#বৃষ্টি_শেষে_রোদ (পর্ব ২১)
#মেহেদী_হাসান_রিয়াদ
লেখাটা কয়েকবার পড়ে স্থির হয়ে দাড়িয়ে আছে আরশি। এক মুহুর্তের জন্য ঘটে যাওয়া সব কিছুকেই একটা স্বপ্ন মনে হচ্ছে। নাকি কোনো দুঃস্বপ্ন? কাঁপা হাত থেকে পড়ে গেলো চিরেকুট। তাড়াহুড়ো করে সেটা তুলে নিয়ে হাতের মাঝে মুষ্টিবদ্ধ করে চেপে ধরলো।
‘শত অপেক্ষার পর অবশেষে নিজের করে পেতে চলেছি তোমায়।’ এই লাইনটার মানে কি? কয়েক সেকেন্ড ভাবলো আরশি। তার মানে যার সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছে সে ঐ অগন্তুক? মা’ও তো সেদিন বলেছিল বিয়ে ঠিক হওয়া মানুষটা আমাকে আগে থেকেই চেনে। তাহলে কে এই লোক? কি হচ্ছে এসব? মাথা ভার হয়ে আসছে তার। লোকটা ছাদে দাড়িয়ে আছে তার অপেক্ষায়। তার কি যাওয়া উচিৎ? এই সন্ধা বেলায়,,, না সন্ধা বললে ভুল হবে। সন্ধা পেড়িয়ে রাত হয়ে এসেছে। এই রাত্রিকালিন কোনো অপরিচিত মানুষের ডাকে ছাঁদে যাওয়াটা কি আদৌ ঠিক হবে?
একটা শ্বাস নিল সে। তার ভাবনা মতে এই জীবনের কোনো মূল্য নেই এখন। এই মূল্যহীন জীবন নিয়েই বা এত ভাবার কি আছে? কিছুক্ষণ নিশ্চুপ দাড়িয়ে থেকে অতঃপর ওড়নাটা মাথায় টেনে হাটা চুপচাপ সিড়ির রুমে এসে দাড়ালো। অস্থিরতায় এক এক করে সব সিড়ি পেড়িয়ে পৌছে গেলো ছাদের কিনারায়। সিড়ির ঘরের দরজা পার হলেই খোলা ছাঁদ। মানে ঐ মানুষটা। হটাৎ যেন বুকটায় ধুকপুক করতে শুরু হলো। উত্তেজনায় অন্য কোনো কিছুর প্রতি মনযোগ নেই তার। আবারও চোখ বুঁজে পূনরা নিজেকে স্বাভাবিক করে নেওয়ার চেষ্টা করতেই ছাদের এক পাশ থেকে গিটারের শব্দ কানে এলো তার।
এবার যেন হার্ট’টা প্রচন্ড রকমে বিট হতে শুরু করলো। কিছু সময়ের জন্য মনে মনে বারংবার দোয়া করতে লাগলো, সে এই মুহুর্তে যেটা ভাবছে সেটাই যেন সত্যি হয়। গিটার গান এটাতো তার খুব পরিচিত প্রিয় একটা মানুষের শখ।
ছাঁদে দাড়াতেই সমস্ত শরির যেন জমে গেলো তার। এক মুহুর্তের জন্য যেন মনে হচ্ছে এটা শুধুই একটা দৃষ্টিভ্রম। নয়তো বাস্তবে এটা কিভাবে সম্ভব? হয় দৃষ্টিভ্রম নয়তো স্বপ্ন। এক দৃষ্টিতে সামনে ছাদের কর্নিশে বসে থাকার মতো করে গিটার হাতে গান গাওয়া রিদের দিকে চেয়ে আছে সে।
‘এই সন্ধায় দু’চোখ সাগরে,
বুকের পাঁজরে ভেসে যায়।
অবাক জোছনায় লুকিয়ে রেখেছি,
ভেজা চোখ দেখাইনি তোমায়।
এই অবেলায় তোমারই আকাশে,
নীরব আপসে ভেসে যায়।
সেই ভীষণ শীতল ভেজা চোখ,
কখনো দেখাইনি তোমায়।’
এতটুকু গেয়েই থেমে গেলো রিদ। শেষ দুই লাইন আরশির দিকে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে গেয়েছিল। সত্যিই তো, দুর দেশে প্রিয় মানুষটার জন্য লুকিয়ে কাঁন্নার সেই অঝড় অশ্রু কখনো দেখানো হয়নি তাকে। সব কান্না সব দুঃখ নিজের মাঝেই লালন করেছিল নীরবে নিভৃতে।
নিশ্চুপ হয়ে কয়েক পা এগিয়ে রিদের পাশে গিয়ে দাড়ালো আরশি। রিদের মুখপানে বিষণ্নতায় ঘেরা স্থির দৃষ্টি রেখে বলে,
“এটা কি সত্যিই আপনি? কোনো ভুল হচ্ছে না তো আমার? নাকি কোনো স্বপ্ন এটা? যা একটু পরই ভেঙে যাবে?”
এতটুকু বলে কাঁপা হাত বাড়িয়ে রিদের গাল ছুয়ে দেখলো এটা সত্য নাকি তার কল্পনা। কিছু বললো না রিদ। ক্ষনিকটা মৃদু হেসে তাকালো আরশির দিকে। এবার যেন আর এক মুহুর্তও দেড়ি না করে রিদকে ঝাপটে ধরে হুহু করে কেঁদে দিল আরশি। যেন তার জীবনের সবচেয়ে বড়ো পাওয়াটা এখানেই। কিভাবে হয়েছে, কিভাবে চিরেকুটের এতকিছু ঘটেছে কিছুই বুঝতে পারছে না। এই মুহুর্তে বোঝার ইচ্ছেও নেই। শুধু এতটুকুই বুঝতে পারছে প্রিয় মানুষটার বুকে মুখ লুকিয়ে অশ্রুকনায় সব বিষাদ ধুয়েমুছে শেষ করে দিচ্ছে সে। প্রাপ্তির কাঁন্না এটা। এক মুহুর্তের জন্য মনে হচ্ছে তার জীবনের সব সুখ এই মুহুর্তটাকেই আটকে ছিল। যেটা ছিল তার জীবনে পাওয়া সবচাইতে বড়ো সারপ্রাইজ।
আরশিকে দু’হাতে আবদ্ধ করে কপালে চুমু এঁকে দিল রিদ। আরশি ছিল ছোট কোমল হৃদয়ের বাচ্চাসূলভ একটা মেয়ে। সবে তখন আবেগের বয়সে পা রেখেছিল। অথচ সেই পিচ্চিটাকে ঘিরেই প্রেমময় অনুভুতি গুলো যেন রঙিন প্রজাপতির ন্যায় ডানা মেলে উড়ে বেড়াতো। আবেগ কে প্রশ্রয় দিয়ে ভুল করতে চয়নি রিদ। কারণ এই পিচ্চিটাকে শুধু তারই মনে হতো। হারানোর প্রশ্নই উঠে না। যেন হারালে মরেই যাবে সে।
তাই প্রকাশ্যে না বললেও অনুভূতি গুলো চিরেকুট আকারে পৌছে দিত প্রিয় মানুষটার কাছে। সরাসরি কখনো আরশিকে ভালোবাসি শব্দটা রিদ একবারের জন্যও বলেনি। কারণ তার মতে ভালোবাসা এতটা সস্তা না, যে যখন তখন তা বললেই ভালোবাসার প্রকাশ হবে। এটা খুবই মুল্যবান একটা শব্দ। আর এই মহা মুল্যবান শব্দটা তখনই বলবে যখন পিচ্চিটা বড়ো হয়ে ভালোবাসার মানে বুঝতে শিখবে।
রিদ যাওয়ার আগে কয়েক রাত জেগে প্রায় দুইশত চিরেকুট লিখে রোহানকে দিয়ে গিয়েছিল। বলেছিল প্রতি সাপ্তাহে একটা করে আরশির বারান্দায় পৌছে দিতে। তবে আরশি যেন কোনো ভাবেই টের না পায়। রোহান প্রথম এমন পাগলামি দেখে হাসলেও অতঃপর রিদের কথায় রাজি হলো।
একদিন আরশির কাছে ধরা পড়তে পড়তে অল্পের জন্য বেচে গিয়েছিল। যদিও সেদিন আরশি সন্দেহও করেছিল তাকে। কোনো ভাবে সেদিন বেচেছিল।
অনেকটা সময় কেটে গেলো। রাত হলো অনেকটা। রিদের বুকে মাথা রেখে বসে আছে আরশি। শান্ত গলায় বলে,
“আমার উপর কি এখন আর একটুও অভিমান নেই আপনার? এখনো আমাকে ঘৃণা করেন তাই না?”
রিদ তার চুলে বিলি কেটে দিয়ে বলে,
“আমি কখনোই তোকে ঘৃণা করতে পারিনি।”
“তাহলে এতটা কষ্ট দিয়েছেন কেন?”
“যাতে তুই নিজেকে বুঝতে পারিস।”
আরশি এবার মুখ তুলে রিদের চোখে দৃষ্টি রেখে বলে,
“আমি ভেবেছিলাম, ভুল বুঝে আপনি মন থেকেই মুছে ফেলেছেন আমায়।”
ক্ষনিকটা মুচকি হাসলো রিদ। অতঃপর স্বাভাবিক গলায় বলে,
“কারণ না খুঁজে ভুল বুঝে দুরে সরিয়ে দেওয়ার জন্যই কি ভালোবেসেছিলাম? যদিও কষ্ট দিয়েছিস খুব। কিন্তু ভালোবাসলে সেক্রিফাইজ করতেও শিখতে হয়।”
আরশি মুখ লুকালো রিদের বুকে। লাজুক স্বরে বলে,
“এবার ভালোবাসায় সব কষ্ট মুছে দিব আপনার। তখন হৃদয় জুড়ে শুধু ভালোবাসাই অনুভব করবেন।”
,,
ঘরে প্রবেশ করে আরো অবাক হয় আরশি। রিদের মা, রুমকি, রোহান ভাইয়াও উপস্থিত সেখানে। এরা কখন এলো? ছাঁদে যাওয়ার সময় তো এরা কেউই ছিল না ঘরে। ভাবতে ভাবতেই মামির সাথে কথা বলে রুমকির পাশে গিয়ে দাড়ালো সে। রোহানের দিকে কিছুটা রাগম্বিত দৃষ্টিতে চেয়ে বিড়বিড় করে বলে,
“খবর আছে আপনার।”
আরশির কথায় কিছুটা হাসলো রোহান। পাশ থেকে রুমকি হাত ধরে আরশিকে নিয়ে চলে গেলো ভেতরের রুমে। ক্ষনিকটা ভ্রু নাচিয়ে বলে,
“ভাইয়ার সাথে সব ঠিকঠাক হয়ে গেছে, তাই না ভাবি?”
“তার মানে তুইও জানতি সব।”
“না, সত্যি আমি কিছুই জানতাম না। তবে রোহান বললো সে সব জানতো।”
“রোহান ভাইয়া কি তোর ছোট? নাম ধরে বলছিস কেন, বেদ্দপ?”
রুমকি ক্ষনিকটা ইতস্তত বোধ করে বলে,
“মানে রোহান ভাই।”
বলেই পিটপিট করে তাকালো আরশির দিকে। কিছু বললো না আরশি। হয়তো সন্দেহটা গাড়ো হচ্ছে একটু একটু।
“””””””””””””””””””””””””””””””””
সকাল সকাল একটু হাটাহাটি করতে ছাদের দিকে পা বাড়ালো রিদ। নিচে নাস্তা রেডি করছে ফুপি ও মা মিলে। ছাঁদে পৌছে ঘুম ভাঙার ক্লান্তিতে দু’দিকে হাত মেলে ক্ষনিকটা ক্লান্তি কাটাতেই বাম দিকে দৃষ্টি পড়ে তার। অবাক হয়ে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রইল সেদিকে।
ছাদে গোলাপ জবা সহ কয়েক রকমের ফুল গাছ লাগানো আছে। এটা অবাক হওয়ার মতো কিছু না। প্রায় সব জায়গায়ই ছাদের সোন্দর্য বাড়াতে এমনটা লাগানো হয়। রিদের চরম অবাক হওয়ার কারণটা হলো রোহান ও রুমকি। এই সাজ সকালে ছাদের এক পাশে থাকা জবা গাছটার নিচে দাড়িয়ে রুমকির চুলে লাল টকটকে একটা জবা গুঁজে দিল রোহান। আরেকটা ফুল ছিড়তেই রিদকে চোখে পড়ে তার। ফুল টা আচমকাই পরে গেলো হাত থেকে। এক মুহুর্তের জন্য যেন আজ তার বন্ধুর মতো ভাই রিদের দিকে তাকাতেই বুকটা কেঁপে উঠলো তার।
রিদ অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তাদের দুজনের দিকে। চোখ বুঁজে নিল রুমকি। হয়তো ভয়ে, নয়তো লজ্জায়। কারণ প্রেম করতে গিয়ে ভাইয়ের হাতে ধরা পরার অনুভূতি টা এই মুহুর্তে বলে বোঝানোর মতো না।
To be continue………………