঠিক হয়ে যাবি। বাজে কথা বলবি না একদম। বেশি বুঝিস তুই?….

তাসরিফ জবাব দিলো না সাফার কথার পিঠে। কেবল বলল

— মা’কে কিছু বোলো না আপু।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here