#পরিণয়_প্রহেলিকা
#লেখিকা_সিনথীয়া
#পর্ব_৪৪
– শৈলীর আব্বু, আমি মিহরান আর শৈলীর বিয়ে মানি না। এই বিয়ে ভেঙে দাও।
শৈলী নিজের দরজার সামনেই থমকে দাড়ায়। পাথুরে রূপ ধারণ করে তক্ষণই। নিজেও বুঝে না চোখের মাঝ দিয়ে বেয়ে যাওয়া চিকন বারিধারা আগমন।
নিপুন মাত্র বাসায় ঢুকেছে। মায়ের কথাটা কানে পৌছাতেই ও নিজেই আটকে গেল সদর দরজার কাছে। একবার মা বাবা এবং তার পেছনে বোনকে দেখে আঁতকে ওঠে ও। কিছুক্ষণ আগেই না সব ভালো দেখে গেল? এই এক দেড় ঘন্টার মাঝে কি থেকে কি হলো? কিছুই তো বোঝা যাচ্ছে না।
আজাদ সাহেব বাসায় এসেই স্ত্রীকে অস্থির দেখছিলেন। কিন্তু কিছু জিজ্ঞেস করায় ঠিকঠাক ভাবে উত্তর পাচ্ছিলেন না। বারবার রেহানা বলছিলেন, আগে শৈলীর সাথে কিছু কথা আছে। সেটা হয়ে যাওয়ার পর তিনি আজাদের সাথে কথা বলবেন।
এখন যখন স্ত্রীর মুখে এতো বড় এবং অনাকাঙ্ক্ষিত একটা সিদ্ধান্ত শুনলেন, আজাদ থম মেরে দাড়িয়ে পরলেন কতোক্ষণ। মোটামোটি বাসার সবাই তখন স্তব্ধ। কিন্তু আজাদ সাহেবই আবার প্রথম ব্যক্তি যিনি বিষয়টা সবচাইতে প্রথমে সামলে নিলেন।
– নিপুন আম্মু, তোমার আপিকে নিয়ে ভেতরে যাও তো? আমি তোমার আম্মুর সাথে কথা বলে আসছি।
নিপুন বাবার ইশারা সাথে সাথে বুঝেই শৈলীর কাছে দৌড় লাগালো। ওর কাধে হাত দিয়ে, ঘোরে থাকা শৈলীকে ঘুরিয়ে রুমে নিয়ে গেল।
এদিকে আজাদ সাহেব রেহানাকেও ঠিক একই নিজের কাছে টেনে আনলেন,
– রেহানা, রুমে চলো। ঠান্ডা মাথায় কথা বলি। চলো।
রেহানা তখন অঝোরে কাঁদছেন। কিন্তু স্বামীর কথা অমান্য করলেন না।
রুমে এনে আজাদ সাহেব প্রথমে রেহানাকে খাটে বসালেন। বেড সাইড টেবিল থেকে গ্লাসের ঢাকনা সরিয়ে পানি আগিয়ে দিলেন। রেহানা পানিটা খেতে খেতেই আজাদ যেয়ে দরজাটা লাগিয়ে আসলেন। তারপর আস্তে ধীরে বসলেন নিজের স্ত্রীর পাশে।
– তুমি ঠিক আছো?
ফোফাতে ফোফাতে রেহানা হালকা মাথা ঝাকালেন। আজাদ সাহেব বললেন,
– এবার বলো কি হয়েছে। কি এমন হলো যে তুমি এরকম একটি সিদ্ধান্তে পৌছালে?
রেহানা একটা দীর্ঘ দম নেন। তারপর সবকিছু খুলে বলেন। গতকাল আফিয়ার অভিব্যক্তি, সেটা দেখে সারা রাত ওনার নিজের চিন্তা এবং সব শেষে আকলিমার থেকে শোনা সব ঘটনা, সব কিছুই বিস্তারিত জানালেন স্বামীকে।
সব শুনে আজাদ সাহেবের ভ্রু জোড়া কুচকে গেল।
– আফিয়া ভাবির চেহারা আমিও গতকাল খেয়াল করেছিলাম। বিষয়টা আমাকেও খটকা দিয়েছিল। কিন্তু আকলিমার….কথা নিয়ে তোমার এতোটা….রিয়্যাক্ট করা….আই মিন আমরা তো জানিও না আসলে কি হয়েছে ওখানে। বুয়ারা তো এমনিতেই কথা ছড়াতে ওস্তাদ, ওদের কথা আমলে আনাটা আমার মনে হয় ঠিক না রেহানা।
রেহানা স্বামীর হাত ধরে তার দিকে ফিরে তাকালেন,
– আমি আকলিমার কথায় এই সিদ্ধান্ত নেই নি শৈলীর আব্বু। আমি অনেক কিছু ভেবে এই কথা মুখ থেকে উচ্চারণ করেছি, নয়তো তোমার কি মনে হয়, আমার এতো স্বচ্ছ একটা মেয়ের গায়ে আমি এমনি এমনিই ডিভোর্সের তকমা লাগিয়ে দিতে উদ্যত হবো? আমাকে কি এতোটাই নির্দয়ই মনে হয় তোমার?
আজাদ তখন স্ত্রীর দিকে স্থীর চোখে তাকান। একটু সময় নিয়ে রেহানা আবার শুরু করেন,
– একজন স্ত্রী বা একজন মা হওয়ার আগে আমি একজন নারী শৈলীর আব্বু। সেটা আমার প্রথম স্বত্বা। তাই একজন নারীর সন্মানকে আমি অনেক বেশী প্রধান্য দেই। রুপকথার গল্পে হ্যাপিলি এভার আফ্টার শব্দটা থাকলেও বাস্তব এতোটা সহজ না। বিশেষ করে নারীদের জন্য তো আরও না। যেখানে মেয়েরা সমাজের সব নিয়ম মেনেও কারো ঘরের বউ হয়ে নিজেদের প্রাপ্য সন্মান পায় না, কারণে অকারণে নির্যাতিত হয়, সেখানে আমাদের শৈলীর সম্পর্কটাতো সামাজিক ভাবে বাধেই নি। ওর সন্মানের কি হবে একবার ভেবে দেখেছো তুমি?
রেহানা থামলেন। এক দম নিয়ে আবার বললেন,
– আমি মা, সেটা মেয়ের হই বা ছেলের। যেকোনো মায়ের মন বোঝা আমার জন্য কঠিন কিছু না। ছেলেমেয়েরা আজকাল নিজে থেকে পছন্দ করে বিয়ে করে, এই বিষয়টাই যেখানে বুকে পাথর বেধে আমাদের কখনো কখনো মানতে হয়, সেখানে একটা পরিস্থিতির চাপের বিয়েটাকে মানা কি এতোই সহজ? হ্যা, আমি মেনেছিলাম। কারণ আমার মিহরানকে ভালো লেগেছে। ওর শৈলীর প্রতি দায়িত্ববোধ আমাকে আকৃষ্ট করেছে। কিন্তু আফিয়া ভাবি? ভাবি কতোটুকু মানতে পারবেন বিষয়টা এটা কি ভেবে দেখেছো? উনি তো হয়তো এটাই মনে করছেন যে তার ছেলে দায়িত্ববোধের বেড়াজালে বেঁধে গিয়ে নিজের জীবন বিসর্জন দিচ্ছে। উনি এটা ভাবলে অবাক হওয়ার কিছু নেইও কিন্তু দেখ। কারণ শৈলী আর মিহরান তো একে অপরকে পছন্দ করে না। ওদের মাঝে তো ভালোবাসার কোনো সম্পর্ক নেই যে সেই টানে তারা বিয়ে করেছে। ওদের মাঝে যা এখন আছে তা শুধুই সামাজিক একটা শিকল আর কিছুই না।
আজাদ সাহেব স্ত্রীর প্রতিটা শব্দ মন দিয়ে শুনেন। রেহানা তখনো কথা বলছেন,
– আর সবচাইতে বড় বিষয়। মিহরান ও শৈলী। দুজনই যুবক যুবতি, জীবনের হালখাতা খুলবে বলে। এই সময়টায় সবকিছুই অনেক সুন্দর থাকে, রঙ্গিন লাগে। মিহরান আজ একজন ভালো মানুষের পরিচয় দিয়ে শৈলীর দায়িত্ব নিচ্ছে। শৈলীও হয়তো এই আবেগে ভেসে মিহরানের হাত ধরবে। কিন্তু একবার যখন আসল সংসার শুরু হবে, প্রতিনিয়ত একে অপরের সাথে থাকা লাগবে, সঙ্গ দেওয়া লাগবে, তখন যদি একে অপরের কাছে ওরা পছন্দের মানুষ না হয়ে উঠতে পারে তখন? একে অপরকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন যদি না করতে পারে? তার সাথে পরিবারের বিষয় টাতো আছেই। মা যেখানে রাজি না, খুশি না এই সম্পর্কে, সেখানে মিহরান ছেলে হিসেবে কতদূর অবাধ্য হবে? সমাজের চাপ তো আলাদা আছেই। এতো প্রশার না নিতে পেরে এক সময় মিহরান যদি আমার মেয়ের হাত ছেড়ে দেয়? বলে দেয় এই চাপের বিয়ে ও মানে না, তখন? তখন আমার মেয়ের সন্মান টা কই যেয়ে ঠেকবে শৈলীর আব্বু? বলো না?
আজাদ সাহেব স্ত্রীর প্রশ্নে থমকে যান। কি উত্তর দিবেন বুঝতে পারেন না। সত্যিই এই ভাবে চিন্তাগুলো তার মাথায় আসেনি। বাবা তো! বাবাদের বোধহয় এভাবে চিন্তা করার ক্ষমতা বিধাতাই দিয়ে পাঠাননি। এসব ভাবনা শুধু মা জাতিই করতে পারে। আর তাই তো মায়েদের মর্যাদা অনেক ওপরে।
রেহানা কঠোর কন্ঠে নিজের ইতি কথা টানলেন,
-আমি জীবিত থাকতে আমার মেয়ের কোনো প্রকার সন্মানহানি হোক তা চাই না শৈলীর আব্বু। লোকে এসে বলবে আমার মেয়ে ফুশলিয়ে ফাশলিয়ে মিহরানকে বিয়ে করেছে, আর আমি তা শুনবো, সেটা কখনোই সম্ভব না। তাই প্রথম পদক্ষেপ টা আমাদেরই নেওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। আর এমনিতেও আকলিমার মুখে যা শুনলাম তা যদি সত্যি হয় তাহলে তারাই হয়তো এই সম্পর্ক নিয়ে দ্বিতীয়বার চিন্তা করবে। তারা মুখ খোলার আগে তুমি ওনাদের মানা করে দাও শৈলীর আব্বু। প্লিস।
এরপর রেহানা একদম চুপ হয়ে যান। তার সাথেসাথে পুরো রুমটাও ডুবে যায় নিস্তব্ধতায়। এতোটাই চুপচাপ পরিবেশ যে ঘড়িতে সেকেন্ডের কাটা টাও বাজার শব্দ স্পষ্ট পাওয়া যায়। এভাবে চলে হয়তো পুরো দশ মিনিট। এরপর আজাদ সাহেব মুখ খোলেন। শান্ত কোমল কন্ঠে আওয়াজ তোলেন,
– আমি দেখি বিষয়টা নিয়ে কি করা যায়। বাবুল ভাইয়ের সাথে বৈঠকে বসা জরুরী। তবে আজ মনে হয় ওনাদের বাসায় গেস্ট আছে। আজ কথা বলা যাবে না।
রেহানা আবার বিচলিত হন,
– কিন্তু, ওনারা যদি আগে কোনো ডিসিশ…
– আহ্ রেহানা! আমি তোমার ভয়টা বুঝতে পারছি, কিন্তু সবকিছু সবসময় আমাদের হাতে থাকে না। চাইলেই করা যায় না। আল্লাহ্ এর ওপর ছেড়ে দাও। দেখো উনি কি করেন। আর আমি তো কথা বলবোই।
রেহানা একটু স্বস্তি বোধ করেন এই মুহূর্তে। সারাদিনের এতো স্ট্রেস তাকে ভীষণ ভাবে ক্লান্ত করে তোলে। আজাদ স্ত্রীকে শুইয়ে দেন খাটে। তারপর রুমের আলো নিভিয়ে বের হয়ে যান।
…………………………
মিহরান গাড়ি পার্ক করতে গিয়েই ছোট খালাদের গাড়ি দেখতে পেল। বড় ফুফুও এসেছেন, ওনার গাড়ি দেখেই বোঝা যাচ্ছে। ও জানতো আজ সবাই আসবে দেখে দ্রুত নিজের এ্যাপার্টমেন্টে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিচে নামলো বাবার বাসায়।
দরজা দিয়ে ঢুকতে গিয়েই বেশ আওয়াজ শুনতে পেল মিহরান। ড্রয়িং রুম থেকে বেশ উত্তপ্ত শব্দের আদান প্রদান শুনে কপাল কুচকে গেল ওর। একটু সামনে এগোতেই দেখে মালিহা, মাহিরা আর মেহরাব সিড়ির দোড়গোড়ায় দাড়িয়ে ভেতরের সব কথা কান পেতে শুনছে। মিহরানকে দেখে ওরা তিনজনই একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেল। এক এক জনের মলিন মুখটা দেখে মিহরান আরও অবাক হয়। তবে ওদের সাথে কোনো কথায় যায় না। নিঃশব্দে ড্রয়িং রুমের দিকে আগাতে আগাতেই কিছু কথা ওর কানে বাধে।
– তারপরেও ভাইজান আমি মানতে পারছি না আপনার কথা। কি এমন হয়ে গেল যে এই বিয়ে একদম মানতেই হবে? না কোনো বড়দের মতামত, না কোনো আচার আচারিতা, একটা কাবিন নামা দেখালো আর হয়ে গেল? ঐ সময়টায় আসলে কি হয়েছিল আমরা কেউ দেখিনি। কি গ্যারান্টি আছে যে মেয়েটা অভিনয় করে আমাদের মিহরানকে ফাসায় নি? এরকম বড়লোক ঘরের ছেলেদেরকে টোপে ফেলতে ওস্তাদ আছে অনেক মেয়ে। এতোগুলো ফ্ল্যাটের মালিক তার সাথে…..
নিশাত কথা শেষ করতে পারেন না। বাবুল সাহেবের চোখ অনুসরণ করে পেছনে তাকান। মিহরানকে পর্দার পাশে দাড়িয়ে থাকতে দেখে হকচকিয়ে উঠেন তিনি। আরও বেশী মিইয়ে যান ওর শক্ত চোয়ালে বসানো কঠোর মুখটা দেখে। চোখের শীতল দৃষ্টি স্পষ্ট জানান দিচ্ছে ওর ক্ষোভের পারা কোথায় ওঠানো।
নিশাত তাড়াতাড়ি চোখ সরান। তার এই ভাতিজা টা অন্য সবার থেকে আলাদা। অতিরিক্ত রাগী আর একরোখা স্বভাবের। ওর সামনে কোন কথা বলাই দায়।
মিহরান কোনো কথা না বলে নিঃশব্দে রুমে পা রাখলো। উত্তেজিত মাহিবের পাশে যেয়ে চুপচাপ বসলো। সবাই ওর দিকেই তাকানো। একবার সবার দিকে চেয়ে শুধু একটা বাক্য উচ্চারণ করলো,
– এতো হইচই কিসের? কোনো সমস্যা?
ব্যাস! সাথে সাথে সবার মুখে কুলুপ এটে গেল। এতোক্ষণের হইচই যেন তল্পিতল্পা গুটিয়ে পালালো। মিহরান বড় ভাইয়ের দিকে শান্ত চোখে দেখলো একবার। বোঝাই যাচ্ছে মাহিব এতোক্ষণ বেশ উত্তেজিত ছিল। রাগে মুখ কালো হয় গিয়েছে ওর। মিহরান কিছু বললো না, সরাসরি তাকালো নিশাতের দিকে,
– ফুফু, তুমি মনে হয় কিছু বলছিলা। আমি আসাতে থেমে গেলা কেন? বলো না।
নিশাতের ভেতর ভেতর ঘাম ছোটে। সারসে পুরা! এই ছেলে ওনাকে কেঁচকে ধরেছে। নিশাত তাও বুকে সাহস নিয়ে কথা যোগায়,
– ওই আব্বু বলছিলাম কি, তোর…আর…ওই মেয়েটার বিয়ে…
– ওই মেয়েটার নাম শৈলী ফুফু।
মিহরানের কাঁচের মতন কন্ঠে নিশাত ঢোক গেলে। মিহরান প্রশ্ন আবার করে,
– হ্যা আমার আর শৈলীর বিয়ে নিয়ে কি বলছিলা?
নিশাত দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। বেশ বিরক্ত হয়। এই দুই দিন আগে জন্ম নেওয়া ছোকরাকে এতো ভয় পাওয়ার কি আছে? নিশাত এবার সরাসরি তাকান,
– দেখ মিহরান, তোর আর ঐ শৈলীর বিয়ে আমরা মানতে পারছি না। এই বিয়ে তোর ভেঙে দেওয়া উচিত।
রুমে বসা বাকি বড়রা একটু অপ্রস্তুত হয়ে পরলেন। এমনকি মাহিবের চোখেও কিছুটা ভয় দেখা দিল। ও মিহরানের দিকে তাকায়, ভাবলেশহীন চেহারা দেখে নিজের অনুজের।
মিহরান একটুও থমকায় না,
– কেন ভাঙতে হবে? এখানে বিয়ে না মানার কি আছে?
নিশাত তখন পুরোই উত্তেজিত মেজাজে,
– না মানার কি আছে মানে? এটা কোনো বিয়ে হলো নাকি? এরকম ফিল্মি বিয়ে আমাদের পরিবারে আগে হয়নি। সমাজ বলে একটা কথা আছে মিহরান। আমাদের পরিবারের একটা নাম আছে। সেই পরিবারে এই কান্ড শুনলে মানুষ কি বলবে? সবাই ছি: ছি: করবে। আমরা মুখ দেখানোর জায়গা পাবো না আব্বা।
মিহরান এবার একটু নড়চড়ে বসে,
– তোমার কথাটা ঠিক বুঝতে পারলাম না ফুফু। যা বলার সরাসরি বলো।
নিশাতের রাগে পারা বাড়তে থাকে। ওর পাশে বসা আফিয়ার ছোট বোন তখন মুখ খোলে,
– মিহরান, তোর ফুফু যা বলেছে একদম ঠিক বলেছে। আমিও ওর সাথে একমত। সমাজ এই ধরনের বিয়েকে কখনো মেনে নেয় না বাবা। মেয়েটা নাকি কোথায় বন্দি ছিল, সেখান থেকে তুই উদ্ধার করেছিস শুনলাম। না জানি মেয়েটার সাথে আগে কি হয়েছিল….
– কি হয়েছিল মানে খালা? কি বলতে চাও তুমি?
মিহরানের উদ্যত আওয়াজে একটু চমকে ওঠেন ঐশ্বর্যের মা।
– ননা মানে বলতে চাচ্ছি এভাবে কোনো মেয়ে তো কোথাও আটকে যায় না, তাই না? নিশ্চয়ই কোনো সমস্যা হয়েছিল আগে। কারো সাথে কোনো কিছু থাকতেও তো পারে ওর। এসব উল্টোপাল্টা মেয়েদের কে নিজেদের পরিবারের বউ বানানো কতোটা যুক্তিসঙ্গত বল্?
মিহরানের হাত ততক্ষণে মুষ্টিবদ্ধ হয়ে গিয়েছে। এতোক্ষণ নিজেকে কোনোমতে সামলাতে পারলেও এখন ওর চেহারায় স্পষ্ট ফুটে উঠছে রাগের রেখা। কপালের রগ্ গুলো দপ্ দপ্ করে জ্বলছে। উচিত একটা উত্তর বের করতে যাবে তার আগেই পাশ থেকে শুনতে পেল মাহিবের কঠিন কন্ঠস্বর,
-খালামণি, একটু বুঝে শুনে কথা বইলো। মেয়ে কিন্তু তোমার ঘরেও আছে। আজ না জেনে না বুঝে শৈলীকে যেখানে দাড় করাচ্ছো, কাল তোমার মেয়েও ওখানে দাড়াতে পারে। তখন কি বলবা, হ্যা?
আসিয়ার চোখ বের হয়ে আসার জোগাড়। ঐশ্বর্যর চেহারা ততক্ষণাত মনে পরতেই রীতিমতো কাঁপুনি ওঠে তার পুরো বদনে। নিমিষেই চুপটি মেরে যান তিনি।
এদিকে বাবুল সাহেব আর আফিয়া সব দেখছেন, সব শুনছেন কিন্তু কিছুই বলছেন না। বাবুল সাহেব বলার সুযোগ পাচ্ছেন না। এতোক্ষণ অনেক কিছু বোন আর শালিকাকে বুঝিয়েছেন কিন্তু লাভের খাতায় পরেছে বড় একটা শুন্য। ওনার বড় বোন যদিও চুপ করে আছেন, তবে বোঝা যাচ্ছে না উনি রাজি কি না।
আর আফিয়া এতোক্ষণ চুপ ছিলেন ইচ্ছা করেই। গতকাল রাতে স্বামীর কথায় নিজ থেকে পুরোপুরি শৈলীকে মেনে নিলেও, দুপুরের পর আসা ছোট বোন আর ননদ তার কিছুটা হলেও ব্রেইন ওয়াশ করতে সক্ষম হয়েছেন। প্রথম দিকে আফিয়া ওদেরকে বুঝানোর চেষ্টা করেছিলেন নিজের মতন করে, কিন্তু একটা জায়গায় যেয়ে তিনি আটকে যান, যখন তার ছোট বোন তার সামনে কয়েকটি প্রশ্ন রাখেন,
– দেখো আপা, তোমার সব কথা মানলাম। মেয়ে ভালো, পরিবার ভালো, মিহরান নিজেই দায়িত্ব নিয়েছে সব কিছুর। সব ঠিকাছে। কিন্তু এগুলা সব বর্তমান আপা। ভবিষ্যত না। মনে রাখো এই মেয়েকে মিহরান পছন্দ করে বিয়ে করেনি।চাপে বিয়ে করসে। কাল যদি এই মেয়ের থেকে ও মুখ ফিরায় নেয় তখন কি করবা তুমি? তোমার মেঝ ছেলেকে তুমি চেনো না? যেই একরোখা স্বভাবের ও, পারবা এই সম্পর্কে ওকে ফিরায় নিয়ে আসতে ? তাই তখন যেই ডাভোর্সটা হবে সেটা এখন হয়ে যাওয়া ভালো না? এখন তো লোকজন জানেও না বিষয়টা, চুপিচুপি সব সেরে ফেলা যাবে। নয়তো পরে সমাজেও আসা যাওয়া করা যাবে না আপা।
এই কথাগুলো আফিয়াকে ভীষণ ভাবনায় ফেলেছে। আগেও চিন্তা করেছিলেন এটা নিয়ে, তবে স্বামীর কথা তখন যুক্তিসঙ্গত লেগেছিল কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সত্যি মিহরান যদি শেষ পর্যন্ত মেনে না নেয় এই বিয়ে? ছেলেটার জীবনটাও যাবে সাথে মেয়েটার গায়েও দাগ লাগবে। সবকিছু চিন্তা করে পুরো আউলিয়ে গিয়েছেন আফিয়া। ঠিকঠাক কিছুই সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না।
হঠাৎ মাহিবের আওয়াজে এইসব ভাবনা থেকে তিনি বের হয়ে এসেছিলেন। বড় ছেলে তার বোনের সাথে এমন ভাবে কথা বলছে দেখে রেগে ফুসে উঠলেন আফিয়া,
– মাহিব, এতো বড় হয়ে গেছিস তাও বড়দের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় শিখিসনি? খালার সাথে কেউ এই টোনে কথা বলে?
– মা, তুমি আমার কথাটাই শুনলা? খালামনি কিভাবে শৈলীকে অপমান করছেন সেটা দেখলা না? আমাদের ঘরের বৌ সেই মেয়ে।
– হ্যা, আজ বৌ সে ঠিক আছে। তবে কালও থাকবে তুই এই গ্যারান্টি কিভাবে দিতে পারিস?
এই বলে তব্দা খাওয়া মাহিবের থেকে মিহরানের নিরেট শক্ত চেহারায় চোখ রাখেন আফিয়া,
– তোকে আমি সরাসরি প্রশ্ন করছি মিহরান। আজ যেই মেয়েকে নিজের স্ত্রীর মর্জাদা দিতে গিয়ে তুই তোর খালা ফুফুদের সাথে তর্কে নেমেছিস, সেই সম্পর্ককে টিকিয়ে রাখার গ্যারান্টি আছে তোর কাছে? তোদের বিয়েটা, না লাভ ম্যারেজ, না এ্যারেঞ্জ ম্যারেজ। কোনো নামই নেই যেই সম্পর্কের সেটার স্থায়িত্ব তুই কিভাবে আশা করিস? শৈলীকে তুই পছন্দ পর্যন্ত করিস না সেখা…..
-কে বলেছে আমি শৈলীকে পছন্দ করি না আম্মু?
আফিয়া নিজের কথার মাঝেই হোচট খান। চোখ বড়বড় করে তাকান ছেলের দিকে। মিহরান এখন তার দিকে সোজা তাকানো,
– তোমাকে কে বলেছে আমি শৈলীকে পছন্দ করি না?
আফিয়া ছেলেকে বোঝানোর চেষ্টা করেন,
– আমরা এই পছন্দের কথা বলছি না আব্বু। বিয়ের পর প্রথম প্রথম আবেগের ভরে পছন্দ চলেই আসে।
– আমি শৈলীকে বিয়ের পর পছন্দ করি নি আম্মু। বিয়ের অনেক আগ থেকেই আমি শৈলীকে পছন্দ করে রেখেছিলাম। সেই রাতের ঘটনা না ঘটলেও আমি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম তোমাদের কাছে শৈলীর ব্যাপারে আমি কথা বলবো। বিয়ে যেভাবেই হোক, আম্মু, শৈলীকেই আমি আমার জীবনসঙ্গীনী হিসেবে চেয়েছি। এবং তাকেই পেয়েছি। তাই এই সম্পর্কটাকে নিয়ে আমার এক বিন্দুও সন্দেহ নেই। এবং তুমি জানো আমি আমার কথায় কখনো হেরফের করি না।
এবার মিহরান স্তব্ধ হয়ে যাওয়া আফিয়ার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে তা নিবদ্ধ করে সামনে বসা ওর খালা আর ফুফুর দিকে। গা হিম করা শীতল কন্ঠে বাক্যগুলো উচ্চারণ করে ও,
– এতোক্ষণ আপনারা বলেছেন, আমি আপনাদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ দেখিয়ে চুপ থেকেছি, কিছু বলিনি। তবে এখন আমি কিছু কথা বলবো।
মিহরানের এক দম শ্বাস নেওয়াটা যেন নিশাত আর আসিয়ার গলায় আটকায়,
-শৈলী বৈধ রুপে আমার স্ত্রী এবং ওকে আমি সম্পূর্ণ ভাবে গ্রহন করেছি। ওর ভুত ও বর্তমান আমার জানা আছে। সেই রাতে ওর সাথে কি হয়েছিলো এবং কি হতে পারতো সেগুলোর ব্যাপারেও আমি অবগত। তাই পৃথিবী অথবা সমাজ কে কি বললো, তা নিয়ে আমার মাথা ব্যাথা নেই। আজ ওর পাশে আমি যেভাবে দাড়িয়েছি ভবিষ্যতেও সেভাবেই থাকবো ইনশাআল্লাহ। এই নিয়ে কাউকেই চিন্তা করতে হবে না। তাই আপনারা অহেতুক এইসব আলোচনায় বসবেন না।
অবশেষে মিহরান তাকায় ওর বাবার দিকে। বাবুল সাহেবের চেহারা থেকে ঠিকরে বের হয়ে আসা গর্বিত হাসিটা দেখে কোমল স্বরে ডাক দেয় ও,
– বাবা, সবাইকে বিয়ের আলোচনা করার জন্য ডেকেছো, সেটা করে নিজের ঘরের মেঝ বউকে বরণ করার প্রস্ততি নাও।
মুখ থেকে আর একটা বাক্যও না উচ্চারণ করে মিহরান হলরুম ছেড়ে বের হয়ে গেল। পেছনে রেখে গেল একদম শীতল এক পরিবেশ।
চলবে।