পরিণয়_প্রহেলিকা #লেখিকা_সিনথীয়া #পর্ব_৪৮

0
977

#পরিণয়_প্রহেলিকা
#লেখিকা_সিনথীয়া
#পর্ব_৪৮

রাতেই ছোটখাটো এক আয়োজনের মাধ‍্যমে পারিবারিক ভাবে প্রথম ধাপ পূরণ করলো মিহরান-শৈলী। আফিয়া মজা করে শৈলীকে নিয়ে যাওয়ার কথা বললেও, বিয়ের কাজ দ্রুত সম্পন্ন করার ব‍্যাপারে বড়দের মাঝে কোনো হেয়ালিপনা দেখা দিল না। বরং এই চিন্তাকেই বাস্তবরূপে ধারণ করতে রাতেই দুজনের মাঝে আংটি বদলের অনুষ্ঠানের প্রস্তাব রাখা হলো।

মাহিরা আর নিপুন শৈলীকে নিয়ে রুমে গিয়েছে ওকে তৈরী করতে। মালিহা বাসায় ফিরেছে কিছুক্ষণ আগে। এসেই সবকিছুর এতো অগ্রগতি শুনে ও ভীষণ অবাক হয়েছে। বলেছে ফ্রেশ হয়ে একেবারে রেডি হয়ে আসছে। মাহিব মেহরাবকে নিয়ে বাইরে গিয়েছে অনুষ্ঠানের টুকটাক সরঞ্জাম কিনতে। মিহরানকে কিছুই করতে দেওয়া হয়নি। ওকে শুধু বলা হয়েছে ফ্রেশ হয়ে, পাঞ্জাবী পায়জামা পরে নিচে নামতে।

শৈলীর রুমে ওকে সাজানোর বেলায় ভীষণ হাসাহাসি চলছিল। নিপুন আর মাহিরা ওকে ক্ষেপাচ্ছিলো অনেক। তবে লজ্জা পেলেও সেদিকে নিজের মনোযোগ দিচ্ছিলো না ও। ওর কিছুটা বিভ্রান্ত মুখ দেখে মাহিরা প্রশ্ন করলো,
– কি রে শৈলী? এতো খুশিতে কি পাগল হয়ে গেলি নাকি? চেহারার এক্সপ্রেশন থাকার কথা লাজুকলতার মতন, কিন্তু সেখানে তোর মুখে ছেয়ে আছে গম্ভীরতা। ব‍্যাপার কি বলতো?

শৈলী আয়নার সামনে বসেই মাহিরার প্রতিবিম্বর দিকে তাকায়,
– আমি আসলে কনফিউস্ড হয়ে আছি রে মাহি।
– কি নিয়ে কনফিউস্ড তুই?
-আম্মু মানলো কিভাবে রে সবকিছু? এমন কি হইলো আমার অবর্তমানে যা সবকিছুকে এভাবে পাল্টে ফেললো?

শৈলীর প্রশ্নে নিপুন হেসে দেয়,
– আপি, এর উত্তর আমার কাছে আছে, শোন। আমাদের সবার আজ সকালে চলে যাওয়ার পর, আম্মুর শরীর নাকি বেশ খারাপ হয়েছিল। তখন আকলিমা খালা যেয়ে আফিয়া আন্টিকে ডেকে এনেছেন। আন্টি এসে মাকে দেখে নাকি পুরাই তব্দা খেয়ে গিয়েছিলেন। দুই জনের মাঝে সুখ দুঃখের অনেক আলাপ আলোচনা হয়েছে। এক পর্যায়ে আম্মুর শরীর আরও খারাপ হওয়াতে আন্টি আব্বুকে ফোন দেন। তার সাথে মনে হয় আঙ্কেলকেও আন্টি সব কিছু জানান। ততক্ষণে আমিও চলে এসেছি। এরপর আব্বু বাসায় আসলে প্রথমে তিনজনের মাঝে কথা হয়, তারপর কিছুটা বিরতি নিয়ে বিকেলের দিকে আঙ্কেল সহ আন্টি আবার আসেন বাসায়। তারপর দুই পরিবার সব সমস‍্যা ও তার সমাধান নিয়ে বিস্তর ভাবে আলোচনায় বসেন। আম্মুর যেই সব চিন্তা তোমাকে নিয়ে ছিল, সেগুলো আন্টি একে একে আম্মুর মাথা থেকে দূর করেন। ব‍্যাস! এইভাবেই আম্মুও গলে যায়, আর তোমার ভাইয়ার সাথে, অলরেডি হয়ে যাওয়া বিয়েটাও, ফিক্সড হয়ে যায়।

নিপুনের বলার ভঙ্গিতে মাহিরা হো হো করে হেসে দিলেও এবার শৈলী স্পষ্ট লজ্জা পায়। এবং ভেতর থেকে ওর বয়ে যায় প্রশান্তির নহর। এতোদিন আস্তে আস্তে মিহরানের কাছে আসার, ওর ভালোবাসা পাওয়ার আনন্দ শৈলীর মাঝে থাকলেও, মনের কোন এক কোণে বাবা মা কে নিয়ে দুশ্চিন্তার এক প্রাচির গড়ে উঠছিল। এই প্রাচির কে ভাঙার জন‍্য কি করা লাগবে তা বুঝে উঠতে পারছিলো না ও। মিহরানের প্রতি ভরসা থাকলেও, শেষ পর্যন্ত কি হবে তা নিয়ে বেশ অনিশ্চিত ছিলো ও। কিন্তু এখন সেরকম কোনো সমস‍্যাই নেই। পানির প্রবাহের মতন কোনো বন্ধক ছাড়া একদম স্বচ্ছ এখন ওদের সম্পর্ক সবার কাছে, সবার মাঝে।

ঘন্টা খানেক পরে বাইরে থেকে ডাক পরলে শৈলীকে নিয়ে আসে মাহিরা আর নিপুন। মেরুন জামদানি তে শৈলীর লাল রঙা রূপ যেন ঠিকরে বের হয়ে দ‍্যুতি ছড়াচ্ছে। একদমই সাদা মাটা মেকাপে সামনে উপস্থিত হওয়া রমণীর এই বিধ্বংসী রুপে মিহরান ভেতর ভেতর বেসামাল হয়ে পরে। তখনই মনে মনে এক উদ্ভট চিন্তা মাথায় আসে তার। শৈলীকে সেটা বলতে মন আনচান করে ওঠে।

শৈলীকে দেখে আফিয়া আবার তৎপর হয়ে ওঠেন। মাহিরাকে বলেন শৈলীকে মিহরানের পাশে বসাতে। চপল পায়ে শৈলী সেই পথে হাটা দেয়। মিহরানের কাছে আসতেই একটু সরে বসে শৈলীকে জায়গা করে দেয় ও। মাহিরা যত্ন সহকারে বান্ধবীকে পাশে বসায়। তারপর সরে যেয়ে দাড়ায় নিপুনের সাথে।

দুজনকে একসাথে বাঙালি নবদম্পতি সাজে কতোটা মানিয়েছে তা নিয়েই পুরো ঘরে রব পরে যায়। সবার প্রশংসার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে ওরা। শৈলীর মায়ের তো চোখের পানি আজ কদিন ধরে থামার নামই নিচ্ছে না। পার্থক্য শুধু এখানেই যে আজ সকাল অব্ধি সেই অশ্রুর কারণ ছিল ভয়, শংকা আর কষ্ট এবং এখন সেই একই অশ্রু হয়ে উঠেছে খুশির ও প্রশান্তির প্রতিফলন। ঠিক একই প্রশান্তি বয়ে যাচ্ছে আজাদ সাহেবের বুকেও। মিহরানকে জামাই হিসেবে তার খুবই পছন্দ হয়েছিল। বিশেষ করে শৈলীর প্রতি ছেলেটার টান ওনাকে আকর্ষণ করেছিল। কোন বাবা না চায় তার সন্তানের সুখ? কোন বাবা এই ক্ষেত্রে স্বার্থপর না হয়? আজাদও হয়েছিলেন কিছুটা। মিহরানের শৈলীর প্রতি টান দেখে এই বিয়েটা তিনি কোনোভাবেই ভাঙতে চাননি। কিন্তু আবার স্ত্রীর কথাগুলোও যৌক্তিক লেগেছিল ওনার কাছে। তাই এক দ্বিধাদন্ধের বেড়াজালে জড়িয়ে ছিলেন তিনি। তবে আজকে মিহরানের মা বাবার সাথে খোলাখুলি সব আলোচনার পরে তিনি নিজেকে এখন ভারহিন মনে করছেন। যাক্ তার মেয়েটা সুখের খোজ পেল বলে।

আপনজনদের উপস্থিতিতে খুব সুন্দর ভাবে মিহরান শৈলী এক অপরের মাঝে আংটি বদল সম্পন‍‍্য করলো। বাসর রাতের উপহার স্বরুপ, মিহরান যেই আংটি আগেই শৈলীকে পড়িয়েছিল তা বুদ্ধি করে শৈলী আরেক হাতে পরে নিয়েছিল রুমে থাকতেই। যেই হাতেই পরুক না কেন, দুটো আংটিই তো তার প্রেমিক পুরুষের ভালোবাসার চিন্হ। দুটোই সযত্নে আগলে রাখবে ও।

মূল অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর বড়রা বসলো প্রোগ্রামের তারিখ ঠিক করতে। সেটা অবশ‍্য বেশী সময় লাগলো না। মাহিব নাম করা তিন টা কনভেনশন হলে কল দিয়ে কোন সাপ্তাহিক ছুটির দিন ফাঁকা আছে তা খোজ নিল। এখন তো আবার বিয়ের তারিখ ভেন‍্যুর লভ‍্যতার ওপর নির্ভর হয় কি না! আর্মি গল্ফ গার্ডেন ফ্রী পাওয়া গেল আগামী শনিবারে। বড়রা সেটাই পছন্দ করলেন। মিহরান শৈলীকে জিজ্ঞেস করাতে তারাও বড়দের ওপর মতামত ছেড়ে দিল। অবশেষে ধার্য হলো যে শনিবারে ওদের রিসেপশন প্রোগ্রাম, শুক্রবারে হলুদ আর বৃহস্পতিবার ঘরোয়াভাবে মেহেন্দির অনুষ্ঠান হবে। সিদ্ধান্ত হওয়ার সাথে সাথেই সবার মাঝে তৎপরতার সৃষ্টি হলো। যে যার মতন বিয়ের প্রস্তুতির আলোচনায় বসলো। হেলদোল নেই তো শুধু দুজনের মাঝে। মিহরান আর শৈলী। তারা নিজেদের মতন বসে আছে স্থির হয়ে। তবে সেটা শুধু বাহির থেকে মনে হচ্ছে অবশ‍্য।

সবার অগোচরে মিহরান অনেক আগেই শেলীর এক হাতের ভাজে নিজের হাত গলিয়ে তা মুঠিবদ্ধ করে ফেলেছে। এতে শৈলী কিছুটা বাধা দিলেও মিহরান সেটা শুনার পাত্র না। শৈলী আর কি করবে, নিজেকে লজ্জার হাত থেকে বাঁচাতে সেই মুষ্টিবদ্ধ হাতের ওপর সবার অগোচরে শাড়ির আঁচল দিয়ে ঢেকে দিয়েছে। এতে যেন মিহরানের সাহস বেড়েছে আরও। হাতের ওপর অনুভূতির অত‍্যাচারে শৈলীকে জর্জরিত করছে ও। ভেতর থেকে শিহরনের প্রবল জোয়ার বইলেও বেচারি শৈলী মুখে কিছুই বলতে পারছে না, শুধু মখটাই রক্তিম হচ্ছে। এক সময় আর না পেরে মিহরানের দিকে চোখ পাকিয়ে তাকালো ও। মাথা হাল্কা এগিয়ে মৃদু ধমক দিল,
– কি করছেন কি? ছাড়ুন না আমার হাতটা?

মিহরান ঠোটে বাঁকা হাসে। সামনে ঝুকে গলা খাদে নামায়,
-প্রশ্নই আসে না।

শৈলী চোখ বন্ধ করে ফেলে ততক্ষণাত। মিহরানের মাদকময় কন্ঠ তখনো ওর কানে বাজে,
-একটা আবদার করবো, রাখবা?

শৈলী নিশ্চুপতার মাঝেই সম্মতি জানায়। রাখবে সে। মিহরান প্রশন্নতার সাথে নিজের আবদার বয়ান করে।
– বিয়ের পর রোজ রাতে, আমার সামনে, তুমি শাড়ি পরবা। তোমাকে দেখে নেশা লেগে গিয়েছে। এই নেশা আমি রোজ রাতে করতে চাই।

শৈলী চকিতে থমকায়। বন্ধ চোখ আরও যেন খিচে যায়। এমন আবদার শুনে পায়ের তালু পর্যন্ত শিহরণে নড়ে ওঠে ওর। মানুষটা এভাবে ওকে ভাসায় কেন নিজের প্রেমে? শৈলী এর উত্তর পায় না। এখন এতো মানুষের মাঝেও শৈলীকে উন্মাদ করার পেছনে পরেছে। একটু থামলেই হয়, কিন্তু মিহরান থামলে তো?
– অনুষ্ঠানের পর আমাদের রুমে আসবা। আর শাড়ি পরেই আসবা, এভাবে মাথায় আঁচল রেখেই।

বলেই মিহরান আবার সটান পিছিয়ে সোজা হয়ে বসে। নির্দয়ী মানুষটা বুঝেও, না বোঝার ভান করলো তার প্রিয় মানুষের বেহাল দশা। এতো লজ্জায় শৈলীর মনে হচ্ছিলো ওর দম বন্ধ হয়ে আসবে। আর পারবে না নিজেকে বাঁচাতে ও।

এরই মাঝে রাতের খাওয়ার ডাক পরে। শৈলী যেন দম ছেড়ে বাঁচে যখন নিপুন মিহরানকে ‘দুলাভাই, দুলাভাই’ বলে গদগদ করে ডাইনিং টেবিলে নিয়ে যায়। তাড়াহুড়োর মাঝেই বেশ জম্পেশ খানাদানার আয়োজন করা হয়েছে। যেহেতু রেহানা অসুস্থ ছিলেন তাই আফিয়া তাকে বেশী একটা কিছু করতেই দেননি। নিজের বাবুর্চি, আলেয়াকে ডেকে এনেই রান্না চড়িয়েছেন। কিছু জিনিস বাইরে থেকে আসার সময় মাহিবও নিয়ে এসেছিল।

খাবারের আগে ও পরে মিলে বেশ কিছু ফটোসেশন পর্ব চললো মিহরান আর শৈলীকে ঘিরে। হুট করে ওদের নিয়ে এতো আয়োজনে শৈলী আসলে লজ্জায় মিইয়ে পরেছিল। তাই সঙ্কির্ণ রুপে মিহরানের পাশে চুপটি মেরে বসে ছিল ও। তা দেখে ওকে একটু ক্ষেপাতে ওর আরেকপাশে এসে বসলো মাহি,
– কি রে শৈলু, তুই এরকম আশির দশকের বধুদের মতন বসে আছিস কেন? মাথা তো মোটে উঠছেই না। ভাইয়া বুঝি এরকম লাজুকলতা পছন্দ করে?

শেষ প্রশ্নটা একদম শৈলীর কানের কাছে নিয়ে বললো মাহিরা। শুনেই শৈলী কপট দৃষ্টিতে তাকায় বান্ধবীর দিকে,
– তুই একদম তোর ভাইয়ের মতন। পুরাই ঠোটকাটা। লাগাম দে মুখে।

মাহিরা লাগাম দেওয়া তো দূর, খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে। কানের কাছে এসে আবার দুষ্টুমি শুরু করে,
– ভাইয়া বুঝি এভাবেই তোকে লজ্জা দেয়? আমার এই গম্ভীর ভাইটার মাঝে রোমান্টিকতা আছে তাহলে? এই শৈলু, বল না, ভাইয়া কি তোর কাছে এসেছে? আই মিন…তোদের মাঝে কিছু হয়েছে? নাকি বিয়ের প্রোগ্রামের জন‍্য এখনো ওয়েট করছিস তোরা? প্রপার বাসর করবি….হাহাহা

ঝট্ করে শৈলীর চোখের সামনে আবারও গত রাতের প্রেমগাঁথা উপস্থিত হয় স্পষ্ট হয়ে। মুহূর্তেই অনিয়ন্ত্রিত কাঁপুনি ওঠে সর্বাঙ্গে। মুখ ফসকে বের হয়ে আসে বাক‍্য,
– তোর ভাইয়ের এতো ধর্য‍্য কই যে অপেক্ষা করবে?

বলেই শৈলী দাঁত কামড়ায়। কি সর্বনাশ করেছে বুঝতে পেরে আড়চোখে তাকায় মাহিরার দিকে। ওর বিস্ফোরিত চাউনিই বুঝিয়ে দিচ্ছে যে মেয়ে কথাটা শুনেছে এবং সেটা আমলে এনেছে। শৈলী সাথেসাথে চোখ সরায়। ও জানে মাহিরা এখন কি করবে, এবং হলোও তাই। উত্তেজিত মাহিরা শৈলীর বাহু শক্ত করে ধরে,
– তুই বান্ধবী নামে কলঙ্ক বুঝলি। সবকিছুই আমাকে দেরীতে জানাস। বিয়েটাও জানালি দেরীতে আর বাসরের খবর তো মনে হয় পেতামই না। তুই এই মির জাফরগিরি কেন করিস বলতো? ভাবি হয়ে বন্ধুত্ব ভুলে গেলি?

শৈলী মাথা নুয়ায় লজ্জায়। মাহিরা ওর সবচাইতে কাছের বান্ধবী, আর বান্ধবীদের সাথে এইসব নিয়ে মজা করা তো ওদের নৈতিক অধিকার। তাই এই বিষয়টা ওকে শৈলী জানাতোই, কিন্তু এখনো চব্বিশ ঘন্টাই হয়নি, নিজেই তো সবকিছু গোছাতে হিমশিম খাচ্ছে। তার ওপর পাশে বসা মানুষটার দিনে দিনে বারন্ত অনিয়ন্ত্রিত আবদার ও দুষ্টু মিষ্টি অত‍্যাচারে নিমজ্জিত ও। বান্ধবী পর্যন্ত যাবে কখন?

কোনমতে মাহিরাকে শৈলী বুঝিয়ে সুঝিয়ে মান ভাঙালো। তবে মাহিরা মেনেছে শুধু এক শর্তে আর তা হলো শৈলীকে নিজেদের প্রেমের সব গল্প বিস্তারিত শোনাতে হবে ওকে। ভীষণ রকম লজ্জায় পরলেও বান্ধবীর শর্তে শৈলী রাজি হয়ে যায়।

সবকিছু গোছাতে গোছাতে প্রায় রাত দশটা পার হয়ে গেল। আফিয়া যাওয়ার সময় মজা করে আবার তাল ধরেছিলেন শৈলীকে নিজের সাথে নিয়ে যাওয়ার। এক পর্যায়ে তিনি বলেই বসলেন রেহানাকে,
– ভাবি আমার মেঝ বৌমাকে আপনার কাছে আমানত হিসেবে রেখে গেলাম। হেফাজতে রাখবেন কিন্তু।

রেহানা হেসেই জবাব দেন,
– আপনি চিন্তা করবেন না ভাবি। আপনার আমানতের পূর্ণ হেফাজত আমি করবো ইনশাআল্লাহ।

এইসব হাসি মজার মাঝেই বিদায় হয় মিহরানের পরিবার। এতো ভীড়ের মধ‍্যেও মিহরানের চোখ পড়ে শৈলী। যেই চোখ ইশারা দেয় ওকে ওপরে আসতে। শৈলীও ইশারায় বোঝায় সব ঠিক করে আসবে। একটু দেরী হবে।
………………………..

ঘড়ির কাটায় যখন রাত সাড়ে এগারোটা বাজে তখন শৈলী ছয়তলায় ওঠে। ঠিক যেভাবে অনুষ্ঠানে ছিল, সেরকম হয়েই এসেছে ও। মাকে সাহায‍্য করার সময় মা কতোবার বললেন, শাড়ি পাল্টে আয়, নতুবা নষ্ট হয়ে যাবে, কুচকে যাবে শাড়িটা। কিন্তু শৈলী শাড়ি পাল্টায়নি, বিভিন্ন অজুহাতে কথা কাটিয়েছে। এখন সে উঠে আসতে আসতে এই চিন্তাই করছিল,
-ভালোবাসার জন‍্য আর কতো মিথ‍্যা বলা লাগবে?

মিহরানের রুমে একবার নক্ করতেই ভেতর থেকে দরজা খুলে যায়। যেন মানুষটা ওর অপেক্ষায় দরজাতেই দাড়ানো ছিল এতোক্ষণ। শৈলী ঢুকতেই দরজাটা বন্ধ করে ওকে পেছন থেকে কোমর জড়িয়ে ধরলো। লাজে কাবু হওয়া স্ত্রীর ঘাড়ে তারপর থুতনি রাখলো,
– থ‍্যাঙ্কস।
-কেন?
-আমার আজকের আবদার রাখার জন‍্য। শাড়িতে আমার কাছে আসার জন‍্য। আমাকে নেশা ধরিয়ে দেয়ার জন‍্য।

শৈলী হেসে মাথা নুয়ায়। মিহরান ততক্ষণে শৈলীকে নিজের দিকে ঘুড়িয়ে ফেলেছে। ওর চিবুকের নিচে আঙ্গুল আটকে মুখ ওঠায় নিজের দিকে। পলক ফেলা শুভ্র নারীর লাজ রুপে দেখে একান্ত এই মুহূর্তে নিজেকে সামলানো যে কারো জন‍্যই অসম্ভব। সেখানে মিহরান তো শৈলীর সেই প্রেমিক পুরুষ। ওর সামলানোর তো কোনো অর্থই নেই। পরক্ষণেই নিজের অধর দিয়ে ভালোবাসার জানান দেয় মিহরান শৈলীকে। লজ্জা পেলেও ভড়কায় না শৈলী। বরং আজ অনেকটা মন্থরগতিতে, রয়ে সয়ে স্বামীর আদর বুঝে নিতে থাকে। ও তো জানতোই মিহরান কেন ওকে এখন চায়, আর ওর নিজেরও কি সেই একই নেশায় মাতাল হওয়ার ইচ্ছে নেই? আছে তো।

সময় গড়ায়, সাথে দুজনের প্রেমমুহূর্তের গভীরতাও। এমনই এক ক্ষণে, আশপাশের নিরবতাকে ভঙ্গ করে শৈলীর মোবাইল চিৎকার দিয়ে জানান দেয় কারও কলের কথা। প্রথম বাজার সময় শৈলী উঠতে চাইলেও মিহরান দু হাত খাটের সাথে লেপ্টে ধরে থামিয়ে দেয় ওকে। নিজেদের উষ্ণ মুহূর্তের রেষ কাটাতে সে নারাজ। স্বামীর ইচ্ছায় শৈলী তখন বাধা না দিলেও, দ্বিতীয়বারের কলে শৈলী খাটে উঠে বসতে চায়। মিহরানকে নিজের কাধের ভাজ থেকে ওঠানোর প্রচেষ্টায় বলে,
-আচ্ছা একবার দেখতে দাও না কে ফোন দিয়েছে।
– বাজতে দাও। এখন যেও না।
– আহা! জরুরী কারও কলও তো হতে পারে। কোনো এমারজেন্সি…

বলতে বলতে ফোনের লাইন আবার কেটে যায়। মিহরান বাঁকা হেসে শৈলীর ওপর আবার ঝুকে আসে,
-এমারজেন্সি শেষ।

শৈলী কপট রাগ দেখিয়ে হাসি ওঠায় ঠোটে। আবার মিহরানের সংস্পর্ষে আসতে ওর ঘাড়ে দু হাত পেচাতেই, তৃতীয় বারের মতন ফোনটা বেজে ওঠে। এবার শৈলীর ওপর থেকে মিহরানই সরে আগে। শৈলী উঠে বসতে বসতে মিহরান রুক্ষ স্বরে বলে,
– দেখ তো কে ফোন দিচ্ছে।

স্বামীর মন ভেঙেছে বুঝেও শৈলী মিষ্টি একটা হাসি দেয়। এদিকে শাড়ি কুচকে একাকার। সেটাকেই কোনমতে সামলে বেডসাইড টেবিল থেকে ফোনটা টেনে আনে ও। নাম্বারটা আননোন দেখে কপাল কুচকায়। এবার কল কেটে যাওয়ার আগেই ধরে ফেলে,
– হ‍্যালো আস্সালামুআলাইকুম?

ওপাশ থেকে মেয়েলি কন্ঠ ভেষে আসে,
– শৈলী বলছো?
-জ্বী। আপনি কে বলছেন?
-আমি তুরিন।

শৈলীর একটু সময় লাগে চিন্তে।
-তুরিন….?
-আমি মালিহার ফ্রেন্ড।

এবার শৈলী চিনে, প্রফুল্লচিত্তে কন্ঠে হাসি টানে,
– ওওও আপু, কেমন আছেন?
-তুমি কি ব‍্যস্ত শৈলী?

মিহরান ততক্ষণে শৈলীর পাশ ঘেসে বসেছে। নিজের দুষ্টুমি বহাল রাখতেই শৈলীকে বিভিন্ন ভাবে জ্বালাতন করতে শুরু করলো ও। বেচারি শৈলীর তখন বেহাল দশা। স্বামীকে সামলাবে না ফোন। তবে ও এই কলটা পেয়ে একটু অবাকও হয়। মালিহা আপুর বান্ধবী ওকে কেন ফোন করেছে? তাও আবার এতো রাতে?
-জরুরী কিছু আপু?
– হ‍্যা বেশ জরুরী।

শৈলী মিহরানের থেকে একটু সরে বলে,
– তাহলে বলুন।

ওপাশ থেকে কিছুক্ষণের নিরবতার পর কঠিন কন্ঠে আওয়াজ আসে শৈলীর কানে,
– শুনলাম তোমার নাকি এক্সিডেন্টালি মালিহার মেঝ ভাইয়ার সাথে বিয়ে হয়েছে?

‘এক্সিডেন্টালি’ শব্দটা শৈলীর ভীষণ গায়ে লাগল হঠাৎ। কেন লাগলো ও জানেনা কিন্তু লেগেছে। হয়তো বলার ধরনটা ঠিক ছিল না, এই জন‍্য।
– জ..জ্বি আপু।
– এই বিয়েটা কতটুকু বৈধ বলে মনে করো তুমি? কতটুকু সত‍্যতা আছে এই সম্পর্কের মাঝে?

হঠাৎ এমন বিভ্রান্ত দায়ক প্রশ্নে শৈলী চমকে ওঠে। পাশ থেকে মিহরানের ঠোটের ছোয়া নিজের কানের আশপাশে পাওয়ার পরেও শরীর শক্ত হয়ে ওঠে ওর। মিহরানও বিষয়টা বুঝতে পারে। শৈলীর কাধ থেকে মুখ সরিয়ে চেহারার দিকে তাকায় ও। স্ত্রীর কঠিন আবির্ভাব দেখে কপাল কুচকায়। শৈলীকে ইশারায় জিজ্ঞেস করে কার ফোন। শৈলী প্রশ্নটি উপেক্ষা করে ফোনে উত্তর দেয়,
– আমাদের বিয়ে কতটুকু বৈধ আর সত‍্য, এটা নিয়ে আপনি কেন প্রশ্ন করছেন আপু?

সাথেসাথে মিহরানের হাত নিজের কানের কাছে পায় শৈলী। মুখ ফিরিয়ে স্বামীর এতোক্ষণের খেলাচ্ছল মুখশ্রি উধাও হয়ে গম্ভীর চাউনির উপস্থিতি দেখে। ও কিছু বলার আগেই মিহরান ফোনটা ওর কান থেকে সরিয়ে লাউড স্পিকারে দেয়। এখন দুজনেই শুনতে পায় তুরিনের কথা।

– আমার প্রশ্ন করার সম্পূর্ণ অধিকার আছে। কারণ আজ যেই জায়গায় তুমি অবৈধ ভাবে অবস্থান করছো সেটার আসল অধিকার আমার ছিল। মিহরানকে মন প্রাণ থেকে আমি ভালোবেসেছি। ওনার স্ত্রী হওয়ার হক্ আমার। আর সেই হক্ তুমি নষ্ট করেছ শৈলী।

তুরিনের কথায় শৈলী পুরাই হতভম্ব হয়ে যায়। মিহরানের দিকে তাকাতেই আলো আধারির মাঝেও রক্তিম চোখ জোড়া দেখে ওর পিলে চমকে ওঠে। পরিস্থিতি সামলাতে শৈলী তখনই তৎপর হয়,
– আপু আপনি এসব কি বলছেন। মিহরান আপনাকে পছন্দ করেন না। তাহলে তার সাথে বিয়ের কথা আপনি কিভাবে বলছেন?
– তো তোমার কি মনে হয় মিহরান তোমাকে পছন্দ করে? এই বিয়েটা তোমার মনে হয় খুব ইসিলি মেনে নিয়েছে ও? জীবনেও না। ছেলে মানুষ এতো সহজে কারো কাছে ধরা দেয় না। আর মিহরানের মতন ব‍্যক্তিত্বের মানুষ তো আরও না। আমি জানি মিহরানের জীবনে কেউ নেই তাই আমিও আমার ভালোবাসা ওকে ব‍্যক্ত করিনি। পারিবারিক ভাবে আগাতাম আমি এবং পেয়েও যেতাম ওকে। কিন্তু মাঝখান দিয়ে আমার সব স্বপ্ন, আকাঙ্খাকে ধুলায় মিশিয়ে তুমি আমার বৈধ জায়গাটা ছিনিয়ে নিয়েছ শৈলী।

তুরিনের কান্নার দমক স্পিকারের মাধ‍্যমে ওদের সারা রুমে ছড়িয়ে পরলো। শৈলী কি বলবে, কিভাবে মেয়েটাকে সান্ত্বনা দিবে কিছুই বুঝতে পারছিলো না। তবে ওর কিছু করাও লাগলো না, তার আগেই তুরিনের রাগান্বিত আওয়াজ শুনতে পেল ওরা,
– তুমি কি মনে করেছ শৈলী, তুমি আমার ভালোবাসা ছিনিয়ে নিয়ে জিতে গিয়েছো? আসলে জানো, তোমার জন‍্য না, আমার আফসোস হয়। তুমি খুবই দুর্ভাগা। বিয়ের মতন একটা পবিত্র বন্ধনে তুমি জড়িয়েছ অপবিত্র ভাবে। যে তোমাকে চায় না, তোমার প্রতি কোন ফিলিংস রাখে না, তোমাকে ভালোবাসে না, সেই মানুষটার সাথে জড়িয়েছ তুমি। আমি এগুলো এতো শিউর হয়ে কিভাবে বলছি এটাই হয়তো তোমার মনে চলছে তাই না? বুদ্ধি সম্পন্ন মেয়ে তুমি নিজেও হয়তোবা। একটু চিন্তা করে দেখলে তুমিও বুঝবা। যেই মানুষ বিয়ের আগে তোমার দিকে তাকায়নি অব্দি, সে কিভাবে হুট করে বিয়ের পর তোমাকে ভালোবাসবে? তাও আবার এমন এক আকস্মিক বিয়েতে যেটাতে না তোমাদের দুজনের, আর না তোমাদের পরিবারের কোনো মতামত ছিল।

তুরিন একটু থেমে আবার বলে,
– তুমি দেখতে শুনতে সুন্দরী। তোমাকে পেয়ে প্রথম দিকে মিহরান হয়তো মোহে আটকাতেও পারে। ছেলে মানুষের স্বভাব নিশ্চয়ই তোমাকে বিশ্লেষন করে বোঝাতে হবে না আমার। কিন্তু একটা সময় পর যখন ওর এই মোহ কেটে যাবে? তখন কি করবা? ও যদি তখন তোমায় ছেড়ে দেয়, তখন তুমি যাবা কোথায়? সমাজে মুখ দেখাবা কিভাবে? কলঙ্কের দাগের ভার কিন্তু অনেক শৈলী। নিতে পারবা তো সেই ভার?

মিহরান এতোক্ষণ থমকে যেয়ে শুনছিল সব। কপালের রগ এখনো ফেটে যায়নি সেটাই একটা বিস্ময়কর বিষয়। কারো মনে এভাবে বিষ আছে তা ও আজ এখানে না থাকলে জানতে পারতো না। নিজের অর্ধাঙ্গিনীর দিকে তাকালো। ফর্সা মুখটা একেবারে কালো হয়ে গিয়েছে। এই আদুরে মুখশ্রীতে কিছুক্ষণ আগেও মিহরানের ভালোবাসার স্পর্শে লাজের রঙ লেপ্টে ছিল। এখন সব উধাও। শৈলী যেন পাথর বনে গিয়েছে। ওপাশে তুরিনের কথা এখনো শেষ হয়নি।

– আমি তোমার মিত্র না হলেও তোমার শত্রু না শৈলী। তবে আমার অধিকার থেকে আমাকেই বঞ্চিত করে তুমি ঠিক কাজ করোনি। তাই এখনো সুযোগ আছে, সুধরে নাও। মিহরানের জীবন থেকে…..

লাইনটা খট্ করে কেটে যেতেই শৈলী কেঁপে ওঠে। মিহরানের হাতে মোবাইলটা দেখে ও ভাবলেশহীন চোখ তাকায়। ঘন ঘন শ্বাস ওঠা নামা করা মিহরান এখনো মোবাইলের দিকে তাকানো। সেই দিকে তাকিয়েই শৈলীকে গম্ভীর সুরে আদেশ দেয়,
– আমি মালিহা কে রুমে ডাকছি। তুমি ফ্রেশ হয়ে শাড়ি পরে নাও ভালো করে। যাও।

শৈলী মাথা নুইয়ে খাট থেকে নামে। খাটে বিস্তৃত শাড়ির কুচিগুলো গুটাতে গুটাতে মিহরানের রাগান্বিত শীতল কন্ঠ কানে যায়,
– হ‍্যালো মালিহা। কোথায় তুই?….এখনি আমার রুমে আয়। ফাস্ট।

শৈলী ওয়াশরুমে ঢুকতে ঢুকতে ফোনের লাইন কাটার শব্দ বোঝে।

চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here