#পরিণয়_প্রহেলিকা
#লেখিকা_সিনথীয়া
#পর্ব_৩৪
নিস্তব্ধ রজনী, নিস্তব্ধ পরিবেশ। পিনপতন নিরবতার মাঝে শোনা যাচ্ছে শুধু ঘড়ির কাঁটা ঘোরার ‘টিক, টিক’ আওয়াজ। তার সাথে তাল ধরেছে দূর থেকে ভেসে আসা ধরণীর বুকে নামা বৃষ্টিধারার মধুর শীতল ধ্বনি। আর কোন শব্দের অস্তিত্ব কি পাওয়া যায় ? যায় তো। দুই মানব মানবীর গভীর নিঃশ্বাসের শব্দ, যা একেঅপরের সাথে মিশে লুটিয়ে পরছে।
এমন এক আকষ্মিক আক্রমণে শৈলী সম্পূর্ণ দিশা হারিয়ে ফেলে। কি থেকে কি হয়ে গেল বোঝার আগেই মিহরান ওকে নিজের মাঝে আগলে নেয়। কোমরের বাধন আরেকটু দৃঢ় করে বুকের সাথে মিশিয়ে ধরে। মাথাটা খানিক উচিয়ে কাছে টেনে আনে খানিকটা। নিজের ভালোবাসার পরশ করে আরও একটু গভীর। চোখ খিঁচে আসে শৈলীর। মিহরানের টানে পায়ের পাতা উঁচু হয়ে ওঠে। আপনাতেই দুই হাত উঠে আসে মিহরানের বুকে। বাসার পরনের টিশার্ট টা খামচে ধরে ও।
ঘড়ির সেকেন্ডের কাঁটা মনে হয় চল্লিশতম গর্জন তুলছে যখন মিহরান শৈলীর ওষ্ট আলগা করে। আস্তে ধীরে ও চোখ খুলে নিজের সামনে খুজে পায় এক রক্তিম মুখশ্রি। দেখে, ছোট্ট, আদুরে ত্বকে লজ্জা স্পষ্ট ঠিকরে বের হচ্ছে। মিহরান মুচকি হাসে। কানের পেছন থেকে হাত সরিয়ে মসৃণ সেই ত্বকেই আঙ্গুল বোলায়,
– শৈলী।
শৈলী নির্বাক, তবে পিটপিট করে চোখ খোলে। স্বামীর মাদকময় দৃষ্টিতে নিজেকে আটকা পায় পরক্ষণেই। লজ্জায় যেন গাল হয়ে যায় দ্বিগুন রক্তিম। সাথেসাথেই চোখ নামায় নিচে। মিহরানের বাহুবন্ধন থেকে ছাড়া পাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টায় লেগে পরে। কিন্তু পুরুষালি শক্তির সাথে ওর মতন ছোট্ট খাটো মানুষ কি পারে? শেষে হাল ছেড়ে দিয়ে গভীর শ্বাসে, ক্ষীণ স্বরে আকুতি জানায়,
– ছাড়ুন না।
মিহরান ঠোট নামায় ওর কানের কাছে। শুনতে পায় দুষ্টুমি ভরা প্রশ্ন,
– এখন বোঝাতে পেরেছি আমি কে? এখনো স্যার ডাকবা আমাকে?
চকিতে শৈলী তাকায় মিহরানের দিকে। মানুষটা ওকে ‘ডাকবা’ বলেছে, ‘ডাকবেন’ না। তার মানে সে ‘তুমি’ বলে সন্মোধন করছে শৈলীকে।
মিহরান নিজের প্রেয়শীর চোখের অবিশ্বাস দেখে আবার মুচকি হাসে। কপালে চলে আসা কিছু ছোট চুলের পাপড়িগুলোকে সরাতে সরাতে বলে,
– আমার বউ দেখি বেশ অভিমানি। তবে আমার জন্য এটা ভালো লক্ষণ। অভিমান করলেই এখন থেকে এভাবে অভিমান ভাঙানো যাবে, কি বলো।
শৈলী তক্ষুণি মুখ লুকায়,
– ধ্যাত! আপনি ভীষণ খারাপ। ছাড়ুন আমাকে।
-যদি না ছাড়ি?
শৈলী সতর্ক হয়,
– দেখুন, নিচে আমাদের পরিবারের অনেকেই আছে। এতোক্ষণ আমি ওপরে জানলে খারাপ মনে করতে পারে। প্লিস ছাড়ুন না।
মিহরান কিছুক্ষণ ভাবে,
-এক শর্তে ছাড়বো।
– কি?
মিহরান সময় নেয় না। সাথে সাথেই আবার শৈলীকে আকড়ে ধরে। ছোট্ট কিন্তু গভীর এক আদর বসায় ওর ওষ্টযুগোলে। তাড়াতাড়িই ছেড়ে দেয় শৈলীকে তারপর।
কপট রাগে শরীর কাঁপে শৈলীর,
– আপনি খুব খুব খুবই খারাপ।
বলেই আর থাকে না। এক দৌড়ে রুম থেকে বের হয়ে যায়। পেছনে রেখে যায় আঙ্গুল দিয়ে ঠোট মুছে হাসতে থাকা মিহরানকে।
………………
রুম থেকে বের হয়েও শৈলীর দৌড় থামেনা। মুখে লাজুকলতার হাসি এপার ওপার ছড়িয়ে পরছে। মিহরানের সামনে রাগ দেখালেও এখন মন খুলে হাসছে ও। স্বামীর ভালোবাসা কোন স্ত্রী উপেক্ষা করতে পারে? কেউই না। সেখানে মানুষটা যদি হয় এতোটাই রোমান্টিক তাহলে তো আর কোনো কথাই নেই। কখন অভিমান গলিয়ে দিয়েছে, শৈলীর সেটা খবরই নেই। মানুষটা জাদু জানে, প্রেমের জাদু।
………………….
এদিকে শৈলী যাওয়ার পর বেশ কিছুটা সময় গিয়েছে দেখে মাহিরা অবাক হয় একটু। এক বাটি মুড়ি মাখা দিতে কি এতোটা সময় লাগার কথা? ভাইয়া কি দরজা খোলে নি নাকি? হঠাৎ মাহিরার ভেতরে ভয় ঢোকে। ভাইয়া ঘুমিয়ে থাকলে কেউ তাকে ডিস্টার্ব করলে সে ভীষণ রকমের বিরক্ত হয়। যদি ভাইয়া ঘুমিয়ে গিয়ে থাকে? শৈলী তো দরজা ধাক্কাবেই। ভাই অনেক রাগ করবে তখন। হায়! হায়! শৈলী তুই গেসিশ বোন!
মাহিরা উঠে পরে ততক্ষণাত। বান্ধবীকে বাচাতে জোরে হেটে সিড়ির দিকে পা বাড়ায়। তবে এক পা দিতেই ওপর থেকে শৈলীকে নামতে দেখে হাফ ছাড়ে ও। কিন্তু দ্বিতীয় পলকেই আবার তাকায় শৈলীর দিকে। ভ্রু কুচকে আসলো। মেয়েটার পুরো চোখ মুখ হাসছে দেখে মাহিরা অবাক।
শৈলী এখনো মাহিরা কে দেখেনি। নিজের খেয়ালেই মগ্ন ছিল ও। কিন্তু নিচ তলার খুব কাছে আসতেই দেখলো বান্ধবী দুই হাত বুকের সাথে বেধে দাড়ানো। হকচকায় শৈলী,
– ততুই এখানে?
শৈলীর ভ্রু আরও কুঞ্চিত হয়,
– আমি এখানে মানে?
– মমানে ততুই সিড়ির ঘরে কি করিস?
– তোর খোজে ওপরে যাচ্ছিলাম।
শৈলীর চোখ বড় হয়ে যায় এটা শুনে। ইয়া আল্লাহ! আর এক মিনিট আগে মাহিরা উঠলেই হয়তো শৈলীকে বন্ধ দরজা ভের থেকে ছুটে আসতে দেখতো। কি হতো তখন?
মাহিরার কাছে শৈলীর এই অভিব্যক্তিও ধরা দেয়। এতো কাছে থেকে যে কারও কাছেই ধরা পরার কথা, আর সেখানে মাহিরা তো সবচেয়ে কাছের বান্ধবী। এক পা এগিয়ে মাহিরা শৈলীর একদম কাছে দাড়ায়,
– তোর হয়েছে কি বল্ তো?
শৈলী সাথে সাথেই এক পা পিছায়।
– কি হবে?
-কিছু একটা গড়বড় মনে হচ্ছে আমার।
– ককি গড়বড়? কি যা তা বলছিস তুই? চলতো সবার কাছে যাই।
বলেই শৈলী মাহিরার হাত টেনে ওকে ঘোরানোর চেষ্টা করে কিন্তু মাহিরা ত হতে দেয় না,
– না না, দোস্ত। আমি যা তা বলছিনা। কিছু একটা হইসে আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি। তোদের বাসায় আসার পরই আমার অবাক লেগেছে যখন মেঝ ভাইয়াকে সবার সামনে এতো স্যার স্যার করে মুখে ফেনা তুললি। ভাইয়ার সাথে তো আগে তোকে কথাই বলতে দেখিনি আমি। এখন আবার খাবার দিয়ে আসতে গিয়ে হেসেই খুন হচ্ছিস। ব্যাপার কি বলতো। কিছু ঘটেছে নাকি বান্ধবী? হম হম?
শেষের প্রশ্নটা দুষ্টুমি মাখা মুখ নিয়েই মাহিরা ছোড়ে শৈলীর দিকে। শৈলী এর উত্তর কি দিবে তা খুজে পায় না প্রথমে। মনে মনে ঠিক করে আর বান্ধবীর কাছে লুকাবে না। সব বলে দিবে। কই, মিহরান তার বন্ধুর কাছে তো লুকায়নি, তাহলে ও লুকাবে কেন? মাহিরা তো শুধু বান্ধবীই না, মিহরানের বোনও মানে সম্পর্কে ওর ননদও হয়। ওর তো সত্যটা জানার অধিকার আরও বেশী। শৈলীর মুখে না শুনে অন্যখান থেকে জানলে ভীষণ কষ্ট পাবে মেয়েটা।
এসব চিন্তা করে শৈলী সিদ্ধান্ত নিল মাহিরাকে এখনই সব বলবে।
– এই শৈলী, কি ভাবছিস এতো? আমার প্রশ্নের উত্তর দে।
শৈলী মাথা ওঠায়,
– মাহি শোন, আমার না তোর সা…..
-এই যে দেখ কান্ড! দুই বান্ধবী একসাথে হলে পৃথিবীতে কি হচ্ছে সব ভুলে যায়। তৃতীয় যে একজম ব্যক্তি আছে এই গ্রুপে সেটার ব্যাপারেও তারা থাকে লাপাত্তা।
শৈলীর কথা মাঝপথেই আটকায় কারণ মেহরাব চলে আসে মাঝে। বোন আর বান্ধবী মাথায় হালকা চাটি মেরে বলে,
– কি কথা বলছিস দুজন?
মাহিরা চটে যায়,
– তুই সব জায়গাতেই ব্যাটা থার্ড পারসেন সিঙ্গুলার নাম্বার। আমাদের খোশগল্পে ব্যাঘাৎ ঘটালি।
– আমার ছাড়া গল্প করলে এমনই হবে বুঝলি। আর এমনিতেও এখন আর কোন গল্প হবে না কারণ আম্মু তোদের দুজনকে ডাকছে। যা।
কথা ওখানেই থামিয়ে দিতে হয় ওদের। তবে মাহি যেতে যেতে একটা কথা বলেই,
– এখন তোরে স্পেয়ার করলাম শৈলী। কিন্তু রাতে তোর কাছ থেকে আমি সব বের করবো দেখিস।
শৈলী বান্ধবীর কপট রাগ দেখে হেসে দেয়। মনে মনে বলে,
– তোর কষ্ট করার দরকার নেই দোস্ত। আমি নিজেই সব বলবো।
………………..
ডাইনিং হলে ওরা যেয়ে দেখে মানুষের সমাগম আরও বেড়েছে। সন্ধ্যার খালার দুই মেয়েও এসেছে ইতি মধ্যে। একজন মালিহা সমান, নাম ইতি। আরেকজন ইন্টারে পড়ে, নাম বিথী। দুজনকেই শৈলীর খুব ভালো লাগলো। বেশ মিশুক। ওদের সাথে গল্প করার জনই মূলতো আফিয়া, মাহিরা আর শৈলীকে খুজছিলেন। নিপুণ সহ পাঁচজন একসাথে হয়ে ড্রয়িং রুমে বসে আড্ডা দিতে বসলো। কিছুক্ষণ পর মালিহাও জয়েন করলো ওদের। শেষ মেষ এক বিশাল গ্রুপে পরিণত হলো ওদের আসর।
গল্পে গল্পে কখন রাত নয়টা বেজে গেছে সেই খবরও রাখলো না কেউ। আফিয়া বেগমের ইনসুলিন নেওয়ার সময় হওয়ার উসিলায় ডিনারের কথা মনে পরে সবার। আগেই মিসেস রেহানাকে আফিয়া বলেই রেখেছিলেন সবাই আজ এখানে একসাথে ডিনার করবে। রেহানার শত মানাও তিনি শোনেনি।
ডিনার সার্ভ হতে হতেই বাড়ির পুরুষরাও উদয় হলো। সাথে শৈলীর বাবাকেও রেহানা ডেকে আনলেন। মাহিরা আর মালিহা মাকে সাহায্য করতে রান্না ঘরে চলে গিয়েছে। শৈলীও যেতে চাচ্ছিলো কিন্তু বীথির সাথে নিপূণ থাকলেও ইতি একা হয়ে যাবে বলে ওকে রেখে গেল মালিহা।
মিনিট পাঁচেক পরেই মিহরানকে ওপর থেকে নামতে দেখে শৈলীর মুখ আপনাতেই আবার লাল রুপ ধারণ করে। দুষ্টু লোকটা ওকে দেখেই সবার অগচরে চোখ টিপ মেরেছে। আবার মুখ সোজা করেছে পরক্ষণেই। দেখে কেউ বিশ্বাসই করবে না এক মুহূর্ত আগে করা তার কান্ডের কথা। শৈলী কই মুখ লুকাবে জানে না। এরইমধ্যে যেন আগুনে ঘি ঢালতে পাশ থেকে বিথী বলে ওঠে,
-শৈলী আপু, তুমি ঠিক আছো? তোমার মুখ এরকম লাল হয়ে গিয়েছে কেন?
মিহরান কাছেই ছিল। আর বিথীও জোরেই বলেছে তাই কথাটা শুনতে কষ্ট হয়নি ওর। ঠোট টিপে হেসে দিল ও। সাথে সাথেই মোবাইল বের করে।
শৈলী বেচারির তখন করুণ অবস্থা। বিথী এতো জলদি কথা বলে, মাঝ পথেও থামানো মুশকিল ছিল ওকে। আশপাশ দিয়ে কে কে শুনেছে কে জানে। ইয়া আল্লাহ! বাঁচাও।
তক্ষুনই ওর মোবাইলে ম্যাসেজ রিংটোন বাজতেই শৈলী সেটা দেখতে যায়। মিহরানের ম্যাসেজ দেখে খোলে। পরক্ষণেই চোখ কপালে না, যেন ঠিক যেয়ে ওঠে মাথার চান্দিতে। পুরো শরীর থরথরিয়ে কাঁপে। মিহরান বিথীর কথা শুনে ফেলেছে সেটা ক্লিয়ার বোঝা যাচ্ছে। হায় খোদা, যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই রাত হয়। সবাই ছেড়ে মিহরানকেই শুনতে হলো কথাটা? আর শুনেছে ঠিক আছে। তাই বলে এভাবে উত্তর দিতে হবে? কি দুষ্টু লোক রে বাবা! কি লিখেছে এইসব?
শৈলী চুপটি করে মোবাইল টা বন্ধ করে উঠে পরে। মিহরান ওর দিকে তাকিয়ে ছিল অভিব্যক্তি বোঝার জন্য কিন্তু, সেই সুযোগ শৈলী দেয় না। মাথা নিচু করে ওর সামনে দিয়ে রান্না ঘরে ঢুকে পরে ও।
………………
খাওয়া দাওয়ার সাথে জম্পেশ আড্ডা বসে সবার। আজ অতিথিরা যাত্রা করেছে বলে আফিয়া শাহি কোনো খাবার রান্না করেননি। সব বাঙালি খাবারের আয়োজন ছিল। তবে তাতেই যে কতো আইটেম তার কোন ইয়ত্তা নেই। বিভিন্ন ধরনের সব্জি ও মাছের ভর্তা ছিল হরেক রকম। তার সাথে দেশী মুরগির ঝোল, শরীষা ইলিশ, ভূনা গরুর মাংস আর ঘন ডাল। গরম গরম ভাত দিয়ে খেতে সেইরকম মজা লেগেছে। অনেকে তো আঙ্গুল চেটে পুটে খেয়েছে।
শৈলী খাবার শেষ করে হাত ধুয়ে আসার সময় মিহরানকে সামনে পায়। সাথে সাথেই মাথা নিচু হয়ে যায় ওর। মিহরান ছোট্ট করে হেসে আশপাশে সবাইকে দেখে। তারপর আসতে করে শৈলীর কানে প্রশ্ন দেয়,
– ম্যাসেজটা পরেছো?
শৈলীর বিশ্বাস হয় না। কি খারপ মানুষ! শব্দের মাধ্যমে এতো লজ্জা দিয়ে আবার সেটার প্রশ্নও করে। খুব ক্ষীণ কিন্তু কঠিন স্বরে উত্তর দেয়,
– অসভ্য।
মিহরান শুনতে পায়। ঠোট টিপে নিঃশব্দে হাসে তবে কিছু বলে না। এদিকে শৈলী ওর দিকে চোখ রাঙাতে ওপরে তাকাতেই সামনে থেকে মাহিরাকে আসতে দেখে। সাথে সাথেই তৎপর হয়ে মিহরানকে বলে,
– আমি একটা কথা বলবো আপনাকে। ফোন দিচ্ছি, ধরুন।
বলেই ওখান থেকে সরে যায় ও। মাহিরা ওদের দুজনকে একসাথে দেখার আগেই পালায়।
একটা নিরাপদ দুরূত্বে গিয়ে কল করে শৈলী। এক রিং না শেষ হতেই মিহরান ধরে,
– বলো, কি হয়েছে?
– আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
– সিদ্ধান্ত? কিসের?
– আমি মাহিরাকে সব জানিয়ে দিতে চাই আমাদের বিষয়ে।
ওপাশ থেকে কোন কথা না আসায় শৈলী একটু অবাক হয়। সামনে তাকিয়ে এদিক ওদিক মিহরানকে খোজে। ঠিক তখনই ওপাশ থেকে আওয়াজ আসে,
– তুমি শিওর শৈলী?
– হমম একদম। আমি চাই না আমার বান্ধবী আমার মুখ থেকে শোনার আগে অন্য কোথাও থেকে শুনুক। অনেক কষ্ট পাবে ও।
আবার একটু নিরবতা। তারপর মিহরান বলে,
– ঠিকাছে। ভালো ডিসিশন নিয়েছো। আমারও মনে হয় মাহিরাকে জানানো উচিত আগে। শি হ্যাস দা রাইট টু নো বিফোর।
শৈলীর মুখে হাসি ফোটে, মিহরান ওকে বুঝবে এই বিশ্বাস ছিল ওর।
– কিন্তু, শৈলী তুমি একা ওকে কিছু বলতে যেও না। আমিও থাকবো। আমরা একসাথে বলবো ওকে।
শৈলী একটু অবাক হয়,
– কেন? আমি বলতে পারবো তো ভালো করে।
– আমি জানি তুমি পারবা শৈলী। কিন্তু তারপরেও আমি থাকতে চাই। তোমার বান্ধবী আমার আপন ছোট বোন। ওকে আমি চিনি খুব ভালো করে। ভীষণ চঞ্চল মেয়ে। তোমার কথায় বড় একটা রিয়্যাকশন দিবে ও যেটা তোমার সামলাতে কষ্ট হতে পারে। আমাকে পাশে থাকতে দাও। ট্রাস্ট মি।
শৈলী নিঃশব্দে মাথা নাড়ে। আসলেই মিহরান ভুল বলেনি। মাহিরা যে একটা বড়সর ধাক্কা খাবে এটা জানাই আছে। তখন আসলেই যদি শৈলী পরিস্থিতি সামলাতে না পারে একা? ঠিক ভাবে সব না বলতে পারলে মাহি যদি ওকে ভুল বুঝে? বলবে কিভাবে ঠিক করে সব? সেই রাতের ঘটনার আধা সময় তো ও অজ্ঞানই ছিল। মিহরান থেকে শুনেছে সব, কিন্তু শোনা পর্যন্তই, নিজে তো অনুভব করেনি। মিহরান থাকুক ওর সাথে, এটাই বেস্ট ডিসিশন।
– ঠিকাছে। তাহলে আমরা কোথায় কথা বলবো ওর সাথে?
-মমম, তোমরা তো ছয় তলাতেই যাচ্ছো তাই না?
-হমম।
– আচ্ছা, আমি ম্যাসেজ দিলে মাহিকে নিয়ে সাত তলার ছাদে এসো। ওখানেই কথা বলবো।
– আচ্ছা। রাখি তাহলে।
– হমম।
ফোনটা রেখে শৈলী আবার চলে গেল মেয়েদের মাঝে। ওদের আড্ডায় আবার যোগ দিল।
সারাদিনের যাত্রার ধকল আর এতো সুস্বাদু ডিনারের পর সন্ধ্যা আর তার স্বামী আর টিকতে পারলেন না। ওনাদের ক্লান্ত লাগছে দেখে রেহানা উঠে পরে লেগে গেলেন তাদের নিজের বাসায় নিয়ে রেস্ট করাতে। সাথেসাথেই ছোটদের আড্ডার আসরও ভেঙে গেল, কারণ ইতি বিথীও যাত্রা করে ক্লান্ত। ওরা রুমে চলে যেতেই আফিয়া তার মেয়েদেরকে আর শৈলী নিপুণ কেও বললেন শুতে চলে যেতে। রাত হয়েছে বেশ, আর কাল থেকে সব আত্মীয়রা আসা শুরু করবে দেখে সকালেই অনেক কাজ আছে। মেয়েরাও আর দ্বীমত না করে ওপরে চললো।
……………..
মিহরানের রুমে সন্ধ্যা বেলাতেই চারজনের জন্য বিছানা পাতা হয়েছে। একটা ডাবল বেড যেহেতু, তাই ওপরে মালিহা আর নিপুন উঠলো কারণ শৈলী আর মাহিরা আগেই বলে রেখেছিল ওরা একসাথে শুবে। সেই শর্তে ওদের স্থান হলো মাটিতে পাতা বিছানায়। ওরা এটাতেই বরং খুশি। গরমে নিচে ঘুমানোর মজাই আলাদা।
নিজেরা শুতে যাওয়ার পর থেকেই মাহিরা শৈলীকে নিঃশব্দে খোচাচ্ছে। কিন্তু শৈলী এখনো নির্বাক। শুধু চোখের ইশারায় বুঝিয়েছে, সব বলবে।
…….
রাত সাড়ে বারোটা। শৈলীর মোবাইল অন্ধকারে জ্বলে ওঠে। ম্যাসেজ দেখেই পাশ ফিরে ও। আধা তন্দ্রায় নিমজ্জিত বান্ধীর কানে ফিসফিস করে,
– মাহি ওঠ জলদি।
ঘুমন্ত কন্ঠের উত্তর আসে,
– কেন? কি হইসে?
– সার্প্রাইস।
চলবে।