পরিণয়_প্রহেলিকা #লেখিকা_সিনথীয়া #পর্ব_২০(২)

0
894

#পরিণয়_প্রহেলিকা
#লেখিকা_সিনথীয়া
#পর্ব_২০(২)

শৈলী জ্ঞান হারাতেই মিহরান বিলম্ব না করেই ওকে পাঁজাকোলে তুলে নেয়। আতঙ্কে মেয়েটা জ্ঞান হারিয়েছে এটা বুঝতে বাকি রয় না ওর। শৈলীকে নিয়ে বের হয় ঘর থেকে। ওপাশে জোরে মিউসিক শোনা যাচ্ছে। বোঝাই যাচ্ছে পার্টি ওখানেই চলছে। তাই এদিকে কেউ নেই। রুমের সামনের ছাউনি থেকে বের হয়ে এক সিড়ি নামতে গিয়েও আবার পা ভেতরে ঢুকালো মিহরান। টিপ টিপ বৃষ্টি শুরু হয়ে গিয়েছে। এরকম বৃষ্টিতে বের হলে ঠান্ডা লেগে যেতে পারে। ও পেছনে ঘুরে। নাহ্ এখানে মোটেও থাকা যাবে না। পুরো তল্লাটে একটা মানুষ নেই। এখানে ওদের দুজনকে, যারা সম্পর্কে একজন শিক্ষক ও ছাত্রী, একা দেখলে তুলকালাম ঘটতে সময় লাগবে না এক মুহূর্তও। পুরো ক‍্যাম্পাস জুড়ে দাবানলের ন‍্যায় বদনাম ছড়াবে। সেটা মিহরান কারোর জন‍্যই চায় না, আর যেখানে বিষয়টা শৈলীকে ঘিরে, তাহলে তো কোনোভাবেই না।

তাহলে যাবে কোথায়? মূল ভবনেও যাওয়া যাবে না। লনে মেয়েরা আছে, ভেতরে সব ফ‍্যাকাল্টিদের আড্ডা চলছে। এদের মাঝে শৈলীর অবচেতন দেহ এভাবে নিলেও একশো একটা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে। যেখানে মিহরান নিজেই কিছু বুঝে উঠতে পারছে না, সেখানে অন‍্যদের জবাব দিবে কি?

আচমকা মিহরান এক আজব সিদ্ধান্ত নিল। ও পুরো শাহজাহান সাহেবের খামারবাড়ির উল্টোদিকে যাওয়ার জন‍্য পা বাড়ালো। উদ্দেশ‍্য এই এরিয়া থেকে বের হয়ে যাওয়ার।

বৃষ্টির জোর একটু একটু করে বাড়ছে। কিছুক্ষণের মাঝেই হয়তো ঝুম ধরে নামবে। তখন বাইরে সবাই থাকবে না, অনেকেই রেস্টহাউসের দিকে ফিরবে। এটা বুঝেই মিহরান তাড়াতাড়ি পা বাড়ালো। শৈলীকে বুকে টেনে নিল আরও নিকটে। মেয়েটার আগে জ্ঞান ফেরানোটা দরকার, তারপর ভেবে চিনতে নেক্সট স্টেপ নেওয়া যাবে।

সকালে ছেলেদের থাকার জায়গা ঠিক আছে কিনা সেটা দেখতে এসে খেয়াল করেছিল এদিক দিয়েও একটা গেইট আছে বের হওয়ার। মিহরান সেদিকেই দ্রুত আগালো।
রব মনে হয় মিহরান শৈলীর সাথেই ছিল আজ। তাইতো গেটের কাছে এসে কোনো গার্ডকে দেখা গেল না। হয়তো বৃষ্টির জন‍্য ভেতরে আছে। এই সুযোগে গেট ঠেলে শৈলীকে কোলে করেই বেরিয়ে গেল মিহরান।
……………………

রিক বন্ধুদের সবার সাথে পার্টিতে এসে কিছুক্ষণ ওদের সাথে থাকলো। বাসাটা যেহেতু ওর, এবং এই পার্টিরও হোস্ট ও নিজেই তাই সিনিয়র, জুনিয়র সবাই ওকেই চাচ্ছে। এরকম ভাবে একা হুট করে গায়েব হলে ওকে খোজা শুরু হবে অচিরেই। তাই একটু এদিকে সেটেল করে যেতে চাচ্ছে ও। আফটার অল, এতো সাধনার একটা মুহূর্ত ওর জন‍্য অপেক্ষা করছে, এটায় কোনো ব‍্যাঘাত ঘটুক, তা সে চায় না। কোন ক্রমেই না।

বাবার টিমের মেম্বারদের সব বুঝিয়ে দিয়ে রিক পার্টি থেকে বের হলো। ইতিমধ‍্যে বৃষ্টি শুরু হয়ে গিয়েছে। দেখে খুশিই হলো রিক। এমন এক শীতল পরিবেশে শৈলীর সাথে সময়টা কাটাতে ভালো লাগবে ওর।

এসব চিন্তা করতে করতেই রিক ছেলেদের রেস্টহাউসের সামনে এসে দাড়ায়। তবে আসতেই চোখের সামনে যা দেখে তা ওর মুখের ভাবমূর্তি নিমিষেই বদলে দেয়। এক দৌড়ে শৈলীকে বন্দি রাখা রুমটার সামনে এসে দাড়ায় ও। দরজা হা করে খোলা দেখেই পায়ের রক্ত মাথায় ওঠে। ভেতরে প্রবেশ করে রিক্। শৈলীর অনুপস্থিতি বুঝেও অহেতুক রুমের সব দিক খোজে এমন ভাবে যেন বিছানায় পরে যাওয়া পিন খুজছে। যতক্ষণে নিজের এতোদিনের স্তরে স্তরে গড়ে তোলা সুক্ষ প্ল‍্যানের এরকম ভয়াবহ পরিণতি বোঝে রিক, ততক্ষণে গগণ বিদারি আক্রোশের চিৎকার বেরিয়ে আসে ওর কন্ঠ থেকে।
-শা*লা বা***দ, কোন মা***দ আমার প্ল‍্যান নষ্ট করলো? কোন মা**রের পো*লার সাহস হইলো আমার, রাকিব শাহজাহানের প্ল‍্যানে হাত দেওয়ার? শৈলী….খা*কি তোকে আমি দেখে নিব। আজ বাচ্ছিস বলে কি দিন শেষ? আই উইল সি দা এন্ড অফ দিস।

পাশে থাকা কাঠের চেয়ারে স্বজোরে লাথি মেরে গটগট করে রুম থেকে বের হয় এক ব‍্যর্থ, অহংকারী মানব।
………………………..

মিহরান শৈলীকে নিয়ে গাছতলার নিচ দিয়ে হেটে যাচ্ছে। বৃষ্টির চাপ ক্রমাগত বাড়ায় এই পন্থাতেই যেতে হচ্ছে ওকে। শাহজাহান বাড়ি থেকে অনেকটা দূরে চলে এসেছে, আসলে দূরেই সরতে চায় ও। শৈলীর এখনো জ্ঞান ফেরেনি মানে মেয়েটা ভীষণ ভাবে শক্ড হয়েছে। আর জ্ঞান ফিরলেও কি অবস্থায় থাকবে তা বোঝা মুশকিল। কিভাবে রিয়‍্যাক্ট করবে কে জানে। নেগেটিভ ভাবে রিয়‍্যাক্ট করাই স্বাভাবিক এই পরিস্থিতিতে। তবে ওর কোনো প্রতিক্রিয়ায় আশপাশের মানুষ যদি ভুলটা বোঝে? সেই বদনাম ছড়ানোর ভয় বাড়ির ভেতর থাকলো সেই বদনামই আবার ছড়াবে। যদিও মিহরান ওপর থেকে যতটুকু দেখছে তাতে স্পষ্ট যে মেয়েটার বড় কোনো ক্ষতি হয়নি। তবে সমাজ বুঝবে কতটুকু?

অনেক পথ হেটে ফেলেছে মিহরান। পেছন ফেরে শাহজাহান বাড়ি আর দৃষ্টি সীমানায় নেই। এই মুহূর্তে মিহরান দাড়িয়ে পরলো, হাপিয়ে উঠেছে সে। শৈলীর অবচেতন শরীরের পুরোটুকুর ভর ওর ওপর, তার সাথে বৃষ্টি ও বাতাস, সাথে গাছপালার উত্তাল চলন, সব কিছুর সাথে লড়ে সামনে আগাতে হয়েছে ওকে। তবে এখন আর পা চলছে না। বৃষ্টির বেগ এখন অনেক বেশী। সামনে কিছু দেখাও যাচ্ছে না ঠিক ভাবে।

পাশে বিস্তৃত ক্ষেতের দিকে তাকায় মিহরান। বেশী বড় না ক্ষেতটা আর তার অপর পাশে অনেক গুলো ঘরের আবছা অবয়ব চোখে পরছে। চোখে মিহরানের এক পলকের জন‍্য স্বস্তি ফুটলো। না, ঘরগুলো দেখে না। ওখানে গেলে আরেক বিপদ হতে পারে জানে সে। মিহরান খুশি হয়েছে, ক্ষেতের ভেতর একটা ছনের কাঁচা ঘর দেখে। অনেক ক্ষেতেই এরকম ঘর দেখা যায়। চাষীরা বিশ্রামের জন‍্য ও বিভিন্ন মেশিন ও যন্ত্রপাতি রাখার জন‍্য বানিয়ে থাকে।

হঠাৎ কোলে নড়চড়ের টের পেয়ে মিহরান নিচে তাকায়।শৈলীর জ্ঞান ফিরেছে তবে চোখ এখনো খোলেনি ও। চোখ জোড়া কুচকে রেখেছে। বৃষ্টির বড় বড় ফোটা ওর মুখে পরাতে কষ্ট হচ্ছে ভেবেই মিহরান গাছের আড়ালে যায়। ততক্ষণে পিটপিট করে পলক ঝপকায় শৈলী। প্রথমে ভাসা ভাসা তারপরে স্পষ্ট হয় এক পুরুষ অবয়ব। শৈলীর মানুষটাকে চিন্তে এক মিনিট সময় লাগে।
– স‍্যার….

মিহরান স্নিগ্ধ ও স্বস্তির এক হাসি ছড়ায় মুখে।
-শৈলী, আপনি ঠিক আছেন? কেমন লাগছে এখন?

শৈলীর নিজেকে একটা ঘোরের মাঝে মনে হয়। খুব কাছ থেকে বৃষ্টির আওয়াজ পাচ্ছে। মিহরানও বেশ কাছে। ও কোথায়? কি করছে? শুয়ে কেন ও?

হঠাৎ বিদ‍্যুতের ন‍্যয় সবকিছু মনে পরে যায় শৈলীর। সেই রুম, বন্দি দশা, ওর চিৎকার এবং শেষে মিহরানের আগমন সব মনে পরে। এসব চিন্তা করতেই হুড়মুড়িয়ে ওঠে ও। মিহরান ইঙ্গিত বুঝে আস্তে করে ওকে কোল থেকে নামায়। তবে পরমুহূর্তেই হাতটা ধরে নেয় যাতে শৈলীর ব‍্যালেন্স রাখতে সুবিধা হয়।

শৈলী দাড়িয়ে একটা বড় দম নেয়। এরপর ভয়ার্ত চোখে আশপাশে তাকায়,
-আআমরা…ককোথা…

মিহরান শৈলীকে কথা শেষ করতে দেয়না। কোনো ভ্রান্ত ধারণা মেয়েটার মাথায় আসার আগেই সব ক্লিয়ার করে,
– আপনি অজ্ঞান হয়ে পরেছিলেন শৈলী। এমন অবস্থায় আপনাকে নিয়ে সবার মাঝে যাওয়ার আমার অবস্থা ছিল না। তাই আমি আপনাকে নিয়ে বাইরে বের হয়েছি। ভেবেছি আগে আপনি একটু ঠিক হোন, তারপর আমরা ফিরবো।

শৈলীর সব মনে পরলেও মাথা ঠিক ভাবে কাজ করছিল না। সবই ব্ল‍্যাঙ্ক লাগছিল। ওর চেহারার ভাব বোধহয় মিহরান বুঝলো,
– মাথায় এতো চাপ দিয়েন না এখনি। আগে চলুন বৃষ্টি থেকে মুক্তি নেওয়া যাক। নয়তো ঠান্ডায় কাবু হয়ে যাব।
– কোথায় যযাবো?

মিহরান শৈলীকে হাত তুলে সামনের সেই ঘরটা দেখায়। তারপর ওর হাত শক্ত করে চেঁপে ধরে মেইন রোড ছেড়ে আস্তে আস্তে কাঁচা পথে নেমে আসে। কাদা মাটির মধ‍্যে দিয়ে ক্ষেতের রাস্তায় ঢুকলো ওরা। খুব সাবধানে পার হয়ে সেই ঘরের কাছে এসে দাড়ালো। এই ধরনের দরজায় সাধারণত কিল দিয়ে আটকানো থাকে। এটাও তাই ছিল। সেই কিলটা খুলে ভেতরে ঢুকলো মিহরান। কিন্তু পেছনে চেয়ে দেখলো শৈলী ঠায় দাড়িয়ে বৃষ্টির নিচে। ওর চোখে আতঙ্ক মিহরান স্পষ্ট দেখতে পেল,
-কি হলো শৈলী? ভেতরে আসুন?

কেঁপে ওঠে শৈলী। কাঁপতে কাঁপতেই মাথা নাড়ায়। সে ভেতরে যাবে না। মিহরান প্রথম কপাল কুচকে তাকায়, সাথেসাথেই বুঝে যায় শৈলীর আতঙ্কের কারণ। নিজের ফোনের ফ্ল‍্যাশলাইট জ্বালিয়ে ঘরের সুইচ খুজতে লেগে গেল। একটা জায়গায় পেয়েও গেল। সেটা জ্বালাতেই রুমের আঁধার মিটিয়ে আলোকিত হলো চারপাশ। শৈলীর দৃষ্টি এবার নরম হলো। সাথে মিহরানের প্রতি কৃতজ্ঞ বোধ করলো ওর আঁধার ভীতিটা নিমিষেই বুঝে নেওয়ার জন‍্য।

শৈলী চপল পায়ে ঢোকে ভেতরে। রুম টা স্বাভাবিক ভাবেই খুব একটা বড় না। একপাশে যন্ত্রপাতি আর সাথে একটা চটের মোড়ানো নিচু খাট, এই যা। মিহরান শৈলীকে খাটে বসতে দিল। নিজেও আর কোথাও জায়গা না পেয়ে ওর পাশেই বসলো।

কিছুক্ষণ চুপ রইলো দুজন। বাইরের বৃষ্টির বর্ষণ আস্তে আস্তে কমছে বোঝা গেল। ইচ্ছা করেই দরজাটা খোলা রেখেছে মিহরান। অন্ধকারের মতন যদি বদ্ধ দরজা নিয়েও শৈলী আতঙ্কিত হয় এই কারণে।

চুপচুপে ভিজে এসে এখন গায়ের সাথে সব কাপড় লেপ্টে গেছে দুজনের। মিহরান সমান তালে এক হাত দিয়ে বুকের ওপরের শার্টের পোর্শনটা ধরে নাড়াচ্ছে পানি সুখানোর জন‍্য। অপর হাত চলে গিয়েছে ওর চুলে। সামনে পিছে ঝাড়ছে চুলের পানি বের করতে। তবে এক দুবার করতেই ওর চুলের পানি যেন লাফিয়ে পরলো শৈলীর গালে। এমনিতেই ভেজা কাপড়ে কাবু হওয়া মেয়েটা গালে ঠান্ডা ছিটার স্পর্শ পেয়ে খাট নাড়িয়ে কেঁপে উঠলো। সাথেসাথে পাশ ফিরে মিহরান,
– ওহ! সরি শৈলী… আমি খেয়াল করি ন…

অজান্তেই মিহরানের হাত উঠে যায় শৈলীর গালে, পানির ফোটা মুছতে। শৈলীও চকিতে তাকায়। কিছুক্ষণের জন‍্য আটকে যায় একে অপরের মাঝে দু জোড়া দৃষ্টি। মিহরানের আঙ্গুল নিজ গতিতেই শৈলীর গাল ছোয়। শৈলীও যেন সরতে ভুলে যায়।

হঠাৎ ধরণী কাঁপিয়ে বিদ‍্যুৎ চমকায়। খোলা আকাশে ক্ষেতের মাঝে বজ্রের আঘাত শুনতে লাগে বিকট ভয়াবহ। শৈলী চিৎকার দিয়ে উঠে তখনই, মিহরানকে আচমকা আবার জাপটে ধরে। তবে মিহরান এবার নিজে চমকায় না, তার সামনে বসা আদুরে আননের নারীকে আগলে রাখতে সে এখন প্রস্তুত। তাই দু হাত দিয়ে শৈলীর পিঠ জড়িয়ে ধরে। তারপর এক হাত ওর মাথায় ওঠায়। চুলের মাঝে আল্তো আদুরে পরশ বুলায়,
– হুশ!… হুশ!…কোনো ভয় নেই, আমি আছি তো। আপনার কিচ্ছু হবে না।

তবে শৈলীর কাঁপুনি থামে না। বার বার সেই অন্ধকার রুমে বজ্রাঘাতের আওয়াজ টা কানে বাজছে ওর। আরও ভয়ে সিটিয়ে যাচ্ছে মিহরানের ভেতর। ফোঁপাচ্ছে পুরোদমে।
মিহরান বুঝলো মেয়েটা এখন নিজের মাঝে নেই। কোনো কিছুই জিজ্ঞেস করা এখন উচিত হবে না। তারচেয়ে বরং এখন ওকে স্বাভাবিক করাটাই জরুরী। মিহরান শৈলীকে নিজের বুক থেকে সরায় না। ওকে ওর নিজের মতন নরমাল হওয়ার সুযোগ দেয়।

এক সময় শৈলীর নিঃশ্বাসের স্বাভাবিক গতি শুনতে পায় মিহরান। বোঝে ও মনে হয় একটু ঠিক হয়েছে। নিজের হাতঘড়ির দিকে তখন তাকায়, দেখে আটটা বেজে পাঁচ মিনিট। এখন ফিরতে হবে ওদের।
– শৈলী…

ঠোট টিপে শৈলী আস্তে মুখ ওঠায়। ওর ভেজা ল‍্যাপ্টানো কেশের মাঝে চাঁদের ন‍্যায় উঁকি দেওয়া নয়ন জোড়ার দিকে তাকিয়ে মিহরানের বুক ধক্ করে ওঠে। এতো নেশালোও কি কারও চোখের মণি হয়? এতোটাই আকর্ষণীয়? মিহরান ঢোক গিলে। রীতিমতো নিজের সাথে যুদ্ধে নামে। নিজের ভারসাম্য রক্ষা করতে প্রাণপণ চেষ্টা চালায়।
– শৈলী….আমাদের এখন যাওয়া…..

– হায় হায় হায়! কই জাই আমি, ও রহিমের বাপ, আইয়ো, আইয়া দেহ। দেহ আবার আমগো ছনের ঘরে নষ্টামো করতে আইছে ফাজিল গুলো। আইয়ো আইয়ো..

চকিতে ধড়ফড়িয়ে ওঠে মিহরান আর শৈলী। নিজেদের অবস্থান বুঝে আরও ঘাবড়ে যায় দুজন। সাথে সাথে উঠে এক অপরের থেকে দুরত্ব নিয়ে দাড়ায়। দরজার সামনে দাড়ানো চল্লিশোর্ধ মহিলার চিৎকারে ততক্ষণে আশপাশ দিয়ে দৌড়ানোর আওয়াজ স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। পরমুহূর্তেই ঘরের দোড়গোড়ায় মানুষে ভরে একাকার হয়ে গেল। প্রথম মহিলাটা তারস্বরে চিৎকার করেই যাচ্ছে,
-তোগো বাড়িত বাপ মা নাই? হ‍্যারা তোগো কিসু শিহায় নায় নি? এইসব নষ্টামি শিহস কোন হান দিয়া হ? আর এইসব নষ্টামি করার জন‍্য এইহানেই আওন লাগে ক‍্যা? আমগো জাইগাই নষ্ট করবার ইস্সা জাগে ক‍্যান? ক? ক‍্যা?

শৈলী হতভম্বের ন‍্যায় তাকায় মহিলার দিকে। এক রাতে দুই দুই বার ওর সাথে ভয়ংকর ঘটনা ঘটেছে। কিভাবে, কি করে সবকিছু ওর মাথায় নেবে ও কিছুই বুঝছে না।

কিংকর্তব‍্যবিমুড় মিহরানও। এতো কিছু চিন্তা করে, সব সমস‍্যাকে পিছে রেখে ও শৈলীকে নিয়ে এই পর্যন্ত আসলো। কিন্তু সবচাইতে বড় সমস‍্যাটাই বাধলো এখানে। এখন কি করবে ও? কঠিনতম সময়েও নিজের মাথা ঠান্ডা রাখার এক বিশেষ ক্ষমতা আছে ওর। আজকে সন্ধ‍্যা থেকেও সেটার প্রমাণ সে দিয়েই আসছে। কিন্তু এইরকম পরিস্থিতিকে কিভাবে সামলাবে?

বৃষ্টি অনেকটা শেষ। মাঝে মধ‍্যে টুপটাপ পানি পরছে শুধু। এরকম সময় গ্রামের অর্ধেকেরও বেশী জনতা এসে জড়ো হয়েছে এইখানে। রাতের বেলা দুজন প্রাপ্তবয়স্ক নারী পুরুষকে এই জায়াগায় একসাথে দেখে সবচাইতে নিকৃষ্ট চিন্তা যা করা যায় তাই করছে তারা। আর প্রথম মহিলা তার নিজের চোখে দেখা দৃশ‍্য আরও মাখিয়ে চাখিয়ে বর্ণনা তো দিচ্ছেই।

– দ‍্যাখসো রহিমের বাপ। আমার কতা তো কানে ন‍েও না। কইসিলাম এই সনের ঘরে তালা লাগাইতে? কইসিলাম? গত মাইসে এক কান্ড ঘইটা গেল, পুরা গেরামে কথা হইলো। তোমারে কতো জনে দুষাইলো এই ঘরের লাইগা। হেইডা সুপ হইতে না হইতে আরেক জোড়া পাখি ফাল মারসে। আমি হঠাৎ আলো ঝালানি দেইহাই বুঝবার পারসি আবার আইসে হেগুলা। বলি এই ঘর সাড়া আর কুনোডা চোহে ফরে না হ‍্যাগো? সি সি সি, কি দ‍্যাখলাম আমি, ও আল্লাহ্। দুইডা একে অপররে জরাইয়া ধইরা কি সব করতাসিল, সি সি সি, আমার কইতেও শরম লাগে।

মহিলার কথায় আর বাকিদের প্রতিক্রিয়া শুনে মিহরানের কান থেকে যেন লাভা ঝড়তে লাগতো। চোখ তুলে থরথর করে কাঁপতে থাকা শৈলীর দিকে চেয়ে নিজেকে শক্ত করলো ও,
-থামুন আপনে খালা। কি সব বলে যাচ্ছেন তখন থেকে? আমরা এমন কিছুই করি নাই….
– ঐ সুচ। একদম সুপ থাকবি হা**য়ার পো*লা।

“রহিমের বাপ” নামে যেই মানুষটাকে ডাকা হচ্ছিল সে মিহরানের দিকে আঙ্গুল তুলে চিৎকার দিয়ে উঠলো।
– আগে আমগোর ফ্রশ্নের উত্তর দে। তোরা ক‍্যাডা, তোদের মাঝে সম্ফর্ক কি? এইহানে কি করস ক? একদম মিথ‍্যা কবি না কয়া দিলাম।

পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে মিহরান জানে। আবারো শৈলীর দিকে ফিরলো ও। শৈলীও ও আঁকুতি ভরা দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকানো,
– আমরা স্বামী – স্ত্রী। এইখানে ঘুরতে এসেছিলাম, বৃষ্টির কবলে পরে আটকা পরি। তাই আপনাদের এইখানে আশ্রয় নিয়েছিলাম।
মিহরানের কথা শেষও হতে পারলো না, তার আগেই চেঁচিয়ে উঠলেন সেই “রহিমের মা”
– হ, অহন ধরা খাইসোস, তাই অ তোর ইস্ত্রি হইয়া গেল তাই না? তুই কইলি আর আমরা মাইনা লমু? অতই সোজা? হেহ্!!! ঐ বেডি তোর মুহে কি কুলুপ আটাইসে? তুই কিসু কস্ না ক‍্যা? আসলেই অ তোর সোয়ামি? বল্?

মিহরানের এবার মন ঘাবড়ালো। শৈলী চেহারা স্পষ্ট বলছে ওর মুখের থেকে বের হওয়া কথাটাই তখনো ঠিক ভাবে মেয়েটা হজম করতে পারে নাই। নিজেদের স্বামী-স্ত্রী পরিচয় দিয়েছে, সেটাই মস্তিষ্কে গাঁথতে সময় নিচ্ছে। এখন এই মহিলার আক্রমন সামলাবে কিভাবে ও?
– কি হইলো? অহন কতা বাইড়ায়না ক‍্যা? এতো নষ্টামি করবার পারো, তহন খই ফোটে মুহে অহন বন্ধ ক‍্যা?
মিহরান চরম রেগে যায়,
– আপনি কেমনে কথা বলছেন ওর…
– উনি ঠিক বলেছেনআমরা স্বামী স্ত্রী।
মিহরান নিজেই নিজের কথা গিলে ফেলে। পাশে শৈলীর দিকে অবিশ্বাস্য চাহনি নিক্ষেপ করে। মেয়েটা এতো বাজে মানসিক যন্ত্রণাতেও ওর তালে সাথ দিচ্ছে সেটাই মিহরানের কাছে অদ্ভুত সুন্দর লাগে।

কিন্তু শৈলীর এই স্বীকারোক্তি মিহরানকে মুগ্ধ করলেও রহিমের মায়ের মন এক ফোটাও নরম করতে পারলো না।
– কইলেই হইলো? অয় কইলো আর আমি বিশ্বাস করমু? জীবনেও না। এই দুডা স্বামী স্ত্রী আমি বিশ্বাস করি না। হায় খোদা, এইসব কান্ডকারখানা হইতে থাকলে আমগো গেরামের নাম, ইজ্জত সব শ‍্যাশ হইয়া জাইবো গো।

মহিলা এ কথা বলেই কান্নায় ভেঙে পরলেন। ওনার এই শেষের কথায় সেখানে উপস্থিত সব নারীরাই হই হই করে ওনাকে সম্মতি জানায়, এতে পরিস্থিতি হয়ে যায় আরও ঘন। মিহরানের মাথা ধরে যায়। ঘড়ি তে সময় নয়টা ছুই ছুই। ঐদিকে শাহজাহান বাড়ি নিয়েও টেনশন হচ্ছে। এখানে আবার এই প‍্যাচাল, সব মিলিয়ে ওর কাছে এখন সব ঘোলাটে মনে হচ্ছে।

তখনই সেই জটলার মাঝ দিয়ে এক বয়ষ্ক লোকের আবির্ভাব হয়। ওনার পোষাক আষাক দেখেই বোঝা যায়, উনি হুজুর গোছের কেউ। ধবধবে সাদা পাঞ্জাবী আর লুঙ্গি পরে সামনে এসে মিহরান- শৈলী আর গ্রামের জনতারদের মাঝে দাড়ান।
– হোন হোন। এইভাবে সিল্লিসিল্লি কইরা কুনো লাভ হবার নাই। আমি একটা ভালো প্রস্তাব দেই হোন সবাই।

হুজুর মিহরানের দিকে ঘুরে আবার সামনে চাইলেন,
– জেহেতু, অরা কইতাসে, ওরা স্বামী ইস্ত্রী, অগো বিয়া হইসে, তাইলে আরেকবার বিয়া করত তো সমস‍্যা হইবো না তাই না? আমরা ওদের এক্ষনি এইহানে বিয়া ফরাইয়া দেই, তাইলেও তো সব পানির মতন ফরিষ্কার হইয়া যাইবো। কি কও রহিমের মা? ঠিক আসে তো?

হুজুরের একটা একটা শব্দ কানে গিয়েছে শৈলীর। চোখ কোটর থেকে বের হয়ে শুধু নিচে পরা বাকি ওর। কি বলে এই লোক? ওর আর মিহরানের বিয়ে দেবে ওরা? তাও আবার এখন? এসবের মানে কি?

শৈলী যা মনে মনে চিন্তা করছিল সেটাই রাগের চোটে চিৎকার রুপে বেরিয়ে আসে মিহরানের মুখ থেকে,
-কি বলছেন এইসব চাচা? আমাদের বিয়ে দিবেন মানে? এটা কোন ধরনের কথা? আমরা তো বললামই আমরা স্বামী স্ত্রী। আর কি চাই আপনাদের? কি সমস‍্যা কি আপনাদের?
মিহরানের রাগ উঠতে না উঠতেই আবার চড়াও হলো সেই মহিলা,
– দেখসুন নি চাচা, দেখসুন। আমি কইসি না এই দুইডা জামাই বউ না। জামাই বউ হইলে এইভাবে চিক্কুর ফারতো না। এই মাইয়া নিস্চিত নষ্টা মাইয়া, এই পোলায় অরে ক্ষ‍্যাতে লইয়া আইসিলো নষ্টামি করবার। অহন জহন ল‍্যাঝে ঝুইল‍্যা দিবার সাইতেসি, তয় ফাল পারে।

শৈলীর মহিলার ইঙ্গিত বুঝতে একটুও সময় লাগলো না। সাথে সাথে দুই কানে হাত দিয়ে জোরে কেঁদে ফেললো ও। মিহরান কারো তোয়াক্কা না করে শৈলীকে তক্ষুনি নিজের বুকে নিয়ে নেয়। মাথায় হাত বুলিয়ে বার বার সান্ত্বনা দেয় চুপ হতে।
এই দৃশ‍্য দেখে ওখানের জনতা তো গেল আরো ক্ষেপে। সবাই বলাবলি করতে লাগলো, এতোজনের সামনে এভাবে জড়ায়ে ধরতে পারলে একা রুমে তো না জানি কি করসে দুজন। রহিমের মায়ের কথাই আরও পাকা পোক্ত হয়ে উঠলো সবার কাছে। সেই মুহূর্তেই গ্রামবাসি মিলে সিদ্ধান্ত নিল, হয় দুইজনের এইখানে এখুনি বিয়ে হবে, নয়তো ওরা পুলিশ ডাকবে।
মিহরান পুরো থমকে যায়। ওরা দুজন বনাম এতো গুলো গ্রামের মানুষ। এদের সাথে পেরে ওঠা অসম্ভব। এখনো যে গণ ধোলাই খায় নি এই তো অনেক। ভার্সিটির কাউকেও ডাকতে পারছে না, সেখানে হবে আরেক বিপদ বলে। পুলিশের ফ‍্যাকড়ায় পরলে ওদের দুজনেরই ভবিষ‍্যত বিপদে পরবে। সেদিকে তো যাওয়া যাবেই না।
মিহরান শৈলীর কান্নারত অসহায় চোখে একবার গভীর ভাবে নিবদ্ধ করে । সিদ্ধান্তে পৌছায়,

– চাচা আপনি বিয়ে পড়ান আমাদের।

চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here