পরিণয়_প্রহেলিকা #লেখিকা_সিনথীয়া #পর্ব_৪৩

0
897

#পরিণয়_প্রহেলিকা
#লেখিকা_সিনথীয়া
#পর্ব_৪৩

শৈলীদের বাসায় আজ ইদ না লাগলেও মনে হচ্ছে যেন চাঁদ রাতের আসর বসেছে। নিপুনের হইহুললোড়ে অন্তত তাই মনে হচ্ছে। শৈলীর আশ পাশ দিয়ে ঘুরঘুর করে ওর কান ঝালাপালা করে ফেলছে মেয়েটা। শৈলী নিজের লজ্জা লুকোবে না বোনের খুশি দেখবে তাই ঠাওর করতে পারছে না। অথচ এই মুহূর্তের এই খুশিটা কিছুক্ষণ আগেও ছিল ভয়ংকর এক রুপে। শৈলীর সেটা চিন্তা করলেও গা কাঁটা দিয়ে উঠছে।

বিকাল থেকে, মিহরানদের বাসায় যা যা হচ্ছে তা সরাসরি না দেখতে পেলেও শৈলী সব জানতে পেরেছে। মাহিরা সময়ে সময়ে ওকে ফোনের মাধ‍্যমে সব আপডেট দিয়ে চলেছে। যখন মাহিরার প্রথম ফোন আসলো, আর শৈলী মিহরানের ওর মাকে সব কিছু বলে দেওয়ার কথাটা শুনলো, মাথাটা ঘুরিয়ে উঠেছিল ওর। যেই পরিস্থিতিতে মিহরান বলেছে সেটা যে ওদের সম্পর্কের অনুকূলে ছিল না এটা মাহিরার আতঙ্কিত স্বরেই বুঝেছিল শৈলী। থমকে গিয়েছিল তখন ও।

হৃদস্পন্দনের গতি আরও কয়েকশো গুণ বাড়িয়ে দিতেই যেন কিছুক্ষণ পর হয়েছিল মাহিবের আগমন ওদের বাসায়। ভাইয়া এসে যখন মা বাবাকে ডেকে নিয়ে যায় তখন শৈলীর আত্মা শুকিয়ে আসার জোগাড়। এরকম ভাবে সব জানাজানি হয়ে যাবে সেটা কল্পনাতেও আসেনি কখনো।
কিন্তু কিছুক্ষণ আগে মাহিরার সুসংবাদ সহ কল, এবং তার পরপরই বাসায় ঢুকে মায়ের আলিঙ্গনে জড়িয়ে যাওয়া, এসব পেয়ে শৈলীর মনে হচ্ছিলো ও আকাশে উড়ছে। এতোটাই হালকা বোধ হচ্ছিলো। রেহানা ওকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদলেন অনেক্ষণ,
-তোর সাথে এতো ভংয়কর ঘটনা ঘটতে যাচ্ছিলো, আসার পর কেন জানাইস নাই আমাদের আম্মু। মিহরান সেই জায়গায় না থাকলে তোর কি হতো? আমি কেমনে বাঁচতাম মা? আমি কেমনে বাঁচতাম?

আজাদ সাহেব রেহানার উত্তেজিত অবস্থা দেখে শৈলীকে তখনই কিছু বলতে চাইলেন না। আর এমনিতেও বলার ছিলও না কিছু। সব বিভ্রান্তি মিহরান নিজেই যে দূর করে দিয়েছে।

আজাদ আর রেহানা ওদের বাসার থেকে বিদায় নিয়ে বের হওয়ার সময় পেছন থেকে মিহরানের আওয়াজে থামে সবাই। মিহরান সামনে এসে সরাসরি আজাদ আর রেহানার সামনে দাড়ায়,
– আঙ্কেল একটা অনুরোধ ছিল।

আজাদ কৌতুহল নিয়ে মিহরানের দিকে তাকালো। মিহরান নিজের কথার মাঝে থামেনি,
– আপনারা শৈলীকে প্লিস কিছু বলবেন না। এসব কিছুতে ওর কোনোই দোষ নেই। রুমে থেকে উদ্ধার করার পর অনেক্ষণ ও অজ্ঞান ছিল, তাই সব সিদ্ধান্ত আমাকে একাই নিতে হয়েছিল। ও কিছুই বুঝতে পারেনি। আর….বিয়েতে প্রথমে ও মত দিতে চায়নি, বার বার শুধু আপনাদের দুজনের কথা বলছিল। আমিই পরিস্থিতির গম্ভীরতা বুঝে জোর করেছিলাম ওকে। এই পুরো ঘটনায় ও শুধু আমার সাথে ছিল, সিদ্ধান্তে না। তাই ওর কোনো দোষ ধরবেন না প্লিস।
আজাদের তখনই বুক ভরে ওঠেছিল মিহরানের কথায়। শৈলীর প্রতি ওর দায়িত্ব ওর যত্নশীলতা দেখে তিনি মুগ্ধ। মিহরানের কাধে হাত চাপড়ে বাক‍্য বিহীন শুধু মাথা নেড়ে নিজের সম্মতি জানিয়েছিলেন।

বাস্তবে ফিরে আজাদ সাহেব নিজের মেয়ের কাছে যান। স্ত্রীর কাছ থেকে মেয়েকে আল্তো হাতে টেনে নিজের বুকে জড়ান। এইবার বাধ শৈলীরও ভাঙে। কেঁদে ফেলে ও বাবার বুকে। কেউ কোনো কথা বলে না তবে কথোপকথন অনুভূতির মাধ‍্যমেই হয়ে যায়।

কিছুক্ষণ এভাবেই থাকার পর আজাদ সাহেব মুখ খুলেন। মেয়েকে শুধু দুটি প্রশ্ন করেন,
– মিহরানকে জীবন সাথী হিসেবে মেনে নিতে তোমার কোনো সমস‍্যা নেই তো? এই বিয়েতে তুই সুখী তো?

কান্না ততক্ষণে থেমেছিল শৈলীর, বাবার প্রশ্ন টা তাই মন দিয়ে শুনেছে। ঠোট টিপে নিজের লজ্জা লুকোনোর প্রচেষ্টা চালালো কিছুক্ষণ তারপর হাল্কা মাথা ঝাকিয়ে নিজের সম্মতি জানালো। ও মিহরানকে পেয়ে সুখি।

আজাদ সাহেব এবার সন্তুষ্টির এক বড় নিঃশ্বাস ছাড়লেন। সব কিছুর ওপরে তার কাছে এই উত্তরটা বিশেষ জরুরী রুপে দরকার ছিল। এখন তার আর বিন্দু মাত্রও আপত্তি নেই এই সম্পর্কটা নিয়ে।
……….

রাতে আজ বাতাস ছেড়েছে। গরমের উষ্ণ আবহাওয়ায় এই শীতল বাতাস দেহ, মন কে সতেজ করে দিতে সক্ষম। কমিউনিটির পার্কে তাই এই রাতেও বাচ্চারা খেলতে নেমেছে। বড়রা হাটছে, কেউ বসে আড্ডা দিচ্ছে। অনেক হাসি কলরবে মুখরিত চারিপাশ। এসবের মাঝেও এই কমিউনিটির একটি বিল্ডিংয়ের চতুর্থ তলার একটি বাসায় কোনো কলরবের আওয়াজ আজ নেই। সবকিছু থমথমে হয়ে আছে। যেন ঝড় আসার আগের থমকে যাওয়া পূর্বাভাস বিরাজমান। হাসেম সাহেব ঘন ঘন ডাইনিং রুমে পাইচারি করছেন আর বন্ধু মহলে যত ডক্টর আছে সবার সাথে বারে বারে যোগোযোগ করছেন। টেনশনে মাথার ঘাম পায়ে পরে একাকার তার। এক মাত্র সন্তান বার বার জ্ঞান হারাচ্ছে, তা নিয়ে চিন্তা হবে না তার?

মিসেস দিলারা তুরিনের রুমে ওর মাথার পাশে বসা। ঘুমন্ত মেয়ের দিকে তাকিয়ে আজ সন্ধ‍্যা থেকে পার হওয়া বিভীষিকাময় সময় গুলো নিয়ে ভেবে মুখে হাত দিয়ে নিঃশব্দে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছেন তিনি।

তুরিনের অজ্ঞান হওয়ার খবর শোনার পর দিলারা, মালিহাদের বাসা থেকে ওকে নিয়ে সোজা ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলেন। নিজের কম্পানির সব কাজ ফেলে হাসেম সাহেবও পৌছেছিলেন সেখানে। মালিহাদের বাসায় জ্ঞান ফিরতে সময় লেগেছিলো, ওখানে প্রেশার মাপা হয়েছিল, প্রেশার ফল্ করেছে দেখাচ্ছিলো। হাসপাতালে নিতে নিতে রাস্তায় আবার জ্ঞান হারিয়েছিল। ডাক্তার দেখে কয়েকটা পরীক্ষা দিয়েছে। তবে প্রাথমিক ভাবে বলেছে যে তুরিন কোনো কারণে ভীষণ স্ট্রেস্ড অথবা শক্ড যার কারণে ও জ্ঞান হারাচ্ছে।

দিলারা এটা শুনে ভীষণ ভড়কে গিয়েছেন, ওনার মেয়ে স্ট্রেস্ড অথচ উনি অবগত না এই বিষয়ে। জানতে চাওয়া উৎসুকতা প্রকাশ করতে গিয়ে ডাক্তার তাকে থামিয়ে দিয়েছেন। এই মুহূর্তে তুরিনকে কোনো কিছু বলে অথবা জিজ্ঞেস করে উত্তেজিত করা যাবে না। ওকে সময় দিতে হবে নিজেকে গোছানোর। এই বলে ডাক্তার ছেড়ে দিয়েছেন তুরিনকে কিন্তু বাসায় আসার পর মেয়ে আবারো জ্ঞান হারানোর পর হাসেম দম্পতি এখন আসলেই গভীর চিন্তায় পরে গেছেন। কি হয়েছে তাদের প্রাণ প্রিয় সন্তানের, কি নিয়ে সে এতো চিন্তিত?
………………….
বেশ রাত হয়েছে। আজ রাতের রুটিনে অনেকটাই ব‍্যাঘাথ ঘটেছে বলে খাওয়া দাওয়া করেই সবাই যে যার মতন শুতে চলে গিয়েছে। নিপুন বোনের বিয়ের খবর শুনে এতোটাই উত্তেজিত ছিল আর এতো লাফালাফি করেছিল, যে ক্লান্ত হয়ে খাওয়ার পর বিছানায় আসতেই তলিয়ে গেছে সে ঘুমের সাগরে। মা বাবার রুমের দরজাও বন্ধ। এই নিস্তব্ধতায় শুধু শৈলী জেগে আছে। শুয়ে আছে কিন্তু কোনোভাবেই ঘুমাতে পারছে না ও। নিপুনের মতন লাফালাফি করতে পারেনি শুধু লজ্জায়, কিন্ত ভেতর ভেতর তো খুশিরা মিছিলে নেমেছে আজ। এতো জটিল একটা বিষয় এতো সহজে সমাধান হয়ে যাবে এটা শৈলীর কল্পনায় ছিল না। ও তো ভেবেছিল বাসায় কুরুক্ষেত্র বাঁধবে। বাবা মা ওর ওপর ক্ষেপে থাকবেন দিনের পর দিন, মিহরানদের পরিবারও ওকে মেনে নিবে না, আরও কতো কি। কিন্তু সেখানে তেমন কিছুই হলো না। বাহ্!

হঠাৎ ঘর কাপিয়ে ফোনের রিংটোন বাজায় শৈলী ধরফরিয়ে ওঠে। নিপুন জেগে যেতে পারে ভেবে জল্দি ফোনটা পিক করে। মিহরানের নাম্বার দেখে কানে তোলে,
– হ‍্যালো।
– কি ব‍্যাপার? ফিস ফিস করে কথা বলছো যে?
– নিপুন ঘুমাচ্ছে, তাই।
– তাহলে আমার রুমে আসো।

শৈলীর চোখ কপালে উঠে। কি অকপট প্রস্তাব লোকটার!
– আপনি কি পাগল হয়ে গিয়েছেন নাকি?
– পাগল কেন হবো? আমার স্ত্রীকে আমার কাছে ডাকা কি ভুল কথা নাকি?

শৈলী নিঃশব্দে হাসে,
– আজকে সন্ধ‍্যার পর থেকে দেখছি আপনার সাহস অনেক বেড়ে গিয়েছে। তখন নিপুনের সাথেও বেশ দুলাভাই সুলোভ ভাব নিয়ে কথা বললেন। এখন আবার আমাকে সরাসরি….
– সরাসরি কি?

ব‍্যাস্! মানুষটা এই একটা প্রশ্ন করে শৈলীকে লজ্জায় লাল করে রাঙিয়ে দেয়। এরকম নেশাতুর কন্ঠ শুনলে নিজেকে সামাল দেওয়া যায়? ফাজিল লোকটা কি বোঝে না?
-আমি জানিনা।
– তুমি আসলেই আসবা না ওপরে?

শৈলী অধৈর্য‍্য হয়,
– কিভাবে আসবো বলুন তো? আজকেই সবাই সব জানলো, এখনই এভাবে বাসা থেকে বের হলে মা নিশ্চিত বুঝে যাবে আমি কোথায় গিয়েছি। কেমন একটা লজ্জার বিষয় না? প্লিস আজকে আসবো না। ফোনেই কথা বলেন।

অপর পাশে কিছুক্ষণ নিরবতা পালন করা হয়। এরপর শৈলী শোনে সেই পুরুষালি গম্ভীর কন্ঠ,
-ঠিকাছে। তাহলে কালকে আমার সাথে ডেইটে চলো।

শৈলীর নিঃশ্বাস গলায় আটকায়। এভাবে করে ডেইটে যাওয়ার কথা কেউ বলে? সামনের মানুষ তো হার্ট এ‍্যাটাকও করতে পারে, পারে না? লোকটা আসলেই কিছু শিখে নাই।
– কি ব‍্যাপার যাবা না আমার সাথে?
– কোথায়?
– ডেইটে।
– আরে তা বুঝলাম কিন্তু কোথায়?
– সেটা বলবোনা। গেলেই বুঝতে পারবা।
– কখন যাবো? ভার্সিটি আছে তো? আপনারই ক্লাস আছে।
– ক্লাসের পরেই যাবো।
– সন্ধ‍্যা হয়ে যাবে না?
– হলে হবে। তোমার স্বামীর সাথেই বের হচ্ছো, এখন সেটা সবাই জানে। আমি তোমাকে আমার কাছে কাল চাই, এটাই শেষ কথা।

শৈলী নিশ্চুপ হাসে। নিজের প্রেমিক পুরুষের এই অধিকার খাটানো টা ওর মনকে উষ্ণতায় ভরে দেয়। এতো ভালোবাসার আবদার না মানার মতন সাহস শৈলী নিজেকে কখনোই দিতে চায় না। রাজি হয়ে যায় ও। মিহরান এরপর টুকটাক কিছু গল্প করে ওকে ঘুমিয়ে যেতে বলে। কিন্তু শৈলীর মন জানে আজ রাতের জন‍্য চোখ থেকে ওর ঘুম পালিয়েছে। এমনিতেই আগে এক্সাইটেড ছিল এখন সেটা কয়েকগুণ বেড়ে গেল কালকের বিকেলের অপেক্ষায়। কখন যাবে পুরোটা দিন? কখন কাল বিকেল হবে?
……………

রাতে বাবুল সাহেব শুতে আসলে আফিয়াকে দেখেন নামাজের পাটিতে বসে জিকির করতে। স্বামীকে দেখে আফিয়া নিঃশব্দে চোখ তোলেন তবে জিকির থামান না। বাবুল সাহেব ওয়াশরুমে যেয়ে ফ্রেশ হন। নামাজ তিনি মসজিদে যেয়ে আগেই পরে আসছেন। ফ্রেশ হয়ে রুমে এসে দেখেন আফিয়া উঠেছে জায়নামাজ থেকে,
– আফিয়া?

আফিয়া চোখ তুলেন। বাবুল খাটে বসে নিজের পাশের জায়গায় হাত রাখেন,
– এখানে এসে বসোতো।

আফিয়া স্বামীর দিকে একবার ভালো করে চেয়ে চুপচাপ যেয়ে দেখানো জায়গায় বসেন। উনি বসতেই বাবুল সাহেব পাশ ফেরেন,
– তোমার কি হয়েছে আমাকে খুলে বলতো? কি নিয়ে এতো চিন্তা করছো?

আফিয়া জানতেন এই প্রশ্নের সম্মুখীন তাকে হতেই হবে। পৃথিবীর কারো কাছ থেকে লুকাতে পারলেও এই একটা মানুষের কাছে তিনি অসহায়। এই ব‍্যক্তি তার ভেতরের অনুভূতি ধরে ফেলবেই।
– কি হলো আফিয়া? বলো? মিহরান শৈলীর বিয়েটা নিয়ে কি তুমি নারাজ? কোনো সমস‍্যা বোধ করছো?

আফিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলেন,
– না সমস‍্যা বোধ করছি না। প্রথমে খুব শক্ড হলেও সব শোনার পর আমি বুঝতে পেরেছি বিষয়টা।
– তাহলে?

এবার আফিয়া সরাসরি তাকান নিজের স্বামীর দিকে,
– আমি না আসলে বুঝতে পারছি না আমি কি করবো বুঝছো? এরকম ঘটনা আগে কখনো শুনিওনি দেখিওনি। সেখানে নিজের সন্তানের সাথেই এরকম হলো…. এটাকে স্বাভাবিক ভাবে মেনে নিতে আমার একটু কষ্ট হচ্ছে। শৈলী খুবই ভালো একটা মেয়ে। ওর সাথে মিহরানের প্রেম পছন্দ থাকতো, বিশ্বাস করো আমি নিজে সামনে বসে ওদের বিয়ে দিতাম। এমনকি মিহরানের জন‍্য শৈলীকে পাত্রী হিসেবে আমার মনে চিন্তাও করে রেখেছিলাম আমি। কিন্তু এখন…এইভাবে বিয়েটা…

বাবুল সাহেব স্ত্রীর হাতের ওপর নিজের হাত রাখেন।
– আমি তোমার কথা বুঝতে পারছি আফিয়া। মা হিসেবে তোমার এরকম বোধ হওয়াটা স্বাভাবিক। কিন্তু যেটা হয়ে গিয়েছে সেটাকে তো আমরা পাল্টাতে পারবো না। আমি মিহরানের কাছ থেকে কাবিন নামাটা দেখেছি। ওদের বৈধ ভাবেই বিয়ে হয়েছে। পরিস্থিতির শিকার হলেও এটা সত‍্য যে ওরা স্বামী স্ত্রী, এবং মিহরানকে দেখে আমি যেটা বুঝতে পারছি, ও এই সম্পর্কটাকে পুরোপরি মেনে নিয়েছে। শৈলীকে ও সন্মান করে, পছন্দ করে, ওর ব‍্যাপারে যত্নশীলও। শৈলীও নিশ্চয়ই একই অনুভূতি ধারণ করে নাহলে মিহরান এতোটা দৃঢ় বোধ করতো না।

বাবুল একটু থামেন। নিজের স্ত্রীকে কথা গুলো বোঝার কিছুক্ষণ সময় দিয়ে আবার কথা শুরু করেন,
– দেখো তুমি তো নিজেই চাইতে শৈলীকে এই ঘরের বউ বানাতে। তোমার ইচ্ছাটাই তো পূরণ হলো, হ‍্যা হয়তোবা একটু অন‍্যভাবে হয়েছে তবে পূরণ তো হয়েছে।
এতোটা ভেবো না আফিয়া। ওরা দুজন প্রাপ্তবয়স্ক, বাবা মা হিসেবে আমাদের এখন মূল কাজ ওদের সমর্থন করা, সাপোর্ট করা। ওদের সদ‍্য গড়া নড়বড়ে বন্ধনটাকে মজবুত করে দেওয়া। আমি কি ভুল কিছু বললাম?

আফিয়ার ঠোটে এবার হাসি ভাঙে। প্রাণবন্ত চোখে তিনি তাকান।
– আপনি ঠিক বলেছেন। আসলে প্রথমে এতো কিছু নিয়ে আউলিয়ে গিয়েছিলাম যে ঠিক ভাবে চিন্তা করতে পারিনি।
বাবুল সাহেব স্ত্রীর কথায় তুষ্ট হন।
-আমি কাল সবাইকে ডেকেছি। একসাথে মিলে আলোচনা করে আমরা একটা ডেট বের করি কি বলো? বিয়ে তো হয়েই গেছে যেহেতু, তাই বৌমাকে তুলে আনতে আর দেরী করবো কেন?
– হ‍্যা ঠিক বলেছেন। কালকেই সবার সাথে কথা বলে আজাদ ভাইকে জানিয়ে দিন। আমাদেরও শপিং এর অনেক কাজ আছে। শৈলীর জন‍্য গয়নাও তো বানাতে হবে।

বাবুল জোড়ে হেসে ফেললেন।
– তুমি পারোও আফিয়া। এই চেহারা দেখে কে বলবে যে কিছুক্ষণ আগে এখানে অমাবস‍্যার চাঁদ দেখা দিয়েছিল? হাহাহা। এখন চলো ঘুমাই। টেনশন নিও না, আস্তে আস্তে সব হয়ে যাবে।

আফিয়া মুচকি হেসে খাট থেকে উঠে রুমের পর্দা টেনে লাইট নিভিয়ে দিলেন।
……………

সকালে শৈলী ঘুম থেকে উঠে রুম থেকে বের হয়ে অবাক হলো। নিপুনকে চা বানাতে দেখে ও কাছে গেল।
-কি রে নিপুন? তুই চা বানাচ্ছিস যে? আম্মু কই?

নিপুন মলিন মুখে তাকায়,
-আম্মুর নাকি একটু শরীর খারাপ। বাবা বললো।
শৈলী শুনেই দৌড় দিলো মায়ের রুমে। রেহানা কে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে টেনশনে পরে গেল। মা তো এইসময় কখনো ঘুমান না। তাহলে? বাবাকে তৈরী হতে দেখে ডাকলো ও,
– বাবা।

আজাদ সাহেব ঘুরে তাকান। শৈলীকে দেখে সামনে আসেন। শৈলী স্বর নামিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
– আম্মুর কি হয়েছে?

আজাদ মুচকি হাসেন,
-কিছু হয়নি রে মা। গতকাল অনেক রাত পর্যন্ত জেগে তাহাজ্জুদের নামাজ পরে কেঁদেছে। তোকে নিয়ে আসলে কালকে অনেক বেশী ভয় পেয়ে গিয়েছিল ও। ফজরের নামাজের পর জোর করে আমি ওকে বিছানায় শুইয়েছি। তারপরও কি ঘুমায়? চোখ লেগেছে মনে হয় ঘন্টা খানেক আগে। তাই নিপুন কে বলেছি মা কে ডিস্টার্ব না করতে।

শৈলী মিইয়ে যায়। ইশ! মা কতো টেনশন করছেন ওকে নিয়ে।
-বাবা আজ আমি ভার্সিটি যাব না। মায়ের সাথে থাকি।
-কোনো দরকার নেই আপি, তুমি যাও। আমি আছি আম্মুর সাথে।

পেছন থেক নিপুনের আওয়াজ শুনে শৈলী তাকায়। বাবার চা ওনার হাতে দিয়ে নিপুন বলে,
– আজ আমার কলেজে মাত্র একটা ক্লাস। কোচিং এর স‍্যারও কি একটা কাজে আজ অফ দিয়েছেন। আমি তাই পুরো সময়টা বাসাতেই আছি। তুমি চিন্তা করো না। আর আম্মুর তো তেমন কিছু হয়নি। ভালো একটা ঘুম দিলেই ঠিক হয়ে যাবেন।

আজাদ সাহেবও ছোট মেয়ের কথায় সম্মতি দিলেন। শৈলী মলিন মুখে মাথা নাড়া দেয়। আজাদ সাহেব চা নিয়ে ভেতরে যেতেই নিপুন বোনের কানের কাছে ঠোট নিয়ে আসে,
– আপু, আজকে তো কোনভাবেই ক্লাস মিস করা যাবেই না তোমার। দুলাভাইয়ের সাথে ডেইট আছে ভুলে গেছ?

শৈলী তড়াক করে ফিরে তাকায়। বোনের দুষ্টামি ভরা মুখ দেখে ভীষণ লজ্জা পায়। পাকনিটা তাহলে রাতে সব শুনে ফেলেছে। ইশ! কি লজ্জা!

তবে লজ্জার বহর যে সবে শুরু সেটা শৈলী তখনো বুঝেনি। রেডি হয়ে বাসা থেকে বের হতেই মাহিরা মেহরাবের আক্রমনে রীতিমতো হকচকিয়ে উঠলো ও। মেহরাব ওকে ভাবি ভাবি বলে বলে যারপর নাই লজ্জায় লাল করে ফেললো। আর মাহিরাও আজ ওর জমজকে থামালো না, শৈলীকে এই লাজ থেকে বাঁচালো না। বরং মেহরাবের সাথে যুক্ত হয়ে ওকে আরও লাজে ডুবিয়ে ছাড়লো।

এমনকি নিচে মিহরান গাড়ি নিয়ে আসার পর, প্রতিদিনের মতন শৈলী পেছনে বসতে গেলে মেহরাব থামিয়ে দিল ওকে,
– সরি ভাবি, আপনার সিট আপনার স্বামীর পাশে। দয়া করে নিজের সিটে যেয়ে বসুন।

শৈলী মেহরাবকে কপট রাগ দেখিয়ে কাধে চাপড় মারে। শেষে ধীর পায়ে যেয়ে মিহরানের পাশের সিট টায় বসে মাথা নোয়ায়।

মিহরান সবই দেখে, সবই বোঝে তবে পেছনে ছোট ভাই বোন দেখে কিছুই বলে না। শুধু ঠোটে হালকা হাসি নিয়ে গাড়ি স্টার্ট দেয়।

ভার্সিটির পার্কিং লটে এসে গাড়ি পার্ক করতেই মিহরান চট্ করে শৈলীর ডান হাত ধরে ফেলে। এতে করে মাহিরা মেহরাবের সাথে শৈলী নামতে পারে না। মিহরান ভাইবোনদের নামার অপেক্ষা করে। পেছনের দরজা বন্ধ হয়ে গাড়ি খালি হতেই মিহরান কাছে আসে শৈলীর,
– আমার ক্লাস শেষে এখানেই ওয়েট করবো তোমার জন‍্য।

কথাটা যত দ্রুত বলেছে ঠিক তত দ্রুতই শৈলীর গালে একটা চুমু বসিয়ে সরে এসেছে মিহরান। শৈলী চোখ গোল করে সামনে তাকানো। কি হলো তা বোঝার আগেই মিহরান ওর হাত ছেড়ে গম্ভীর কন্ঠে বলে,
– নামো, মাহিরা মেহরাব ওয়েট করছে তোমার জন‍্য।
শুকনো ঢোক গিলে, রোবটের ন‍্যায় শৈলী নামলো গাড়ি থেকে। এই লোক একদিন ওকে হার্ট এ‍্যাটাক করিয়ে ছাড়বে ফর শিওর।
………………….

বিকেলে ক্লাসের পরে শৈলী আসে পার্কিং লটে। এসে মিহরানকে খোজে আশপাশে কিন্তু পায় না। তখনই ফোন আসে নিপুনের। শৈলী ফোন ধরে,
– হ‍্যালো আপি, ফোন দিয়েছিলা?
– হ‍্যা, আম্মুর কি অবস্থা রে?
– তুমি এই নিয়ে চারবার খোজ নিয়েছো আপু। বললাম তো আম্মু ভালো আছেন। এখনো মনমরা হয়ে আছেন। চুপচাপ আছেন তবে শরীর ভালো।
– আমি কি চলে আসবো? কি বলিস তুই?
-খবরদার আপি। তুমি ভাইয়ার সাথে যাবা অবশ‍্যই। আম্মুর তো কিছুই হয়নি আর আমি তো আছিই। কোনো সমস‍্যা হলে আমি ফোন দিব কিন্তু তার আগে তুমি আর টেনশন করবা না। ইনজয় ইয়র টাইম।

শৈলী তখনই মিহরানকে আসতে দেখে, নিপুনের ফোনটা রাখলো। ওর মুখের মলিনতা ধরতে মিহরানের একটুও সময় লাগলো না। সাথেসাথেই কাছে এসে পরলো,
– কি হয়েছে শৈলী? সব ঠিক আছে তো?
শৈলী হাসতে চেষ্টা করে,
– কিছু না। আসলে আম্মু কে নিয়ে একটু টেনশন করছিলাম।
– কেন? কি হয়েছে মায়ের?

শৈলী থমকে তাকায় মিহরানের দিকে। ও কি আসলেই ‘মা’ শব্দটা উচ্চারণ করলো?

– মমম…আম্মুর কিছু হয়নি। রাতে আমাকে নিয়ে টেনশন করেছিল তাই ভালো ঘুম হয়নি ওনার। এই কারণে…
– বাসায় যেতে চাও। আজ তাহলে বাদ দিব?
– না না চলুন। নিপুন আছে আম্মুর কাছে। একটু তাড়াতাড়ি ফিরলেই হবে।
মিহরান হাসি টেনে শৈলীকে গাড়িতে বসতে বলে নিজে চলে গেল ড্রাইভিং সিটের কাছে। তারপর দ্রুতই বের হয়ে যায় ওকে নিয়ে ক‍্যাম্পাস থেকে।
……………..

সন্ধ‍্যা সাড়ে সাতটায় মিহরান গাড়ি এনে লিফ্টের সামনে থামে। খুব সুন্দর একটা সন্ধ‍্যা কাটিয়েছে দুজন। শেফ’স টেবিল কোর্টসাইডে গিয়েছিল দুজন। জম্পেস খাবার খেয়ে, মনে ভরে গল্প করেছে সূর্যাস্তের মাঝে। শৈলীর গাল গুলো গরমে যে ফেটে পরেনি এই রক্ষে। কারন মিহরান একটুও সুযোগ দেয়নি ওকে স্বাভাবিক থাকার। শৈলী শেষ পর্যন্ত বুঝতে পেরেছে, ওকে এসব মেনেই নিতে হবে। ওর স্বামী যে ভালোবাসা অত‍্যাচারী!

নামার সময় শৈলী একবার তাকায় মিহরানের দিকে। মিহরান অবাক চোখে বলে,
-কি ম‍্যাডাম? কি দেখেন এতো আমাকে?
– একটা কথা বলি?
-হমম।
-কানে কানে বলবো, জোড়ে বলা যাবে না। কাছে আসুন।

মিহরান ভ্রু জোড়া হালকা কুচকে কাছে আসে। সীমানার ভেতর আসতেই শৈলী হেসে ওঠে। তারপর টুপ করে মিহরানের গালে একটা চুমু বসায়। ঠিক যেভাবে সকালে মিহরান দিয়েছিল।

চুমুটা দিয়েই সরে আসে শৈলী। এতোটা সাহস কেমনে জোগালো ও নিজেই জানে না। তাই এখানে আর থাকা যাবে না বুঝে দরজা খুলতে তৎপর হলো, কিন্তু তার আগেই ওকে নিজের কাছে টেনে নিল মিহরান। শৈলী হকচকিয়ে তাকায়। ও ভেবেছিল মিহরানও হয়তো ওর মতন অবাক হয়ে যাবে এবং এর মধ‍্যেই ও হবে পগার পার। কিন্তু এটাতো মিহরান, শৈলী না। মিহরান শৈলীর কোমর জড়িয়ে কাছে টেনে নেয় ওকে,
– পালাতে চাচ্ছিলা? টু লেইট।

বলেই আর সময় নেয় না। শৈলীর ওষ্টে নিজের ভালোবাসা ছড়াতে ব‍্যস্ত হয়ে পরে।
…………………..

মিহরানের নিপিড়ন থেকে বাঁচতে সময় লাগে শৈলীর। তবে ওকে ছেড়ে দিতেই আর দাড়ায় না। দরজা খুলে দৌড়ে পালায় শৈলী। লিফ্ট ডেকে একেবার ভেতরে ঢুকে দম নেয়।
নিজের মাঝেই হাসতে থাকা শৈলী বাসায় ঢুকে ওয়াশরুমেও যেতে পারে না হঠাৎ ওর মাকে রুমে দেখে অবাক হয়ে যায়। আরও অবাক হয় ওনার ফ‍্যাকাশে চেহারার ভাড়াক্রান্ত অভিব‍্যক্তি লক্ষ‍্য করে।

রেহানা শৈলীর রুমের দরজা বন্ধ করে ওকে টেনে নিয়ে বিছানায় বসান। শৈলী কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই উনি প্রশ্ন ছোড়েন,
-কোথায় ছিলি এতোক্ষণ?

শৈলী লুকায় না। মাথা নিচু করে বলে,
– ওনার…সাথে।

রেহানার মন ধ্বক করে ওঠে,
– শৈলী, তোকে এখন আমি যা জিজ্ঞেস করবো সব সত‍্য জবাব দিবি।

শৈলী কপাল কুচকে তাকায়। রেহানা কঠোর মুখে প্রশ্ন করেন,
– তোর আর মিহরানের মাঝে…স্বামি স্ত্রীর সম্পর্ক ঘটেছে?

শৈলী হতভম্ব এই প্রশ্নে। রেহানা ভাবেন মেয়ে মনে হয় তার প্রশ্ন বোঝে নি,
– আমি বলতে চাচ্ছি…তোদের মাঝে…শারিরিক সম্পর্ক হয়েছে?

শৈলী নিজের কানকে বিশ্বাস করে না। মা এইসব কি হঠাৎ জিজ্ঞেস করছে?
– আম্মু তুমি এগুলা কেন জিজ্ঞেস করছো?
– আমার প্রশ্নের উত্তর দে। হয়েছে কি হয়নি?
– ননা…হয়নি।

রেহানা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। এরপর ঝড়ের বেগে রুম থেকে বের হয়ে যান তিনি। শৈলী ধরফরিয়ে পেছনে দৌড়ায়। কি হলো বুঝে ওঠার আগেই ও ডাইনিং রুমে দাড়ানো ওর বাবার কাছে বলা মায়ের একটি বাক‍্য শুনে থমকে যায়,

– শৈলীর আব্বু, আমি মিহরান আর শৈলীর বিয়ে মানি না। এই বিয়ে ভেঙে দাও।

চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here