#পরিণয়_প্রহেলিকা
#লেখিকা_সিনথীয়া
#পর্ব_৩৮
মানুষ এক অদ্ভুত জীব। যেই জিনিসটা সে কোনোভাবেই তার জীবনে চায় না, তাই নিয়েই সবচেয়ে বেশী ভাবে। আবার যেই ঘটনা সে চায় না তার জীবনে ঘটুক, সেটার আঁচ সবার আগে সেই পায়। তুরিনের অবস্থা আজ এর থেকে ব্রতিক্রম না। ওর হঠাৎ কেন এটাই মনে হলো মিহরান আর শৈলীর মাঝে সম্পর্ক হয়ে গেছে ও জানে না। তবে মনের কু ডাক টা থামছেই না কোনভাবে। কি করবে ও এখন? কি করা উচিত?
এসবের মাঝেই ঝুমাকে ওপরে নেওয়ার তোড়জোড় শুরু হলো। সব মেয়েরা একত্রে উঠলো ছাদে। তুরিনের প্রবোল আপত্তির মাঝেও মালিহা টেনে ওকে ওপরে নিয়ে আসলো। ঝুমাকে বরণ করে নেওয়ার পরপরই অনুষ্ঠান শুরু করতে বলা হলো।
অনেক নাচ গানের এবং বিভিন্ন ইভেন্টস্ এর মাধ্যমে প্রোগ্রামটা খুব শুষ্ঠভাবে সম্পন্ন হলো। শৈলী ভীষণ মজা করেছে সবার সাথে। মাহিরার ফোনে বলা কথাগুলো আমলে নেওয়ার পর থেকে নিজ দায়িত্বেই এগিয়েছে। জানাজানি আজ হয়নি, কাল হবে। তাই বলে ও এই বাড়ির বউ, এই সত্যটা তো আর ঝুলে থাকবে না এবং না ঝুলে থাকবে ওর দায়িত্ব।
……………..
এক সময় মেয়েদের পোগ্রাম শেষ হয়। কথা ছিল, এখানেই মেয়েরা খেয়ে নিবে, ছেলেদের খাবারের এ্যারেঞ্জমেন্ট নিচে হবে। কিন্তু শেষে আর তা হলো না। দুই ফ্লোর জুড়েই নারী পুরুষরা নিজ নিজ সুবিধা অনুযায়ী ছড়িয়ে পরলো।
শৈলী আর মাহিরা এক পাশে দাড়িয়ে নিজেদের গল্পে মশগুল,
– ভাবীর সাদ টা সুন্দর ভাবে হলো তাই না রে মাহি। এতো মজা হবে আগে বুঝতেই পারি নাই।
-তোর সময়ে আরো মজা করবো আমরা দেখিস। ইনশাআল্লাহ।
শৈলীর কথাটা বুঝতে দুই তিন সেকেন্ড লাগে। বোঝার সাথে সাথে মাহিরা পিঠে একটা চাপড় মারে ও।
– তোর পাখনা কালকে থেকে গজাইসে দেখছি। ডাকবো তোর ভাইয়াকে? বলি তুই কি শুরু করসিশ?
মাহিরা বেখেয়ালি হাসি দেয়,
– ‘তোর ভাইয়া’ তাই না? কেন এখন ‘স্যার’ সম্মোধনটা গেল কই? হাহাহা। আর শোন, ভাইয়াকে ডেকে এগুলা জানালে ভাইয়া রাগ তো হবেই না বরং আরও খুশি হবে। দেখবি, আমি ঠিক বলসি কি না? ডাকবো ভাইয়াকে?
শৈলী তাড়াতাড়ি থামায়। ও জানে মাহি একদম ঠিক বলেছে। ঐ দুষ্টু লোকটা এখন এসব শুনলে ভীষণ লজ্জায় ফেলবে ওকে। এখানেও মাহিরার সামনে, আবার একা পেলে তো কথাই নেই।
হঠাৎ ওদের কথার মাঝেই তৃতীয় একজনের উপস্থিতি অনুভব করে দুজনেই তাকায়। ছেলেটাকে শৈলী না চিন্তে পারলেও মাহি হেসে দেয় ততক্ষণাত।
-আরে আবিদ ভাইয়া, কি খবর? কেমন আছো?
আবিদ নামক মানুষটা শৈলীর দিকে ক্ষণিক চোখ রেখেই আবার মাহিরার দিকে চায়। হেসে উত্তর দেয়,
-এইতো মাহি। ভালো আছি। তোমার কি অবস্থা? বাসায় আসোই না একদম।
– ভাইয়া, ভার্সিটির ক্লাস করতে করতেই সময় কোথায় চলে যাচ্ছে বুঝে পারছি না।
-হমম। এই সময়টা আসলেই টাফ্ যায়।
এইবার আবিদ সরাসরি তাকায় শৈলীর দিকে। মাহিরা তখন ওকে পরিচয় করায়,
– ভাইয়া, এটা আমার বান্ধবী, শৈলী। আর শৈলী এটা আমার কাজিন, আবিদ ভাইয়া, ডেইসি খালার ছেলে।
শৈলী স্মিত হাসি দিয়ে সালাম জানায়। আবিদও নেয় সেই উত্তর।
-আপনি মাহিরার সাথে পড়াশোনা করছেন?
-জ্বি।
– একই সাবজেক্ট?
– না। আমি সিএসসি নিয়ে পড়ছি।
– ও তাহলে তো, মিহরান ভাইয়া…
– জ্বী উনি আমাদের ডিপার্টমেন্টের ফ্যাকাল্টি।
-ও আচ্ছা।
হঠাৎ শৈলীর চোখ যায় সামনে। মিহরানকে এ পথেই আসতে দেখে মুখ নামায়। মিহরান এসে আবিদের পাশে দাড়াতেই আবিদ হাসি দেয়,
-আরে মিহরান ভাই যে। আপনাকে নিয়েই কথা হচ্ছিলো।
মিহরান সরাসরি তাকায় শৈলীর দিকে,
– ভালো কথা নিশ্চয়ই?
আবিদ শৈলীকে দেখায়
– ওনার সাথে আপনার ব্যাপারে কথা হচ্ছিলো। আপনি ওনার ডিপার্টমেন্টের ফ্যাকাল্টি, এটাই বলছিলেন তিনি।
– হমম? ফ্যাকাল্টি? ….ওওও…যাই হোক, ডিনার সার্ভ হয়ে গিয়েছে। মাহি সবাইকে খেতে আসার জন্য বল্।
এটা বলে শেষ বার শৈলীকে দেখে মিহরান চলে গেল। শৈলীর যেন তখন জানে পানি আসলো। উফ! লোকটার চাউনি ওকে বার বার খুন করে।
……………
আফিয়ার ফুফাতো বোন, ডেইসি থাকেন উত্তরায়। দুই ছেলে এক মেয়ে নিয়ে ভরপুর সংসার তার। বড় ছেলে আবিদ একটা মাল্টি ন্যাশনাল ব্যাংকে কর্মরত। চুপচাপ, রিসার্ভ থাকা এই ছেলেটাকে নিয়ে তার হয়েছে ভীষণ বিপদ। কোনো মেয়েই এই ছেলের পছন্দ হয় না। এদিকে বিয়ের বয়স যায় যায়, কিন্তু ছেলের কোন হেলদোল নেই। এটা বড় একটা জ্বালা না?
কিন্তু আজ একটা বিস্ময়কর ঘটনা ঘটেছে। প্রতিবারের মতন আজও ডেইসি আবিদকে বলে এসেছিলেন, যেহেতু তার পছন্দ করা কোনো মেয়েই আবিদের পছন্দ হচ্ছে না, তাই অনুষ্ঠানে আজ অনেক মেয়েই আসবে। তাদের মাঝ থেকে কোনো মেয়েকে একটুও ভালো লাগলে ওনাকে জানাতে। অন্তত কথা তো শুরু করা যাবে। প্রতিবারই বলেন, প্রতিবারই নিরাশ হন।
শুধু এইবার ছাড়া।
খাবারের জন্য সবার ডাকাডাকি শুনে ডেইসি উঠে এসেছিলেন নিজের আসন থেকে। হাটতে হাটতেই ওনার চোখ যায় নিজের ছেলের ওপর। এক অবিশ্বাস্য চিত্র তার চোখে আটকায়। আবিদ দুটা মেয়ের সাথে গল্প করছে। একটা তো মাহিরা, চেনাই যাচ্ছে। আরেকট মেয়ে কে? আর আবিদ সেই মেয়েটার সাথেই কথা বলছে সরাসরি। এটাও সম্ভব? তাও এতো হেসে হেসে? তখনই সেখানে মিহরান আসায় ডেইসি আর আবিদকে দেখতে পান না। তবে মনে রাখেন বিষয়টা।
………….
প্রোগ্রাম শেষ হতে হতে প্রায় এগারোটা বেজে গেছে। ঢাকার ভেতরেই যারা দূরের আত্মীয় তারা ইতিমধ্যেই প্রস্থান করেছেন।
মালিহা পরেছে এক বিশাল প্যাড়ায়। দুইটা একদমই পৃথক পথ সামলাতে হয়েছে ওকে। একদিকে যেখানে পরিবারের সকলের সাথে হেসে, খেলে, মজা করে সময়টা পার করেছে। সেখানেই তুরিনের অত্যাধিক মন খারাপ টাকে সামলাতে হয়েছে। মেয়েটা হঠাৎ এতো কষ্ট কেন পেল তা মালিহা বুঝতে পারছে না। জিজ্ঞেস করেওছিল কিন্তু তুরিন এখন বলতে নারাজ। বলেছে রাতে ফোনে সব জানাবে। মেয়েটা রাতে ডিনারো করেনি, না খেয়েই চলে গিয়েছে অনুষ্ঠানের মাঝ পথেই। মালিহার বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে মিহরানকে ঘিরেই কিছু একটা ঘটেছে। দীর্ঘশ্বাস ফেললো ও। তুরিনের জন্য খুব মায়া হলো।
তখনই ফোন বাজায় মালিহার মনোযোগ ছোটে। রায়হানের কল দেখে মুখে হাসি ফোটে। আজ বিকেলেই দুজনের মিটমাট হয়েছে। মালিহাই ফোন দিয়ে সমস্যা ঠিক করেছে। তারপর থেকে রায়হানের গদগদ ভালোবাসার শিকার হচ্ছে সে।
ওদিকে মালিহা যেখানে ভালোবাসার ঢেউয়ে ভাসছে সেখানে মাহিরাও নিজের প্রেমের সাগরের নৌকায় বিরাজমান। বৈঠা হাতে তন্ময় নামক মাঝি ওর পাশেই দাড়ানো। আশপাশে আত্মীদের ভীড়ে খুব একটা জমিয়ে গল্প করতে পারছে না দুজন তবে চোখে চোখেই প্রেম নিবেদন হচ্ছে নিরন্তর।
ঠিক সেই সময়ই শৈলীকে সামনে দিয়ে যেতে দেখে মাহিরা ডাক দেয়। নিজের আর তন্ময়ের ব্যাপারে শৈলীকে যদিও অনেক আগেই জানিয়েছিল মাহিরা, কিন্তু শৈলীকে তন্ময়ের সাথে ব্যক্তিগত ভাবে কখনো পরিচয় করানো হয়নি।
শৈলী মাহিরার ডাকে সাড়া দিয়ে কাছে আসে। ঠোটে সুন্দর একটা হাসি ছড়িয়ে তন্ময় সালাম দিতে উদ্যত হয়। উদ্দেশ্য দুজনকে সামনে পেয়েছে যখন, তাহলে একটু দুষ্টুমি করা। কিন্তু শৈলীর ইচ্ছায় গড়গড়িয়ে পানি পরে যায় যখন তন্ময় আগে সন্মোধন করে ওকে,
– আস্সালামুআলাইকুম ভাবি।
শৈলী থমকে যায়। মুহূর্তে রক্তিম আভা ছড়ায় গালে। ও ভুলেই গিয়েছিল মিহরান যে ওদের বিষয় টা তন্ময় কে বলেছিল। ঠোটে ঠোট টিপে কাছে আগায় শৈলী। দুষ্টুমি করার ইচ্ছা তল্পিতল্পা গুটিয়ে পগারপার।
– ওলাইকুমসালাম ভাইয়া। কেমন আছেন?
– আছি কোনমতে ভাবি। দেবরদের খোজ খবর তো রাখছেন না। তাই আর কি ভালো থাকি বলেন?
শৈলীর ঘাম ছুটে যাওয়ার মতন অবস্থা। এতোদিন শুধু মিহরানের দুষ্টুমিতেই ও অতিষ্ট ছিল। এখন ওর বন্ধুরাও শুরু করেছে। উফফ! কই লুকাবে ও?
মাহিরা শৈলীর অবস্থা বুঝে হেসে দেয়। ওর পাশে দাড়িয়ে এক পাশ দিয়ে জড়ায়। তারপর তন্ময়ের দিকে কপট রাগ দেখিয়ে বলে,
– এই, এইভাবে আমার ভাবিকে লজ্জা দিও না তো। দেখো কেমন লাল হয়ে গেছে মুখ।
শৈলী চোখ বড় বড় করে তাকায় মাহিরার দিকে,
– নিজের চেহারা দেখেছিস? তন্ময় ভাইয়া আসার পর থেকে তো চারশো চল্লিশ ভোল্টের আলো জ্বলছে সারা মুখে সেটার কি?
মাহিরা এভাবে ক্লিন বোল্ড হবে বুঝতে পারেনি। জল্দি নিজের মুখ শৈলীর পিছে লুকায় ও। শৈলী ততক্ষণে একটু স্বাভাবিক হয়েছে। তন্ময় সামনে দাড়িয়ে তখন হেসে বললো,
– মহম, আমাদের আড্ডার গাড়ি আগাচ্ছে না। একটা চাকা যে এখনো গায়েব। দাড়ান ভাবি, আপনার বরকে ডাকি।
বলেই তন্ময় ফোন দেয় মিহরানকে। ছাদেই আরেক পাশে এক চাচার সাথে কথা বলছিল মিহরান। তন্ময়ের ফোন পেয়ে কিছুক্ষণের মাঝেই হাজির হলো ওদের আড্ডায়। শৈলী কে দেখে নির্দ্বিধায় ওর পাশে যেয়েয় দাড়ালো। তন্ময় বন্ধুর কান্ড দেখে সাথে সাথে ফোরণ কাটে,
– হ্যা বন্ধু, এখন বউ পাইসো আমাদের তো আর চিনবা না। কিভাবে সোজা যেয়ে বউয়ের পাশে দাড়ালি। আমাকে কি চোখে দেখা যায় না?
মিহরানের বিলম্বহীন সাবলীল উত্তর,
– সুন্দর বউ থাকতে তোকে দেখবোই বা কেন?
বাকি তিনজন যেন হোচট খেয়ে থামে। এরকম সোজা সাপ্টা উত্তর আসা করেনি মিহরানের থেকে। তাও এরকম ভাবে শৈলীর প্রশংসা?
তন্ময় অবশ্য নিজেকে সামলেছে সবার আগে।
-তুই পারোস বন্ধু। হ্যাটস্ অফ টু ইউ। ইউ হ্যাভ ড্রাউন্ড ইন লাভ্।
মিহরান ঠোটে হাসে শুধু। আড়চোখে শৈলীকে দেখে। মেয়েটা নিজের মাঝেই বোধহয় হারিয়ে গিয়েছে, এতোটাই নির্বাক এখন ও। কিন্তু মিহরানের হাতের সাথে ওর কম্পিত হাতের ছোয়াই বলে দিচ্ছে মেয়েটার মনের ভেতর কোন ভূমিকম্প চলছে।
মিহরান তন্ময়ের দিকে তাকায়,
– ফোন দিলি যে?
– ভাবছিলাম একটু আড্ডা দিব, তাই। তোর ছাড়া আড্ডা জমছিলো না।
– এখন আড্ডার সময় নাই। কাজ আছে, তুইও চল।
বলেই গম্ভীল মিহরান বিভ্রান্ত তন্ময়কে নিয়ে ওখান থেকে চলে গেল। ওরা যেতেই মাহিরা ঝাপ্টে ধরে শৈলীকে।
-ওহ মাই গুডনেস বান্ধবী! আমার ভাই দেখি তোর ওপর পুরাই ফিদা। এই অল্প সময়ে কেমনে জাদু করলি রে?
শৈলী ঠোট চেঁপে হাসে। মানুষটা আস্তে আস্তে ওকে পাগল করে দিচ্ছে।
…………………
সেই সময় আড্ডার আসর ভঙ হলেও, রাতে একটা বড় আসর বসলো মিহরানের ঘরে। তবে সেটায় অংশগ্রহন করার অধিকার পেয়েছে শুধুই মেয়েরা। আরও নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে বলতে হয় তিন জোড়া বোন: মাহিরা, মালিহা, শৈলী, নিপুন আর ইতি,বিথী। ছয়জনের গল্প যেন আজ রাতে শেষ হওয়ার নয়, ইচ্ছাও অবশ্য নেই শেষ করার। আজ তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছে সারা রাত জাগবে। একেবারে ফজরের নামাজের পর ঘুমাবে।
রাত যত বাড়তে থাকে ওদের গল্পের বিষয়বস্তু নিমজ্জিত হয় ততই গহীনে। প্রথমে ইতি কে ঘিরে কথা শুরু হয়েছিল ওর বাগদান হয়ে গেছে, দু মাস পরে বিয়ে। সবার জোড়াজোড়িতে নিজের হবু বরের সাথের প্রেম কাহিনী শুনাতে হলো সবাইকে। ওকে লজ্জায় ডুবিয়ে বাকিরা হেসেই কুটিকুটি। সিনিওরিটি বেইজ করে এরপরে নাম আসলো মালিহার। ওর জীবনে কেউ নেই এই ধারনাই সবার, তবে আজ মাহিরা নিজের বোনকে জেকে ধরলো,
– আপু আজকে তুমি ছাড়া পাবা না। দেখ কেউ থাকলে বলে দাও।
– কি বলছিস উল্টাপাল্টা মাহি? কেউ নেই রে এমন?
– আমার মন বলছে আছে। আমি দেখেছি তোমাকে ফোনে বেশ কয়েকবার কারও সাথে কথা বলতে। তখন তোমার চেহারার রঙ পাল্টে যেতে লক্ষ করেছি বহুবার। বলো না, বলো না আপু। আমরা কসম দিচ্ছি কাউকে কিছু বলবো না, তোমার নিজের থেকে বড়দের না জানানো পর্যন্ত এই কথা আমাদের ছয় জনের মাঝেই থাকবে। প্রমিস প্রমিস বলো না…
মাহিরার সাথে একে একে বাকিরাও এক প্রকার জাপ্টে ধরলো মালিহাকে। শেষমেষ হাল ছেড়ে দিয়ে মালিহা সবার দিকে একে একে তাকালো,
– তোরা প্রমিস করছিস, কাউকে কিছু জানাবি না?
একসাথে পাঁচটা উত্তেজিত আওয়াজ শোনা যায়,
– প্রমিস।
মালিহা ধাতস্থ হয়। লজ্জায় ভরে ওঠে চোখ।
– আমার একজনের সাথে রিলেশন আছে। ওর নাম রায়হান।
চাঁপা চিৎকারে ভেসে যায় রুম। মাহিরা গর্ব করে বলে ওঠে,
– আমি জানতাম তোমার কেউ আছে। আচ্ছা বলো বলো, ভাইয়া কি করেন, তোমার সাথে পরিচয় কিভাবে?
– ওর পড়াশোনা শেষ। ওর বাবার বিজনেস আছে, সেটাই দেখে। আর আমার সাথে দেখা হয়েছিল ভার্সিটির এক বান্ধবীর মাধ্যমে।
এর পর মাহিরার জোড়াজোড়িতে মালিহাকে ওর প্রেম কাহিনী বিস্তারিত বলতে হয়। শোনার মাঝ দিয়ে দিয়ে একজনের হাসির আওয়াজ যেন পুরো ঘটনাটাকে আরো রোমাঞ্চকর করে তোলে।
মালিহা কথার মাঝে একটা দম নিতে গিয়েই ওকে এবার প্রশ্ন ছোড়ে শৈলী,
– আচ্ছা আপু, ভাইয়া তোমাকে প্রপোজ কিভাবে করলো বলো না?
মালিহা হাসে দৃষ্টি নামিয়ে। সেদিনটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে স্পষ্ট ভাবে,
– আমাকে একটা রেস্টুরেন্টে প্রপোস করেছিল ও। রেস্টুরেন্টের ছাদটা বুক করেছিল। আমি যেয়ে ডেকোরেশন দেখে অবাক। শেষে….ও হাটু গেড়ে বসে আমাকে প্রপোজ করেছিল পুরো একশোটা গোলাপ দিয়ে।
সবার চোখ বড় বড় হয়ে যায়,
– একশোটা গোলাপ?
-হমমম।
মাহিরা সামনে যেয়ে নিজের বোনকে জড়িয়ে ধরলো।
– কনগ্র্যাট্স আপু। ভাইয়া মনে হচ্ছে তোমাকে অনেক পছন্দ করেন। আই এ্যাম সো হ্যাপি ফর ইউ।
ইতি পাশ থেকে প্রশ্ন তোলে,
– তো মালিহা? বিয়ের দাওয়াত পাচ্ছি কবে? বাসায় কবে জানাবা?
মালিহার মুখটা এইখানে একটু ছোটো হয়ে যায়,
– আসলে আমরা জানাতেই চাচ্ছি। সমস্যা হলো ওর বাবা দেশের বাইরে ছিলেন বেশ কিছুদিন। তখন জানাতে পারেনি। এখন উনি ফিরেছেন তবে এসেই অসুস্থ হয়ে পরেছেন। একটু সুস্থ হলেই ও বলেছে জানাবে। তারপর আমি আব্বু আম্মুকে বলবো।
হইহই লেগে যায় পুরো রুমটাতে। মালিহার খবরটাই হজম হতে সারা রাত লাগবে বোঝাই যাচ্ছে তাই আর কারো দিকে আগায় না ওদের আড্ডা। মাহিরা আর শৈলী এক দিক থেকে হাফ ছেড়ে বাঁচে। নিজেদের টার্ন আসলে কি বলতো কে জানে?
………………
পরদিন ছিল রবিবার। আজ বাসায় তেমন কাজ নেই তাও মেহমান যেহেতু প্রচুর তাই মালিহা, মাহিরা আর মেহরাব ভার্সিটি যাওয়া পারমিশন পেল না। ওরাও খুশি মনে রয়ে গেল। বোরিং লেকচার্স শোনার থেকে কাজিনদের সাথে আড্ডা দেওয়া ঢের ভালো।
তবে মিহরানের ছুটি নেই। মাত্রই এক মাস হলো জয়েন করেছে, এখনই ছুটি চাইতে ভীষণ গায়ে লাগছিল ওর। তাই চায়নি। ওদিকে শৈলীর তো ভার্সিটি যেতেই হবে। প্রোগ্রাম তো ওর বাড়ির না, তো ও কোন খুশিতে ভার্সিটি যাবে না, এই যুক্তি দেখিয়ে ওর মা ওকে পাঠাচ্ছে। শৈলী তখন ভেতর ভেতর হেসেছে,
আসলেই ওর বাড়ির প্রোগ্রাম না এটা?
মিহরানের রুমে রেডি হতে হতে শৈলী কয়েকবার চেক করেছে ফোন। নাহ্ মিহরানের কল্ আসেনি। এতোক্ষণের হাসিটা মুখ থেকে মুছে গিয়েছে। তখনই রুমে ঢোকে মাহিরা,
-কি রে? তুই এখনো বের হোসনি? ভাইয়া নিচে ওয়েট করছে তো তোর জন্য?
শৈলী নিচের ঠোট বের করে উদাসীন নয়নে তাকায়। মাহিরা তা দেখে উদ্বিগ্ন হয়ে কাছে আসে,
– কি হয়েছে রে শৈলী? এরকম মন খারাপ কেন তোর?
– তোর ভাইয়া ভীষণ রাগ করে আছে আমার ওপর।
মাহিরা অবাক হয়,
– কি বলিস? কেন রাগ করসে?
– আসলে…দোষ আমারই।
– কি করসিশ তুই?
শৈলী স্বাস ছাড়ে,
– আসলে গতকাল রাতে তোর ভাইয়া বলেছিল, একটার পরে সাত তলার ছাদে আসতে। কিন্তু আমাদের গল্প আড্ডার মাঝে আমি সিরিয়সলি ভুলে গিয়েছিলাম বিষয়টা। সারাদিনের দৌড়াদৌড়িতে ফোনটাও চার্জে দিতে পারিনি, সেটাও বন্ধ হয়ে পরেছিল।
ঘুমানোর সময় ফোন চার্যে দিয়ে দেখি সতেরো টা ম্যাসেজ আর একুশবার কল দিয়েছেন উনি। আমি হন্তদন্ত হয়ে ফোন দিলাম, রিং হলো কিন্তু উনি ওপাশ থেকে কেটে দিলেন। এরপর যতবারই ফোন দিয়েছি একই কাজ করেছেন তিনি। বারবার লাইন কেটে দিয়েছেন। ম্যাসেজ করেছি, সেটার রিপ্লাইও দেননি। ভীষণ রেগে আছেন বোঝাই যাচ্ছে।
মাহিরা হঠাৎ ঘর কাঁপিয়ে হেসে উঠলো।
– ওওও, তাহলে এই সব ঘটসে? তাই তো বলি, তোকে নিচে নামতে বলার জন্য ভাইয়া আমাকে কেন ফোন করেছেন। এখন বুঝলাম।
শৈলী অসহায় চোখে তাকায়,
– আমি এখন কি করি বলতো মাহি?
মাহিরা দুই ঘাড় উঁচু করে। কেয়ার না করার ভাব নিয়ে বলে,
– তোর স্বামী তোর ওপর রাগ করসে। এখন তাকে কিভাবে মানাবি সেটা আমি কি জানি? আহারে আমার ভাইটা! নিজের বউ কে কাছে পাওয়ার জন্য গতকাল রাতে না জানি কতোক্ষণ অপেক্ষা করসে। এখন রাগ তো করবেই।
শৈলী চোখ গরম করে,
– তুই একটা কুটনি ননদ বুঝলি মাহি।
মাহি হেসে ফেলে আবার,
– শোনেন ভাবিজান। স্বামীদের রাগ বেশিক্ষণ থাকে না। তবে স্ত্রীদের রাগ কমানোর টেকনিক জানতে হয়, তবেই তারা সফল হয়। একা যাচ্ছিস দুজন আবার একসাথেই ফিরবি। এইটুকু সময়ে ভাইয়ার রাগটা ভাঙ্গিয়ে ফেলিস। এটাই সুযোগ বুঝলি?
-কিভাবে ভাঙ্গাবো?
– সেটা আসলেই আমি বলতে পারবো না। তবে তুই নিজেই বুঝে যাবি আই এ্যাম শিওর। এবার আর ভাইয়ের রাগ না বাড়িয়ে বের হ। যা নিচে।
আল্লাহ্ র নাম নিয়ে শৈলীও বের হয়। আজ কি আছে কপালে ওর কে জানে? পারবে তো স্বামীর অভিমান ভাঙতে? হবে তো সফল?
চলবে।