পরিণয়_প্রহেলিকা #লেখিকা_সিনথীয়া #পর্ব_৩৭

0
937

#পরিণয়_প্রহেলিকা
#লেখিকা_সিনথীয়া
#পর্ব_৩৭

রাতের পরিবেশে বেশ জমকালো ভাবে সাজানো হয়েছে সাত তলার ছাদটা। হাসান পরিবারের এটাই একটা বৈশিষ্ট্য। তারা ছোট আকারে কখনোই কিছু করতে পারে না। এই না বললো, সাদের অনুষ্ঠান টা ছোট করে শুধু বাড়ির মেয়েরা মিলে পালন করবে? এখন সেই অনুষ্ঠানের মেহমান প্রায় দুইশো জন। তাওতো শুধু মেয়েদের জন‍্য ছাদের এ‍্যারেঞ্জমেন্ট, ছেলেদের জন‍্য আলাদা ভাবে নিচে পুলের পাশে খাবার দাবারের আয়োজন করা হয়েছে।

তুরিন সন্ধ‍্যা বেলাই এসে হাজির হয়েছে এই বাসায়। সব মেয়েদের আজ বেবি পিঙ্ক অথবা পেস্টেল পিংক এর ওপর শাড়ি পরতে বলা হয়েছে। সেই অনুযায়ী তুরিন হাল্কা গোলাপি একটা জামদানি শাড়ি পরেছে। পার্লের হাল্কা জুয়েলারি আর এলিগেন্ট একটা মেকআপে ভীষণ নজরকাড়া লাগছে ওকে, এবং এটার ব‍্যাপারে সে অবগত।
থাকবেই না কেন? অনেক ভেবে চিন্তে সে আজ সেজেছে। এতো পরিপাটি করে নিজেকে এখানে নিয়ে এসেছে। সাথে এনেছে বুক ভরা সাহস, মিহরানের সাথে কথা শুরু করার। কি বিষয়ে কথা বলবে তাও ঠিক করে ফেলেছে। অনেক ডায়লগ্ বাসায় আয়নার সামনেও প্র‍্যাক্টিস করেছে। এখন শুধু বাকি সেটা ইমপ্লিমেন্ট করা।

ঝুমার রুমে মেয়েরা সাজছে শুনে তুরিন ওখানেই সরাসরি উঠে যায়। ওকে দেখে সবাই কম বেশী প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়। কিন্তু তুরিনের কৌতুহল থাকে অন‍্য কোথাও। এবং সেটা নিয়ে সে উদ্বিগ্নও বোধ করে। মালিহার পাশে যেয়ে ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করে ও,
– এই তোদের ঐ পড়শি কই রে? শৈলী না কি যেন নাম?

মালিহা এক পলক তাকায়,
– শৈলীকে তো দেখি নাই আমি। দাড়া।

বলেই নিজের ছোট বোনের দিকে তাকায় ও,
– এই মাহি, শৈলী কই রে? ও সাজবে না?
-ও সেজে ফেলেছে আপু। মেঝ ভাইয়ার রুমেই সেজে নিচ্ছে।

‘মেঝ ভাইয়ার রুম’ শুনেই আৎকে উঠে তুরিন। এখানে মেঝ ভাইয়া যে কে সেটা ওর খুব ভালো ভাবেই জানা। মালিহাকে ভীষণ ভাবে ঝাকায় ও। হতভম্ব মালিহা বিরক্তি নিয়ে তাকায়,
– কি হইছে তোর? এরকম ঝাকাচ্ছিস কেন?
– ঐ মেয়ে তোর ভাইয়ের রুমে কি করে? ওখানে কেন সাজতেসে ও?

বিরক্তিতে দীর্ঘশ্বাস ফেলে মালিহা,
-তুরিন, আমরা সবাই ওখানেই রাতে শুচ্ছি। শৈলীদের রুম গুলো তো আমাদের আত্মীয়রা দখল করে রেখেছে। তাই ও ভাইয়ার ওখানেই সাজছে, আর কই যাবে? তুই এতো হাইপার হচ্ছিস কেন? মনে হচ্ছে যেন ভাইয়াও শৈলীর সাথে ঐ রুমেই আছে, আর দুজন মিলে একে অপরের কাছে প্রেম নিবেদন করছে। হাহ্!

তুরিন চুপ মেরে যায়। বান্ধুবীর এই সব মন ভোলানো কথায় ও গলার মানুষ না। ঐ শৈলী নামক মেয়ের হাবভাব তুরিনের একদম ভালো লাগে নি আগেও। তারচাইতেও বড় সমস‍্যা খোদ মিহরান। পুরুষ মন! কখন যে কার কি ভালো লেগে যায় বোঝা মুশকিল। ঘটনা ওর হাত থেকে পুরোপুরি পিছলানোর আগেই কিছু একটা করতে হবে তুরিনকে।

হঠাৎ তুরিন তৎপর হয়,
– এই মালিহা, তোর মেঝ ভাই কই রে?
– হবে কোথাও। আমি কি জানি?
– দেখিসনি তুই?
-আরে আজ সব খাবারের দায়িত্ব ভাইয়ার হাতে। সে চরম বিজি। কোথা থেকে কোথায় যাচ্ছে সেটা ধরা মুশকিল।

তুরিন একটু থামে। তারপর উঠে দাড়ায়। মালিহার চোখ ওকে অনুসরণ করে ওপরে তাকায়,
– তুই কই যাচ্ছিস?
– আসতেসি। তুই সাজতে থাক।

এই বলে হন্তদন্ত হয়ে বের হয় তুরিন রুম থেকে।
……………………….

মিহরান আস্তে ধীরে শৈলীর কোমর ছেড়ে পেছনে আসে। ভয়ানক লজ্জায় ডোবা শৈলীর হিতাহিত জ্ঞান হারানোর জোগাড় তখন। মিহরানের থেকে আল্গা হতেই যেন নিজের ভারসম‍্য ঠিক রাখা দায় হয়ে যায় ওর। হবে নাই বা কেন? লোকটা যে হাড়ে হাড়ে দুষ্টু। এই মুহূর্তের সাক্ষী যে হবে সে কিভাবে মেলাবে এই মানুষটাকে ভার্সিটির গুরুগম্ভীর মিহরান হাসান স‍্যারের সাথে?

কিছু করবে না, নিজেকে সামলেছে এইবার। কতো কিছু না বললো? তাও তো ছাড়ে নি শৈলীকে। ঠোটের রং মন হয় না শুধু লেগে আছে আর নিজ জায়গায়। শৈলী শিওর সেটা ছড়িয়েছে আশপাশে। এতোটা অধ‍্যর্য মানুষ হয়? এখন আসলেই শৈলী চিন্তায় পেরে গেছে। শুধু এই চুমুগুলোতেই যদি ওর এরকম বেহাল অবস্থা করে এই মানুষটা, তাহলে সামনে কি হবে শৈলীর?

মিহরান নিজের ওষ্টে আঙ্গুল দিয়ে মুছতে মুছতেই স্ত্রীর অভাব‍্যক্তি দেখে বাঁকা হাসে। হঠাৎ একটা ফোন আসাতে সেই মধুর মুহূর্তটা ভাঙতে হেয়েছে ওকে। সেই ফোন এখনো বাজছে। মিহরান আর কোন কথা বললো না। সোজা ফোনটা রিসিভ করে রুম থেকে বের হয়ে গেল।

ও যেতেই শৈলী কপট রাগ নিয়ে আয়নায় নিজের আনন দেখে। ঠিক যা ভেবেছিল তাই। টিশ‍্যু দিয়ে আল্তো হাতে ঠোটের চারিপাশ মুছতে মুছতে বকা দিল মিহরানকে
– অস‍ভ‍্য মানব।
……………….

মিহরান রুম থেকে বের হয়েই সাত তলার ছাদের দিকে যায়। ও উঠার কিছুক্ষণের মধ‍্যেই তুরিন আসে ছয় তলায়। আর পাঁচ সাত সেকেন্ড আগে আসলেই মিহরানকে এখান থেকে বের হতে দেখতে পেত ও। ছাদে এসে আশপাশে প্রথমে চোখ বোলায়। এক পাশে কিছু লোক চেয়ার টেবিল লাগানোর কাজে ব‍্যস্ত। তুরিন ছাদ থেকে বের হয়ে মিহরানের রুমের দরজায় টোকা দেয়।

শৈলী লিপস্টিক মাত্র হাতে নিয়েছে, এসময় টোকা শুনে কপাল কুচকায় ও। এখন কে আসলো? উনি নাকি? না, উনিতো মাত্রই গেলেন, ফিরলে দরজায় টোকা দিবেন না। জানেনই তো দরজা খোলা। তাহলে?

শৈলী আগ বাড়িয়ে দরজার কাছে যায়। নব্ মোচড় দিয়ে খুলে তুরিনকে দেখে প্রথমে অবাক হয়, তারপর হেসে দেয়,
– আস্সালামুআলাইকুম আপু। কেমন আছেন?

তুরিন একবার আপাদমস্তক শৈলীকে দেখে নেয়। খুবই সিম্পল হাল্কা গোলাপির মাঝে সিল্ক কাতান শাড়ি পরেছে মেয়েটা। ছোটছোট সেল্ফ প্রিন্টের কারুকাজ শাড়িতে। খোপার গাজরা, চোখের কাজল, গহনা সব মিলিয়ে এমনিতেই সুন্দরি এই মেয়েটাকে মারাত্মক আকারে আকর্ষণীয় লাগছে। তুরিন বোঝেই না কখন ঈর্ষার জ্বালা ওকে ঘিরে ধরলো।

শৈলী একটু অবাক হয় তুরিন কথা বলছে না দেখে। ও আবার আওয়াজ দেয়,
– আপু…

তুরিনের চিন্তার সুতা কাটে,
– হমম? ওও। তুমি এখানে একা আছো?
– জ্বি আপু। আপনি কাউকে চাচ্ছিলেন? ভেতরে আসুন না?

তুরিনের ভেতরে জ্বালা ধরে। এমন ভাবে অফার করছে মেয়েটা যেন রুমটা ওর নিজের। অসহ‍্য! তবে মুখে তেমন কোনো বিরক্তি দেখালো না।
– না…মানে…মালিহা কোথায়?
– আপুরা সবাই নিচে ঝুমা ভাবির রুমে সাজছে।
– তুমি একা এখানে সাজছো?
– জজ্বি আপু।

তুরিন গভীর ভাবে শৈলীর মুখের দিকে তাকায়,
– তোমার লিপস্টিক ঠিক ভাবে লাগাওনি। ছড়িয়ে গেছে ঠোটের পাশে।

সাথে সাথে ঠোটে হাত চলে যায় শৈলীর। লজ্জায় চোখ নামিয়ে ফেলে। তুরিন সেটা দেখে মুখ বাকায়। এই মেয়ের ঢং দেখার সময় নাই এখন।

তুরিন আর দাড়ায় না। ওপরের দিকে পা বাড়ায়। নিচে পুরো বাসা খুজে এসেছে, মিহরানকে পায় নি। এখানেও নেই। তাহলে নিশ্চয়ই ছাদেই হবে। এখনই মানুষের সমাগম কম, মিহরানের সাথে কথা বলা যাবে।

শৈলী তুরিনকে ওপরে যেতে দেখে অবাক হয়,
-আপু, মলিহা আপুরা নিচে…

কে শোনে কার কথা? তুরিন তখন বহু দূর।
………………..

ছাদের ডেকোরেশনের দায়িত্ব মেহরাবের ঘাড়ে পরেছে। বাসায় অনেক সদস‍্য থাকলে এটা একটা বড় সুবিধা। কাজ ভাগ করে দেওয়া যায়। মেহরাবই তখন ফোন দিয়েছিল মিহরানকে একটা কাজের পরামর্শের জন‍্য। এখন দুই ভাই মিলে সেটাই ঠিক করছে ডেকোরেটরের সাথে।
এরই মাঝে সেখানে প্রকট হয় তুরিন। মিহরানকে এখানে পেয়ে স্বস্তি ফেরে ওর। ছাদে কাজ হচ্ছে দেখে এখনো মেহমানরা ওঠেনি। তুরিনের প্রথমে একটু অস্বস্তি লাগছিল। কিন্তু এই মুহূর্তে না আগালে আর আগানো যাবে না।
তুরিন সামনে আগায়। মিহরানের পাশে মেহরাবকে দেখে খুশি হয়। মেহরাবের সাথে খাতির আছে ওর। এই সুযোগে কথা শুরু করা যাবে। সেই চিন্তার ভিত্তিতেই চপল পায়ে দুই ভাইয়ের কাছে গিয়ে দাড়ায় ও। মেহরাব প্রথমে তাকায়,
– আস্সালামুআলাইকুম তুরিন আপু, কেমন আছো?

তুরিন চকচকে দাঁতে মুক্তার মতন হাসি ছড়ায়।
– অনেক ভালো আলহামদুলিল্লাহ্। তুমি কেমন আছো মেহরাব?
– এই তো ভালো।

তুরিন এবার চোখ তোলে তার কাঙ্ক্ষিত পুরুষের দিকে। এক হাতে চুলের গোছা কানের পেছনে ঠেলে মুখ খোলে,
– আস্সালামুআলাইকুম। কেমন আছেন?

মিহরান ফোনে চোখ টিকিয়ে কিছু দেখছিল। ওকেই যে প্রশ্নটা করা হয়েছে সেটা বুঝে দৃষ্টি তোলে ও,
– জ্বী। আপনি ভালো?

মিহরান আবার ভাবলেশহীন দৃষ্টিতে মোবাইলের দিকে তাকায়। কিন্তু তুরিনের যা হাল হবার তা তো হয়েই গেছে। গলে গলে পরে যাওয়ার অবস্থা ওর। নিজেকে সামলাতে রীতিমত যুদ্ধ করতে হলো ওকে। শেষে এই যুদ্ধে সফলতা লাভ করে কথা আগানোর চেষ্টা করলো,
– আসলে….আপনার সাথে..একটু ককথা ছিল।

মিহরান মোবাইলের দিকে তাকিয়েই ভ্রু কুচকায়। তারপর পাশে চায়,
– আমার সাথে? বলুন?
– মমম… আমার মাস্টার্স আগামী বছর শেষ হচ্ছে। এরপর এমফিল করার ইচ্ছা রাখি। অস্ট্রেলিয়াতে এ‍্যাপ্লাই করতে চাচ্ছি। যেহেতু আপনার অভিজ্ঞতা আছে তাই আসলে…একটু পরামর্শ চাচ্ছিলাম।
-ওও আচ্ছা। আপনার সাবজেক্ট কি?
– ইকনোমিক্স। মালিহার সাথেই আছি।
– কোন সিটিকে টার্গেট করতে চাচ্ছেন?
– আপনি কোথায় ছিলেন?
– মেলবোর্ণে।
– আমিও সেখানেই যেতে চাই।

মিহরানের কপালে ভাজ হয়। তুরিন পরক্ষণেই বুঝে ও কি বোকামি করেছে।
– আই মিন মেলবোর্ণে আমার আত্মীয় আছে তো, তাই ওখানে গেলে আমার জন‍্য ভালো হয়।
-হমম। তাহলে মেলবোর্ণ ইউনিভার্সিটিতে ট্রাই করতে পারেন। তবে আপনার মাস্টার্সের রেসাল্ট লাগবে সেক্ষেত্রে। আপনাকে আগামী বছর ট্রাই করতে হবে।

তুরিন হাসে স্বচ্ছ করে,
– জ্বি। সেটা আমি জানি। তাও প্রিপারেশন নিব কিভাবে তাই আপনার সাথে আলোচনা করতাম। আজ তো আপনি ভীষণ বিজি। এখন আপনাকে ডিস্টার্ব করা মোটেই ঠিক হবে না।….আপনি যদি কিছু মনে না করেন….তাহলে আমি আপনার নাম্বারটা রাখতে পারি কি? পরে যোগাযোগ করে গল্প…আই মিন আলোচনা করে নিব।
-ঠিকাছে।

অতি উৎসাহে তুরিনের মনে হচ্ছে উড়ে যেতে। তবে নিজের মনের পেখমগুলোকে এখন বন্দি করে আগে মিহরানের ফোন নাম্বার নিতে তৎপর হলো ও। এতো সহজে পেয়ে যাবে বুঝেনি ও। নাম্বারটা মালিহার থেকেও নিতে পারতো । কিন্তু এখন যে নাম্বারের সাথে আরেকটা জিনিস পাচ্ছে। মিহরানের অনুমতি ওকে ফোন দেওয়ার। তুরিন এই অনুমতিকে কাজে লাগাবে। খুব ভালো করে কাজে লাগাবে। সবে তো দরজায় কড়া নেড়েছে, মিহরানের মনের ঘরে অতি শিঘ্রই ও পা রাখবে। এখনের এই গোমড়া, গম্ভীর পুরুষালি মুখে তখন হাসি ফুটবে শুধু তুরিনকে দেখে।

মিহরান নাম্বারটা দিয়েই ‘এক্সকিউজমি’ বলে ওখান থেকে সরে আসলো। কেটারার খাবার এখনো উপরে ওঠায়নি কেন, তাই দেখতে হবে।
……………

সন্ধ‍্যার শেষ প্রান্তে শুরু হলো অনুষ্ঠান। কিছুক্ষণ আগেও খালি থাকা ছাদটা আস্তে আস্তে ভরে গেল মানুষের কলরবে। সাউন্ড সিস্টেমের আওয়াজেও সাড়া পাচ্ছে খুশির আমেজ। এক পাশে ফুচকা আর হাওয়াই মিঠাই য়েল স্টল বসেছে। আপাতত সেখানেই ঢল পরেছে অতিথিদের।

শৈলী নিজের সাজ পুরো করে নেমে এসেছে মিহরানদের বাসায়। কিছুক্ষণ আগেই মাহিরার ফোন এসেছিল,
– হ‍্যালো ভাবি….

মাহিরা দুষ্টুমি ভরা কন্ঠে ওকে টেনে টেনে ভাবি ডাকায় শৈলীর লজ্জা বাড়ে,
-মাহি দুষ্টুমি বন্ধ কর্।
– কেন? উপস্ তোদের পারসোনাল টাইমে ব‍্যাঘাত ঘটালাম নাকি? ভাইয়া কি এখনো রুমে?
– তোকে আমি পেয়ে নেই মাহি, তারপর বার করছি তোর ফাজলামো। বেশি বাড় বেড়েছিস তুই।
– আমি আবার কি করলাম?
– আমি নিপুণের হাতে ফুল পাঠাতে বলেছিলাম। তুই ইচ্ছা করে তোর ভাইকে পাঠিয়েছিস তাই না?

ওপাশ থেকে খিলখিলিয়ে হাসির আওয়াজ শুনতে পাওয়া যায়। মাহিরা নিজের হাসির দমকের মাঝেই কথা বলে,
– তুই যেভাবে কথা বলছিস আর রাগ দেখাচ্ছিস, তাতে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে তোর আর ভাইয়ার মাঝে কিছু হয়েছে। উউউউ। এই বলনা, বলনা দোস্ত। প্লিজ…

শৈলীর ব্লাশন দেওয়া গোলাপি গালে পরে লাল রাঙা আরেক প্রলেপ। ঘাড়ের লোমে আপনাতেই শুড়শুড়ি ওঠে।
– মাহি সিরিয়াসলি এখন আমি তোর মুখের ওপর ফোন কাটবো।
– আচ্ছা আচ্ছা মেরি মা, এখন তোক ছাড় দিলাম। এবার বল্ কই তুই?
– এই তো বের হচ্ছি রুম থেকে।
– সোজা নিচে আয়। কিছুক্ষণের মাঝেই ভাবিকে নিয়ে আমরা উপরে উঠবো। আমি, তুই, ইতি আপু আর বিথী ধরবো ওরনা। মালিহা আপু ধরবে ভাবিকে।

শৈলী ইতস্তত বোধ করে। মাহিরা কেন ওকে নিচে ডাকছে ও ভালো ভাবেই বুঝতে পারছে।
– মাহি আমি আর নিচে এসে কি করবো? তোরা নিয়ে আয় না ভাবিকে ওপরে।
– না শৈলী, তোকে আসতে হবে। ঘরের মেয়েদের সাথে সাথে ঘরের বউদেরও এটা করার সমান অধিকার ও দায়িত্ব দুটোই রয়েছে। নিজেকে এই ঘরের বউ যত তাড়াতাড়ি মানতে পারবি, তোর জন‍্য ততই সহজ হবে সব। এখন জলদি আয়। আমরা প্রায় রেডী।

মাহিরার গম্ভীর কথাগুলোয় প্রবল যুক্তি খুজে পায় শৈলী। তাই আর সময় নষ্ট না করে রুম থেকে বের হয়ে দরজা লক্ করে নিচে নামে।
…………

ঝুমাকে আজ পুতুলের মতন সাজানো হয়েছে। ঐ যে মাটির পুতুলকে লাল শাড়ি আর সোনার গয়না পড়ানো হতো না? সেরকম পুতুল। মাহিব, নানান বাহানায়, বেশ কয়েকবার উঁকিঝুঁকি দিয়ে গেছে রুমে। বউকে দেখার তর সয় না কোনোভাবেই। এই জন‍্য যখন ঝুমা কে নিয়ে মেয়েরা রুম থেকে বের হয়, মাহিবকে সবার প্রথমেই দরজার সামনে পাওয়া যায়। উপস্থিত সবার এই কান্ড দেখে সেই কি হাসি। ছোট খালা আর ছোট ফুফু তো দুষ্টুমির ছলে মাহিবের কান ধরেই বসলেন।
-কি রে মাহিব? বাসায় এতো মেহমান উপস্থিত আর তাদেরকে না দেখে, তুই এখানে দাড়িয়ে আছিস কেন? এখানে কি দেখিস?
– আর বইলো না আসিয়া, আমাদের পরিবারের ছেলেগুলো সব এক কথায় বউ পাগল? বউ ছাড়া এরা কিছুই বুঝে না।

ছোট ফুফুর কথায় হো হো করে হেসে দেয় সবাই। মাহিরা শৈলীকে পাশ থেকে কনুই দিয়ে গুতা মারে। চোখের ইশারায় বোঝায়, ফুফুর কথাটাকে আমলে আনতে । শৈলী হেসে দেয় লাজুক হাসি। ঠিক তখনই ওর ফোনে ম‍্যাসেজ টোন বেজে ওঠে। শৈলী মোবাইল লক্ খুলতেই মিহরানের নাম ভেসে ওঠে।
-শুনলে তো আমার ফুফুর কথা? আমাদের বাড়ির ছেলেরা বউ পাগল। এখন এই পাগলের অত‍্যাচার সহ‍্য করতে হবে তোমাকে সারাজীবন।

শৈলী ম‍্যাসেজটা পড়ে মুখ তোলে। মাহিবের পাশেই বুকে হাত গোজা মিহরানকে সরাসরি ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে হেসে চোখ নামায়। দুষ্টুমি ভরা সেই চাউনি তে দৃষ্টি নিবদ্ধ করার সাহস নেই ওর। তাও আবার এতো মানুষের সামনে? অসম্ভব।

সবার হাসাহাসির মাঝেও একটি মুখশ্রিতে অমাবস‍্যার রাত ভর করেছে সেটা কেউ দেখলো না। ঝুমাকে ওপরে নিয়ে যাওয়া হবে শুনে তুরিন নিচে নেমেছিল। ওর মুখ ততক্ষণাত কালো হয় যখন শৈলীকে মালিহাদের সাথে ঝুমাকে ছায়া দিয়ে নিয়ে যাওয়ার ওড়না ধরতে দেখে। রাগের সাথে অসম্ভব অবাক হয় ও। মালিহাদের তো কাজিনের কমতি নেই। তাহলে এই বাইরের মেয়েকে কেন এই বিশেষাধিকার দেওয়া হলো? ঐ যে মালিহার খালাতো বোনটা গোমড়া মুখে দাড়ানো। কি যেন নাম? মমমমম….হ‍্যা ঐশ্বর্য। ওকেও তো নিতে পারতো।

এর মাঝেই ফুফুদের কৌতুকের জন‍্য সবাই হেসে ওঠে। তুরিন তখন দাড়ানো দরজার সামনে। এখান থেকে মিহরানকেও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। তুরিন খেয়াল করলো মিহরানকে মোবাইল বের করতে। কিছু একটা টাইপ করে আবার রেখে দিল পকেটে। হাত গুজলো বুকে। চোখে মুখে স্পষ্ট হাসি তবে তার আলাদা এক ভাষা আছে। তুরিন সেই বিশেষ দৃষ্টি অনুসরণ করে। শৈলীর দিকে চোখ আটকায় ওর। মেয়েটা নিজের মোবাইলে কিছু একটা পড়ছে আর হাসছে। তুরিনের বুক ধ্বক করে ওঠে। ওর মস্তিষ্কে ধারনাটা বাজতেই হৃদস্পন্দন থমকে যাওয়ার জোগাড় হয়।

মিহরান কি শৈলী কে কোন ম‍্যাসেজ পাঠালো? সেটাই পড়ছে নাকি অন‍্যকিছু?

তুরিন গভীর ভাবে তাকায় শৈলীর দিকে। ওর বুক নেমে যায় ভেতরের দিকে যখন ও শৈলীর দৃষ্টি তুলতে দেখে মিহরানের পানে। দুজনের চোখের না বলা স্পষ্ট অনুভূতির ভাষা নিমিষেই স্বচ্ছ হয় তুরিনের কাছে। সাথে সাথে যেন পৃথিবীটা ঘুরে ওঠে ওর সামনে।

ইয়া খোদা! মিহরান আর শৈলীর মাঝে কোনো সম্পর্ক হয়ে গেছে।

চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here