#পরিণয়_প্রহেলিকা
#লেখিকা_সিনথীয়া
#পর্ব_৩২
নিচে নেমে আসার পরে মিহরান আর তন্ময় তাজ্জব বনে যায়। যেই পরিস্থিতিতে মেয়ে চারটাকে রেখে গিয়েছিল, তারা মোটামুটি সেখানেই, সেই লেভেলেই বিরাজমান রয়েছে। মালিহা একটা লেহেঙ্গা পছন্দ করেছে কিন্তু দামে হচ্ছে না, মাহিরার যেই লেহেঙ্গা ক্যাটালগ দেখে ভালো লেগেছে, সেই রঙটা নেই দোকানে। আরেকটা রঙ আছে কিন্তু সেটা ওর পছন্দসই না। আর তুরিনের অবস্থা সবচাইতে সোচনীয়। সে একটা কলাম থেকে যত শাড়ি আছে সব বের করে ফেলেছে, কিন্তু গায়ে দিয়ে তার কাছে মানাচ্ছে না বলে একটাও ভালো লাগছে না, সব ছুড়ে ফেলছে সে। এদের মাঝে একমাত্র শৈলী চুপচাপ বসে আছে। মাহিরাকে এতোক্ষণ ধরে যেই লেহাঙ্গাটা পাওয়া যাচ্ছে তাই নিয়ে নেওয়ার জন্য বোঝাতে গিয়ে না রাজি করাতে পেরে ও ভীষণ ক্লান্ত।
আরও প্রায় আধা ঘন্টা পর তারা সেই দোকান থেকে প্রস্থান করতে পারলো। এতটাও সময় লাগতো না যদি এখানে মিহরান ওদের ধমক দিতে পারতো। কিন্তু এখানে তা সম্ভব হয় নি কারণ বোনদের ছাড়াও বাহিরের একটা মেয়ে শপিং করছে ওদের সাথে। মালিহার বান্ধবীর শাড়ি নাড়াচাড়ার ব্যস্ততা, মিহরানকে চরম বিরক্তিতে ফেললেও ও চুপ থাকলো।
কাপড় নড়চড় করতে আর দাম কষাকষি করতে গিয়ে সবারই টায়ার্ড অবস্থা দেখে ফুড কোর্টে উঠতে চাইলো মেয়েরা। অগত্যা ছেলেদেরকেও আবার ওপরে আসতে হলো। এবার একটু খোলা জায়গায় তিনটা টেবিল এ্যাড করে বসলো ওরা। শৈলী আর মাহিরা যেই পাশ টায় বসেছে ঠিক তার উল্টো পাশে বসলো মিহরান আর তন্ময়। নিজেদের পছন্দের মানুষের মুখোমুখি বসেছে তারা। আর মালিহা আর তুরিন বসেছে একপাশে। প্রথমে মালিহা মিহরানের পাশে বসলেও গরমের অজুহাতে মালিহাকে সরিয়ে ওখানে যেয়ে তুরিন বসে। হঠাৎ ই কেন যেন এই একটা কাজ বান্ধবীর পছন্দ হয় না মালিহার। তুরিনের এভাবে নিজে থেকে মিহরানের কাছ ঘেষাটা ওর চোখে লাগছে। এটা কেউ শুনলে ওকেই খারাপ মনে করবে, বলবে বান্ধবী হয়েও খারাপ ভাবছে, কিন্তু মালিহা জানে এখানে আসল সমস্যাটা কোথায়।
মিহরান নামক মালিহার মেঝ ভাইয়া এমন এক দেয়াল যেটা নিজে থেকে দরজা তৈরী না করলে জোর করে টপকানো মোটামুটি অসম্ভব। মালিহা খেয়াল করেছে, এই কয়েকবারের সাক্ষাতে, মিহরান তুরিনের প্রতি পছন্দ তো অনেক দূর, ও একবার মুখ তুলে তুরিনকে দেখেছেও কি না সন্দেহ আছে। ক্লিয়ারলি বোঝা যাচ্ছে, তুরিনের প্রতি ওর ভাইয়ের বিন্দু মাত্র ইন্টারেস্ট নেই। কিন্তু এই কথাটা মেয়েটাকে বোঝাবে কে? মালিহার সাহস হচ্ছে না বলতে। তুরিনের ইমোশনটা নিজের চোখে উপলব্দি করেছে ও। আসলেই পছন্দ করে ও মিহরানকে। কিন্তু এক তরফা ভালোবাসা কতদূর আর আগায়?
মালিহা নিজের মনেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তুরিনের একপাশ থেকে মিহরানকে ব্যাকগ্রাউন্ডে নিয়ে সেল্ফি তোলা দেখে মুখ ঘুরায়। হায় রে! মেয়েটার মন ভাঙার দিন এলো বলে।
এদিকে মাহিরা আর তন্ময়ের মাঝে ম্যাসেজিং এর মাধ্যমে অনেক কথা হচ্ছে যেটা আশপাশে কেউ বুঝতে পারছে না। নিজের কেনা লেহেঙ্গাটা আগেই তন্ময়কে পাঠিয়েছিল ও। বেশ পছন্দ হয়েছে তন্ময়ের। সাথে মাহিরাকে লজ্জার সাগরে ডোবানোর মতন কিছু কম্প্লিমেন্টসও ছুড়েছে ও। মেয়ে আর যায় কই? মুখটাই তুলতে পারছে না এখন।
তন্ময় এইমুহূর্তে দুটো জায়গায় ম্যাসেজ আদান প্রদানে ব্যস্ত। মাহিরার সাথে কথা লিখতে লিখতেই ওর বন্ধুদের গ্রুপ চ্যাটেও তৎপর। ইতিমধ্যেই গ্রুপ চ্যাটে টর্নেডো হিট করে ফেলেছে। তন্ময় সবাইকে মিহরানের বিয়ের সুখবর জানিয়ে দেওয়াতেই এই তান্ডবের আগমণ। পর পর এতো এতো ম্যাসেজ আশাতে মিহরান যারপর নাই বিরক্ত। তন্ময়ের দিকে দাঁত চিবিয়ে তাকিয়ে শেষ মেষ মোবাইল ডেটাই অফ করে দিল ও।
নানান কান্ড ঘটার মধ্য দিয়েই খাবার খাওয়া শেষ হলো ওদের। নিচে নামার সময় লিফ্ট নিল ওরা। ক্যাপসুল লিফ্টে উঠেই শৈলী চলে গেল একদম পেছনে। ওর মলের ভেতরের ৩৬০° ভিউটা বেশ পছন্দ। মাহিরা শৈলীর পাশে দাড়াতে যাওয়ার আগেই পেছন থেকে তন্ময় ওর হাত ধরে টেনে নেয় নিজের কাছে। পেছন থেকে হাত ধরায় অন্য কেউ দেখে না এবং মাহিরা মনে করে তন্ময় নিজের কাছে রাখার জন্য ওকে থামিয়েছে। এই সুযোগে শৈলীর পাশে যেয়ে দাড়ায় মিহরান। ততক্ষণাৎ ভিড়ের মাঝে ওর হাত খুজে গলিয়ে দেয় তা নিজের আঙ্গুলের ভাজে। শৈলী ছলকে মুখ ফেরায়। প্রথমে নিচে জোড়া লাগানো দুই হাতের দিকে চোখ যায়, তারপর উপরে তাকায়। মিহরানের গভীর চোখে মুহূর্তেই আটকা পরে। দেখে পুরু ঠোটের ছোট্ট তৃপ্ত হাসি। লাজে শৈলীর আক্ষি যুগল নিচে নেমে আসে, তবে হাতের বাধন আরও একটু দৃঢ় হয়।
মিহরান সামনে তাকায়, ঠোট ফাঁক না হলেও চোখে খেলে যায় তুষ্ট সুখের ছোয়া। শৈলী নিজের থেকে বাধন মজবুত করার মাধ্যমে বুঝিয়ে দিচ্ছে, আছে ও, মিহরানের পাশেই আছে।
গ্রাউন্ড ফ্লোরে লিফ্ট নামার পরও মিহরান শৈলীর হাত ছাড়লো না। একে একে সবাইকে আগে নামতে দিল তারপর আস্তে করে শিথিল করলো বন্ধন। শৈলীও সময় নিয়েই নিজের হাত সরায়, আজ যেন ওর ভয় লাগে না ধরা পরার। ভয় কিসের? স্বামীর হাতই তো ধরেছিল।
নিচে নেমে মিহরান সবাইকে একটু থাকতে বলে কোথায় যেন যায়। এই সুযোগে নিচ তলার কসমেটিক্সের দোকান গুলোতে একটা ঢু মারার সিদ্ধান্ত নেয় মেয়েরা। তন্ময় বেচারা এতোগুলো নারী সঙ্গে ফেঁসে যায়। কি আর করা, বন্ধুর বউ, নিজের প্রেয়শী, প্রেয়শীর বড় বোন, বোনের আবার বন্ধবী, সবাইকে দেখে রাখার দায়িত্ব যে এখন তার। সেটাই পূরণ করুক।
বিশ মিনিটের মাথায় মিহরানের কল্ আসে তন্ময়ের কাছে, সবাইকে এক্সিটের কাছে আসতে বলে। ও গাড়ির কাছে যাচ্ছে। তার কিছুক্ষণ পরেই মিহরানের গাড়িতে জায়গা হয় চারজনের। তুরিনের বাসা এদিকেই তাই ও এখান থেকেই বিদায় নিচ্ছে। যাওয়ার সময় মেয়েটার ভয়ংকর রকম মন খারাপ হতে দেখেছে মালিহা, ওরও তাই খারাপ লাগছে এখন।
তন্ময় কে ওর বাসার কাছাকাছি নামিয়ে আবার এলিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়ে ধরে বাসার পথে রওনা হলো ওরা। নিজেদের জিনিস কিনে মাহিরা, মালিহা ভীষণ রকম খুশি, সেগুলো নিয়েই আলোচনা জমলো গাড়ির ভেতর। বাসায় নেমেও যেন সেই গল্প শেষ হওয়ার নয়। শৈলীও ওদের আড্ডাতেই শামিল ছিল যখন মিহরানের থেকে আবার ম্যাসেজ আসায়, ওর মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটে। লিফ্টে উঠতে উঠতেই ও থেমে গেল। মাহিরা ভেতরে ঢুকে, পেছনে ঘোরে,
-কি রে শৈলী থেমে গেলি কেন? আয়?
– আআমি আমার ছোট মানি পার্সটা পাচ্ছি না। গাড়িতে রেখে এসেছি বোধহয়। তোমরা যাও আমি আসছি।
মালিহা, মাহিরা মাথা ঝাকিয়ে লিফ্টের বাটন চাপ দেয়। ওমনে সেটা বন্ধ হয়ে গেলেই ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ে শৈলী। মিহরানের দেওয়া ম্যাসেজটা আবার বের করে পরে,
– মাহিরা আর মালিহাকে কোনো একটা অজুহাত দিয়ে আপনি চলে আসুন পার্কিং লটে। আমি অপেক্ষা করছি।
কপট রাগ দেখায় শৈলী। নিজের মিনি পার্সটা ব্যাগ থেকে বের করে ফোঁস ফোঁস করে। মানুষটার জন্য বান্ধবীকে মিথ্যা বলতে হলো ওর।
………………………
পার্কিং লটে যেয়ে মিহরানের গাড়ির ব্যাক লাইট জ্বলতে দেখেই বুঝলো সে ভেতরে আছে। সামনে যেয়ে ড্রাইভিং সিটের পাশের সিটের জানালায় নক্ দিল ও। সাথেসাথেই ভেতর থেকে দরজা খুলে যাওয়ায় মিহরানের চেহারা সামনে আসলো ওর,
– গাড়িতে উঠুন।
শৈলী একটু অবাক হয়,
– কেন?
– আগে উঠুন, তারপর বলছি।
শৈলী আর কথা বাড়ায় না। চুপচাপ উঠে পরে।
-বলুন কিসের জন্য থাকতে বললেন।
কথা শেষও করতে পারেনি মেয়েটা, ওমনি মিহরান গাড়ির গিয়ার চালু করে। মুহূর্তেই ওদের বিল্ডিং থেকে বের হয়ে যায় গাড়ি। শৈলী পুরাই আতঙ্কিত,
-কি ব্যাপার? কোথায় যাচ্ছেন?
মিহরান উত্তরে শুধু একটু বাঁকা হাসে। এতে শৈলীর ভয় বেড়ে যায় আরও,
– আরে বলবেন তো কোথায় যাচ্ছেন?
– কেন?আপনার ভয় হচ্ছে আমার সাথে?
শৈলীর রাগ উঠে,
– আপনার সাথে ভয় হবে কেন? পাগল নাকি আপনি? আমার ভয় হচ্ছে, বাসায় কিছু জানাইনি। আম্মু মাহিরাদের দেখলেই আমার খোজ করবে। তখন কি বলবো?ওদিকে মাহিও তো কিছু বলতে পারবে না। মানি পার্স হারিয়েছি, আপনার গাড়িতে সেটা খুজতে যাচ্ছি বলে ওদের থেকে দলছুট হয়েছি। তাই বলে এতোক্ষণ ধরে তো আর পার্স খুজবো না তাই না?
মিহরান একবার শৈলীর দিকে বাঁকা হাসি দিয়ে মাহিরাকে ফোন দেয়। দুই রিং পরেই গাড়ির স্পিকারেই মাহিরার কন্ঠ গমগম করে ওঠে।
-হ্যালো ভাইয়া?
– হ্যা মাহি? শৈলীর মানিপার্স গাড়িতে খোজা হলো কিন্তু পাওয়া যাচ্ছে না। উনি বোধহয় সেই শাড়ির দোকানেই রেখে এসেছেন। আমি ওনাকে নিয়ে সেটা দেখতে যাচ্ছি।
-আয় হায়! কি বলো? এটা তো ভয়ংকর ব্যাপার। ওর পার্সে আইডি কার্ড টার্ড সব আছে। খুজে না পেলে মুশকিল। তোমরা কোথায়? আমি নামবো? যাবো তোমাদের সাথে?
– না তোর লাগবে না আসা। আমরা অলরেডি বের হয়ে গিয়েছি। এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে বেশিক্ষণ লাগবে না।
-হমম ঠিক আছে। শৈলী কোথায়?
মিহরান, এতোক্ষণ মুখ হা হয়ে থাকা শৈলীর দিকে চোখ ওঠালো। ইশারায় কথা বলতে বললো। নিজেকে কোনমতে সামলে ডাকলো শৈলী,
– মাহি।
-দোস্ত, শোন তুই একদম টেনশন করিসনা। বুঝলি? আল্লাহ্ আল্লাহ্ কর্। নিশ্চয়ই পার্স পেয়ে যাবি ইনশাল্লাহ্।
শৈলী দুই ঠোট টিপে রাগ দেখায় মিহরানকে। বেচারি মাহিরাকে খালি খালি টেনশনে ফেলা হচ্ছে। শুধু এই ফাজিল মানুষটার দুষ্টুমির জন্য। তারপর আবার বলে,
– দোস্ত আম্মুকে একটু জানিয়ে দে প্লিস। বল্ আমি তাড়াতাড়ি চলে আসতেসি।
– আন্টিকে নিয়ে টেনশন করিস না। আন্টি আমাদের বাসায়ই আছেন। সন্ধ্যা খালার সাথে তার খুব খাতির জমেছে। আম্মু সহ ওনারা একসাথে বসে গল্পে মশগুল। আমি তোর পার্সের কথা বলেছি। এখন খুজতে যাচ্ছিস তাও বলে দিচ্ছি। আর ভাইয়া আছে তো সাথে তাই তারা টেনশন করবে না। তুই নিশ্চিন্তে যা।
শৈলী মনে মনে রাগ ঝারে,
– তোর ভাইই তো আসল টেনশন। হুহ্!
ফোন কাটার পর শৈলী নিজের সিটে এক প্রকার হেলান দিয়ে ছিটকে পরলো যেন হঠাৎ ওর কাধ থেকে ভারি কিছু নেমেছে। মিহরান পাশ দিয়ে ঠিক তখনই বলে ওঠে,
– এবার কমেছে টেনশন?
শৈলী একবার ফেরে ওর দিকে। তারপর আবার মাথা ঘোরায়,
– হমম।
-এখন কি আমাকে সময় দেয়া যাবে?
শৈলী উঠে বসে। পাশ ফিরে সরাসরি তাকায় মিহরানের দিকে,
-আমরা কোথায় যাচ্ছি এখনো বললেন না কিন্তু।
এবার মিহরান হাসে,
– আপনি তো বললেন আমার সাথে যেতে আপনার ভয় নেই, তাহলে আবার জিজ্ঞেস করছেন যে?
-জিজ্ঞেস করছি কৌতুহল থেকে। না বলতে চাইলে বলিয়েন না।
বলেই শৈলী আবার সিটে হেলান দিয়ে মুখ বাইরে ফেরায়। অর্ধাঙ্গিনি যে অভিমান করেছে তা বুঝতে একটুও সময় লাগে না মিহরানের। মুচকি হাসি দিয়ে হাত বাড়ায় ও।
পরক্ষণেই শৈলী টের পায় ওর হাত আর ওর কোলে নেই, তা চলে গেছে মিহরানের আঙ্গুলগুলোর ভেতর। ঠিক সেই লিফ্টে থাকাকালীন সময়ের মতন। ভেতর ভেতর ভীষণ ভালো লাগা কাজ করলেও ও মুখ ফেরায় না। মিহরান তখন বলে,
– সত্যি বলতে আমি নিজেও জানি না আমরা কোথায় যাচ্ছি শৈলী। শুধু এটুকু জানি আপনার সাথে কিছুটা সময় একান্তে কাটাতে ইচ্ছা করছিল। ইচ্ছাটা মাথা চাড়া দিয়েছে শপিং মল থেকেই। বুঝতে আপনার নিশ্চয়ই বাকি নেই যে আমি শুধু আপনার জন্যই আজ মার্কেটে গিয়েছিলাম। কিন্তু এতো মানুষের মাঝে সেইভাবে সময়ই স্পেন্ড করা হলো না। আর আগামী কয়েকদিন মানুষের আনাগোনায় আমাদের সেভাবে কথা হবেও না। প্রোগ্রামের নানা ঝামেলায় দুজনেই ব্যস্ত থাকবো। তাই হুট করেই ডিসিশন নিলাম আপনাকে নিয়ে ঘুরে আসার। আর এমনিতেও এখনো আমাদের একটা ডেটও হয়নি। এটা কিছু হলো, বলেন তো?
শৈলী ভীষণ রকম লজ্জায় পরে। তবে তার সাথে মিশে যায় এক রাশ ভালোলাগা। ও মুখ ফিরায় মিহরানের দিকে। মিহরানও ক্ষণিকের জন্য হেসে শৈলীর দিকে চেয়ে আবার সামনে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,
– তাহলে বলুন, কোথায় যেতে চান?
শৈলীর তৎপর জবাব,
– হাতির ঝিল যাই?
– হাতির ঝিল? চলুন।
মুহূর্তেই মনটা চাঙ্গা হয়ে ওঠে শৈলীর। মিহরানের থেকে অনুমতি নেয়,
– একটা গান ছাড়ি?
– আপনি নিজে গান গেলে আরও খুশি হতাম।
– আমি গাব? এখন?
– সমস্যা কি? আমিইতো। আর এখন তখন বলে কিছুই হবে না। সারাজীবন এরকম যখন তখন আবদার সহ্য করতে হবে আপনার।
শৈলী ঠোট টিপেই হেসে দেয়,
-আচ্ছা কেমন গান শুনবেন?
-যেটা আপনার ইচ্ছে।
-মমম আচ্ছা।
শৈলী একটা শ্বাস নিয়ে গান ধরে,
“সোনার মেয়ে,
তোমায় দিলাম ভুবন ডাঙ্গার হাসি,
তোমায় দিলেম মধ্যদিনের,
টিনের চালের বৃষ্টি রাশি,
আরও দিলাম রৌদ্রধোয়া সবুজ ছোঁয়া
পাতার বাঁশি।
মুখে বললাম না, বললাম না রে ভালবাসি।
সোনার মেয়ে,
তোমায় দিলাম ভুবন ডাঙ্গার হাসি।
হারাবো হৃদয় টানে, ভালবাসার একটু মানে
ইচ্ছে করছে দুজন মিলেই খুঁজি,
আবেগে মেঘের ভেতর, পৃথিবীর সব আদর,
তুমি হবে আমার ভেবে দুচোখ বুজি।
প্রজাপতি হৃদয়টাই আমাতে নেই,
এ যে কি হল আমার, কোথায় আমি ভাসি।
তোমাকেই,
তোমায় দিলাম ভুবন ডাঙার হাসি।
তোমাকে,
তোমায় দিলাম ভুবন ডাঙার হাসি।
সোনার মেয়ে,
তোমায় দিলাম ভুবন ডাঙার হাসি।
তোমাকে,
তোমায় দিলাম ভুবন ডাঙার হাসি।
তোমায় দিলেম মধ্যদিনের,
টিনের চালের বৃষ্টি রাশি,
আরও দিলাম রৌদ্রধোয়া সবুজ ছোঁয়া
পাতার বাঁশি।
মুখে বললাম না, বললাম না রে ভালবাসি।
তোমাকে,
তোমায় দিলাম ভুবন ডাঙার হাসি।
সোনার মেয়ে,
তোমায় দিলাম ভুবন ডাঙ্গার হাসি।”
মোহিত হয়ে এক ধ্যানে গানটা শুনছিল মিহরান। একহাতে স্টিয়ারিং হুইল ও আরেক হাতে স্ত্রীর কোমল মুঠো বন্ধন ওকে সুখের ভেলায় ভাসাচ্ছিলো। এরকম সময়টা ও শেষ হতে দিতে চাচ্ছিলো না কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন।ভেতর ভেতর দিয়ে গাড়ি নিয়ে নিকেতন ক্রস করে বিশ মিনিটের মাথায় ওরা পৌছায় হাতির ঝিলে।
সন্ধ্যা নেমেছে কিছুক্ষণ আগেই। মাগরিবের আজানও ইতিমধ্যে পরেছে। একটা মসজিদের সামনে গাড়ি পার্ক করলো মিহরান। ও মসজিদে যেয়ে নামাজ ধরলো। আর মাহিরা গাড়ি লক্ করে ভেতরেই বসে নামাজ পরলো।
…………..
সারা শহর জুড়ে গরম পরলেও হাতিরঝিলের খোলামেলা আবহওয়ায় বাতাসের ছোয়া মেলে। পানির ছলছল আওয়াজ সেই ছোয়ায় মিশিয়ে দেয় ভালো লাগার আরেক মাত্রা। সেই নিবিড় পরিবেশেই গাড়ির বাইরে হেলান দিয়ে দাড়ানো এক কপোত কপোতি। ছেলেটার শুভ্র পাঞ্জাবি যেন দ্যুতি ছড়াচ্ছে। দুই হাত বুকে বেঁধে দাড়িয়ে পাশে তাকিয়ে আছে এক রমণীর পানে। মেয়েটার সিল্কের ওড়নার দুই দিকের আঁচল বাতাসে দুলছে। মাথার পেছনে নিচু করে বাঁধা কুচকুচে কালো, বড় খোপাটা বেশ মানাচ্ছে ওকে। দুপাশ থেকে বের হওয়া সিল্কি চুলের গোছাও চেহারায় নিয়ে এসছে অন্যরকম এক মায়াবী ভাব।
সবমিলিয়ে একসাথে ভীষণ রকম মানিয়েছে দুই মানব মানবী কে।
– আগেও বলেছি, আপনার গানের গলার প্রতি মুগ্ধ আমি।
শৈলী এই কমপ্লিমেন্টে ওপরে তাকায়,
– ছোট বেলায় শিখেছি গান। তবে বড় হয়ে গিটার বাজানোর প্রতি ঝোকটা বেড়ে গেল বলে গান শেখা আর কন্টিনিউ করিনি। এখন আর কৈ ভালো গাই?
– তাতেই এতো ভয়ংকর সুন্দর কন্ঠ আপনার? আচ্ছা একটা আবদার করি? রাখবেন তো?
শৈলী আগ্রহ নিয়ে সুধায়,
– বলুন না।
– একদিন ছাদে, পুলের পাশে পা ভিজিয়ে এবং আমার কাধে মাথা রেখে আপনি আমাকে গান শোনাবেন।
শৈলী লজ্জায় হেসে দেয়। এতো আদুরে আবদার সে আশা করেনি।
-হঠাৎ এমন ইচ্ছে কেন হলো আপনার?
মিহরান সামনে চেয়ে কাধ দোলায়,
– জানিনা। তবে সেদিন ছাদে আপনার পা ভেজানোর দৃশ্যটা আমার এখনো চোখে লেগে আছে। মনে হলো সেরকমই একটা সময় রিক্রিয়েট করবো। তবে এবার আমি আপনার আরো কাছে থাকতে চাই। আরো নিকটে।
শ্বাস হঠাৎ ভারী হয়ে পরে শৈলীর। এতো ভালোলাগা গুলো হুট করে ওর হৃদয়ে প্রবেশ করছে, ও সামলে উঠতে পারছে না। মিহরান যেন আজ একটু বেপরোয়া, তাই তো শৈলী স্পষ্ট লাজের মুখশ্রি দেখেও সে এক ধাপ এগিয়ে আসে,
– কি হলো? দিবেন না কাছে আসতে?
শৈলীর হাত মিহরানের হাতের মুঠোয় কখন পৌছেছে ও জানে না। তার ওপর এমন এক প্রশ্নর কি মুখে কোনো উত্তর হয়। কিন্তু কেউ তো অপেক্ষা করছে সেই উত্তরের। তাহলে?
শৈলীর হঠাৎ কি হয় ওর জানা নেই তবে নিঃশব্দে নিজের মাথা মিহরানের বুকের সাথে ঠেকিয়ে সে নিজের উত্তর বুঝিয়ে দেয়।
তুষ্ট মিহরান চুপ করে উপোভোগ করলো এই সময়টা। নিজেকে খুব সুখী সুখী মনে হচ্ছিলো তখন।
কিছুটা সময় এভাবেই পার হয়। শৈলী মীহরানের বুকে মাথা রেখেই বলে,
– আচ্ছা একটা কথা জিজ্ঞেস করি?
মিহরান হাসে,
-কি?
– আমার না আপনার ফ্রেন্ড, তন্ময় ভাইয়ার হাবভাবে অবাক লেগেছে আজকে।
মিহরান অবাক,
-কেন? ও কি করলো?
– না কিছুই করেননি তিনি। তবে আপনারা শাড়ির দোকান থেকে কোথায় গেলেন না? ওখান থেকে আসার পর থেকে ওনাকে মুখ ভরে আমার দিকে তাকিয়ে শুধু হাসতে দেখেছি। বুঝলাম না ব্যাপারটা। আগে তো আমার দিকে তাকাননি পর্যন্ত কিন্তু পরে এতো এ্যাটেনশন। কেন?
মিহরানের কপাল এবার সোজা হয়,
– কারণ আমি ওকে আমাদের বিয়ের ব্যাপারে বলে দিয়েছি। হি নোওস দ্যাট ইউ আর মাই ওয়াইফ। এবং শুধু ওই না, আমার বন্ধু মহলে সবাই জেনে ফেলেছে।
শৈলী সটান দাড়িয়ে পরে মিহরানের মুখোমুখি,
– কি? আপনি বলে দিয়েছেন?
– হ্যা।
– আয় হায়! তাই বলি এভাবে হাসছেন কেন উনি।
শৈলী লজ্জায় মাথা নোয়ায়। কিন্তু পরোক্ষণেই সেই নোয়ানো চোয়ালটা নিজের আঙ্গুলে ধরেই মিহরান ওর মুখ বরাবর ওঠায়। কন্ঠে মাদকতা মিশিয়ে ফিসফিস করে বলে,
– এখনতো একে একে পুরো পৃথিবী আমাদের ব্যাপারে জানবে মিসেস মিহরান। সাবধান! আপনার লজ্জার কৌটা খালি হলো বলে।
চলবে।