#পরিণয়_প্রহেলিকা
#লেখিকা_সিনথীয়া
#পর্ব_১৮
শহর পার হয়ে শাহজাহান সাহেবের ফার্মহাউসে পৌছতে সকাল সাড়ে এগারোটা বেজে গেল। ফার্মহাউসটা পুরোই একটা গ্রামের ভেতরে অবস্থিত বলে ঢাকার খুব কাছে হলেও ওদের পৌছতে সময় লেগে গেছে।
মূল টাউন ছাড়িয়ে যখন দু পাশের বিস্তৃত ক্ষেতের মাঝখান দিয়ে বাসগুলো চলছিল, তখনই মিহরানের বুঝতে অসুবিধে হলো না, যে এই খামারবাড়ি একদম ঘোর গ্রামে অবস্থিত। এমনিতেই এখানে আসা নিয়ে আপত্তি ছিল মিহরানের এখন তো পিকনিকের ঠিকানার এই দিশা দেখে ওর মাথায় রক্ত চড়ে বসলো। এতো দূরে, এরকম নির্জন এলাকায়, এতগুলো ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে আসার কোনো মানে আছে? এখন তো তাও নাহলে সকাল, অনেক কিছু দেখা যাচ্ছে। ঘুটঘুটে সন্ধ্যার অন্ধকারে কি হবে? তখন যদি কেউ কোনো বিপদে পরে, অথবা কেউ নিজেকে বা অন্য কাউকে বিপদে ফেলে, তাহলে সেটার দায়িত্ব নিবে কে? অভিভাবকদের জবাব দিবে কে? আশ্চর্য! কর্তৃপক্ষের কি এসব নিয়ে কোন মাথা ব্যাথাই নাই?
মুহূর্তেই মিহরানের চোখে ভাসলো শৈলীর নির্মল মুখশ্রী। তার সাথে সাথেই আসলো রিকের হিংস্র চেহারার দৃশ্যপট। দুটো মিলিয়ে রাগের পারা আরও তরতর করে বাড়লো ওর। সাথে জেগে উঠলো শৈলীকে নিয়ে পাহাড় সম চিন্তা। এই ট্রিপটা কেন যেন মিহরানের মনে কু ডাকাচ্ছে। মনে হচ্ছে কোনো একটা সরযন্ত্র রচিত হচ্ছে যেটার খবর ওর জানা নেই। এসব ভাবতে ভাবতেই অন্য মনষ্ক হয়ে পরে সে।
গ্রামের গাছে ঘেরা পথ পারি দিয়ে তিনটা বাস এসে থামলো এক বিশাল ফটকের সামনে। কালো আর সোনালি রঙের মিশ্রণে ভারী কারুকাজ সম্মত ফটকটা এই গ্রামীণ পরিবেশে যেন বড্ড বেমানান। জানালার এপাশে বসে এই সবই মাথায় ঘোরে শৈলীর। ততক্ষণে দরজাটা খুলে গেছে, এক একটা বাস সারি বেধে প্রবেশ করলো। হঠাৎ মনে হলো যেন আবহাওয়া হুট করেই বদলে গেল। বাঙালি গ্রামীণ দৃশ্য হুট করেই বদলে গেল আলিশান, আধুনিক চিত্রপটে। মেঠো পথগুলো উধাও হয়ে উদয় হলো পিচ ঢালা মার্বেল টাইল্সের রাস্তা। আরও সামনে যেতেই সবার সামনে প্রকট হলে ধবধবে সাদা রঙের একটা প্রাসাদ সমতুল্য দালান কোঠা। তিনতলা বিশিষ্ট এই বাড়িটার দিকেই জানালার ভেতর দিয়ে ঘাড় উঁচু করে তাকিয়ে সবাই। এর মাঝেই কে যেন হই হই করে উঠলো,
– আরে দেখ্ দেখ্ কি সুন্দর ফোয়ারা।
সবার সাথে শৈলীও চোখ নামায়। দেখে মার্বেল পথের মাথায় বৃত্তাকারে বড় এক জায়গা কাটা। তার ঠিক মাঝখানেই বিশাল এক ফোয়ারা যার তিনটি আলাদা স্তর থেকে ঝরছে বারি ঝর্ণা। চারদিকে গোলাকার হয়ে ছড়িয়ে পরা এই বর্ষণ আসলেই নজরকাড়া ছিল। এইটুকু দেখেই কারও বুঝতে বাকি নেই শাহজাহান সাহেব কতোটা ধনী। তবে তার যে রুচিও ভালো সেটার প্রশংসাও করা উচিত।
ফোয়ারার একপাশ দিয়ে ঘুরে তিনটা বাস পর পর এসে থামলো মূল ভবনের সামনে। দরজা খুলতেই হর হর করে সব ছাত্রছাত্রীরা নামা শুরু করলো। মিহরান নিজের বাস থেকে প্রথমে নামলো না। ওর পাশে বসা ফিমেল কলিগ কে নামতে জায়গা করে দিয়ে নিজে গেট থেকে একটু সরে দাড়ালো। উদ্দেশ্য, সব স্টুডেন্টরা এবং বিশেষ করে শৈলী ঠিক ঠাক ভাবে নামছে কি না সেটার খেয়াল রাখা। মিহরান এই না নামার ব্যাপারটা আবার দূর থেকে লক্ষ্য করলো শৈলী। ঠোটে ঠোট টিপে হাসলো এক মুহূর্ত। এরই মাঝে সামনে জায়গা ক্লিয়ার হওয়াতে কেয়া, পিয়াল আর প্রিতিও উঠে দাড়ালো বের হওয়ার জন্য। কিন্তু শৈলীর দিকে প্রিতি তাকাতেই দেখলো মেয়েটা নিচে ঝুকে কি যেন খুজছে। প্রিতি নিজেও ঝুকে আসে,
– এই শৈলী, কি হলো রে?
শৈলী মুখ না তুলেই বলে,
-দোস্ত আমার ছোট পার্সটা নিচে পরসে। ওটাই খুজতেসি।
– আমি সাহায্য করে দিবো?
– না না তোর কিছু করা লাগবে না। তুই নিচে যা, আমি খুজে নিয়ে আসতেসি।
– আর ইউ শিওর দোস্ত?
– হম হম শিউর, তুই কেয়া দের সাথে নেমে যা।
প্রিতি আর কথা বাড়ালো না, এমনিতেও ওদের জন্য পেছনের অনেকে আটকে গিয়েছে, তাই দ্রুত বাস থেকে নেমে পরলো ও।
প্রিতি নামতেই শৈলী মাথা ওঠায়, মুচকি হাসে। নিজেকে সবার পরে নামানোর জন্য অর্থাৎ মিহরানের সাথে নামার জন্য কতো কিইনা মিথ্যা সাজাতে হলো ওকে। প্রেমে পরলে মনে হয় এইসবই করতে হয় তাই না?
প্রিতির যাওয়ার দিক থেকে চোখ সরাতেই শৈলীর চোখ পরলো মিহরানের ওপর। দেখলো মানুষটার চোখ কুচকানো তবে ঠোট জোড়ার সাথে চলছে লড়াই, মনে হচ্ছে যেন সে অনেক চেষ্টা করছে একটা হাসি বের হয়ে আসা থেকে থামানোর জন্য। শৈলী ব্যাপারটা বুঝলো না তখন। নিজের দৃষ্টি নিয়ে গেল পেছনের দিকে, কতোজন আরও বাকি নামার জন্য, তা দেখলো। চলতি পথে আরও কজন সহপাঠি ওকে নামার কথা বলতেই একই ভাব দিল শৈলী যে ওর পার্স হারিয়েছে। খুজে নিয়ে নামবে ও।
অবশেষে মিহরান আর শৈলী বাদে সবাই নেমে গেল বাস থেকে। সর্বশেষ ছাত্র নামতেই দরজার দিকে আগালো শৈলী। নিজের হাত ব্যাগটা চেপে ধরে হাটতে হাটতে মিহরানের পাশে যেয়ে থামলো। একটা সুন্দর, স্থির হাসি দিয়ে মিহরানের পাশ কেটে যেই না নামতে যাবে, ওমনি কানে আসলো এক প্রশ্ন,
– পার্স পাওয়া গিয়েছে?
শৈলী ঠিক সেখানেই থমকায়। অবাক এর সীমা পার হয় ওর। পার্সের ঘটনা ইনি কিভাবে জানলেন? শৈলী তো ওনার থেকে পাঁচটা সিট পরে বসেছিল। এতো দূরে কথা কি ভেসে আসতে পেরেছিল?
শৈলী পেছনে তাকায় চোরা চোখে,
-জজ্বি স্যার।
মিহরানের এতোক্ষণের বেধে রাখা হাসিটা যেন বাধ হারায়। দুষ্টুমি মাখিয়ে বের হয়ে আসে,
– গুড। আমিতো ভাবছিলাম আজ পার্স খুজতে খুজতে আপনি এখানেই রয়ে যাবেন। আর আপনার সাথে আমাকেও থেকে যেতে হবে। যাই হোক পেয়েছেন, ভালো হয়েছে। এবার চলুন নামা যাক্।
মিহরানের দুষ্টুমিতে ভরা বাক্য গুলো কর্ণগোচর হতে ও মস্তিষ্কের নিউরনে সেগুলো বাজতে শৈলীর একটুও দেরী হলো না। কপট রাগের অভিব্যক্তি সারা চেহারায় ছড়িয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে রইল ও। এই রাগটা মিহরানের ওপর, কিন্তু তাকে প্রকাশ করার মতন সাহস অথবা সাচ্ছন্দ্যবোধ কোনোটাই এখনো শৈলীর হয়নি। তবে মনে মনে ভীষণ বকলো ও মানুষটাকে,
– এমনি তে তো সবার সাথে খুব গম্ভীর, সিরিয়াস মুড নিয়ে থাকেন। কেউ কি বিশ্বাস করবে এই মানুষটা এতো বড় ফাজিল? কিভাবে আমাকে খোটা দিচ্ছে। আমার জন্য তাকে ওয়েট করতে বলেছিল নাকি কেউ? চলেই যেতেন অন্যদের সাথে।
মিহরান ততক্ষণে হাটা ধরে সামনে এগিয়েছে। কিন্তু বাস থেকে পা বের করার আগেই ঘুরে শৈলীর দিকে তাকায়,
– মনে মনে আমাকে বকা যদি শেষ হয়ে থাকে তাহলে চলুন সামনে যাই। অন্যরা সবাই নেমে পরেছে।
ভীষণ রকম ভড়কায় শৈলী,
– নননা স্যার, আপনাকে আমি কেন বক….
তবে শৈলীর কথা শেষের আগেই ছোট্ট একটা হাসি দিয়ে মিহরান এগিয়ে যায়। ভ্রু কুচকে শৈলী “ধুর” বলে পিছ ধরে মিহরানের।
………….
শৈলী ছাত্রছাত্রীদের জটলার মধ্যে থেকে প্রিতি আর কেয়াকে খুজে পেল। ওদের থেকে কিছুটা দূরে, সামনের সারিতে রিক দাড়ানো ওর বন্ধুদের নিয়ে। এই মুহূর্তে সবার থেকে বেশী ওর গলা শোনা যাচ্ছে। কন্ঠ হতে ঝরে ঝরে পরছে অহমিকা। নিজের বন্ধু ও ডিপার্টমেন্টের সামনে এভাবে নিজের বড়লোকি উপস্থাপন করতে পেরে যেন সে ভীষণ গর্বিত। ওর বন্ধু আর কিছু সুযোগসন্ধানী ছাত্রছাত্রীদের ছাড়া অবশ্য বাকিরা কেউই ওর এই ভারিক্কি ভাবটাকে পছন্দ করতে পারছে না। প্রিতি তো ক্ষেপেই গেল। শৈলী,কেয়া পর্যন্ত শোনা যায়, এমন স্বরে রাগ ঝাড়লো তীব্র ভাবে,
– শা*লার এই কারণে আমি ট্রিপে আসতে চাই নাই। এই ব*জ্জা*তটার নখড়া আমাদের সহ্য করতেই হবে জানতাম। এমনেই সারাটা দিন ক্যাম্পাসে গু*ন্ডামি করে বেড়ায়। ওটাকে নিজের বাপের সম্পত্তি মনে করে চলে, আর এই টাতো আসলেই ওর বাপের সম্পত্তি, এইখানে নিজের অহংকার ঝাড়বেনা, তা কি হয়?
কেয়া প্রিতির হাত ধরে,
-আরে আস্তে বল্। সব শুনে ফেলবে। কাছেই আছে।
প্রিতি যেন আরও ক্ষেপে যায়,
– আর কতো আস্তে বলবো? এল চেয়ে আস্তে আমার স্বর বের হয় না। আর শুনলে শুনুক। আমি ওরে ডরাই নাকি?
কেয়া আর প্রিতির এই কথোপকথন পাশ দিয়ে শৈলীও শুনছিলো। মুখে না বললেও, প্রিতির প্রতিটা কথার সাথে ও সহমত পোষণ করে। সাথে ওর নিজের জন্যও কিঞ্চিত চিন্তা হয়। আজকের রাতটা ভালোয় ভালোয় পার করলে বাঁচে ও। নয়তো এই ব*জ্জাত ছেলে, পাবলিক ক্যাম্পাসে ওকে যেভাবে হ্যারাস করে, সেখানে এটাতো ওর নিজের বাসা। এখানে ওর আধিপত্য অনেকগুণ বেশী।
শৈলী যখন শুনতে পেয়েছিল যে পিকনিকের ভেন্যু চেঞ্জ হয়ে রিকদের খামার বাড়িতে করা হচ্ছে তখন ও একবার ভেবেছিল পিকনিকে আসবে না। কিন্তু কেয়ার জোড়াজোড়িতে ওকে আর প্রিতিকে রাজি হতেই হলো। কেয়ার বয়ফ্রেন্ড পিয়াল আর কিছুদিনের মধ্যেই গ্র্যাজুয়েট হয়ে বের হয়ে যাবে। এরকম একটা সুযোগ, যেখানে দুজন একসাথে এতোটা সময় কাটাতে পারবে, ওদের জীবনে সামনে অনেক দিনের মধ্যে নাও আসতে পারে। তাই কেয়া এইটা মিস করতে চাচ্ছিলো না কোনোভাবেও। কিন্তু কেয়ার মা, প্রিতি আর শৈলীকে ছাড়া ওকে এই পিকনিকে যেতে দিবেন না বলেই ও দুই বান্ধবীকে জোর করে রাজি করিয়েছে।
শৈলী এই স্মৃতি রোমন্থন করতে করতেই পাশ ফিরে। চোখে পরে ফ্যাকাল্টিদের সারিতে দাড়ানো মিহরানের সেই অতিপরিচিত গুরুগম্ভীর চেহারা। মুহূর্তেই মনের আকাশ থেকে বাদল সরে আলোর প্রবেশ ঘটে। এই মানুষটা, শুধু এই মানুষটা আছে বলে শৈলীর এখানে কোনো ভয় করছে না। মনে হচ্ছে ওকে আগলে রাখার কেউ একজন আছে আশপাশে।
হঠাৎ মিহরান শৈলীর দিকে ফিরে। দুজনের চোখাচোখি হয়। শৈলী একটু হকচকায়, একবার পলক ফেলে চোখের। মিহরান নিজের ভ্রুজোড়া হালকা উঁচিয়ে ইশারায় প্রশ্ন করে,
-কি হয়েছে?
শৈলী সাথেসাথেই চোখ নামায়, উত্তর দেয় না। কি উত্তর দেবে, ও তো লজ্জায় কাবু।
……………
সবাইকে অভ্যর্থনা জানাতে খোদ শাহজাহান সাহেব তার ম্যানেজার সহ মূল ফটকে উপস্থিত হলেন। ডিপার্টমেন্টের ডিন ও চেয়ারম্যানকে কে ফুলের বুকে দিয়ে তিনি স্বাগতম জানালেন। ওনার টিমের বাকি মেম্বাররা ভার্সিটির ফ্যাকাল্টিদের ফুলের স্টিক দিয়ে শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করলো। তারপর সবাইকে নিয়ে যাওয়া হলো ভেতরে।
বাহির থেকে দালানটা যেরকম আলিশান দেখা গিয়েছে, ভেতরের স্থাপনা আরও নজরকাড়া। হল পেরিয়ে ড্রয়াইং রুম ও তার সামনে খোলা বারান্দা যা সামনে বাগানের দিকে চলে যায়, দেখে কেউ বলবে না এই বাড়ি বাংলাদেশের একটি গ্রামে অবস্থিত। আধুনিকতার ছোয়া লেগে আছে এখানের প্রতিটা ইটে।
বাবা যেদিকে গুরুজনদের নিজের এই আলিশান সম্পদ দেখাতে ব্যাস্ত, সেখানে ছেলের তো পিছিয়ে থাকার প্রশ্নই আসেনা। নিজেদের ড্রয়িং রুমের ওয়ালে লাগানো ওয়াল পেইন্টিংগুলো কোন কোন দেশ থেকে কতো লক্ষ্য টাকায় আনা হয়েছে তা আউরাতেই কুল পাচ্ছে না ও। শৈলীর এই অহেতুক শোঅফ খুব গায়ে লাগে। ও একদমই নিতে পারছে না এগুলো। তাই বান্ধবীদের বলে একটু দূরে সরে আসলো ও। রিক সবার সাথে কথায় ব্যস্ত থাকলেও শৈলীর হঠাৎ এই নড়চড়টা ওর চোখ এড়ায়নি। ভেতর ভেতর হাসলো ও,
– এই বার শৈলী পাখি আমার খাঁচায় প্রবেশ করেছে। আজকে ওর দেমাগ ছাড়াবো আমি।
বাকি সবাইকে নিজেদের মতন গল্প করতে রেখে, রিক জোহেব আর ওর আরও কিছু ঘনিষ্ট বন্ধুদেরকে এক কোণায় ডাকলো। ওরা আসতেই গলা খাদে নামালো রিক,
– শোন, আজ রাতে আমি ঐ শৈলীরে জব্দ করবো। তোরা আমার সাথে থাকবি, মজা দেখবি।
সকালে ক্যাম্পাসে শুধু জোহেব এই কথাটা রিকের মুখে শুনেছিল। তখন থেকেই ওর ভয় লাগছে। রিকের বন্ধু ও, বলা যায় চামচাও কিন্তু রিকের মতন এতো আস্পর্ধা নিয়ে চলে না ও। ওর পরিবার খুব সাধারণ, তারা রিকের বাবার মতন এতো প্রভাবশালী না। তাই তো জোহেব ভয় পায়।
অন্যরা হাসাহাসি করলেও, জোহেবের ভয় মুখ ছোট হয়ে আসাটা রিক খেয়াল করলো। মনে মনে ইচ্ছামতন গালি দিল ওকে। কিন্তু মুখে মধু টানলো,
– আরে দোস্ত তুই টেনশন্ নিচ্ছিস কেন? তোর কি মনে হয় আমি শৈলীর কোনো বিরাট ক্ষতি করবো? আরে না না। এইসব কিছুই নাই আমার মাথায়। আমি তো শুধু ওকে একটু শায়েস্তা করতে চাই। ওর সাথে একটা প্র্যাঙ্ক খেলে ওকে ভয় দেখাবো। বুঝলি?
জোহেবের এখন জানে পানি আসে। সাথে সাথেই মুখ উজ্জ্বল হয় ওর। রিক সেটা বুঝতে পেরে হাসে। সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলে,
– শোন আমার প্ল্যান। আজ সন্ধ্যায় শৈলীকে আমাদের ফার্মহাওউস থেকে বের করে একটু দূরে আমাদের আরেকটা বাড়ি আছে, ওখানে নিয়ে যাবো। তারপর ওকে রুমে বন্ধ করে লাইট অফ করে ওকে ভয় দেখাবো। ওর কান্নার আওয়াজ শুনলেই আমার মন শান্ত হয়ে যাবে।
ওদের আরেক বন্ধু মারজুক ভ্রু কুচকায়,
– তুই নিতে চাইলেই কি শৈলী যাবে নাকি ওখানে? ওরে নিবি কেমনে?
রিক বিজ্ঞের হাসি হাসে,
– সেটারও ব্যবস্থা আছে বন্ধু, তোমরা টেনশন নিও না, জাস্টা ফান টা নাও।
এই বলে রিকের হাসির সাথে মিলিয়ে বাকিদেরও হাসি চওড়া হয়। এক সময় ওরা সবাই ওখান থেকে সরে অন্যান্যদের মাঝে মিশে যায় শুধু রিক বাদে। নিজে নিজে বাঁকা হাসি দিয়ে মনে আউড়ায়,
– তোদেরকে তো শুধু ট্রেইলারটুকু শোনালাম দোস্তরা কারণ এইটুকুই উপভোগ করার পারমিশন আছে তোদের। বাকি মুভি তো আমি একা দেখবো।
………………
এইদিকে ড্রয়িং রুম ছাড়িয়ে শৈলী বের হয়ে এসেছে খোলা বারান্দায়। ভেতরে, এতো চাকচিক্য আর মিথ্যে উপস্থাপনার যাতাকলে ওর দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হচ্ছিলো। সামনের বাগানের উন্মুক্ত পরিবেশে এসে এখন শ্বাস নিচ্ছে স্বাভাবিক ভাবে।
হঠাৎ হাতের মুঠোর ফোনটা টুং শব্দ করে বাজলো। শৈলী মুখের সামনে ফোনটা নিয়ে দেখলো ওয়াট্স এ্যাপে একটা ম্যাসেজ। ম্যাসেজ দাতার নাম দেখে অবাক হলো ও। উনি ম্যাসেজ দিয়েছেন?
সাথে সাথেই ফোনের লক্ খুললো শৈলী। মোবাইলের আলো জ্বেলে বার্তাটা প্রকোট হলো,
– কি হয়েছে শৈলী? আর ইউ অলরাইট?
শৈলী ভ্রু কুচকে মুখ তোলে। এদিক ওদিক করে কাউকে খোজে। বাইরেও অনেক মানুষ ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাড়ানো, সবাই কারো না কারো সাথে গল্পে মশগুল। এদের মাঝেই এক কোণে মিহরানকে দেখতে পেল ও। হাতে ফোন নিয়ে ওর দিকেই চেয়ে আছে। শৈলীর কপালের ভাজ শিথিল হয়। সেও ম্যাসেজের উত্তর দেয়,
-কিছু হয়নি স্যার।
ম্যাসেজটা সেন্ড হতে দেরী, ওপাশ থেকে কল্ আসতে দেরী হলো না। এই আচমকা ফোনের কাঁপাকঁপিতে শৈলীও নড়েচড়ে ওঠে। ফোন কানে লাগানো মিহরানকে এক ঝলক দেখেই কল ধরে। সাথে সাথেই ওপাশের এক সুদর্শন মানবের ভারী কন্ঠস্বর শৈলীর কানে ঠেকে,
– আপনি ঠিক আছেন তো শৈলী?
শৈলী একটু সময় নেয়। প্রথমবার মিহরানের সাথে ফোনে কথা বলছে কি না। এমনিতে তো দিনে ওনার চেহারা আর ব্যক্তিতের ওপর পঞ্চাশ পঞ্চাশ একশোবার ক্রাশ খায়, এখন ফোনের ওপাশের কন্ঠে আরো পঞ্চাশ যোগ হলো বলে।
-আমি ঠিক আছি স্যার।
– তাহলে এভাবে হাপাচ্ছিলেন কেন?
শৈলী ভীষণ লজ্জা পায়, লোকটা এটাও খেয়াল করেছে? ওনার ওটা চোখ না বাইনোকুলার,
– আসলে ভেতরে গরম লাগছিল খুব, তাই বাইরে এসে ভালো করে শ্বাস নিলাম। আর কিছু না।
– আপনার বান্ধবীরা কই?
– ওরা ভেতরে আছে স্যার।
– আমি না আপনাকে বলেছিলাম একা কোথাও মুভ না করতে? বান্ধবীদের কে ভেতরে রেখে বের হয়েছেন কেন?
– স্যার… ওরা তো এখানেই। আমি তো শুধু…
-আমি কিছু শুনতে চাচ্ছিনা শৈলী। আপনি এখনি আপনার বান্ধবীদের মাঝে যান। অথবা তাদেরকে বলেন আপনার কাছে আসতে।
– স্যার…ওরা ভেতরে নিজেদের মতন মজা করছে, আর.. আমার এখানে ভালো লাগছে থাকতে। ওদের ডিস্টার্ব করতে চাচ্ছিনা।
ওপাশ থেকে হঠাৎ চুপ হয়ে গেল আওয়াজ। শৈলী মিহরানের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে কথা বলছিল এতোক্ষণ। এখন কথার ব্যাঘাত ঘটায়, সরাসরি তাকালো ও। চোখ বড় বড় হয়ে গেল ওর যখন দেখলো মিহরান ফোন কানে লাগিয়েই ওর দিকে হেটে আসছে। শৈলী তাড়াতাড়ি শুধায়,
– স্যার কি করছেন আপনি? এদিকে আসছেন কেন?
– আপনার বান্ধবীদের আপনি ডিসটার্ব করতে চান না, আর আমি চাই না আপনাকে একা রাখতে। তাই আমিই আপনাকে সঙ্গ দিতে আসছি।
শৈলীর মনে হলো ও এখুনি একটা চিৎকার দিয়ে বসবে। হালকা চিৎকার একটা দিলোও,
– স্যার থামুন…প্লিজ। আপনার আসা লাগবে না। আআমি যাচ্ছি ওদের কাছে, যাচ্ছি যাচ্ছি।
এই বলে শৈলী ফোন কান থেকে সরিয়ে ভেতরে ভো দৌড় দিল। মিহরান এই দৃশ্য দেখে একাই হাসলো। ফোন কান থেকে সরিয়ে নিজের হাত দিয়েই চুলে ব্যাক ব্রাশ করলো।
-পাগলি একটা।
চলবে।