পরিণয়_প্রহেলিকা #লেখিকা_সিনথীয়া #পর্ব_৫০

0
815

#পরিণয়_প্রহেলিকা
#লেখিকা_সিনথীয়া
#পর্ব_৫০

তুরিনের সাথে ছাদে ঘটে যাওয়া ঘটনারও তিন দিন পার হয়ে গিয়েছে। সেইদিনের সকালের ধাক্কাটাই শৈলীর কাছে মনে হচ্ছিলো অনেক বড় একটা ব‍্যাপার। তুরিনের অবস্থা শেষের দিকে ভয়াবহ হয়ে গিয়েছিল। মিহরান তো কথা শেষ করেই চলে গিয়েছিল। সাথে শৈলীকেও ওখান থেকে সরিয়ে নিয়েছিল। মালিহা একা কিভাবে সব সামলাবে চিন্তা করে শৈলী মাহিরাকে ম‍্যাসেজ করে ওপরে ডেকে নিয়েছিল। পরে ওরা দুই বোন মিলে তুরিনকে নিয়ে গিয়েছিল।
……………………………

এদিকে শৈলী মিহরানের বিয়ের অনুষ্ঠানের ডেট আরও চারদিন পিছিয়েছে। এটার অবশ‍্য দুটো কারণ আছে। বিদেশে থাকা শৈলীর দুই খালা আগের বিয়ের তারিখের সাথে ম‍্যাচ করে ফ্লাইটের টিকেট পাচ্ছিলেন না। এই বাড়ির প্রথম বিয়ে, সব আত্মীয় স্বজনই থাকতে চাবে, এটাই স্বাভাবিক। তাই মূলতো ডেট পিছানো। পরে দেখা গেল কর্মদিবসে তারিখ পরাতে সেনা কুঞ্জ খালি পাওয়া গেল। ওটা আরও বেশি সুন্দর দেখে ওখানেই প্রোগ্রাম করার বিষয়ে সবাই রাজি হলো।
……………………

আজ সকালে ঘটেছে আরেকটা বড় ঘটনা। বড় মানে ভুমিকম্পে সব নাড়িয়ে দেওয়ার মতন বড়। ভার্সিটিতে যেয়ে মানুষের গুঞ্জনমুখর আলোচনায় শৈলী, মাহিরা আর মেহরাব জানতে পারে কোনো এক কারণে রিক, জোহেব সহ আরও দুইটা ছেলে এবং লাবন‍্যকে ভার্সিটি থেকে দুই সেমিস্টারের জন‍্য সাসপেন্ড করে দেওয়া হয়েছে। এর সাথে রিকের বাবা শাহ্জাহান সাহেবও নিজ থেকে বোর্ড অফ ট্রাস্টিসের মেম্বার হিসেবে ইস্তেফা জমা দিয়েছেন।

মাহিরা আর মেহরাব খবরটা শোনা মাত্রই খুশিতে লাফ দিয়ে ওঠে। শৈলীকে জড়িয়ে ধরে ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে মাহিরা প্রফুল্লচিত্তে বলে,
– উচিৎ শিক্ষা হইসে ওদের দোস্ত। আলহামদুলিল্লাহ্। আমি খুব খুব খুব খুশি।

তবে বন্ধুদের খুশির পারা উচুস্তরে পৌছালেও, শৈলী এখনো থমকে আছে। কপালে কোটিটা ভাজ বসিয়ে মাহিরার দিকে নিশ্চুপ চাউনিতে তাকায়। মাহিরা সেটা দেখে অবাক হয়ে যায়,
– কি রে শৈলু, তুই খুশি না এই খবর শুনে?

শৈলী কিছু একটা ভাবছিল, মাহিরার কথা শুনে নড়ে ওঠে ও,
-মাহি আমি তোদের সাথে পরে কথা বলবো।

এই বলে শৈলী বাকি দুজনকে মূর্তিয়মান রেখেই দৌড়ে প্রেমিসিস থেকে বের হলো।
……………..
ফ‍্যাকাল্টিদের ফ্লোরে এসে শৈলী সোজা মিহরানের রুমের দিকে পা বাড়ায়। দরজা নক্ করতেই ভেতরে থেকে গম্ভীর গলার আওয়াজ শুনে ভেতরে ঢোকে ও। মিহরান মনিটারে কাজ করছিল, শৈলীকে দেখে তাড়াতাড়ি ল‍্যাপটপ বন্ধ করলো। ততক্ষণে শৈলী টেবিলের কাছে চলে এসেছে,
– তুমি শুনেছ কি হয়েছে?

মিহরান কপাল কুচকে তাকায়,
– কি হয়েছে?
– রিক্ দেরকে সাসপেন্ড করা হয়েছে।

এই কিছুক্ষণের বিভ্রান্তিময় চেহারাটা এখন মিইয়ে গেল মিহরানের। স্বাভাবিক ভাবেই তাকালো স্ত্রীর দিকে,
– জানি।
– কিভাবে হলো এটা? কি কারণে?

মিহরান ততক্ষণে নিজের আসন থেকে উঠে শৈলীর পাশে এসে দাড়িয়েছে। ওর হাত, কোমল স্পর্শে নিজের মুঠোয় নিয়ে বলে,
– পিকনিকের রাতে ও যেই দুঃসাহস দেখাতে চেয়েছিল সেই কারণে।

শৈলী একদম চুপ মেরে যায়। আতঙ্ক ভর করে ওর দুই চোখে। মিহরানের ধরা হাতটা জাপ্টে ধরে ও,
– তুমি নিশ্চয়ই কিছু করেছ তাই না?
-মোটেও না। আমি কিচ্ছু করিনি।

শৈলী এবার বিভ্রান্ত হয়,
-তাহলে কে?
-বাবা।
– বাবা? বাবা মানে?
– বাবা মানে তোমার আব্বু।

এবার আসলেই শৈলী কেঁপে ওঠে। নিজের বাবার নাম কষ্মিকালেও আসা করেনি ও।
– আব্বু? আব্বু এসবের মাঝে আসলেন কিভাবে?

মিহরান মুচকি হাসে শৈলীর অবস্থা দেখে। চেয়ার টেনে প্রথমে ওকে বসায়, তারপর পাশে বসে কথা শুরু করে।
– আমাদের বিয়ের বিষয়টা যেদিন পরিবারের সবাই জানতে পারে, তখনই আমি পুরো ঘটনাটা সবার সাথে শেয়ার করেছিলাম। বাবা যে কথাগুলো ভীষণ সিরিয়াস ভাবে নিয়েছিলেন আমি বুঝতে পারছিলাম। দুদিন আগে তিনি আমার সাথে আলাদাভাবে ব‍্যাপারটা নিয়ে আবার কথা বলেন। অভিভাবক হিসেবে ভার্সিটির কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনার করার সিদ্ধান্ত নেন। আমিও পূর্ণ সহমত দেই। আসলে সত‍্যি বলতে এমন একটা সুযোগ আমি নিজেও খুজছিলাম। তোমার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা মোটেও ছোট কিছু ছিলো না। এটা কর্তৃপক্ষকে জানানো দরকার ছিল অনেক আগেই, কিন্তু যেহেতু আমাদের বিয়ের ব‍্যাপারে এখানে কেউ যানে না, তাই শুধু একজন ফ‍্যাকাল্টি হয়ে তোমার জন‍্য লড়াই আমি করতে পারতাম না। তাই বাবা যখন পদক্ষেপ নিতে চাইলেন, আমি তাকে সাহায‍্য করতে রাজি হয়ে গেলাম।

শৈলী মিহরানের বলা প্রতিটা শব্দ মন দিয়ে শুনলো। এতোক্ষণের ধাধাগুলো যেন আস্তে আস্তে গিঁট খুলতে শুরু করলো,
– আচ্ছা, আমাকে তো লাবন‍্য রুমে আটকে রেখেছিল। রিকের সম্পৃক্ততার ব‍্যাপারে তো আমাদের কিছুই জানা নেই। তাহলে ও এসবের মধ‍্যে পরলো কেমন করে?

মিহরান এবার বাঁকা হাসি দেয় শৈলীর পানে।
– আসল মজা তো এখানেই ছিল। আমার বলা সেদিন রাতের সব কথাই কিন্তু একটা হাইপথেসিস ছিল কিন্তু। আমি জানতাম কর্তৃপক্ষর কাছে গেলে এতো বড় একটা অভিজোগ শুধু কথার ওপরে টিকতে পারবে না। হয়েছিলোও তাই। প্রথমে বোর্ড মেম্বাররা মানতেই চাচ্ছিলো না কিছু। পরে আমি লাবন‍্যকে ডেকে পাঠিয়েছিলাম। সবার সামনেই আমি ওকে জেরা করেছি একটার পর একটা। এমনিতেই বোর্ড মেম্বারদের দেখে ঘাবড়ে গিয়েছিল ও। আমার প্রশ্নের বাণে কিছুক্ষণের মধ‍্যেই ভেঙে পরে ও। সব নিজেই গলগল করে বলে দেয়। ও যে এইসব রিকের নির্দেশেই করেছিল তা সেই মুহূর্তেই সবার সামনে প্রমান হয়। ওর কথাগুলো আরও জোড়ালো হয় যখন রিকের বন্ধুদের ডেকে পাঠানো হয়। ওরাও রিকের তোমার ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার ব‍্যাপারটা জানায়। এতকিছু শুনে বোর্ড মেম্বারদের আর কিছুই বলার ছিল না। বোঝাই যাচ্ছিলো সব কিছুর পেছনেই ঐ রিক দায়ী। আবার একয়দিন রিকের ভার্সিটি থেকে পুরোপরি অনুপস্থিত থাকাও তখন প্রশ্নবিদ্ধ হয়। তুমি নিশ্চয়ই খেয়াল করেছো সেই দিনের পর রিক কে আর দেখা যায়নি ক‍্যাম্পাসে। ও আসলে শরীর খারাপের বাহানায় গা ঢাকা দিয়েছিল। যতই নিজের থেকে ছোট ও দুর্বলদের ওপর ও জুলুম করে নিজের পুরুষত্ব জাহির করতে চাইতো না কেন আসলে বাস্তবে ও একটা আস্ত কাপুরুষ। ভয় পেয়ে গিয়েছিল যে ওর কারসাজি ফাঁস না হয়ে যায়। তাই ভার্সিটি আসেনি।

এতোকথা একসাথে বলে, একটু থামলো মিহরান। তারপর আবার কথা চালালো,
– ওদের দুই সেমিস্টার সাসপেন্ড করে এমন কোনো শাস্তিই দেওয়া হয়নি। দে ডিসার্ভ মোর। কিন্তু তাও একটা বিহিত হয়েছে ভেবে আমার ভালো লাগছে। কেন? তুমি এগুলো জেনে খুশি হওনি?

শৈলী নিঃশ্বাস ফেলে গভীর চোখে তাকায়,
– তোমাদের অনেক কষ্ট হয়ে গিয়েছে না? বিশেষ করে তোমার। একটার পর একটা ঝামেলা ইদানিং জড়ো হচ্ছে। প্রথমে তুরিন আপু, এখন এটা…

মিহরানের যেন আজ হাসার দিন,
– কষ্ট তো গিয়েছেই, যাচ্ছেই তবে সব কষ্টই পুষিয়ে নিচ্ছিতো এক এক রাতে। তাই না?

শেষ কথাটা মিহরান শৈলীর কানের সন্নিকটে এসে বলে। মুহূর্তেই কান গরম হয়ে ওঠে শৈলীর। এই কয়দিনে মানুষটার ওর সাথে লাগামহিনতার মাত্রা দেখে ফেলেছে ও। তাই ও জানে আর কিছুক্ষণ এখানে থাকলে ওর নিস্তার নেই। তাই ঝটপট উঠে দাড়ালো ও।

আমার ক্লাসের দেরী হয়ে যাচ্ছে। পরে কথা হবে।
এই বলেই এক দৌড়ে বের হয়ে যায় রুম থেকে। মিহরান পলক ঝাপটাতেই চলে যায় ওর নাগালের বাইরে।

চলবে।

জানি আজ অনেক ছোট পর্ব হয়েছে। এটার পেছনে কারণ আছে। এখন যেই পর্বগুলো আসছে বা আসবে, তা এই গল্পের মাঝে চলমানরত সব সমস‍্যার ইতি টানবে। তুরিন, রিক এবং লাবন‍্যর পরিণতি হয়েছে। বাকি আছে আরও একজন। তাকে নিয়ে কথা বলতে গেলে একটা এপিসোড পুরোটাই দিতে হবে। এই এপিসোডে লিখতে গেলে আবার লেখা পরিপাটি হয়ে ওঠে না। আশা রাখি আপনারা বুঝতে পারবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here