#পরিণয়_প্রহেলিকা
#লেখিকা_সিনথীয়া
#পর্ব_৬
মিহরান গাড়ি বের করে ড্রাইভওয়েতে রেখেছে। ড্রাইভিং সিটে বসেই ও মাইলেজ চেক করছিল। গাড়ির ব্যাপারে অনেক বেশী সচেতন তাই প্রতিবার ড্রাইভের পূর্বে কিছুক্ষণ সময় নিয়ে সবকিছু চেক করে নেয়। এখনও তাই করছিল যখন পেছন থেকে হাসাহাসির আওয়াজ এসে ওর কানে বাধলো। গাড়ির প্রতি মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটায় বিরক্তি নিয়ে মুখটা তুলে পাশের লুকিং গ্লাস দিয়ে পেছনে তাকালো। মুহূর্তেই কুচকানো কপালটা সোজা হয়ে আসে, বিরক্তি ছুটি নেয় মুখ থেকে। মিহরানের চোখ আটকে যায় কোন এক নির্দিষ্ট স্থানে।
মাহিরা আর মেহরাবের মাঝে দাড়ানো তৃতীয় ব্যক্তিটির দিকেই নজর বাধা পরেছে মিহরানের। টিয়া হলুদের মিশ্রণে পরা টু পিসে দাড়ানো অপরুপ সুন্দরী সেই নারী । হ্যা, সুন্দরীদের কাতারে এই মেয়ে নির্দ্বিধায় দাড়িয়ে পরে এতে মিহরানের কোন সন্দেহ নেই। নয়তো কোনো মেয়ের দিকে এভাবে বারংবার ওর চোখ আটকাতো না। এই যে এখনের কথাই ধরা যাক না। মিহরান চেয়েও নিজের দৃষ্টি সেই প্রাণবন্ত হাসি ছড়িয়ে পরা মুখ থেকে সরাতে পারছে না। গভীর ভাবে অবলোকন করছে সেই কালো দিঘল কেশগুলো যা মেয়েটার মাথার দুলুনিতে বার বার সামনে চলে আসছে আর হাতের পেছন দিয়ে সেগুলো সরিয়ে দিচ্ছে তাদের মালিক। এই নিয়ে আজ তৃতীয় বার এই রমণীকে নিজের দৃষ্টির সীমানায় মিহরান উপস্থিত পেল। আশ্চর্য ব্যাপার এই যে তিন বারই তিন রুপে মেয়েটার সাক্ষাত হয়েছে ওর সাথে। প্রথমে বৃষ্টির ঝিরি বাতাসের মাঝে সিক্ত সতেজ রুপে, দ্বিতীয়বার বাসায় একদমই ঘরোয়া রুপে আর আজ এই মূহুর্তে….
রোদ ঝলমলে সকালটা যেন হঠাৎ করে আরও উজ্জ্বল মনে হলো মিহরানের কাছে। জানালা দিয়ে আকাশ পানে চেয়ে বিরক্তি নিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো, রোদের প্রখরতা কি হুট করেই বেড়ে গেল নাকি?
ইতিমধ্যে তিনজন যুবক যুবতিই গাড়ির কাছে চলে আসলো। মাহিরা আর শৈলী পেছনে বসলো, মেহরাব বসলো মিহরানের পাশে। শৈলীর এতোক্ষণের হাসোজ্জল চেহারাখানি হঠাৎই অপ্রতিভ হয়ে গেল। আড়চোখে একবার মিহরানকে দেখে সাথেসাথেই চোখা নামিয়ে ফেললো, তবে খেয়াল করলো না যে তার এই চোরা চাহনী সামনের নিরুৎসাহিত অভিব্যক্তির মানুষটার কাছে ধরা পরে গিয়েছে। আসলে শৈলী ভেতর ভেতরে বেশ অস্বস্তি বোধ করছে। এই মানুষটার সাথে প্রথম দেখা হওয়া থেকেই সব উদ্ভট কান্ড ঘটছে। স্বাভাবিক পরিস্থিতি যেন বিদায় নেয় এরা একে অপরের সামনে আসলে। তার মধ্যে গতকাল মাহিরার শৈলীর আর ওনার বিয়ের কথাটা যেন এই সংশয়ের আগুনে আরও ঘি ঢেলে দিচ্ছে । নিজের ভার্সিটির, নিজের ডিপার্টমেন্টের লেকচারার হওয়ার বিষয়টা তো আছেই।
এই সব চিন্তা থাকার কারণেই শৈলী বুঝতে পারছে না, মিহরানকে সে কিভাবে সম্মোধন করবে। অথচ কথা ওরই শুরু করা উচিত কারণ ও মিহরানের গাড়িতে উঠেছে। কৃতজ্ঞতার খাতিরেই ওর কথা শুরু করা আবশ্যক। আর সাত পাঁচ ভাবতে বসলো না শৈলী, নরম কন্ঠে বললো,
-আস্সালামুআলাইকুম স্যার।
গাড়ির ভিতর শৈলী কাকে সালাম দিচ্ছে এটা বোঝা খুব একটা কঠিন ছিল না। এক পাশে হালকা ঘাড় ঘুরিয়ে মিহরান জবাব দিল,
-ওয়ালাইকুম সালাম, ভালো আছেন?
-জ্বী। আপনি?
-ভালো।
ব্যাস! এইটুকু কথাই হলো ওদের মাঝে। আর কথা হওয়ার মতন অবশ্য কিছু ছিলও না। তবে গাড়ির ভেতরের পরিবেশ কিন্তু নিস্তব্ধ থাকলো না। মাহিরা আর মেহরাব ততক্ষণে গল্পের ভান্ডার খুলে বসেছে। অল্পক্ষণের মাঝেই শৈলীও তাতে যোগ দিল। বিষয় বস্তু হলো আগামি দিনের ক্লাব প্রোগ্রাম।
– এই শৈলী তোর স্টেজ ডেকোরেশনের খবর কি?
-চলছে রে মাহি, তবে ধীর গতিতে। কাজ এখনো অনেক বাকি। আজকে বেশ অনেক্ষণ সময় দিতে হবে।
মেহরাব সামনে থেকে গলা উচিয়ে বলে উঠে,
– আজকে কিন্তু আমরা সাউন্ড সিস্টেমটা লাগাবো শৈলী। তোর স্টেজ রেডি না থাকলে আমাদের সেটাপে দেরী হবে। আজকে তো আবার ফাইনাল স্টেজ রিহার্সালও আছে।
শৈলীর অসহায় কন্ঠ পেছন থেকে ভেসে এলো,
– একসাথে কয়টা কাজ করবো আমি বল দোস্ত। একে তো স্টেজের পেইন্টিং গুলোর দায়িত্ব আমাকে দিয়েছে, তার ওপর আবার উপস্থাপনার ভারও আমার ওপরই।
মাঝ দিয়ে ফোরণ কাটলো মাহিরা,
– তো এতো প্রতিভাবান কে হতে বলেছিল তোকে, হ্যা? জানো মেজো ভাইয়া, শৈলীর আর্টের হাত এতো আনকোড়া, তুমি দেখলে মুগ্ধ হয়ে যাবা। একদম প্রফেশনাল লেভেলে এক একটা পেইন্টিং তোলে ও। আর তার পাশাপাশি ম্যাডাম আবার পাবলিক স্পিকিং এ যবরদস্ত। তাই উপস্থাপনা ওর দ্বারা খুবই ভালো হয়, একদমই জড়তা নেই, স্টেজ ফ্রাইটও নেই। এই কারণেই প্রায় সময়ই শৈলীর ডাক পরে যে কোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে।
এতোক্ষণ ধরে নিশ্চুপ হয়ে ড্রাইভ করলেও মিহরানের মনোযোগ ছিল বাকিদের আলোচনাতেই। শৈলীর গুণগুলো ওকে আসলেই মুগ্ধ করলো। সামনের রিয়ারভিউ মিরর দিয়ে খুব সন্তর্পণে দুবার দেখেও নিয়েছে মেয়েটাকে। ওর মনে হয়েছিল মেয়েটা বোধহয় চুপচাপ, ভীতু প্রকৃতির, তবে আজ, কিছুক্ষণ আগের চঞ্চলতা দেখে আর ওর গুণাবলি শুনে মনে হচ্ছে মিহরানের ধারণাটা কিছুটা হলেও ভুল।
মনে এতো কিছু চললেও চেহারায় মিহরান কিচ্ছুটি প্রকাশ করলো না। এমনকি মাহিরার ওকে বলা এতো কথার প্রেক্ষিতে শুধু ‘হমম’ উচ্চারণ করা ছাড়া আর কিছুই বললো না ও। এটা আবার লক্ষ্য করেছে শৈলী। একটু অবকই হলো বিষয়টায় ও। এতো গুরুগম্ভীর মানুষ জিবনে ও খুব কমই দেখেছে। এতো পথ পারি দিল, তারপরেও মুখটা একটুও ফাঁক হলো না? নিশ্চয়ই পড়াবেনও খুব বোরিং ভাবে?
এরই মাঝে ভার্সিটির গেইটে এসে পৌছালো ওরা। বাকি সবাইকে সেখানেই নামিয়ে দিয়ে মিহরান গাড়ি পার্ক করতে চলে গেল। মিহরানের যাওয়াটা শৈলী দেখছিল। মাহিরা পাশেই ছিল ওর, বান্ধবীর চাহনীর পানে চেয়ে দুষ্টু হাসলো,
– ভাইয়ার গাড়িটা কিন্তু ভাইয়ার থেকে বেশী সুদর্শন না…তাই না?
চকিতে ফিরে তাকালো শৈলী,
-মাহি তোর আবোল তাবোল কথা থামাতে কি নিবি বলতো?
– জাস্ট রাজি হয়ে যা ভাইয়াকে বিয়ে করতে।
– উফফ! অসহ্যকর।
………………………
প্রথম দুটো ক্লাসের পরে শৈলী সময় পেল স্টেজের কাজে যাওয়ার জন্য। সময় নষ্ট না করে ছুটলো ও। আজ সব কাজ শেষ করতে হবে, নাহলে কালকে সকালের মাঝে স্টেজ রেডি করা অসম্ভব হয়ে পরবে। তার ওপর উপস্থাপনার স্ক্রিপ্টেও রাকিব স্যারকে দিয়ে চেক করাতে হবে। সে ফাইনাল করে দিলে শৈলী মুখস্ত করবে। সব মিলিয়ে আজ অঢেল কাজ।
অডিটোরিয়ামে ঢুকেই শোরগোলের আওয়াজ এসে শৈলীর কানে বাজলো। সব দিকে হইচই বেধে আছে। নাচের দল স্টেজের নিচে আপাতত প্র্যাক্টিস করছে কারণ সাউন্ড সিস্টেম সেট আপের কাজ চলছে উপরে। মেহরাবকেও ওখানে দেখা গেল। প্রোগ্রাম অর্গানাইজিং কমিটির সদস্যদের পাওয়া গেল রাকিব স্যারের সাথে, বেশ ব্যস্ত তারা আলোচনায়। শৈলী এক ঝলক সব অবলোকন করে ওখানে আর সময় ব্যয় করলো না। ওর কাজ এখন স্টেজের পেছনে। ফোমশিট গুলো সব ওখানেই রাখা, গতকাল স্টেজের দুপাশের জন্য দুটো বড় বড় কারুকাজ শেষ করেছে। আজ ব্যাকগ্রাউন্ডের ডিজাইনটা ধরবে।
ফোন করে আগেই নিজের টিমের সদস্য অরুণাকে ফোমশিটগুলো তৈরী রাখতে বলাতে শৈলীর কাজের গতি বেড়ে গেল। শিট গুলোকে ডিজাইন অনুযায়ী প্রথমে শেইপ করে কেটে নিল ওরা। তারপর শৈলী বসলো রঙ গোলাতে।
মেয়েটা রং গোলাতে এতোই ব্যস্ত ছিল যে পেছনে কে এসে দাড়িয়েছে তা খেয়াল করলো না। নাহলে রিকের বিচ্ছিড়ি হাসিটা দেখে ওর গা গুলিয়ে উঠতো। শৈলীর ওপর পাশেই অরুণা বসা ছিল বিধায় ও রিক কে দেখেছে। ভুরু জোড়া কুচকে বিরক্তি সমেত শৈলীকে সামান্য গুতা দিল। ওমনি মাথা উঠালো শৈলী, অরুণার দিকে প্রশ্নসুচক নজরে তাকালো। অরুণা মুখের ভাব ভাল না হয়ে বরং আরও বিগড়ে গেছে ততক্ষণে, ইশারায় শৈলীকে পেছনে তাকাতে বললো। শৈলী ওর চাহণী অনুসরণ করে পেছনে ঘাড় ঘুরাতেই রিকের খোচা খোচা দাড়ি আলা মুখশ্রীটা দেখলো ওর দিকে নেমে আসতে।
ততক্ষণাত রাগের পারা বেড়ে গেল শৈলীর। রিককে ঝুকে ওর মুখ বরাবর আসতে দেখেই নিজে ঝটপট দাড়িয়ে পরলো ও। মনে মনে যত বিভৎস গা*লি ওর জানা আছে, সব ঢাললো। চিন্তিত হলো এই ভেবে যে আসছে এই বদ লোকটা ওকে উত্তপ্ত করতে! কোনো ভাবেই এখন মাথা ঠান্ডা করে শৈলীকে কাজ করতে দিবে না।
ভেতর ভেতর ক্ষোভের ঝড় উঠলেও আশপাশে মানুষের সমাগম দেখে শৈলী নিরবে নিজের কাজে মন দেওয়ার চেষ্টা করলো। পাশে রাখা সদ্য শেষ হওয়া একটা ফোমশিট হাতে তুলে নিল সরিয়ে রাখার জন্য। কিন্তু ওর মনের ধারনা সত্য প্রমাণিত কে রিকের ফিসফিস আওয়াজ কানে বিধলো ওর,
-কি ব্যাপার আমার মনের রাণী? আমাকে এখানে দেখে খুশি হওনি বুঝি?
রাগে শৈলী ভেতরে ঘামতে শুরু করলেও মুখে একটা কথাও আনলো না। রিক্ এতে যেন আরো তেজী হয়ে উঠলো,
– কি হলো? এতো সুন্দর ঠোট জোড়ায় আজ কথা ফুটছে না কেন বলতো? আমি এতো কষ্ট করে ক্লাস বাঙ্ক করে তোমার কাছে ছুটে আসলাম, আর তুমি কি না আমাকে পাত্তাই দিচ্ছো না? নট্ ফেয়ার!
আর সহ্য করতে পারলো না শৈলী। রাগের পারা তরতরিয়ে বাড়লো। এখান থেকে না সরলে এই ছেলেকে আজ ও চড় মেরেও দিতে দ্বিধা বোধ করবে না। কোনমতে হাতের ফোমশিট টা শক্ত করে ধরে পা বাড়ালো ও চলে যাওয়ার জন্য কিন্তু বাধা পেল এখানেও। রিকের উন্মাদের ন্যায় হাসিটা মুখে লেগেই আছে,
-কই যাচ্ছো ডারলিং আমাকে না বলে?
চকিতে ঘুরে দাড়ালো শৈলী, রক্তিম চোখগুলো বড় বড় করে এক প্রকার ধেয়ে আসলো রিকের দিকে। আঙ্গুল উঁচিয়ে হিসিয়ে উঠলো,
-I am warning you, stay in your limits.
আমাকে, আর কখনো, এইসব উল্টাপাল্টা, থার্ডক্লাস নামে ডাকবেন না নয়তো আমি….
– নয়তো তুমি কি ডার্লিং? কি করবা? আমার নামে কম্প্লেন করবা? কার কাছে? ডিন স্যার নাকি ভি সি স্যার? বলো বলো? চাইলে ট্রাস্টি বোর্ডের কাছেও যেতে পারো। আই ডোন্ট মাইন্ড।
রিকের অহমিকা ভর্তি গা জ্বালিয়ে দেওয়া কথাগুলো শৈলীর কানে জলন্ত লাভার মতন গড়াচ্ছিলো। কোনমতে শরীরের কাপুনি থামাতে সক্ষম হলো ও। চোখটা একবার খিচে বন্ধ করেই আবার খুলে রিককে একটা মোক্ষম জবাব দিতে যাচ্ছিলো, তখনি ওর চোখ পরলো রাকিব স্যারের আগমন। তবে সে একা নয়, তার পাশে ব্যাক স্টেজে প্রবেশ করেছে মিহরান। রাকিব স্যার মিহরানের সাথে কিছু নিয়ে আলাপ করছিলো বলে শৈলী আর রিক কে দেখেনি, তবে মিহরানের সাথে শৈলীর ঠিকই চোখাচোখি হলো। শৈলী, পরপর দৃষ্টি ফিরিয়ে একটা গভীর শ্বাস নিয়ে নিজেকে ঠান্ডা করতে চেষ্টা করলো, স্যারদের সামনে এইসব নিকৃষ্ট পরিস্থিতি উপস্থাপন করতে চায় না সে। রিকের থেকে এক পা পিছিয়ে গেল ও। ততক্ষণে রিকও স্যারদের দেখেছে। এখন আর বেশী কিছু বলা যাবে না এটা ও নিজেও বুঝেছে।
ওদিকে কথার মাঝে মশগুল রাকিব কিছু না টের পেলেও, মিহরান ঠিকই বুঝতে পারলো এখানে কিছু একটা হয়েছে। শৈলীর চেহারায় বিরক্তি আর গাম্ভীর্য ও স্পষ্ট অবলোকন করেছে। রিকের মুখের ভাবটাও যেন কিছুটা অস্বাভাবিক ছিল।
রাকিব মিহরানকে নিয়ে শৈলীর সামনে এসেই দাড়ালো। পাশে রিক কে দেখে একটু অবাক হয়েই বললো,
-কি ব্যাপার রিক? তুমি এখানে? ক্লাস নেই এখন?
রিক উদ্ভ্রান্তের মতন একটা হাসি যোগালো ঠোটে,
– আছে স্যার, এখন যাচ্ছি। আসি স্যার।
যাওয়ার আগে শৈলীর দিকে বাঁকা চোখে একবার তাকালো রিক যেটা মিহরানের নজরে মোটেও এড়ালো না। সাথে সাথেই ভ্রু জোড়া কুচকে এলো ওর।
রাকিবও ছেলেটার যাওয়ার পানে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে মিহরানকে ফিসফিসিয়ে বললো,
– বুঝছেন মিহরান ভাই। নবাবজাদা যদি কখনো না দেখে থাকেন তাহলে দেখে নেন।
মিহিরান বিরক্তি নিয়েই বললো,
– কে ছেলেটা?
– আমাদের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য শাহজাহান স্যারের ছেলে রিক্। বড়লোক বাপের বিগড়ে যাওয়া পোলা বলতে যা বোঝেন ও তার সবই। আটটা সেমিস্টার যে কিভাবে পাশ করে করে পার করছে তা তো শুধু আমরা জানি। আপনার কোর্সেও আছে ও। দেখলেই বুঝবেন কি জিনিস একটা।
মিহরানের প্রথমেই ছেলেটাকে শৈলীর পাশে দেখে পছন্দ হয়নি। ও স্পষ্ট বুঝেছিল যে শৈলী অস্বস্তি বোধ করছিল। এখন তো রাকিবের কথাগুলো শোনার পর ও নিশ্চিত যে শৈলীর সাথে ছেলেটা ভালো কিছু বলছিল না।
রাকিব ইতিমধ্যে শৈলীর সাথে কথা শুরু করে দিয়েছে,
– তা শৈলী? কাজের অগ্রগতি কতোদূর?
শৈলী এতোক্ষণে পুরোই স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছে,
– এই তো স্যার বেশী কাজ বাকি নেই। স্টেজের সেন্টার ব্যাকগ্রাউন্ডে যে ডিসাইনটা থাকবে সেটার রঙ হয়ে গেলেই সব শেষ। আজ আমাদের টিমের সবাই মিলে শেষ করলে সন্ধ্যার মধ্যে শুকিয়ে যাবে, এবং তখন আমরা সেটাপ করতে পারবো।
রাকিব প্রসন্ন হাসলো, মিহরানের দিকে মুখ ফিরিয়ে বললো,
– শৈলীর কথাই আপনাকে বলছিলাম তখন মিহরান ভাই। ও কাজে বেশ পাঙ্কচুয়াল আর দায়িত্বশীল। ওকে যে কোন কাজ দিলে নিশ্চিন্তে থাকা যায়। একদম ঠিক সময় শেষ করে আপনাকে জমা দিবে।
শৈলীর মুখাবয়ব আবারও রক্তিম হলো, তবে এবার রাগে না বরং লজ্জায়। নিজের এতো প্রশংসা শুনে অভ্যস্ত না ও সচরাচর। তার ওপর রাকিব স্যার ওর প্রশংসা করছে কার কাছে? স্বয়ং মিহরান স্যারের কাছে!
মিহরানের কপালের ভাজগুলো ততক্ষণে সোজা হয়ে গিয়েছে। ঠোটে একদমই আল্তো হাসি পরে ও শৈলীর দিকে চাইলো। শৈলী তখন রাকিব কে ধন্যবাদ জানাচ্ছে। আড়চোখে একবার মিহরানকে দেখতে যেয়েই আবার সেই তীক্ষ্ম দৃষ্টির মাঝে ধরা পরে গেল ও। তবে নিজেকে সংযত করে ফেললো তাড়াতাড়ি। পাশে লোকজন অনেক।
রাকিব নিজের কথা চালিয়ে গেলেন,
– আচ্ছা শৈলী উপস্থাপনার স্ক্রিপ্ট রেডি তো?
-জ্বি স্যার। ওটা গতকালই লেখা শেষ করেছি। আপনি একবার দেখে দিলে আমি ফাইনাল ড্রাফ্ট করে ফেলতাম।
– ওহ্ গুড। আচ্ছা আমি তো এখনই আবার আরেকটা মিটিং এ যাচ্ছি। তুমি বরং মিহরান স্যার কে দিয়ে চেক করিয়ে নাও,
এই বলে রাকিব মিহরানের দিকে ঘুরলো,
-মিহরান ভাই, আপনি যদি কিছু মনে না করেন তাহলে একটু স্ক্রিপ্ট টা দেখে দিতেন, আমি আবার…
পুরো কথা শেষ করতে দিল না মিহরান,
– আমি দেখে দিচ্ছি রাকিব, তুমি যাও মিটিংয়ে।
রাকিব যেন হাফ্ ছেড়ে বাচলো। বড় একটা হাসি মুখে মেখে বললো,
– তাহলে আমি চললাম। শৈলী, মিহরান স্যার কিন্তু আমাদের ডিপার্টমেন্টের অনেক ট্যালেন্টেড একজন লেকচারার। স্যারের থেকে অনেক কিছু শিখতে পারবা তুমি। You are in safe hands now.
শৈলী রাকিবের দিকে তাকিয়ে দৃঢ়তার সাথে মাথা ওঠা নামা করলো। সে শিখে নিবে।
ওদিকে মিহরান নিজের প্রশংসা শুনে বিরক্ত হলো। এই রাকিব টা আর শুধরালো না। অনেক বেশী কথা বলে দেখে সিনিয়ার ফ্যাকাল্টিদের থেকে হালকা পাতলা বকাও খায়, তবে ঠিক আর হয় না।
রাকিব বের হয়ে যেতেই শৈলী আর মিহরান সামনাসামনি হলো। শৈলীর হঠাৎই মনে হলো পুরো ব্যাকস্টেজ ফাঁকা হয়ে গিয়েছে। আসলে ওর টিমের সদস্যরা নিচে বসে ইতিমধ্যেই রঙয়ের কাজ শুরু করে ফেলেছে। বাকি যারা কাজ করছে তারাও বেশ দূরে দূরে। কোলাহলোও কম, তাই শৈলীর মনে হচ্ছে ওরা দুজন একা। মিহরানের সাথে কথা কিভাবে শুরু করবে সেই নিয়েই মস্তিষ্কে এই মুহূর্তে উঠলো ঝড়। বলবে নাকি, “স্যার একটু স্ক্রিপ্ট দেখে দেন”। নাহ…কেমন লাগবে বলতে? আজব তো? অন্য স্যারদের সাথে কথা বলতে তো চিন্তার প্রয়োজন হয় না, তাহলে এই মানবের সাথেই কেন?
শৈলীর এই সাত পাঁচ চিন্তার মধ্যেই একটা গম্ভীর কন্ঠ কানে বাজলো,
– আপনার কাছে স্ক্রিপ্ট টা এখন আছে?
তড়িত গতিতে চোখ তুললো শৈলী,
-জ্বি স্যার।
-তাহলে চলুন।
-কোথায় স্যার?
শৈলীর অকপটে প্রশ্ন থমকে গেল মিহরান। তার সাথে বিরক্তও হলো,
– স্ক্রিপ্ট চেক নিশ্চয়ই এখানে দাড়িয়ে দাড়িয়ে করা যাবে না। নাকি এখানেই করতে চান?
নিজের বোকা প্রশ্নে জিভ কামড়ে ধরলো শৈলী। চরম লজ্জিত হলো এই আচরণে। মিহরান বোধহয় ব্যাপারটা বুঝতে পারে। দ্বিতীয় প্রশ্নটা তাই নরম স্বরে করলো,
– অডিটোরিয়ামে বসে কাজ টা করলে ভালো হয় না?
– জ..জ্বি স্যার।
মিহরান নিজের কথা শেষ করে আর দাড়ায় না। শৈলীও বিনা বাক্যে অনুসরণ করে। মঞ্চের সামনে এসে প্রথম সারির এক কোণায় বসলো মিহরান, শৈলীও চুপচাপ ওর পাশে বসে ব্যাগ থেকে স্ক্রিপ্টের ফাইলটা বের করে, মিহরানের হাতে তুলে দিল। সেটা পেয়ে মিহরান প্রথম পাতাটা উল্টোতেই একটু চমকে উঠলো। পলকেই চোখের দৃষ্টিতে ছেয়ে গেল মুগ্ধতা। মেয়েটার হাতের লেখা চমৎকার। একদম গোটা গোটা অক্ষরে, খুব স্পষ্ট ভাবে সব লাইন সমান করে লেখা। একদম মনে হচ্ছে যেন টাইপ করা হয়েছে। মেয়েটা যে নিজের কাজের ব্যাপারে খুব যত্নশীল তা দেখেই বোঝা যায়।
মনে এতো কিছু ভাবলেও বরাবরের মতন সেগুলো আর মুখে আনলো না মিহরান। বরং গম্ভীরতা টেনে এনে কাজে মন লাগালো। স্ক্রিপ্টটা মনোযোগ দিয়ে একবার পরলো, প্রেক্ষাপট বুঝলো। যেখানে যেখানে প্রশ্ন ছিল, শৈলীকে জিজ্ঞেস করলো। শৈলীও এবার কোনো ভুল ছাড়াই সব কিছু ভালো করে বোঝাতে সক্ষম হলো মিহরানকে। একটা লাইনে এসে মিহরানের চোখ আটকালো,
– আচ্ছা এই কবিতার লাইন টা রবীন্দ্রনাথের, আপনি শিওর?
মিহরানের কাছে স্ক্রিপ্ট থাকায় পাশ থেকে শৈলী ভালোভাবে লাইনটা পরতে পারছিল না। তাই একটু সামনে ঝুকে আসলো ও,
– কোন কবিতার লাইন স্যার? একটু দেখি।
শৈলী ঝুকেছে মিহরানের পাশ ঘেষে। ওর মনোযোগ সম্পূর্ণই স্ক্রিপ্টে। কবিতার ছন্দে কবির অস্তিত্ব খুজে বেড়াচ্ছে ও। কিন্তু এই দিকে মিহরান যে শৈলীর চুলের ভাজের সুঘ্রাণে নিজের বর্তমান অস্তিত্ব হারাচ্ছে সেটা বোধহয় খোদ মিহরানও প্রথমে খেয়াল করেনি। ঘ্রাণটা একদম মাথায় ভেদ হয়ে যাচ্ছে ওর। এতো সতেজ! এতো সুন্দর? কোন শ্যাম্পু মাখে মেয়েটা? মিহরান অজান্তে নির্লজ্জের ন্যায় ফের ঘ্রাণ টা আরোহন করে। মুহূর্তেই দু হাতের মুঠো শক্ত হয়ে ওঠে ওর। মুখ ফেরায় অন্য পাশে। চোখ বন্ধ করে দীর্ঘ একটা শ্বাস নেয়, নিজেকে ধাতস্থ করার জন্য। ততক্ষণে শৈলী কিছুটা দূরে সরেছে। এখন সে মোবাইলে গুগল সার্চে ব্যস্ত। মিহরানের পাগলপ্রায় অভিব্যক্তি সে খেয়ালই করেনি।
কিছুক্ষণ পর নিজে দাঁত দিয়ে জিহবা কামড়ে শৈলী তাকালো মিহরানের দিকে। চোখে বোকা হাসি লেপ্টে বললো,
-সরি স্যার। এটা রবিন্দ্রনাথের না, নজরুলের কবিতা।
মিহরান মেয়েটার দিকে তাকালো এক গভীর দৃষ্টি নিয়ে। ঘোরটা কাটতে সময় লাগছে। শ্বাস প্রশ্বাসের গতি এখনো স্বাভাবিক হতে বেশ দেরী।
-স্যার?
………..
-স্যার?
কেউ যেন হুট করে মিহরানকে টেনে বাস্তবে নিয়ে এলো।চঞ্চল চোখে এদিক ওদিক তাকালো ও,
– হমম? কিছু বলছেন?
শৈলী মনে মনে বেশ অবাক হয়। স্যার কি এতোক্ষণ ওর কোনো কথাই শোনেন নি?
– জ্বী স্যার। আসলে আমারই ভুল ছিল। নজরুল ইসলামের কবিতা ভুলে রবিন্দ্রনাথ ঠাকুরের মনে করে লিখে ফেলেছি।
মিহরান পুরো কথাটা শুনেও কোনো রেসপন্স করলো না। কারণ ও বুঝতে পারছে, এখন মেয়েটার সাথে বেশি কথা বলা ওর জন্য অসম্ভব। তাই তাড়াতাড়ি উঠে দাড়ালো ও।
আচমকা এভাবে মিহরানের আসন ছাড়াতে শৈলী একটু চমকালো। ও নিজেও সাথে সাথে উঠে পরলো। মিহরান সামনে দিকে চেয়ে দ্রুত বললো,
– আপনার স্ক্রিপ্ট ভালো হয়েছে, তবে এই ইনফরমেশন গুলোর ব্যাপারে ভবিষ্যতে আরো সচেতন হবেন।
শৈলীর মনে হচ্ছিলো সে মাটিতে মিশে যাক। কুন্ঠায় মাথা হেট তার। এরকম ভুল হয়না ওর সাধারণত, আজ এনার সামনেই কেমনে হলো?
– তাহলে আপনি স্ক্রিপ্টটা ফাইনালি প্রিপেয়ার করে ফেলুন।
নিজের চিন্তা থেকে বের হয়ে শৈলী মিহরানের দিকে চাইলো,
-জ্বি স্যার। আমি…তাহলে আসি? আসলে ব্যাকস্টেজে রঙের কাজটা চলছে…
-হ্যা হ্যা আপনি যেতে পারেন।
-ধন্যবাদ স্যার।
-হমম।
চলবে…..