পরিণয়_প্রহেলিকা #লেখিকা_সিনথীয়া #পর্ব_৪৬

0
992

#পরিণয়_প্রহেলিকা
#লেখিকা_সিনথীয়া
#পর্ব_৪৬

সকালে মাহিরা রেডি হয়ে মেহরাবের রুমের দরজায় জোড়ে একটা থাবড় দিয়ে ডাইনিং এ চলে আসে। মেঝ ভাই ছাড়া বাকি বড়দের টেবিলে দেখতে পায়। একটা টোস্ট হাতে নিয়ে বসতে বসতে মাকে প্রশ্ন করে,
– আম্মু মেঝ ভাইয়া কোথায়? যাবে না ভার্সিটি?

আফিয়া কাজ করতে করতেই মুখ খোলেন,
– সকালে ফোন দিয়ে বললো, একটু শরীর খারাপ লাগছে। আরেকটু ঘুমাবে। নাস্তা নাও করতে পারে। তবে ভার্সিটি যাবে, তাই তোরা দেরী করিস না।

মাহিরা কাঁধ উচিয়ে সম্মতি জানায়। এরপর মেহরাব আসলে নাস্তা সেরে বের হয় বাসা থেকে। লিফ্টের দরজায় গিয়ে শৈলীদের বাসায় নক্ করবে ভেবেও করে না। এখনো আন্টিকে নিয়ে বিষয়গুলো সেন্সিটিভ আছে। তাই এই মুহুর্তে মিহরানদের পরিবারের কেউ বাসায় না গেলেই ভালো। এই ভেবে মাহিরা শৈলীকে কল্ দিলো। অপর পাশ থেকে তিনবার রিং হওয়ার পর রিসিভ হলো,
– হ‍্যা শৈ..
– মাহি আপু, আমি নিপুন।
-ও নিপুন? শৈলী কৈ রে? যাবে না ভার্সিটি?
– আপু, আপি পরে পরে ঘুমাচ্ছে। বলসে পরে যাবে ভার্সিটি।

মাহিরা বেশ অবাক হয় মনে মনে। আজ এই জামাই বউ য়ের আবার কি হলো? দুইটারই এতো ঘুম পায় কেন? ওপরে ভাইয়া দেরীতে উঠলো, নিচে এই ম‍্যাডাম পরে পরে ঘুমাচ্ছেন?

শৈলীকে আর না ঘেটে মাহিরা নিপুনের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে লিফ্টে উঠে পরলো। নিচে নেমে মিহরানকে দেখতে পেল গাড়ির সামনে। অফিসের জন‍্য পুরো ফিটফাট হয়ে তৈরী হলেও ওর ঘুমন্ত চোখ দুটো মনে হয় আড়াল করা সম্ভব হয়নি। হাল্কা পাতলা হাই ও তুলছে। ছোট ভাই বোনকে দেখে নড়েচড়ে দাড়ায়। তবে পরক্ষণেই ভ্রু কুচকায়। মাহিরা কাছে আসতেই ওর পেছন‍ে লিফ্টের দিকে তাকায় মিহরান। ভাইয়ের চোখ কাকে খুজছে তা বুঝতে মাহিরার অসুবিধা হয় না। ও ঠোট টিপে হেসে দেয়।

একসময় মিহরান আর না পেরে বলেই ফেলে,
– ও আসবে না?

মাহিরা চোখেমুখে দুষ্টুমি খেলে,
– কে ভাইয়া? কার কথা বলছো?

মিহরান সরু চোখে বোনের দিকে তাকায়,
– বুঝছিস না? তোর বান্ধবীর কথা বলছি। ও কোথায়?

এবার মাহিরা হেসে ফেলে,
-তোমার বউ এখনো ঘুমাচ্ছে। শরীর খারাপ মনে হয়। পরে আসবে ও।

মিহরানের উত্তরটা শুনে চেহারায় রহস‍্যময়ী বাঁকা হাসি ওঠে।
– থাক্। ওকে ডিস্টার্ব করার দরকার নেই। রেস্ট নিক। তোরা গাড়িতে ওঠ।

মাহিরা, ভাইয়ের এই হঠাৎ কনসার্নের কারণ কিছুই বুঝলো না। স্বামী নিজের স্ত্রীকে নিয়ে চিন্তিত হওয়া স্বাভাবিক ভেবেই আর মাথা ঘামালো না।
…………………
শৈলীর ঘুম ভাঙতে ভাঙতে সকাল সাড়ে দশটা। ক্লান্ত চোখ দুটো অনেক কষ্টে খোলে ও। সাদা পর্দার পানেই দৃষ্টি যায় প্রথম। প্রোজেক্টারের ছবির মতন সাথেসাথেই রাতের দৃশ‍্যগুলো ভেষে ওঠে অক্ষিপটে। হোচট খেয়ে ঘুম পালায় চোখ থেকে। এক একটা মুহূর্ত মনে পরতেই শৈলীর পুরো শরীর পরতে পরতে কেঁপে ওঠে। কাঁপতে থাকা দু হাত চোখের সামনে টানে ও। এই হাত দুটোই কাল ওর কোন কথা মানেনি। স্বার্থপরের মত শুধু স্বামীর ভালোবাসায় লিপ্ত থেকেছে। এক টুকুন ছাড় দেয়নি মিহরানের থেকে আদর কুড়ানোর বেলায়। আর মিহরান? উনিও কি খুব সামলেছিলেন নিজেকে? একদমই না। বরং শৈলীকে আরও লোভ দেখিয়েছেন ভালোবাসার। এতো গম্ভীর স্থীর একজন মানুষও যে নিজের একেবারেই একান্ত মুহূর্তে এতোটা অস্থির হয়ে যেতে পারে তা গত রাতের সেই প্রেমময় ক্ষণে মিহরানকে দেখলে বোঝা যেত। শৈলী তা অনুভব করেছে। গভীর ভাবে অনুভব করেছে।

বাতাসে পর্দা নড়ে ওঠাতে শৈলী বাস্তবে ফেরে। খাটে উঠে বসতে গিয়ে আপনাতেই হাত পেটে চলে যায়। বসার সময় টান পরাতে বোঝে ব‍্যাথা এখনো আছে, তবে সেটা সামান‍্য। শৈলীর লজ্জায় মুখ রেঙ্গে ওঠে। ওদের মুহূর্তের ইতিক্ষণে শৈলীর বেশ শরীর খারাপ হয়েছিল। মানসিক চাপে তো আগেই নিমজ্জিত ছিল ও। তার সাথে বিনা কোনো প্রস্তুতিতে এতো বড়ো পদক্ষেপ ওর মনকে পাখির ডানায় মেলে উড়ালেও ওর শরীরের জন‍্য ভারটা নেওয়া কষ্টকর হয়েছিলো। সেই ক্লান্তিক্ষণেও স্বামীকে ওকে নিয়ে চিন্তিত হতে দেখেছিল ও। মিহরান প্রায় জ্ঞান হারানো শৈলীকে নিজের বুকের মাঝে আগলে রেখেছিল। বেডসাইড টেবিলের ড্রয়ার থেকে মেডিসিনের বাক্স বের করে প্রথমেই একটা ব‍্যাথার ও গ‍্যাসের ঔষধ খাইয়ে দিয়েছিল। এরপর ওকে শুইয়ে দিয়ে নিজেই পাশে হেলান দিয়ে শুয়ে ওর মাথায় ক্রমাগত বিলি কেটেছিল। শৈলী এরপর কখন ঘুমিয়ে পরেছিল সেটা খেয়াল করেনি। সেই ঘুম ভেঙেছিল ওর ফজরের আজানের সময়। কোথায় আছে বুঝতে একটু সময় লাগলেও তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলেছিল ও। মিহরান তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। শৈলী একদিক দিয়ে খুশিই হয়েছিল। মিহরানের চোখে তাকানোর মতন অবস্থা আর নেই, ওর লজ্জা দিয়েই মৃত‍্যু হতো। কোনোমতে নিজেকে গুছিয়ে রুম থেকে নিঃশব্দে বেরিয়ে এসেছিল ও। নিপুন আগেই ম‍্যাসেজ করে রেখেছিল যে দরজা খোলা থাকবে ভেতর থেকে, তাই নিজেদের বাসায় ঢুকতে ও সমস‍্যা হয়নি। পা টিপে টিপে ঢুকে এক নিঃশ্বাসে নিজের রুমে পৌছেছিল ও। গোসল করে ফ্রেশ হয়ে নামাজ পড়ে তারপর ঘুমাতে গিয়েছিল।
শৈলী এখন খাট ছাড়ে। মাহিরারা নিশ্চয়ই আগেই ভার্সিটি চলে গিয়েছে? এক দিক দিয়ে এটাও ভালো। মিহরানের সামনে যেতে হবে না। তবে আজ ওনার ক্লাস আছে, তখন তো সামনে পরতেই হবে। আচ্ছা তখনের টা তখন দেখবে। এখন তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে বের হওয়া উচিত। প্রথম ক্লাস তো মিস গেলই, দ্বিতীয়টাও ধরতে পারবে না।
………………
রেহানা গতকালের পর ভীষণ অসুস্থ হয়ে পরেছেন। খাট থেকে ওঠা দায় হয়েছে তার। প্রেশার বাড়লো কি না আবার কে জানে? সকালে আকলিমা কাজে এসেছিল। ম‍্যাডামের এই অবস্থা দেখে গিয়েছে। রাস্তায় দেখা আলেয়ার সাথে। ওর কাছ থেকেই আলেয়া রেহানার খবর জানতে পারে। বাসায় এসে আফিয়াকে বিষয়টা জানাতেই আফিয়া ভীষণ বিচলিত হয়ে পরেন। সব কাজ ফেলে দৌড়ান পাশের বাড়ি। দরজা ভেড়ানোই ছিল, ঢুকেই ডাক লাগান,
– ভাবি? এই ভাবি? কই আপনি?

বেডরুমে শোয়া রেহানা ডাক শুনে তৎপর হয়ে ওঠেন। ধরফরিয়ে বেডে বসার চেষ্টা করেন। ততক্ষণে আফিয়া রুম পর্যন্ত চলে এসেছেন। রেহানাকে এভাবে উঠতে দেখে তিনি জোরে পায়ে ভেতরে ঢোকেন,
– আরে ভাবি, করছেন কি? এই ভাবে উঠছেন কেন?
– ভভাবি? আপনি?

আফিয়া ততক্ষণে রেহানার পাশে এসে ওনার কাধে হাত রেখে বসেছেন।
-আপনার শরীর এতো খারাপ, তার ওপর বাসায় কেউ নেই। আমাদেরকে একটু জানাবেন না? এটা একটা কাজ করেছেন?

রেহানা মাথা নিচু করে চুপ মেরে থাকেন। চোখের জলে গাল ভিজেছে আগেই, এখন মুখ নিচু করায় গড়িয়ে পরে কোলে। আফিয়া তা দেখে ভীষণ বিচলিত হয়ে পরেন।
-রেহানা ভাবি? আপনি কাঁদছেন কেন? কি হয়েছে আপনার?

রেহানা এবার আর থামান না নিজেকে। অঝর ধারায় পরতে থাকা চোখের পানি নিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন,
– ভাবি, আমার শৈলী একদম খারাপ মেয়ে না। ওর মতন লক্ষী মেয়ে পৃথিবীতে খুব কম হয় ভাবি, বিশ্বাস করেন? ও কোনো ভাবেও আপনার ছেলেকে কোনো জালে ফেলে বিয়ে করেনি। আমি জানি এটা ও কখনো করতে পারে না। নিজের শিক্ষার ওপর এইটুকু বিশ্বাস থাকবে না আমার? আমার মেয়েকে আমি ওভাবে কখনোই বড় করিনি। ও খারাপ মেয়ে না…..
বলতে বলতে কান্নার দমকে রীতিমতো হেচকি উঠে রেহানার। ওনার মুখ ফ‍্যাকাশে হয়ে যেতে দেখে আফিয়া আঁতকে ওঠেন। তাড়াতাড়ি ওনাকে শুইয়ে দিয়ে নিজের ফোন তোলেন হাতে। আজাদ সাহেবের নাম্বার আগেই ছিল। বুদ্ধি করে ফোন দেন তখনই। দুই রিঙেই আজাদ সাহেব ফোন ধরেন,
– আস্সালামুআলাইকুম আপা। কে….
– ভাই, আপনি জলদি বাসায় আসেন। ভাবি যেন কেমন করছে। বাসায় আসেন জলদি।
…………………
শৈলী ক‍্যাম্পাসে পৌছতে পৌছতে দ্বিতীয় ক্লাস টাও মিস করে ফেলে। বান্ধবীরা ক্লাসেই আছে যেনে ওদেরকে আর ডিস্টার্ব করে না। মাহিরা, মেহরাবও ক্লাসেই হবে। থাক্ এখন কাউকেই ফোন না দিক্। বরং একা কিছুক্ষণ নিজের সাথে সময় কাটানো যাক্। এই ভাবনা নিয়েই নির্জন করিডোর দিয়ে হাটতে থাকে শৈলী। পিকনিক থেকে আসার পর রিক নামক ব‍্যক্তিটির আর দেখা পায় নি ও। ওর চেলাদের দেখলেও ওরা শৈলীর সামনে আসে না। কি কারণে এতো পরিবর্তন তা শৈলী জানে না তবে এ নিয়ে ওর মাথা ব‍্যাথাও নেই। জাহান্নমে যাক্ রিক্। ওর কি?

হঠাৎ শৈলীর মোবাইলে ম‍্যাসেজ টোন বেজে ওঠে। মিহরানের নাম দেখে হোচট খেয়ে দাড়িয়ে যায় ও। সাথেসাথে নরমাল মুখ রক্তিম হয়। ম‍্যাসেজটা খোলে শৈলী। তাতে লেখা,
– ওপরে তাকাও।

শৈলী সাথে সাথেই উপরে তাকায়। তিন তলা থেকে সাত তলায় চোখ যায় ওর। মিহরানকে দেখতে পায় দুজন কলিগের সাথে দাড়ানো। বাকি দুজন কথা বললেও, মিহরানের দৃষ্টি ওর দিকেই টিকানো। দুজনের চোখ একে অপরের মাঝে আটকে পরে দু মুহূর্ত। হুট করেই শৈলীর সামনে গত রাতের কিছু ক্ষণ ভেসে ওঠে। ততক্ষণাত চোখ নামিয়ে ফেলে ও। বুকের ভেতরে হাতুড়ি পেটাচ্ছে যেন কেউ, এমন অনুভব হয়। আবার কেঁপে ওঠে ও ম‍্যাসেজের টোনে।
– এক্ষুনি আমার কেবিনে আসো।

শৈলীর চোখ বড় হয়ে যায়। এই লোকটা কেন ডাকছে ওকে? তাও আবার ওনার কেবিনে? ওনার সামনে আজ পরারই ইচ্ছা ছিল না যেখানে সেখানে ক‍্যাম্পাসে এসেই প্রথমে ওনার সাক্ষাত? একেই বোধহয় বলে, যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই রাত হয়।

শৈলী করুণ চোখে ওপরে তাকায়, তবে আর মিহরানকে দেখতে পায় না। তার কলিগদের রেখে সে চলে গিয়েছে।
………………..

মাহিরা আজ তুরিনের সাথে দেখা করতে গিয়েছে। বান্ধবীর পাশে বসে অনেকক্ষণ, অনেকভাবে ওকে বোঝানোর চেষ্টা করেছে,

– দেখ তুরিন। এটা নিয়তির খেলা ছাড়া আর কিছুই না। মহান আল্লাহ্ ওপর থেকেই মানুষের জুটি বানিয়ে পাঠান। মিহরান ভাইয়ার জুটি বোধহয় শৈলী, তাই তো অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে হলেও, তাদের বিয়েটা হয়েছে। নয়তো ভাইয়া আর ওর মাঝে আগে থেকে কোন সম্পর্কই কিন্তু ছিল না। তাই দোস্ত তোকে রিকুয়েস্ট করছি, এই বিষয়টা এখানেই ছেড়ে দে। ভাইয়ার জন‍্য কষ্ট পেয়ে অহেতুক নিজের শরীর খারাপ করিস না। আন্টি আঙ্কেল তোকে নিয়ে অনেক চিন্তিত। শেষে তারাও অসুস্থ হয়ে যেতে পারেন এভাবে। তুই কি তাই চাস্? বল্। তুই এইসব বাদ দে বান্ধবী। ভাইয়াকে প্লিস ভুলে যা। ইনশাআল্লাহ তোর জন‍্য আরও ভালো ছেলে আসবে, মেঝ ভাইয়ার থেকেও অনেক ভালো।

এমন আরও নানান কথা বলে মালিহা তুরিনকে। একসময় তুরিন নিজের পাথুরে অভিব‍্যক্তি থেকে বের হয়। মলিন একটা হাসি ছোড়ে বান্ধবীকে। মাহিরা স্বস্তি পায়।

– ওঠ্। তাড়াতাড়ি রেডি হ। আজ আমরা দুইজন ঘুরবো। স্ট্রিট ফুড খাবো। চল চল। আমি ওয়াশরুম থেকে আসতেসি, তুই ওঠ্ ততক্ষণে।

মালিহা উঠে চলে যেতেই, তুরিন ওর হাত আগায় মালিহার ফোনের দিকে। চোরা চোখে ওয়াশরুমের বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে, তারপর আবার নিবদ্ধ করে মোবাইলের দিকে। জিগড়ি দোস্তের ফোনের পাসওয়ার্ড আগেই মুখস্ত, তাই কাল বিলম্ব না করে ফোনটা খোলে। তারপর সোজা কনট‍্যাক্টস এ যেয়ে ‘এস’ অক্ষরে চলে আসে। কাঙ্ক্ষিত নামবারটা পেয়ে সেটা ঝটপট নিজের মোবাইলে টুকে নিল ও। তারপরবন্ধ করে আগের যায়গা রেখে দিল মালিহার মোবাইল। মনে মনে বললো,
– এইবার দেখাবো মজা।
চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here