#পরিণয়_প্রহেলিকা
#লেখিকা_সিনথীয়া
#পর্ব_৩৫
– মাহি ওঠা না।
মাহিরার চোখে ঘুম কিছুটা পালায়। কোনমতে টেনে উঠে বসে ও। বিরক্তি নিয়ে শৈলীর দিকে চায়,
– তোর প্রবলেমটা কি বলতো? এতোক্ষণ গল্প করতে চাইলাম, তখন চুপ ছিলি। আর এখন যখন ঘুমটা মাত্র ধরলো বলে, তখন ওঠানোর জন্য পাগল হয়ে গেসিশ। এটা কিছু হইলো?
শৈলী বান্ধবীর বিরক্তিতে মুচকি হাসে,
– ওঠ্ ওঠ্। প্রমিস করছি, এমন সার্প্রাইস দিব তোর সব ঘুম চলে যাবে।
মাহিরার চোখ বড় হয়,
-কি সার্প্রাইস? দেখিস শৈলু, রাত বিরাতে হার্ট এ্যাটাক করায় দিস না আবার।
নিচু স্বরে তবে খিলখিলিয়ে হাসে শৈলী,
– দেখা যাক্। এখন ওঠ। আর আস্তে কথা বল্। আপু আর নিপুণ উঠে যেতে পারে।
কিছুক্ষণ পরেই দুইটা অবয়বকে অন্ধকারে রুম থেকে বের হতে দেখা যায়।
………………
শৈলী মাহিরার হাত ধরে ছয়তলা থেকে বের হয়ে ওপরের ছাদের দিকে পা বাড়ায়। মাহিরা ওপরে একবার তাকিয়ে অবাক হয়ে প্রশ্ন ছোড়ে,
-দোস্ত আমরা এতো রাতে ছাদে যাচ্ছি কোন?
শৈলী ঘাড় ফেরায়,
– চল্, গেলেই বুঝবি।
আর কথা না বলে দুজন উঠে আসলো। ছাদে যেয়ে প্রথমে কাউকেই দেখা গেল না। পরে ছাদের এক কোণায় রেলিং এর পাশে মিহরানকে ঝুকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে প্রচুর অবাক হলো মাহিরা। সাথে ভয়ও ঢুকলো মনে। ভাইয়া এখানে কেন?
মনের প্রশ্ন মুখেই টেনে আনলো ও। শৈলীকে কনুই দিয়ে গুতো দিল,
– মেঝ ভাইয়া এখানে কি করছে?
শৈলী সরাসরি কোন উত্তর দেয় না। মাহিরার হাত ধরে টানে শুধু,
-আয়।
ঢাকার রাত। মধ্য রজনী হলেও রাস্তা ঘাটের নিওন আলো আর বাড়িতে বাড়িতে ফ্লোরেসেন্ট লাইটের ফুটফুটে আলোয় সেটা বোঝার উপায় কম। সেই আলোকধারায় ভেসে যাওয়া ছাদের এক প্রান্ত থেকে আরেক দিকে এলো মাহিরা আর শৈলী। অনেকটা কাছে আসতেই মিহরান ওদের দিকে ফিরে ঘুরে দাড়ালো।
দিনের বেলাই যেই মেয়ে এই ভাইয়ের ভয়ে থরথর করে কাঁপে রাতে ওর কি অবস্থা হচ্ছে তা শুধু এক আল্লাহ্ আর মাহিরা নিজে জানে। ভয়ে আত্মার শীতল অনুভুতি নিয়ে শৈলীর পাশে দাড়ায় ও।
– ভাইয়া….মানে….
মিহরান প্রথমে শৈলীর দিকে তাকায়। নিশ্চয়তার চাউনি দিয়ে কথা শুরু করতে বলে। শৈলীর ঠোট তখন একে অপরের সাথে জোড়া দেয়া। নিজেকে ধাতস্থ করতে ব্যস্ত ও। গভীর এক নিঃশ্বাস নিয়ে ও মাহিরার সামনে দাড়ায়।
– মাহি….তোকে একটা বিষয়ে…আসলে…জানানো হয়নি আমার।……আমার জীবনের অনেক বড় একটা ঘটনা ঘটে গিয়েছে কিছুদিন আগে….
মাহিরার চোখ কপালে,
– আয় হায়! কি বলিস? কি ঘটসে? খারাপ কিছু? তুই ঠিক আসিশ তো?
শৈলী মাথা উঠিয়ে সরাসরি তাকায় বান্ধবীর দিকে। মুহূর্তেই চোখ নরম হয়ে ওঠে ওর। তারপর পাশে দাড়ানো বিশাল দেহী পুরুষটার দিকে কৃতজ্ঞতার দৃষ্টি ছোড়ে,
– অনেক খারাপ কিছুই ঘটতে যাচ্ছিলো আমার সাথে। হয়তো ঘটেও যেত যদি তোর ভাই না থাকতেন আমার পাশে। ওপর আল্লাহ্ রহমত, তোর ভাইকে উসিলা করে আমাকে বাঁচিয়েছেন তিনি।
মাহিরা হতভম্ব হয়ে সব শুনেই চলেছে। কিচ্ছু বোঝার মতন উপায়ও খুজে পাচ্ছে না। শৈলীর হাত ধরে একবার হালকা ঝাকায় ও,
– শৈলু, তুই কি বলছিস বলতো? আমার মাথায় কিছুই ঢুকছে না রে। আমার ভয় হচ্ছে ভীষণ। কি হয়েছে বলনা?
হঠাৎ পরিবেশ ভারি হয়ে কেমন এক বিষাদের ছায়া নামলো তিনজনের মাঝে। শৈলীর মুখশ্রির রুপ বদলাতে সময় লাগলো না। যেই চোখ জোড়ায় এতোক্ষণ জলঘোলা ছিল, তা থেকে হুট করেই অশ্রুধারা গড়িয়ে পরতে শুরু করলো। আচমকাই কান্নায় ভেঙে পরে শৈলী।
মাহিরার সম্পূর্ণ দিশেহারা লাগতে শুরু করেছে ততক্ষণে। কি শুনতে এসেছিল, কি হচ্ছে এখন, সব গোল পাকিয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ আগের হাসোজ্জ্বল শৈলীর সাথে এখনের শৈলীর কোনো মিল পাচ্ছে না ও। বান্ধবীর এই অঝরে কান্না আর সহ্য হলো না। ওকে সামলানো দরকার বুঝে হাত বাড়াতে গেল তবে তার আগেই পাশ দিয়ে এক বলিষ্ঠ হাত এসে আগলে নেয় শৈলীকে। মাহিরা পুরো থমকে যায়। আপনাতেই এক পা পিছিয়ে আসে ওর। চোখ জোড়া ভয়ংকর আকারে বড় করে বুঝতে চেষ্টা করলো ও যা দেখছে তা কি সত্যি? নাকি রাতে জাগা স্বপ্ন মাত্র?
মিহরান কোন ইতস্ততা ছাড়াই শৈলীকে নিজের ডান পাশের বুকে জায়গা দিয়ে দিয়েছে। এক হাত মাথায়, আরেক হাত ওর কাধে রেখে পেঁচিয়ে নিয়েছে। আর শৈলী? শৈলীও তো সাবলীলতার সাথে চুপটি মেরে পরে আছে সেই বুকের মাঝে। হেঁচকির দোলা পরছে নিয়মিত, সেটাকেই আবার কপালে আদুরে পরশ বুলিয়ে থামানোর চেষ্টায় মিহরান। ইয়া আল্লাহ্! এরা একে অপরের এতো কাছে আসলো কবে? কখন? হচ্ছে টা কি আসলে?
সেই রাতের স্মৃতি যে শৈলীকে আবার আক্রমণ করেছে সেটা মিহরানের বুঝতে অসুবিধে হয় নি। এই ঘটনার জন্য আগের থেকেই প্রস্তুত ছিল। মূলত এই কারণেই এখানে থাকতে চাচ্ছিলো ও। মাহিরাকে না বরং শৈলীকে সামলাতেই ওর পাশে দাড়াতে চাচ্ছিলো।
হঠাৎ মিহরানের চোখ যায় মাহিরার অবিশ্বাসে ভরা নয়নের দিকে। স্ত্রীর সাথে বোনের প্রতিও যে ওর একটা দায়িত্ব আছে এটা ও ভুলে যায়নি। মেয়েটা নিশ্চিত এই মুহূর্তে ভীষণ রকমের শক্ড এসব দেখে। কিছু ভুল বুঝে ফেলার আগেই ওকে থামাতে হবে ভেবে নিচে শৈলীর কানের কাছে মুখ নিল মিহরান,
– শৈলী, মাহিরা….
এই একটা শব্দই যথেষ্ট ছিল শৈলীকে ধাতস্ত করার জন্য। কান্না আগেই থেমেছিল। যাও একটু ফোফাচ্ছিল, তা থেকেও সামলে নিল নিজেকে। চোখ থেকে পানি মুছে একদম সোজা হয়ে দাড়ালো।
মাহিরা অপলক একবার নিজের ভাইয়ের দিকে চাইছে তো একবার বান্ধবীর দিকে। কি বলবে বা কোন ধরনের প্রশ্ন করলে ঠিক উত্তর পাওয়া যাবে তা বুঝতে পারছে না ও। তবে ওর এই দনোমনো ভাবটা তখনই দূর করতে উদ্যত হয় শৈলী।
– সরি মাহি। আমি মাঝপথেই নিজের খেই হারিয়ে ফেলেছিলাম। আসলে স্মৃতিটা এতোটাই ভয়ানক যে আমার জানা নেই আমি কখনো সেটা ভুলতে পারবো কিনা।
মাহিরা এবার অধৈর্য্য হয়,
– বলবি তো কি হইসে?
শৈলী তাকায়,
– আমাদের পিকনিকেয রাতে আমার সাথে অনেক ভয়াবহ এক কান্ড ঘটেছিল।
শৈলী তারপর একে একে সব ঘটনা শোনায়। লাবন্যর ওদের রুম থেকে নিয়ে বের হওয়া থেকে ছেলেদের রেস্ট হাউস যাওয়া, শৈলীকে বাকি বান্ধবীদের থেকে আলাদা করে ফেলা, তারপর ছলনার জালে ফেলে রুমে বন্দি করা, সব কিছু বলে। এইটুকু শুনেই অস্ফুট চিৎকার বের হয় মাহিরার মুখ থেকে। নিজের প্রাণের প্রিয় বান্ধবীর সাথে এতো কিছু ঘটে গিয়েছে শুনে ওর পৃথিবী থমকে যায় মুহূর্তের জন্য।
– লাবন্যর রগে রগে শয়তানি ঘোরে সেটা আমার জানা আছে। ও একটা বদ*মা*শ মেয়ে। রিকের বিশাল বড় চামচি ও। আমি নিশ্চিত, তোর সাথে এই ঘটনার পেছনে রিকের হাত আছেই আছে। কিন্তু লাবন্যকে তো আমি ছাড়বো না। আমার বান্ধবীর দিকে হাত বাড়ানোর সাহস পাইলো কিভাবে ও। একদিন ক্যাম্পাসে ওকে ধরি আমি, তারপর দেখ কি হয় ওর সাথে।…আচ্ছা তোকে বন্দি করার পর কি করলো ও?
শৈলী শ্বাস নেয়,
-আমাকে বন্দি করার পর তো ও আর আসেই নি। জানিনা কতোক্ষণ বন্দি ছিলাম। তবে ফেরেস্তার মতন বাঁচাতে উনি চলে আসেন সেই রুমে দ্বার প্রান্তে। আমাকে সেখান থেকে উদ্ধার করেন।
শৈলীর ইঙ্গিতে মাহিরা মিহরানের দিকে চায়।
-ভাইয়া, তুমি বাঁচালে মাহিরাকে? কিভাবে? তুমি আশেপাশেই ছিলে?
-না ছিলাম না। তবে সেইদিন এবং তার আগে ভার্সিটিতে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা নিয়ে আমার মনে একটু সন্দেহ ছিল। তাই শৈলী যখন বান্ধবীদের সাথে বের হলো….
মিহরান নিজেও মাহিরাকে শৈলীর বদ্ধ রুম পর্যন্ত যাওয়ার ঘটনার বৃত্তান্ত দিল। মাহিরা শুধু শ্বাসরুদ্ধ করে শুনেই যেতে লাগলো সব। মিহরান বলা শেষ করলে মুখ থেকে হাত সরিয়ে বললো,
– এক রাতে এতো ঘটনা ঘটেছে? আনবিলিভেবল্!
শৈলী এতোক্ষণ মাথা হালকা নুইয়ে দাড়ানো ছিল। এবার মাথা তুলে বললো ও,
-যতটুকু শুনেছিস ততটুকু সেই রাতের আধা ঘটনা মাহি। পৃষ্ঠার উল্টো পিঠ এখনো তোর শোনার বাকি।
মাহিরা যারপর নাই অবাক হয়,
– এতো কিছুর পরও আরও আছে? আরও খারাপ কিছু হয়েছে নাকি?
শৈলী উত্তর দেয় না তবে মাথা নেড়ে না বোঝায়। ওর ঠোটের কোণ ছোয়া হাল্কা হাসিই মাহিরাকে বলে দেয় এখন ও যা শুনতে যাচ্ছে তা ভালো কিছু। মাহিরা আরও লক্ষ্য করে শৈলীর মিহরানের দিকে তাকানোর, ওকে সম্বোধন করার সাবলীলতাটাকে। কোথায় যেন ছক্ বসছে না ঠিক ভাবে।
এদিকে শৈলী মিহরানের দিকে তাকায়,
– এরপরটা আপনিই বলুন। আমার এমনিতেও বেশি কিছু মাথায় নেই। অজ্ঞানই তো ছিলাম আধা সময়।
মিহরান মাথা হাল্কা ঝাকায় এবং বলার প্রস্তুতি নেয়, কিন্তু তার আগেই মাহিরা থামায় ওকে,
– এক মিনিট, এক মিনিট। সরি ইন্টারাপ্ট করার জন্য, বাট কম্প্লিট্লি অফ টোপিকে একটা প্রশ্ন করতে চাই।
মিহরান দুই হাত বুকে ভাজ করে,
– বল্।
মাহিরা এবার একটু থেমে নিজের মাঝে প্রস্তুতি নেয়,
– তোমাদের দুজনের মাঝে এতো সক্ষতা হলো কিভাবে বলো তো? আই মিন, দেখেই বোঝা যাচ্ছে তোমরা বেশ ফ্রেন্ডলি হয়ে গিয়েছো একে অপরের সাথে। ডোন্ট টেইক মি রং, আমি খুবই পছন্দ করছি ব্যাপারটা কিন্তু…আসলে…বন্ধুত্বটা হলো কিভাবে জানতে চাচ্ছিলাম আর কি।
মিহরান শৈলীর দিকে তাকিয়ে হাল্কা একটা হাসি দেয়। শৈলী ততক্ষণে অন্যপাশে চেয়ে ওড়নার আঁচল ঠোটে ধরে মুখ লুকিয়েছে। মাঝে মাহিরা বোকার মতন চেয়ে রইলো। মিহরান তারপর বলা শুরু করে,
– তুই ভুল বলিসনি মাহি। হয়েছে বন্ধুত্ব আমাদের। আবার ঠিক বন্ধুত্বও না। তবে যাই হয়েছে তা জানতে চাইলে সেই রাতে ঘটে যাওয়া বাকি অর্ধেক টাও মন দিয়ে শুনতে হবে তোকে।
মাহিরা তৎপর হয়
-বলো বলো।
ওর ভাবভঙ্গিতে শৈলী হেসে দেয় ছোট্ট করে। মিহরানো হাসে। তারপর এক এক করে খুব সুক্ষ ভাবে শৈলীকে নিয়ে ফার্মহাউস থেকে বের হয়ে সেই ক্ষেতের ভেতরের ছাউনি ঘর পর্যন্ত যাওয়া এবং সেখানের সব ঘটনা আস্তে ধীরে মাহিরার সামনে উপস্থাপন করে। বিয়ের কথাটা মাহিরার সামনে নিয়ে আসে আরও বেশি ধীরে। কিন্তু তাতে লাভ হয় না কিছুই।
দুই জনের কান ফাটিয়ে জোড়ে একটা চিৎকার দেয় মাহিরা। মনি চোখের কোটর থেকে দৌড়ে বের হয়ে যাবার জোগাড়। ঠোট জোড়া দিয়ে অবিরাম আউড়াতে থাকে একটার পর একটা প্রশ্ন,
– কি বললা? তোমরা বিয়ে করে ফেলেছো? মানে বিয়ে? আই মিন ম্যারেজ? তোমরা স্বামী স্ত্রী? শৈলী আমার ভাবী? শৈলী এটা সত্যি?
শেষ প্রশ্ন শৈলীকে ঝাকিয়ে করে মাহিরা। ওর পাগলামো দেখে শৈলী হেসে ফেলে। মাহিরা আবার জিজ্ঞেস করে,
– আরে হাসিস পরে। আগে উত্তর দে আমার প্রশ্নে। ভাইয়া যা বলছে তা ঠিক? আসলেই তোদের বিয়ে হয়েছে?
-হমম। আসলেই হয়েছে।
মাহিরা হঠাৎ থমকে যায়,
– তার মানে…এটা ফান না? রিয়েলি বিয়ে হয়েছে?
শৈলী হ্যা সূচক মাথা ঝাকায়।
হঠাৎ পুরো ছাদে স্তব্ধতা ছেয়ে যায় এক মুহূর্তের জন্য। এরপর হুট করেই মাহিরা দুই হাত উঁচিয়ে আবার চিৎকার দিয়ে ওঠে।
– ইয়ায়ায়ায়া হুউউউউউউউ! আমার ইচ্ছা পূরণ হয়েছে। আলহামদুলিল্লাহ্ আলহামদুলিল্লাহ্ আলহামদুলিল্লাহ্। ইয়া আল্লাহ অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। ইয়েএএএএএ। শৈলু তুই শেষ পর্যন্ত আমার ভাবি হয়েই গেলি?
মিহরান না বুঝলেও শৈলী যেহেতু আগে থেকেই মাহিরার ইচ্ছার ব্যাপারে অবগত ছিল তাই ও হেসে দিল। মাহিরা ওকে জাপটে ধরার সময়, ও নিজেও জড়িয়ে ধরলো। মিহরান মাঝ থেকে একটু বিভ্রান্ত বোধ করলো এবং সেটা ওর চেহারাতেও ছিল স্পষ্ট। মাহিরা শৈলীর ঘাড়ে মাথা দিয়েই নিজের ভাইয়ের এই অভিব্যক্তি ধরতে পারলো। হেসে দিয়ে আস্তে করে বান্ধবীকে ছাড়লো। তারপর সুন্দর একটা হাসি দিয়ে মিহরানের কাছে যেয়ে ওর কোমর জড়িয়ে বুকে মাথা দিল।
– কনগ্র্যাচুলেশন্স ভাইয়া। তুমি কল্পনাই করতে পারবা না আমি কতু খুশি হয়েছি। যখন তখন শৈলী কে চিনেছি বুঝেছি, ওদের পরিবারকে জেনেছি, তখন থেকেই আমার মনে এই ইচ্ছে ছিল যে শৈলীকে তোমার বউ বানাবো। বিশ্বাস করো শৈলীকে এই প্রস্তাব দেওয়ার আমার শেষ। তখন তো ম্যাডাম কতো না না করেছিলেন, বিয়ে করবেন না, হ্যান ত্যান, আরও কতো কি। আর এখন? হা হা হা।
মাহিরার দুষ্টুমি তে ভীষণ লজ্জায় পরে শৈলী। কিন্তু মাহিরা আজ কোন ভাবেই ওকে ছাড় দিতে রাজি নয়। শৈলীকে কিছুক্ষণ মন ভরে ভাবি ভাবি বলে কান ঝালাপালা করে তুললো। মিহরানের পাশে দাড় করিয়ে কতোক্ষণ মন ভরে দেখলো। মোবাইলে ছবিও তুলতে চাচ্ছিলো, কিন্তু মিহরানের মানা করাতে আর আগালো না। শেষে নিজের মনের খায়েশ মিটিয়ে ওদের দেখে, মিহরানের পানে চাইলো।
– অনেক মজা করলাম এখন একটা সিরিয়াস প্রশ্ন করি ভাইয়া?
-হমম।
– বাসায় জানাবা কবে? কি প্ল্যান করছো?
মিহরান গম্ভীর ভাব টানে,
– প্রোগ্রামটা শেষ হলেই আব্বু আম্মু কে নিয়ে বসবো।
মাহিরার মুখ উজ্জ্বল হয়,
-একদম ঠিক ডিসিশন নিয়েছো ভাইয়া। বিয়ে তো করেই ফেলেছো, এখন ঘরে তোলো বউকে। আমি আর আমার ভাবিকে ছাড়া থাকতে চাই না।
বলেই আদুরে আব্দারে শৈলীকে পাশ দিয়ে জড়িয়ে ধরে মাহিরা। শৈলীও মাহিরার মাথার সাথে মাথা মিলায়।
মিহরান না হাসলেও ওর চোখের নমনীয়তা বুঝিয়ে দিচ্ছে মাহিরার রিয়্যাকশনে খুশি হয়েছে ও। ওর এই বোনটা চঞ্চল হলেও অনেক ম্যাচিউর্ড যেটা নিঃশব্দে মিহরান শ্রদ্ধা করে। আজ ও সেটার প্রমাণ দিল মেয়েটা।
……………………..
আশপাশে এখন বেশ চুপচাপ হয়ে গিয়েছে। এখন আসলেই মনে হচ্ছে রাত নেমেছে। চারদিক দেখে মাহিরা বললো,
– শৈলু এখন বোধহয় আমাদের যাওয়া উচিত রে। রাত অনেক হয়েছে। পরে সকালে আম্মুর দাবড়ানি খেয়ে উঠতে হবে।
শৈলীও মাথা দোলায়,
– হমম। চল্ যাই।
মাহিরা তারপর ভাইয়ের দিকে তাকায়,
– ভাইয়া অনেক রাত হয়েছে। যাই আমরা এখন?
আকস্মিক মিহরান শৈলীর হাত ধরে একটু নিজের দিকে টানে। বোনের দিকে তাকিয়ে বলে,
-তুই যা মাহি। ও পরে আসবে।
শৈলী হতবাক। একি! ও কে থামাচ্ছে কেন লোকটা?
এদিকে মাহিরা ভাইয়ের কথা শুনে ঠোট টিপে হেসে ফেললো। হইহই করে বললো,
-হ্যা হ্যা, ঠিকাছে ভাইয়া ভাবি। ইনজয় ইয়র ইউ টাইম। শৈলী তোর রাতে না আসলেও চলবে রুমে। ভোরের সময় চলে আসলেই হবে। ঠিকাছে?
ভাই বোনের দুষ্টুমি ভরা চেহারা দেখে শৈলী হতবিহ্বল হয়ে পরে। মাহিকে থামাতে চায় ও, ওর সাথে যেতে পা বাড়ায় কিন্তু সেই যে পেছন থেকে ওর হাত কারো মুষ্ঠিতে বাঁধা। সেই বলিষ্ঠ হাতের বাধন ছোটাবে কেমনে? সেটা যে অসম্ভব।
মাহিরা আর কোন কথাই বললো না। ছুটে চলে গেল ছাদের দরজা দিয়ে অন্ধকারে উধাও হয়ে গেল।
…………..
মালিহার মন ভালো ছিল না সন্ধ্যা থেকে। রায়হানের সাথে ঝগড়া হয়েছে। বিষয় : আবার সেই বিশেষ ধরনের আব্দার। মালিহা মানতে নারাজ বলেই রায়হান ক্ষেপে গেছে। এই নিয়ে রেষারেষি চলছে দুজনের মাঝে।
তবে বাসায় কাউকেই সেটা বুঝতে দেয়নি ও। সবার সাথেই হেসেছে, মজা করেছে। এমনকি মিহরানের রুমে এসেও কতোক্ষণ নিপুণের সাথে গল্প করে তারপর ঘুমানোর চেষ্টা করেছে। কথায় আছে, মানুষ মানসিক ভাবে ক্লান্ত থাকলেও নাকি অনেক সময় ঘুমিয়ে যায়। মালিহারও মনে হয় তাই হয়েছে। কারণ ও নিদ্রায় ডুবে গিয়েছিল। কতোক্ষণ ঘুমিয়েছে জানে না। ফোনের রিংটোনে ওর ঘুম ভাঙে। রায়হানের ফোন হতে পারে ভেবে উত্তেজিত হয়ে ওঠে পরে ও। বালিশের নিচ থেকে তড়িঘড়ি করে মোবাইল বের করে। তবে বের করেই আশাহত হতে হয় ওকে। রায়হান ফোন দেয় নি। তুরিন দিয়েছে।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মালিহা, তারপর ফোনটা ধরে,
– হ্যা দোস্ত বল্।
-দোস্ত ঘুমায় গেসিশ?
মালিহা নিঃশব্দে হেসে সময় দেখে নেয়।
– না বল্। কি ব্যাপার?
– মমম। আচ্ছা তোদের পাশের বাসার ঐ মেয়েটা, কি যেন নাম বললি ওর? আরে আজকে এসেছিল যে তোদের সাথে,
– কে শৈলী?
– হ্যা হ্যা ঐ ঐ। মাহিরার বান্ধবী তাই না?
– হ্যা। ওরে নিয়ে এই মাঝ রাতে তুই প্যারা নিচ্ছিস কেন? কি হইসে?
ওপাশ থেকে এক পলক চুপ থাকে তুরিন। তারপর বলে,
-আমার না মেয়েটার হাব ভাব ভালো লাগে নাই রে। মেয়েটাকে পছন্দ হয় নাই আমার।
মালিহা খাট থেকে উঠে একবার নিচে চায়। শৈলী নিচেই শোয়া ভেবে এতোক্ষণ ফিসফিস করে কথা বলছিল। কিন্তু শৈলী মাহিরা কাউকে না পেয়ে ও ভ্রু কুচকায়। এই রাতে গেল কই দুইটা? ছাদে নাকি?
– মালিহা আমার কথা শুনতে পাচ্ছিস?
– হহ্যা হ্যা বল্, বল্। শুনছি। শৈলীর কি পছন্দ হয় নি তোর।
-আমার মনে হয়, ও তোর মেঝ ভাইকে পছন্দ করে।
মালিহা আরেকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। মেয়েটা গেসে পুরোপুরি।
– আমার আর মাহি ছাড়া তুই যেই মেয়েকেই দেখিস সেই
মেয়েই তোর কাছে মনে হয় মিহরান ভাইয়াকে পছন্দ করে। এই ভূল ধারণা থেকে বের হয়ে আয় দোস্ত। এমন কিছুই হয়নি। শৈলী ভাইয়াকে সেভাবে পছন্দ করে না। করলে আমি না হলেও মাহি জানতো। কিন্তু এইসব নিয়ে ওদের মাঝে আমি কখনো কথাই বলতে দেখিনি। তুই ভুল মনে করছিস রে।
-না দোস্ত। আমি ভুল ভাবছি না। আমি ঠিকই ভাবছি। আমি যেই নজরে একটা মানুষকে ভালোবাসি সেই একই নজর অন্যকারো থেকে যদি তার ওপরে পরে, আমি সেটা চিনবো না? অবশ্যই চিনবো। আমি শৈলীর চোখে সেই দৃষ্টি দেখেছি আজ। তোর ভাইয়ের প্রতি সে দূর্বল। এবং আমি আরও একটা জিনিস লক্ষ করেছি। …..তোর ভাইয়াও….মনে হয় ওকে…..পছন্দ করে।
পরক্ষণেই মালিহা খাট কাঁপিয়ে হেসে উঠলো। নিপুণ একটু নড়লো দেখে আবার স্থির হলো তবে হাসি থামালো না।
– তুরিন, বান্ধবী। তুই পুরাই গন কেইস বুঝছিস? তোর
মাথার তার ছিড়সে নিশ্চিত। ভাইয়া….পছন্দ?হে আল্লাহ্। এটা জীবনেও সম্ভব না। ভাইয়ার মতন রোবটে মধ্যে এইসব প্রেম ভালোবাসা কাজ করে না বুঝলি? বিয়ের পর বউ য়ের সাথে কেমন হবেন জানি না, তবে বিয়ের আগে পছন্দ আর উনি করবেন?, হইতেই পারে না। তুই এইসব উল্টাপাল্টা চিন্তা বাদ দে দোস্ত। ভালো একটা ঘুম দে নিজেও আর আমাকেও দিতে দে। এখন রাখি বাই।
বলেই ফোন কেটে দেয় মালিহা। হাসতে হাসতেই শুয়ে পরে বিছানায়।
…………
মাহিরা চলে যাওয়ার পর মিহরানের দিকে তাকায় শৈলী। চোখে বিরক্তি নিয়ে রাগের বুলি ছোড়ে,
– মাহিকে এভাবে চলে যেতে বললেন কেন?
মিহরান এক টানে শৈলীকে নিজের বুকে টেনে নেয়। হকচকানো শৈলী কেঁপে ওঠে। সেটা রেগে নাকি লজ্জায় তা বোঝা যায় না। মিহরান এবার কানের কাছে মুখ নেয়,
– তোমাকে মাহি আমাদের বিয়ের কথা বলেছিল?
শৈলীর এই মাদকময় আওয়াজে রাগ মুহূর্তেই গায়েব হলো। তার বদলে শুকনো ঢোক গিললো ও।
-অঅনেক আআগে এএকবার বলেছিল।
– আর তুমি আসলেই মানা করে দিয়েছিলা?
শৈলী চুপ করে নিচে তাকায়। চুপ থাকা সম্মতির লক্ষণ বুঝে মিহরান শৈলীর মুখ ওর দিকে উঁচু করে,
– কেন না করেছিলা?
– এমনিই।
– এমনিই?
শৈলী মিহরানের হাত নিজের চিবুক থেকে সরায়,
– আরে ওটা তো ও সিরিয়াস হয়ে বলে নি। আর তখন আমি আপনাকে আমার স্যার ছাড়া আর কোনো ভাবে চিন্তাম না তো। তাই…
– এখন চিনেছো? স্যার ছাড়া….অন্যভাবে?
শৈলী শিউড়ে উঠে। এরকম নিশুতি আঁধারে এই খাদে নামা কন্ঠ ওকে ব্যাকুল করে তোলে। নিজের পুরো ভাড় আপনাতেই মিহরানের ওপর ছেড়ে দেয়। মিহরান ঠোটের ভেতরেই হাসে।
-আজকে সন্ধ্যায় আমাকে খারাপ মানুষ বলে চলে গেলা কেন রুম থেকে?
শৈলী ক্ষীণ কন্ঠে শুধায়
– আপনি খারাপ তাই। অনেক খারাপ।
– তাই? কিভাবে? কি অপরাধ আমার?
শৈলী ভেতর ভেতর কপট রাগে। এক একটা উদ্ভট দুষ্টামি করবে আর কেমনে খারাপ সেটা জিজ্ঞেসও করবে।
-জানিনা।
– আমার ম্যাসেজটা পড়ে নিজের রিয়্যাকশন দাওনিতো।
শৈলীর কপালে চোখ উঠে। হায় হায়! এই লোক কি শুরু করলো। এখনই এখান থেকে যেতে হবে, নাহলে সর্বনাশ!
শৈলী বাধন থেকে বের হতে তৎপর হয় কিন্তু সেটা তো পারেই না বরং তখনি মিহরান ঘুরে, শৈলীকে রেলিংয়ের পাশের দেয়ালে আটকায়। নিজের দু হাত দিয়ে দুপাশ থেকে ঘিরে ধরে ওকে। শুধু কথাতেই না, নিজের অর্ধাঙ্গের চোখেও এক অন্যরকম মাদকতার অস্তিত্ব পায় শৈলী।
মিহরান কাছে আসে। ঠোটের ছোয়া দেয় শৈলীর কানের লতিতে। একপাশে মাথা ফেলে শৈলী খামছে ধরে ওর কামিজ। মিহরানের আওয়াজ কান দিয়ে মস্তিষ্কে প্রবেশ করে,
-একটা কিসেই যদি আমি খারাপ হয়ে যাই তোমার কাছে তাহলে সামনে কি হবে মিসেস মিহরান? এতো ছোট অপরাধে যদি এমন সাজা মেলে তাহলে বিশাল বিশাল অপরাধগুলোতে তো আমাকে ফাঁসি দিয়ে দেয়া হবে মনে হচ্ছে।
অবিশ্বাস্য নয়নে শৈলী চকিতে ঘোরে সামনের দিকে। মিহরানের চোখে চোখ আটকায়। মিহরানের কথা তখনো শেষ হয়নি। ভারী নিঃশ্বাসে ভারে ডুবে যায় শৈলী,
– তবে আমি সেই অপরাধ গুলো করতে চাই শৈলী। শুধু তোমাকে সেই অপরাধের একমাত্র সাক্ষী রাখতে চাই। থাকবা সাক্ষী আমার অপরাধের?
শৈলী বাক্য গঠনের প্রক্রিয়া ভুলে যায়। মুখ খুলে আবার বন্ধ করে। কি বলবে বুঝতে পারে না। কিভাবে বলবে বুঝতে পারে না। তবে সে যে আসলেই চায় মিহরানকে অপরাধী করতে। সেই অপরাধের সাক্ষী নিজেকে বানাতে।
চলবে।