তুমি_অপরূপা (০৬)

0
428

#তুমি_অপরূপা (০৬)

সকাল থেকে ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। গম্ভীরমুখে সিরাজ হায়দার বারান্দায় বসে আছেন।বৃষ্টিকন্যার আগমনে উঠোনে এক হাঁটু কাঁদা জমেছে।পিচ্ছিল হয়ে আছে বাড়ির সামনের রাস্তা।
সালমা এক মগ লেবু সিদ্ধ নিয়ে এলো সিরাজ হায়দারের জন্য। জ্বর এসেছে তার গত পরশু।
একটা ছাতা কিনবে কিনবে করে কেনা হচ্ছে না। টানা বৃষ্টি হচ্ছে, বৃষ্টিতে ভিজেই সিরাজ হায়দার দোকানে আসা যাওয়া করছেন।আর তারই ফলাফল জ্বর,গলা ব্যথা,কাশি।

রূপা বারান্দায় বসে পড়ছে।অনামিকার সাথে দুদিন ধরে কথা বলছে না।অনামিকা বার কয়েক জানতে চেয়ে ও ব্যর্থ হয়েছে কেনো রূপা রেগে আছে।

ইলশেগুঁড়ি মুহুর্তে বড় বড় ফোঁটায় রূপ নিলো। এরপর ঝুম বৃষ্টি শুরু হলো।
রূপা পাটিতে বসে হিসাববিজ্ঞান অংক করছে,অনামিকা ঘরে পড়তে বসেছে। সিরাজ হায়দার লেবু সিদ্ধ খেতে খেতে মেয়ের বইয়ের দিকে তাকালো। পড়ালেখা নিয়ে এক সময় তিনি নিজেও কতো সিরিয়াস ছিলেন,কে ভেবেছিলো এক সময়ের ফার্স্ট বয় কোনো এক সময় মুদি দোকানি হবে এবং এরকম অভাব অনটনে দিন পার করবে?

পেন্সিল আনার জন্য রূপা ঘরে যেতেই শুনলো অনামিকার ফিসফিস করে কথা বলা।এক মুহূর্ত থমকে দাঁড়িয়ে রূপা ভেতরে গেলো। প্রচন্ড রাগে সারা শরীর কাঁপছে তার।এতো খারাপ কিভাবে হয় মানুষ?

রূপা ভেতরে যেতেই অনামিকা হকচকিয়ে গেলো। তড়িঘড়ি করে মোবাইল বুকের ভেতর লুকিয়ে রেখে দিয়ে তোতলাতে তোতলাতে বললো, “তুই এখানে?”

রূপা কিছু না জানার ভান করে বললো, “আমার পেন্সিল নিতে এসেছি। ”

আর কথা না বাড়িয়ে রূপা চলে গেলো। রূপা চলে যেতেই অনামিকা আবারও ফোন বের করে কথা বলতে লাগলো। রূপার সহ্য হলো না।রান্নাঘরে ছুটে গেলো মায়ের কাছে।

ভাতের মাড় গালতে নিয়েছেন সালমা।মেয়ের ছুটে আসা দেখে জিজ্ঞেস করলেন,”কিছু কইবি?খিদা লাগছে? ভাত হইছে, একটু অপেক্ষা কর।”

রূপা একটু ভেবে বললো, “ভাত খামু না আম্মা।”

সালমা নিজের কাজ করতে করতে বললো, “তাইলে কি হইছে?কিছু কইবি?”

রূপা দ্বিধাদ্বন্দে পড়ে গেলো। কি করবে সে?বলবে মা কে?না-কি বলবে না?

সালমা চুলায় তাওয়া দিয়ে শুকনো মরিচ, রসুন দিলেন টেলে নেওয়ার জন্য। শুঁটকি ভর্তা বানাবেন।রূপা চুপ করে আছে দেখে বললো, “এই গামছাটা মাথায় দিয়া একটু রান্নাঘরের পিছনে যা তো রূপা।কয়েকটা বিলাতি ধইন্না পাতা নিয়ে আয়।ভর্তায় দিলে খুব মজা হইবো। তোর বাপে গরম গরম ভাত লগে ভর্তা দিয়া আরাম কইরা চাইরটা ভাত খাক পেট ভইরা।”

রূপা রশি থেকে ভেজা,ছেঁড়া গামছাটা নিয়ে বের হলো রান্নাঘর থেকে। বড় ঘরের বারান্দা থেকে সিরাজ হায়দার ডেকে বললো, “রূপা,কই যাস এই বাদলা মাথায় নিয়া?”

রূপা বললো, “রান্নাঘরের পিছনে যাই আব্বা।ধইন্নাপাতা আনতে।”

সিরাজ হায়দার নিজে নেমে এলেন বড় ঘরের বারান্দা থেকে। তারপর মেয়ের মাথা থেকে গামছাটা নিয়ে বললেন,”তোর যাওনের কাম নাই।যেই বাদলা শুরু হইছে।জ্বরে পরলে আর সহজে সারবি না।”
রূপা দাঁড়িয়ে রইলো। সিরাজ হায়দার গিয়ে ধনেপাতা নিয়ে এলেন। রূপার হাতে ধনেপাতা দিয়ে ভিজে যাওয়া শার্টটা তিনি বারান্দায় রশিতে শুকাতে দিলেন।

রূপা ধনেপাতা হাতে নিয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে রইলো। বাবার শরীর ভীষণ শুকনো। শার্টের উপর দিয়ে এতো দিন রূপা বুঝতে পারে নি বাবার যে বুকের পাজরের সবকটা হাড়ই গুনে নেওয়া যায়। এতো ভগ্নদেহ কেনো বাবার?

আবারও একবার রূপার চোখ ভিজে এলো। এই মানুষটার উপর কি-না এক সময় প্রচন্ড অভিমান পুষে রেখেছিলো সে।

মায়ের হাতে ধনেপাতা দিয়ে রূপা চলে গেলো। তারপর নিজের পড়ায় মনোযোগ দিলো। সিরাজ হায়দার হঠাৎ করেই রূপাকে জিজ্ঞেস করলেন, “লেখাপড়া করে, বড় হয়ে তুই হতে চাস অপরূপা? ”

রূপা বাবার দিকে এক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে বললো, “আপনার খুশির কারণ হতে চাই আব্বা,আপনার মুখে হাসি ফোটাতে চাই।এই যে সবাই বলে আপনার চারটা মাইয়া হওয়ায় আপনার জীবনটা শেষ হইয়া গেছে, তাদের মুখের উপর জবাব দিয়ে দিতে চাই। ”

সিরাজ হায়দার হাসলেন।তারপর বললেন,”আল্লাহ তোরে অনেক বড় করুক মা।তোর স্বপ্ন পুরা করুক।আমি পারি নাই আমার স্বপ্ন পূর্ণ করতে।তুই যাতে পারস মা।আমার ও অনেক ইচ্ছা আছিলো কলেজে পড়ানোর। অথচ হইলাম মুদি দোকানি। ”

রূপার বুকের ভেতর ব্যথারা আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো। এক বুক হাহাকার বুকের ভেতর ঝংকার তুলতে লাগলো। এমন কেনো মানুষ?
অন্তরা আপা,অনামিকা আপা এরা এরকম হলো কেনো?
কেনো বাবাকে বুঝতে চেষ্টা করলো না এরা।

রূপা উঠে গেলো মায়ের কাছে। ভর্তা বানিয়ে সালমা প্লেটে ভাত নিচ্ছে।রূপা গিয়ে বললো, “একটা কথা কইতাম মা।”

সালমা জিজ্ঞেস করলেন, “কি?”

রূপা বললো, “মেজো আপার কাছে একটা মোবাইল ফোন আছে মা।তুমি ঘরে গিয়ে দেইখা আসো।”
সালমা চমকে উঠলো শুনে।হাত থেকে ভাতের প্লেট পড়ে গেলো। ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়লো কতগুলো ভাত।রূপা চুপ করে বসে ভাত সব কুড়িয়ে নিলো।

সালমা আস্তে করে বড়ঘরে গেলো। অনামিকা তখনো ফোনে কথা বলছে।সালমা গিয়ে খপ করে মেয়ের হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নিলো।অনামিকা কিছু বুঝে উঠার আগে সালমা একটা থা/প্পড় মারলেন মেয়ের গালে।

তারপর গমগমে গলায় বললেন,”আদর যত্তন কইরা আমি নিজের ঘরে কালসাপ পুষি।আল্লাহ এই দিন দেখানোর আগে আমার ম/রণ ক্যান দিলো না।বড় জন তো আমার মুখে চুনকালি দিছে এবার তুই ও দে।”

সিরাজ হায়দার ঘরে এসেছিলেন একটু বিছানায় শুবেন কাঁথা মুড়ি দিয়ে। বিছানায় যাবার আগেই শুনলেন সালমার কথা।পা থেমে গেলো তার।হৃৎকম্পন বেড়ে গেলো মুহুর্তে। ছুটে এলেন ভেতরের দিকে।সালমা কেঁদে দিয়ে বললো, “শুনছেন আপনে,আপনার অন্তরার মতো এই মাইয়া ও তো আপনার মুখে চুনকালি দিবো।এই দেহেন ও মোবাইল চালায়।ভাত পাই না খাইতে আমরা আর ও মোবাইল চালায়।এজন্য নি মাইয়াগো রে পড়ালেখা করাইতেছেন আপনে?”

সিরাজ হায়দার মেয়ের দিকে ছলছল চোখে তাকালেন।বুকের ভেতর তার ব্যথার ঢেউ উঠেছে। একি হলো তার মেয়েদের!
তিনি কেনো এরকম অযোগ্য পিতা হলেন যে মেয়েদের সামলাতে পারে না?
না-কি এসব তারই পাপের ফল?

কান্নাভেজা স্বরে সিরাজ হায়দার মেয়েকে বললেন,”যার লগে কথা কইতাছস,তার বাপ মা’রে নিয়া যেনো আগামী দুই দিনের ভেতর আমার বাড়ি আসে।একজন আমার মান সম্মান শেষ করছে।তুই ও সেই পথে হাটিস না।”

অনামিকা থরথর করে কাঁপতে লাগলো। কাঁপা হাতে শাহেদকে কল দিয়ে সব বললো। শুনে শাহেদ বললো, “অনামিকা, আমি আমার বাড়িতে তোমার কথা আরো আগেই জানাইছি কিন্তু আমার আব্বা আম্মা ব্যাপারটা মাইনা নিবো না।এই সম্পর্কে তাগো মত নাই।আমার পক্ষে সম্ভব না বাপ মা নিয়ে আসা।”

অনামিকার পায়ের নিচের মাটি সরে গেলো যেনো। মাথায় বাজ ভেঙে পড়লো শাহেদের কথা শুনে। তবে কি সব অভিনয় ছিলো?
কিসের জন্য এই অভিনয়?

————–

জুয়েল বাসায় ফিরে অন্তরাকে বললো, “আমাকে একটু গ্রামে যেতে হবে অন্তরা।ফিরতে দুই দিন লাগবে।”

অন্তরা বাঁধা দিলো না।গ্রামে যাওয়ার পর জুয়েল ১ সপ্তাহতে ও ফিরলো না।জুয়েলের ফিরে আসার যতো দেরি হচ্ছে, অন্তরার জুয়েলের প্রতি জমা বিশ্বাস, ভালোবাসা কমে গিয়ে অবিশ্বাস জন্মাতে শুরু করেছে।কলের উপর কল দিচ্ছে অন্তরা কিন্তু ফোন বন্ধ।

এই অচেনা শহরে অন্তরা যেনো অথৈ সমুদ্রে পড়ে গেলো।

চলবে……

রাজিয়া রহমান

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here