#পরিণয়_প্রহেলিকা
#লেখিকা_সিনথীয়া
#পর্ব_৩
সকালের ফুরফুরে রোদে মিহরানের ঘুম ভাঙলো। আড়মোরা ভেঙ্গে কিছুক্ষণ খাটেই বসে রইল ও। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে সকাল ৯ টা বাজে। ফজরের সময় উঠে নামাজ পড়ে আবার ঘুমিয়েছিল বলে এখন মনে হচ্ছে ঘুমটা পুরো হয়নি। মাথা ঝিমঝিম নিয়ে উঠে দাঁড়ায় মিহরান। রুমটার দিকে আজ ভালো ভাবে তাকায়। এটা কে আসলে রুম বলা যায় না ছোটখাটো একটা লফ্ট বলা চলে ।প্রায় সাড়ে ৭০০ স্কয়ার ফিটের এই ইউনিটে আছে একটা লিভিং এরিয়া যেটা দরজা দিয়ে ঢুকলেই হাতের বা পাশে পরে ।তার সাথেই লাগুয়া একটা ছোটখাটো রান্নাঘর আছে । স্টোভ কাউন্টার এর ঠিক উল্টা পাশে সেট করা আছে একটা মার্বেলের কাউন্টার টপ আর দুটো বার টুল যেগুলোকে মিহরান মাঝেমধ্যে ডাইনিং টেবিল হিসাবে ব্যবহার করে। এটাতো গেল ঘরের এক পাশ। আর উল্টো পাশে আছে ফ্লোর এর সাথে যুক্ত করে একটু উঁচু করে বানানো একটা বড় খাট এবং তার পাশে দেওয়ালের সাথে লাগানো একটি ওয়ার্কিং স্টেশন যেখানে মিহরান অফিসের যাবতীয় সব কাজ করে। সবকিছু ফেলে একটু সামনে গেলেই হাতের বাম পাশে ওয়াশরুম আর তার ঠিক উল্টা পাশে মানে খাট ক্রস করে একটু সামনেই সেই থাই গ্লাসের দরজা যেটা দিয়ে সুইমিংপুলে যাওয়া যায়।
রুমটা একদম আধুনিক নিয়মে ছিমছাম ভাবে নিজ হাতে গড়েছে মিহরান । মূলত এই জায়গাটাকে নিজের অফিসের কাজের জন্যই গড়া। কোলাহলমুক্ত শান্ত পরিবেশে ওর কাজ করতে ভালো লাগে। নিচে বাবা-মায়ের বাসায় তো সব সময় হই হট্টগোল লেগেই থাকে। পরিবারের মানুষজন আর বাড়ির কর্ম সহযোগীরা মিলেই তো অনেকজন। তার ওপর ফুফুরা আসা-যাওয়ার মধ্যেই থাকে। ছোট ফুফু তো এই বিল্ডিং এই থাকেন। বড় ফুফুও ভাই বোনের টানে এখানে অনেক সময় ব্যয় করেন।
মিহরান এত আওয়াজে কাজ করতে পারে না। তাই কাজের সময় আর রাতটুকু এই রুমে কাটায়। তিন বেলা খাওয়া অবশ্য নিচে পরিবারের সাথেই করে। অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার আগে এই রুটিনেই ছিল, এখনো সেটাই ফলো করার ইচ্ছা আছে ওর।
ফ্রেস হয়ে একেবারে রেডি হয়ে মিহরান নিচে নামলো। মাকে ডাইনিং টেবিলেই পেল,
-গুড মর্নিং আম্মু ।
-গুড মর্নিং আব্বু, আয় গরম গরম নাস্তা করে নে ।
-বাকিরা কোথায়?
-মালিহা তো সেই সকাল আটটায় বের হয়ে গেছে ।ওর ভার্সিটির রাস্তায় বেশ জ্যাম পরে ।মেহরাব আর মাহিরা ও ভার্সিটি জন্য বের হয়ে গেছে । দশটায় নাকি ওদের ক্লাস ।মাহিব ও অফিসে চলে গেছে। তোর আব্বু আছে ।
-ও ও আব্বু কি আজকে বাসায় থাকবে ?
-না তোর সাথে নাস্তা করবে বলে অপেক্ষা করছে। খেয়েই বের হয়ে যাবে । তা তুইও কি বের হচ্ছিস নাকি কোথাও?
মিহরান চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললো,
-হ্যাঁ মা আমার ভার্সিটি যেতে হবে । ডিন আর চেয়ারম্যানের সাথে দেখা করে আসি ।আর ওখান থেকে যাব তন্ময়ের অফিসে । লাঞ্চ ওর সাথে করব তাই আমার জন্য আর অপেক্ষা করো না, সময় মতন খেয়ে নিও।
আফিয়া স্মিত হাসলেন,
– বিকালে একটু তাড়াতাড়ি ফিরিস বাবা। তোর বড় ফুপু,ছোট ফুফু আর ছোট খালা আসবে। তোর ছোট ফুুপু তো বড় ফুপুর বাসায় গিয়েছে আজ দুদিন হল।না হলে ও এখানে থাকলে তোকে যে কতবার যেয়ে দেখে আসতো! তুই এসেছিস শুনেই পাগল সবাই। তোকে দেখার তরই সইছে না তাদের।
-হম আচ্ছা। তাড়াতাড়ি ফেরার চেষ্টা করব।
এর মাঝেই বাবুল সাহেব চলে আসলেন। বাবা মা আর ছেলে মিলে হাল্কা পাতলা গল্পের মধ্য দিয়ে নাস্তা সারলো। এরপর মিহরান বের হয়ে পরলো। বাসার দুটো গাড়ির মধ্যে একটা নিয়ে মালিহা গিয়েছে। আরেকটার চাবি নিয়ে বের হল মিহরান। মেহরাব আর মাহিরার ভার্সিটি কাছে বলেই তারা রিক্সা করেই চলে যায়। আর মাহিব আর বাবুল সাহেব চলাচল করেন অফিসের গাড়িতে করে। এই গাড়িটা মূলতো বাসাতেই থাকে, তবে এখন মিহরান এটাকে কাজে লাগাবে।
………………..
শৈলীর আজ ক্লাসে আসতে আধা ঘন্টা দেরি হয়ে গেছে। কারণ,ওই যে! কুম্ভকর্ণের ঘুম। রাতে একটু লেট করে শোয়াতে ঠিক সময় উঠতে পারেনি। আর রেডি হতে তার বরাবর একটু বেশি সময় লাগে তার লম্বা চুলের জন্য। এই ধরনের চুল দেখতে খুবই আকর্ষণীয় ও লোভনীয় বটে। কিন্তু এটাকে মেইনটেইন করা সেই রকমই কষ্টদায়ক। যাদের এরকম চুল আছে তারাই শুধু এটার প্যারা বোঝে। শৈলীর সুন্দর করে একটা হাত খোপা করতেই লেগে যায় অনেকক্ষণ,অন্য স্টাইল তো বাদই দিল।
এইসব করতে করতে শৈলী আজ লেট। তার জন্যই অন্য দিন মাহিরাদের সাথে আসলেও আজ ও আসতে পারেনি। যখন শৈলী পৌঁছেছে,ডিপার্টমেন্টের সব ক্লাস তখন শুরু হয়ে গেছে। তাই ক্যাম্পাসের মাঠে বা সিড়ির ঘরে মানুষের আনাগোনা কম। ফাঁকা সিঁড়ি দিয়ে মাথা নিচু করে একপ্রকার দৌড়ে উঠলো শৈলী, ইচ্ছে চলমান ক্লাস টা ধরার। তবে সেটা হওয়ার আগেই ঘটলো এক অপ্রিতিকর ঘটনা। তাড়াহুড়ো করে উঠার দরুনে সামনে দিয়ে কে আসছে এটা শৈলী দেখতে পারল না। পাশাপাশি যেতে গিয়ে কাঁধে কিছু একটার সাথে ধাক্কা পরলো প্রচন্ড। ‘উফ ‘ শব্দ করে উঠলো শৈলী ।আপোনাতেই কাঁধে হাত চলে গেল। সেখানেই দাঁড়িয়ে ভ্রু জোড়া কুচকে পাশে তাকাল। যাকে দেখলো তাকে দেখে গা জ্বলে উঠল ওর ।
শৈলীর দুই সেমিস্টার সিনিয়র রিক আর জোহেব পাশে দাঁড়িয়ে হাসছে। মানুষের হাসি যে এতটা বিচ্ছিরিও হতে পারে এটা শৈলী এদের হাসি দেখে জানতে পেরেছে। শৈলী নিশ্চিত রিকের সাথে ধাক্কাটা অপর পাশ থেকে ইচ্ছাকৃত ছিল। গত এক বছর ধরে এদের জ্বালাতন সহ্য করে আসছে ও তাই এদের স্বভাব রন্ধ্রে রন্ধ্রে চেনা হয়ে গিয়েছে।
শৈলী তারপরেও বিষয়টা নিয়ে রিয়্যাক্ট না করার চিন্তাই করলো। তবে কঠোর চোখে একবার ওদের দিকে তাকিয়ে সামনে অগ্রসর হতেই রিক পথ রোধ করে দাঁড়ালো ওর।
– গুড মর্নিং সুন্দরী ।
দাঁত চিবিয়ে ওঠে শৈলীর,
– পথ ছাড়ুন ।
– গুড মর্নিং এর উত্তর বুঝি এটাই হয়?
শৈলী রক্ত লাল চোখ নিয়ে সরাসরি রিকের দিকে তাকাল কিন্তু তাতে ছেলেটার কোন কিছুই গেল আসলো না। বরং আরো জোরে হেসে দিল।
– দেখছিস জোহেব তোর ভাবীর চোখে কত তেজ?
শৈলী আর সহ্য করতে পারল না, গর্জে উঠলো ও,
– একদম উল্টাপাল্টা কথা বলবেন না। আমার পথ ছাড়ুন ক্লাসের দেরি হচ্ছে।
শৈলীর উত্তরে রিক পথ তো ছাড়লোই না বরং আরো কাছে চলে আসলো। এই দেখে শৈলী ঘাবড়ে যেয়ে এক পা নিচে নেমে গেল সিড়ির। এর মাঝেই হিসিহিসিয়ে উঠলো রিক,
– কেন? ভাবি ডাক টা শুনতে ভালো লাগলো না? আমার বন্ধু তোমাকে ভাবি ডাকবে এটাইতো স্বাভাবিক তাই না? বউ বানাবো কি না সেটা পরে দেখবো কিন্তু গার্লফ্রেন্ড তো তুমি আমারই হবে। আজ নয়তো কাল, কিন্তু তুমি হতে বাধ্য। বুঝলা সুন্দরী?
ভেতর ভেতর ভয় পেলেও চেহারায় সেটা শৈলী দেখালো না, বরং নিজেও তেজী গলায় বলল,
– আপনার মতন উস্সৃঙ্খল ছেলেকে নিজের ভালোবাসার মানুষ তো দূর, আমি মানুষই মনে করি না। আলতু ফালতু কথা বাদ দিয়ে, নিজেও পড়তে যান আর আমাকেও পড়তে দিন।
শৈলির অপমানে রিকের মাথা ফেটে আগুন বের হওয়ার উপযোগী হয়ে গেল। মেয়েটা একটু বেশি সুন্দরী, আর এই সুন্দরীকে ওর ভোগের জন্য চায় বলেই ও কিছু বলে না। নয়তো এই মেয়ের দেমাগ, রিক কবে নামিয়ে ফেলত। তবে আর বেশি দিন নয়, খুব শীঘ্রই রিক নিজের কার্যসিদ্ধি পুরা করবে। এই চিন্তা মাথায় আসতেই রিকের কপালের ভাঁজ সোজা হয়ে গেল। শৈলীর পথ থেকে সরে দাঁড়ালো ও ।
শৈলীও আর এক মুহূর্ত দেরি না করে হাটা দিল নিজের ক্লাসের পথে। এই মানুষটার অত্যাচারে তিক্ত বিরক্ত সে। কিন্তু এ ব্যাপারে কমপ্লেন দিয়ে কোন লাভ হয়নি, কারণ রিকের বাবা ইউনিভার্সিটির ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য। বাপের ক্ষমতায় খেলে এই ছেলে। একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে ক্লাসে ঢুকলো শৈলী।
শৈলীর যাওয়ার পানে জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে থাকা রিকের কাঁধে হাত দেয় জোহেব,
-কিরে দোস্ত? মেয়েটা তোকে এত কথা শুনিয়ে গেল,তুই কিছুই বললি না?
জহেবের দিকে না তাকিয়েই রিক বাঁকা হাসলো,
-এবার কিছু বলবো না, করে দেখাবো।
জোহেব অবাক,
-মানে? কি করবি?
রিক এক রহস্যময় কন্ঠে বলল,
-আমাদের পিকনিক দুই সপ্তাহের মধ্যে না?সেই সময়েই তুই তোর প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবি। এখন চল্ মাথা ঠান্ডা করা লাগবে।
……………………
ভার্সিটির কাজ শেষ করে বন্ধুদের সাথে দেখা করে মিহরান বাসায় ফিরেছে আধা ঘন্টা হল। ভার্সিটিতে ওকে স্বাগতম খুব সুন্দর ভাবেই করা হয়েছে। তবে কাজে জয়নিং আগামী সপ্তাহে হলেও,দায়িত্ব ঘাড়ে চেপেছে আজ থেকেই। দু সপ্তাহ পরে ডিপার্টমেন্ট থেকে পিকনিকের আয়োজন করা হয়েছে এবং অর্গানাইজিং কমিটিতে রাখা হয়েছে ওকে। আজকে সেই কমিটির একটা মিটিং ও ছিল। সেটা শেষ করে তন্ময়ের অফিসে যেয়ে মিহরান তার আরো দুজন বন্ধু শাকিল আর অর্ণবকেও পেল। চার বন্ধু মিলে জম্পেশ আড্ডা আর খানাদানা নিয়ে মেতে রয়েছিল বিকাল পর্যন্ত। তাই বাসায় ফেরার পর থেকেই মিহরানের বেশ টায়ার্ড লাগছে, মনে হচ্ছে একটু বিছানায় গা এলিয়ে দিক। জেট ল্যাগও তো এখনো পুরোপুরি যায়নি।
কিন্তু বিধিভাম! তখনই মালিহা রুমে এসে জানিয়ে গেল যে ফুফু খালারা চলে এসেছে আর মিহরানকে এখনই নিচে ডাকা হয়েছে।
দীর্ঘশ্বাস ফেললো মিহরান। কি আর করা, পরিবারের মায়ায় ঘুমোতে যাওয়ার অদম্য ইচ্ছাকে বর্জন করে নিচের দিকে পা বাড়ালো।
……………
সকালে মাহিরা, মেহেরাবের সাথে ভার্সিটি না আসতে পারলেও এখন শৈলী ওদের সাথেই বাসায় ফিরলো। ওর মনটা বেশ খারাপ হয়ে আছে। রাগে এখনো গায়ের রগগুলো খিঁচে আসছে। রিককে কষে গালে একটা চড় দিতে পারলে ওর খুব আরাম লাগতো। কিন্তু রিক যে কতোটা বেপরোয়া আর বেয়াদব, সেটা এতোদিনে শৈলীর বুঝতে বাকি নেই। এই নিচু মনের মানুষটা সেই চড়ের প্রতিশোধ যে কিভাবে নিবে তার কোন ঠিক নেই। শেষে ফেঁসে যাবে শৈলী নিজেই। নিজেকে ভিষণ অসহায় মনে হচ্ছে ওর আর এই কারণে রাগের পারাটাও তরতর করে বাড়ছে বই কমছে না।
মাহিরা আর মেহরাব ভার্সিটি থাকতেই শুনেছে সকালের কান্ড। এই ঘটনা নতুন না হলেও, ওদেরকে বেশ রাগিয়ে দিয়েছে। মেহরাব তো তখনই উঠে যেতে নিয়েছিল, চেয়েছিল রিকের নাকে একটা ঘুষি মেরে আসতে। কিন্তু মাহিরা আর শৈলী মিলে থামিয়ে দিয়েছিল ওকে। তখন মেহরাবের রিকের ওপরের রাগটা যেয়ে পরলো তার বোন আর বান্ধবীর ওপর। এখনো রাগে গজগজ করছে ও,
-তোরা আমাকে থামাতে গেলি কেন তখন? ঐ হা**র বাচ্চার নাক ফাটায়ে ওর চোদ্দ গুষ্টির নাম ভুলায়ে দিতাম আমি। ইভ টিসিং এর কেইস খাওয়া উচিত ওর ।বাপ ট্রাস্টি বোর্ডে আসে বলে ভার্সিটিটা পুরা কিনে ফেলসে নাকি? শালার গুন্ডামি করার আর জায়গা পায় না।
মাহিরা একবার শৈলীর দিকে তাকিয়ে নিজের ভাইয়ের রাগ কমানোর চেষ্টা করলো,
– তুই ঐ শ*তান পোলার জুনিয়র। তুই ওকে কিছু করতে গেলে, আগে নিজেই ফাসবি। তাই তো তোকে তখন থামালাম। এদের মতন বদ্ গুলোকে সিধা করা এতো সোজা না বুঝলি? মাথা গরম করলে কাজ হবে না, ঠান্ডা মাথায় কাঁটা তুলতে হবে।
মেহরাব বোনের কথা বুঝে শৈলীর দিকে তাকালো। মেয়েটার জন্য ওর মায়া হলো। তিন জন খুব ভালো বন্ধু হওয়ার সাথে সাথে মেহরাব মাহিরার মতন শৈলীকেও নিজের বোনের মত আদর করে। তাই রিকের কাজগুলো ও একদমই সহ্য করতে পারছে না। মেহরাব এসব ভাবার মাঝেই হঠাৎ মাহিরা চেঁচিয়ে উঠলো,
-ইউরেকা!আইডিয়া পাইসি।
শৈলী নিজের মনধ্যানে ছিল, মাহিরার চিৎকার কেঁপে উঠলো ও,
– কি আইডিয়া?
মাহিরা শৈলীর দিকে তাকিয়ে হাসলো,
– রিককে আর ওর চ্যাংড়া সাগরেদ জোহেবকে উচিত শাস্তি দেওয়ার।
সাথে সাথে পিঠ সোজা হয়ে উঠলো শৈলীর,
– কিভাবে?
– মেঝো ভাইয়াকে বলে।
– মেঝো ভাইয়া মানে?
শৈলীর কপাল কুচকানো দেখেই মাহিরা কিছু মনে করার ভঙ্গিতে বলে,
-আরে আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম তোকে বলতে। আমাদের মেঝো ভাইয়া, মানে মিহরান ভাইয়া, কিন্তু আমাদের ভার্সিটিরই লেকচারার। এবং সেটা তোর ডিপার্টমেন্টরই। আরে তুই এভাবে কেঁপে উঠলি কেন শৈলী? Is everything alright?
-হমম? হ..হ্যা।
– আচ্ছা তো শোন, যেটা বলছিলাম, আগামী রবিবার থেকে ভাইয়া ক্লাস নেওয়া শুরু করবে। এইবার মজা দেখাব আমরা রিক চান্দু বাবাজিকে। ভাইয়ার কাছে বলে ওকে একদম সিধা করে ছারবো দেখিস। তোর পথে আর পা মারাবে না কোনোদিন।
মেহরাবও বোনের কথায় তাল মিলায়,
– সারাদিনের মধ্যে এই একটা কাজের কথা বললি তুই মাহি। ভাইয়া যেই রাগি আর ডিসিপ্লিন্ড, তাতে রিকের এই কথা জানলে ওকে ধরে পিওর একটা আছাড় মারবে। একবার ভার্সিটি জয়েন করুক ভাইয়া আর একবার রিক বাবাজি তার হাতে পরুক, তারপর আমরা মজা দেখবো।
শৈলী এই দুই ভাই বোনের কথার মাঝ থেকে অনেক্ষণ আগেই খেই হারিয়ে বের হয়ে এসেছে। কারণ টা হচ্ছে মিহরান নামক ব্যক্তি। মাহিরা নিজের মেঝো ভাইয়ের কথা তুলতেই শৈলীর গতকাল সন্ধ্যার কথা মনে পরে যায়। ওর প্রতি সেই গভীর দৃষ্টি আবার মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে, হাল্কা ঝাকি দিয়ে ওঠে পুরো শরীর। মানুষটার সাথে শৈলীর প্রথম দর্শনই ছিল কেমন যেন বেমানান, অস্বস্থিকর। শৈলী তো মনে মনে পন করেছিল, না পারতে মানুষটার সামনে আর যাবে না ও, বাসার ছাদেও যাওয়া একদমই কমিয়ে দিবে। সেখানে মানুষটা নাকি এখন ওর ডিপার্টমেন্টেরই অধ্যাপক হয়ে আসছে, ওকেই পড়াবে। এটা কিছু হইলো?
মাহিরা,মেহরাবের গল্প আর শৈলীর আকাশ কুসুম চিন্তা ভাবনার মাঝেই বাসায় পৌছে গেল ওরা। শৈলীর মন খারাপ দেখে মাহিরা জোর করে ওকে নিজের সাথে ওদের ফ্ল্যাটে নিয়ে আসলো। শৈলী হাজার বারণ করলেও মেহরাব মাহিরার সামনে ওর যুক্তি ধোপে টিকলো না। অগত্যা ওদের সাথেই যেতে হলো শৈলীকে।
…………………..
শৈলীদের আসার প্রায় আধাঘন্টা পরে বাসায় নামলো মিহরান। যদিও ওর নিজের অ্যাপার্টমেন্টে টায়ার্ড লাগছিল, নিচে এসে ফুফুদের,খালার আর কাজিনদেরকে দেখেই সব ক্লান্তি দূর হয়ে গেল। বড়দেরকে কিছুক্ষণ সময় দিয়ে মিহরান চলে আসলো ছোটদের মাঝে। দোতলার লিভিং রুমে বসেছে ওদের আড্ডা। বড় ফুপুর দুই ছেলে রাজিব সজীব, ছোট ফুফুর মেয়ে অর্পিতা, আর ছোট খালার মেয়ে ঐশ্বর্য,সবাই মিহরানের ছোট। এদের মাঝে কেউ কেউ এখনো কলেজে আবার দুই একজন মাত্র ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে। মিহরানকে পেয়ে যেন তারাও আজ আকাশের চাঁদ পেল। তাদের মিহরান ভাই অনেক গম্ভীর স্বভাবের হলেও, ওদের খুবই আদর করেন কি না!
শৈলী মাহিরার সব কাজিনদের সাথেই বসেছিল। সিড়ির দিকে পিঠ দেওয়াতে মিহরান ওকে প্রথমে দেখেনি। তবে ঘুরে এসে রুমের এক কোণায় বারান্দার সাথে লাগোয়া দোলনা টায় বসার সাথে সাথেই মিহরানের পিঠ সোজা হয়ে গেল। পরিচিত সব মুখ গুলোর মাঝে একটা অতি স্বল্প পরিচিত মুখশ্রীই ওর নজর কাড়লো। সত্যিই সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠার পর থেকে কিছু মুহূর্ত আগ পর্যন্ত এই মেয়েটার কথা ভুলে বসেছিল মিহরান। কিন্তু এখন আবার সব চোখের সামনে চলে আসলো। আবার গাঢ় হলো দৃষ্টি। মিহরান শৈলীর মাটিতে বিচরণ করা আরষ্ট চোখের দিকে তাকিয়েই আস্তে আস্তে দোলনায় ঝুকে বসলো। দুই পা ফাঁক করে দুই হাতের কনুই পায়ের রানের ওপর ভর দিয়ে হাতের আঙ্গুলগুলো ভাজে ভাজে ঢুকিয়ে বসলো ও।
এদিকে শৈলীর অস্বস্তি চরমে পৌছেছে। নিজের দৃষ্টি নিচে থাকলেও ওরদিকে এক জোড়া চোখের মনোযোগ ও ঠিকই টের পাচ্ছে। অন্যদিন হলে হয়তো বিষয়টা নিয়ে এতো ভাবতো না ও, এসব অযথা ন্যাকামি ওর একদম পছন্দ না। তবে সকালে ঐ রিকের ঘটনার পর থেকে নিজের প্রতি অজানা কারণেই বেশ সতর্ক বোধ করছে শৈলী। আর তাই এই মুহূর্তটা ওকে ভীষণ অস্বস্তিতে ফেলে দিচ্ছে।
মিহরান মনে হয় নিজেও ব্যাপারটা বুঝতে পারলো। আর তাই শৈলীর থেকে চোখ সরিয়ে নিজের কাজিনদের দিকে তাকালো ও।
– কি অবস্থা তোদের? এই কম সময়ে তোরা এতো বড় হয়ে গিয়েছিস, বাহ্।
কাজিনরা সবাই এই কথায় হেসে উঠলেও একজনের মুখে লাল বর্ণ ছেয়ে গেল। আর সে হলো মিহরানের খালাতো বোন ঐশ্বর্য। মাথা নুইয়ে চোখ পিটপিট করে হাসছে ও। ঐশ্বর্যের এই লাজুক লতা মুখশ্রী আর কেউ না দেখলেও ওর এক পাশে বসা মাহিরা ঠিকই লক্ষ্য করেছে। নিমিষেই বিরক্তির পারাটা অনেক উপরে উঠে গেল ওর। নিজেই একবার মুখ বাঁকিয়ে ঐশ্বর্যেরকে প্রশ্ন করলো,
কি ব্যাপার ঐশ্বর্য ?তোমার মুখ এরকম লাল হয়ে গেছে কেন ?
ঐশ্বর্য ঝট করে চোখ মেলে মাহিরার দিকে তাকায়,
-ন.ন্না… কিছুনা আপি, এএ..এমনেই।
মাহিরা কপাল টান টান করে একবার ঐশ্বর্যের দিকে তাকিয়ে আবার চোখ ফিরিয়ে নিল। সবার সামনে সিন ক্রিয়েট করতে চায়না বলে আর কিছু বলল না। তবে ওর মুখটা থমথমে হয়ে গিয়েছে দেখে শৈলী নিজের দিকে মাহিরার দৃষ্টি আকর্ষণ করে ওকে চোখ ইশারায় প্রশ্ন করলো যে কি হয়েছে। মাহিরাও একই ভাবে উত্তর দিলো যে ও পরে শৈলীকে সব জানাবে।
এইদিকে কাজিনদের আড্ডা বেশ জমে উঠেছে। ইতিমধ্যে ঝুমাও এসে সবার সাথে বসলো। দুপুরে একটু খারাপ লাগছিল বলে শুয়েছিল ও। উঠে ফুফু আর খালা শাশুড়িদের সাথে দেখা করে তারপর আসলো ছোটদের মাঝে। এসে মিহরানের মতন ওরও চোখ পরলো শৈলীর দিকে,
– আরে শৈলী যে? কেমন আছো? কখন এসেছো?
– এইতো ভাবি, মাহিরার সাথেই ফিরলাম।
মিহরান সবার সাথেই আলাদা ভাবে কথা বলছিলো। ঝুমার প্রশ্নে আরচোখে একবার শৈলীর দিকে তাকিয়েছিল ও। শৈলী বসে ছিল অর্পিতার পাশে। অর্পিতার সাথে কথা বললেও তখন মিহরানের মনোযোগ ছিল ঝুমার প্রশ্নে। নিজের মনের মাঝেই আউড়ালো ও,
– তো মেয়েটার নাম শৈলী?
ভাবির কথায় হঠাৎ টনক নরলো মাহিরার,
– এই যা! দেখেছো ভাবি, আমিও কি গাধি? মেঝো ভাইয়ার সাথে তো শৈলীকে পরিচয়ই করিয়ে দেই নি আমি।
মাহিরার কথার মাঝেই মেহরাব প্রবল উচ্ছাসে বলে উঠলো,
– তুই যে গাধি এটা আবার জোরে বলার কি আছে রে, আমরা তো তা সবাই জানি।
এই এক কথাতেই ওখানে বসা সবাই হো হো করে হেসে ফেললো। মাহিরা চোখ রাঙ্গিয়ে নিজের জমজের দিকে তাকিয়ে কটমট করে বললো,
– তোকে তো আমি পরে দেখতেসি দাড়া। আমি গাধি তো তুই কি হ্যা? এখন অন্য কাজে আমি ব্যস্ত বলে পার পেয়ে গেলি তুই।
নিজের মনোযোগ মিহরানের দিকে ঘুরিয়ে চোখে উচ্ছলতা নিয়ে মাহিরা বলতে লাগলো,
-ভাইয়া, ও হলো শৈলী, আমাদের পাশের বাসায় থাকে। তোমাকে গতকাল বলেছিলাম না, বড় ফুফুর বাসায় নতুন মানুষ এসেছে, শৈলীর পরিবারই তারা।
শৈলী এবার সরাসরি মিহরানের দিকে তাকালো। সৌজন্য হাসি মুখে নিয়ে বললো,
– আস্সালামুআলাইকুম।
মিহরান সেই একই সৌজন্যতার সাথে উত্তর দিল,
– ওয়ালাইকুমাস্সালাম। ভালো আছেন?
-জ্বী।
মাহিরা মাঝখান থেকে বললো,
– আরে ভাইয়া, তুমি শৈলীকে আপনি করে বলছো কেন? ও তো তোমার ডিপার্টমেন্টের স্টুডেন্ট। কাল বলেছিলাম না? এতো তাড়াতাড়ি ভুলে গেলে?
শৈলী আর মিহরান দুইজনই সবার সামনে একদম অপ্রস্তুত হয়ে গেল। শৈলীর তো মন চাচ্ছে মাহিরাকে তুলে মাটিতে পটকাতে। এই মেয়ের মুখ চললে, থামার স্টেশন হারায় ফেলে।
মিহরানও মাহিরার দিকে শান্ত চোখে তাকালো এবং শীতল কন্ঠেই জবাব দিল,
– আমি আমার স্টুডেন্টদেরকেও ‘আপনি’ বলেই সম্বোধন করি মাহিরা।
মাহিরা ভাইয়ের চোখে রাগ ঠিকই বোধ করেছে। তাড়াতাড়ি চোখ সরিয়ে বান্ধবীর দিকে তাকিয়ে দেখলো এখানেও আবহওয়া একই মাত্রায় গরম। কাচুমাচু করে চোখ নামিয়ে ফেললো ও।
এরই মাঝে আফিয়া বেগম নিচ থেকে ডাকলেন সবাইকে নাস্তা করার জন্য। শৈলী এই সময় মাহিরাকে বললো ওর বাসায় যাওয়ার কথা। মাহিরা ওকে এবারও জোর করলো, অন্তত নাস্তা করে যাওয়ার জন্য, কিন্তু শৈলী তা শুনলো না। নিচে আফিয়া বেগমও সাধলেন, তবে শৈলী তাকেও বললো,
– আজকে না আন্টি। সেই সকালে বাসার থেকে বের হয়েছি, এখনো ফিরিনি। আম্মু নিশ্চয়ই নাস্তা বানিয়ে বসে আছেন, এখানে খেয়ে গেলে ওখানে খেতে পারবো না। আর আমি তো বাসারই মানুষ, আসা যাওয়া তো করতেই থাকি। পরে একদিন এসে মজা করে খাব।
আফিয়া বেগম হেসে, যাওয়ার সম্মতি দিলে, শৈলী আর অপেক্ষা করলো না। ব্যাগ নিয়ে ওখানে বসে থাকা সবাইকে সালাম দিয়ে বের হয়ে গেল। মিহরান তখন নিচেই নামছিল, শৈলীর বের হয়ে যাওয়া দেখতে পেল ও।
চলবে….