#পরিণয়_প্রহেলিকা
#লেখিকা_সিনথীয়া
#পর্ব_৩৯
দুরুদুরু বুকে নিচে নামে শৈলী। ভেতর ভেতর এক অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। সেটা ভয় না। কিছুটা অপরাধবোধ, কিছুটা নার্ভাসনেস মিলিয়ে কেমন একটা যেন অনুভূতি। বোঝানো ভীষণ মুশকিল।
লিফ্ট থেকে বের হয়ে, এদিক ওদিকে তাকায় শৈলী। কোথাও মিহরান বা ওর গাড়িটা না দেখে বিচলিত হয়। মন টা দমে যায় হুট করেই। মিহরান ওকে ছাড়াই চলে গেলেন? এতো রাগ করেছেন ওর ওপর?
এসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতেই বেইসমেন্ট থেকে গাড়ি ওঠার শব্দ আসে। মুহূর্তেই শৈলীর সামনে এসে দাড়ায় মিহরানের গাড়িটা। শৈলী, আপনাতেই, এক পা পিছিয়ে যায়। হাল্কা ঝুকে ড্রাইভিং সিটে মিহরানকে একবার পরখ করে। মুখ শক্ত হয়ে ত্বক টানটান হয়ে আছে। দৃষ্টি টিকানো সোজা সামনের দিকে।
শৈলী কোন উচ্চবাচ্যে না গিয়ে নিজেই পাশের সিটের দরজা খুলে ঢুকে পরলো। বসে সিটবেল্ট টা লাগিয়ে পাশ ফিরে মুখ খুললো,
-আপ….
কিন্তু প্রথম শব্দ পুরোনের আগেই বন্ধ হয়ে গেল কথা। মিহরান ঝড়ের গতিতে স্পিড তুলে গাড়ি ছেড়েছে। শৈলী সাথেসাথেই মুখে কুলুপ আটে। ভীষণ রেগে আছে তার প্রেমিক পুরুষ। এখন কিছু বললেই কাঁচা চিবিয়ে খাবে ওকে।
তার থেকে ও এখন চুপই থাক্।
সময় যায়। এক পর্যায়ে ভার্সিটির গলিতেও ঢুকে পরে গাড়ি। এই মুহূর্তে একটু বিচলিত হয় শৈলী। ক্যাম্পাসে ঢুকে গেলে আর সম্ভব হবে না মানুষটাকে মানানো। যা করতে হবে এখুনি।
শৈলী বুক ভরে শ্বাস নিয়ে পাশ ফিরে। কন্ঠে আদরের বন্যা ভাসায়,
– শুনুন, আপনি আমার ওপর খুব রাগ করেছেন তাই না?
মিহরানের চোয়াল আরও শক্ত হতে দেখে শৈলী। শুকনা ঢোক গিলে ও,
-আই এ্যাম রিয়েলি সরি। আসলে মালিহা, ইতি আপুদের সাথে গল্প করতে গিয়ে আমি ভুলেই গিয়েছিলাম।
– ভালো। ননদদের সাথেই থাকো। স্বামীর আর কি দরকার?
শৈলী ভেতর ভেতর একদম দমে যায়। মিহরানের বলা কথাটা আহ্লাদি মনে হলেও কতোটা কঠোর রুপ নিয়ে ও বলেছে তা শুধু শৈলীই জানে। আপনাতেই নিজের হাত মিহরানের উরুর ওপর রাখা বাম হাতে গলিয়ে দিল,
-আমাকে এবারকার মতন মাফ করা যায় না? আর করবো না এরকম, প্রমিস।
এতো আদূরে কন্ঠেও কঠীন পুরুষটার মন বিন্দুমাত্রও গোললো না। ইতিমধ্যে ক্যাম্পাসেও প্রবেশ করেছে গাড়ি। মিহরান একসাইডে গাড়ি থামিয়ে সামনে তাকিয়ে কঠোর সুরে প্রশ্ন করলো,
-ক্লাস কয়টায় শেষ?
মিনমিনে গলায় পাশ থেকে উত্তর আসে,
– সাড়ে তিনটায়। আপনার সাথেই লাস্ট ক্লাস।
– আমি ঠিক পৌনে চারটায় পারকিং এ থাকবো। চলে আসবা।
ব্যাস! এটাই শেষ বাক্য বের হলো মিহরানের মুখ থেকে এবং এখনকার জন্য এটাই যে ইতিবাক্য তা বুঝতে শৈলীর ভুল হলো না। মুখটা ভার করে শেষবার মিহরানের দিকে তাকিয়ে গাড়ি থেকে নামলো ও।
ও সরে দাড়াতেই মিহরান গাড়ি নিয়ে পারকিং লটে ঢুকে পরলো। শৈলীর এখন রীতিমতো কান্না পাচ্ছে। নিজেকে মন ভরে কষলো কতোক্ষণ,
– শৈলী, তুই একটা বড় মাপের অকামের ঢেকি। ধুর! কালকে ঐ আড্ডায় এতো মনোযোগ দেওয়াটাই ঠিক হয় নি তোর। যেখানে নিজের প্রেমই নড়বড়ে অবস্থায়, সেখানে তুই বসছিস অন্যের প্রেমগাথা শুনতে? উনার রাগ হওয়াটাই যায়েজ আছে।
ভীষণ রকমের মন খারাপ নিয়ে শৈলী ক্যাম্পাসে ঢোকে। নিজের ডিপার্টমেন্টের মূল ফটকেই দেখা হয় প্রিতি আর কেয়ার সাথে। ওদেরকে বিয়ের বিষয়টা বলা হয়নি আর কেয়া, প্রিতি দুজনেরই হাসি মাখা জ্বলজ্বল মুখদ্বয় দেখে শৈলী নিজের কষ্টগুলো চেঁপে যায়।
শৈলীকে দেখেই চিৎকার দিয়ে কাছে আসে কেয়া,
-শৈলু, বিশাল নিউজ আছে।
শৈলী অবাক চোখে তাকানোর মধ্য দিয়েই প্রিতি লাজুক মুখে এসে পাশে দাড়ায়। ওকে দেখে শৈলী আরও বিভ্রান্তিতে পরে,
– কি ব্যাপার প্রিতি? তোর গাল এরকম টমেটোর মতন লাল হয়ে আছে কেন?
প্রিতি মাথা আরো নুইয়ে ফেলে। কেয়া ওর হয়ে উত্তর দেয় ততক্ষণাত,
– লাল হবে না আবার? না হয়ে যাবে কই? ম্যাডাম গত পরশুদিন প্রোপোসাল পেয়েছেন তার পছন্দের মানুষের থেকে। বুঝছিস অবস্থা শৈলু? নাও শি ইস অফিশিয়ালি ইন আ রিলেইশনশিপ।
শৈলী খবরটা শুনে চোখ বড় বড় করে হেসে দেয়। অতিরিক্ত খুশির চোটে জাপ্টে ধরে প্রিতিকে।
– কনগ্র্যাট্স দোস্ত। এটা তো বিশাল খবর। আই এ্যাম সো হ্যাপি ফর ইউ। কিভাবে করলো প্রোপোজ? আচ্ছা আগে বল্ ওনার নাম কি?
প্রিতি লাজুক হাসে,
-ওর নাম শাফকাত্।
-ওকে। ভাইয়া কি করেন?
– ফ্যামিলি বিজনেস আছে ওদের।
-হমমম, ভালো ভালো এবার বল্ কিভাবে প্রপোজ করলো তোকে? ফুল ডিটেইল্স বলবি, কোনো কিছু বাদ দিবি না প্রিতি।
শৈলীর আর কেয়ার উত্তেজনা দেখে প্রিতি লজ্জায় ধাতস্থ হয়। বান্ধবীরা যে এভাবে ওকে নিয়ে মেতে উঠবে ও আগে বুঝতে পারেনি। ওদের সাথে আর না পেরে, শেষ পর্যন্ত বর্ণনা দেয় ও,
– শুক্রবার, মানে পরশুদিন ও আমাকে ফোন দেয় দেখা করার জন্য। একটা রেস্টুরেন্টে আসতে বলে। আমিও চলে যাই সেখানে। তিনতলায় উঠে দেখি কেউ নেই, ওপেন স্পেসটা পুরাই জনমানব শুন্য। ভুল জায়গায় এসেছি ভেবে যখনই ছাদ থেকে বেরতে যাব, ঠিক তখনই মাঝখানের অংশে আলো জ্বেলে ওঠে। আমি তখন তকিয়ে দেখি ও ঠিক সেখানটার হাটু গেড়ে বসা, হাতে অনেক বড় একটা ফ্লাওয়ার বুকে।
প্রিতি দুই বান্ধবীদের উল্লাসিত চোখে দৃষ্টি দেয়। তারপর দম নিয়ে আবার শুরু করে,
– জানিস আমি না তখন আসলেই দিশেহারা হয়ে পরেছিলাম। আগাবো না পেছাবো কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। এরকম করে ও আমার জন্য কিছু এ্যারেঞ্জ করবে আমি ভাবতেই পারিনি।
কেয়া মাঝখান থেকে উত্তেজিত স্বরে কথা বলে ওঠে,
– আমি এখান থেকেই চিন্তা করে মনের ভেতর প্রজাপতি ওড়ার ভাবনা পাচ্ছি রে প্রিতি। তোর তখন না যেন কেমন লাগছিল? এতো রোমান্টিক ভাইয়া…ওয়াওও। তারপর কি হলো জলদি বল্।
প্রিতি হেসে দিয়ে আবার নিজের বৃত্তান্ত শুরু করলো।
– যাই হোক, আমি আগালাম এক পা এক পা করে। ওর কাছে যেয়ে দাড়াতেই আমার চোখের দিকে ওপরে তাকিয়ে আমাকে ওর মনের কথা প্রকাশ করলো। বিশ্বাস কর্ দোস্ত আমি তখন এই দুনিয়ায় ছিলাম না। পেছনে সফ্ট একটা মিউজিক চলছিল, তার সাথে বইছিলো মৃদুমন্দ বাতাস, এসবের মাঝে এতো মায়বী মুহূর্ত ও সৃষ্টি করেছিল যা আমার কল্পনার বাইরে ছিল।
শৈলী এবার প্রশ্ন তোলে,
– তুই তখন কি করলি? তোর রিয়্যাকশন কি ছিল? হ্যা বলে দিসিশ তখনি?
প্রিতি আবার লাজুক হাসে,
– আমি কিছুই বলতে পারি নাই জানিস? আসলে বলার মতন আমার অবস্থাই ছিল না তখন। এতোকিছু একসাথে আমাকে বাকরুদ্ধ করে ফেলেছিল। শুধু ওর হাত থেকে ফুলের তোড়াটা নিয়ে নিয়েছি। আই গেস…সেটাতেই ও উত্তর পেয়ে গিয়েছে।
দুই পাশ থেকে শৈলী আর কেয়া প্রায় একসাথে জড়িয়ে ধরে প্রিতিকে। খুশিতে আত্মহারা দুজন আবারো ওকে শুভেচ্ছা জানায়। কেয়া তখন বলে,
– প্রিতি ফুল গুলা পরে কি করসিলি? বাসায় তো নিশ্চয়ই নিতে পারিস নাই তাই না?
– মাথা খারাপ তোর? একশোটা গোলাপের বুকে বাসায় নিতাম কেমনে? ওকেই পরে ফেরত দিয়েছি। প্রথমে একটু কষ্ট পেলেও বিষয়টা বুঝে আর কিছু বলেনি ও।
কেয়ার মাথায় হাত,
– একশোটা গোলাপ? ওরে বাবা! ভাইয়া দেখি সেইরকম রোমান্টিক রে।
কেয়া প্রিতি এগুলো নিয়ে হাসলেও, শৈলী কিছুটা থমকে যায়। কেন যেন মনে একটা আজব খটকা লাগে। নিজের ভেতরেই অবাক হওয়া হাসি হাসে ও,
– কি ব্যাপার? আজকাল রেস্টুরেন্ট বুক করে একশো টা গোলাপ দিয়ে প্রোপোজ করার কোন ট্রেন্ড চালু হয়েছে নাকি? কালকে মালিহা আপুর প্রপোসালও শুনলাম আজ প্রিতিরটা। কেমন হুবুহু মিলে যাচ্ছে।
-এই শৈলী? কি চিন্তা করিস?
শৈলী বাস্তবে ফেরে,
-না কিছু না। তোরা কি বলছিলি?
কেয়া দুষ্টুমির দৃষ্টিতে তাকায়,
– হমমম। বলছিলাম যে, আমার হলো, প্রিতিরও হয়ে গেল। এখন শুধু তুই বাকি। তুই তোর এই বোরিং সিঙ্গেল লাইফ থেকে বের হয়ে এখন একটা রিলেশনে আয় বান্ধবী।
শৈলী ঠোট টিপে। মনে মনে ভীষণ হাসি পায় ওর
– হায় রে দোস্ত, তোরা তো জানলিই না এখনো যে তোদের চ্যাপ্টার পড়ার আগেই আমি পরের চ্যাপ্টারে চলে গিয়েছি। বয়ফ্রেন্ড না, সয়ং স্বামী মহোদয় আমার সিঙ্গেল লাইফটাকে ডাবল করে দিয়েছে। এখন এনাকে আজ মানাবো কিভাবে সেই তরকিব টাই মাথায় আসছে না।
ততক্ষণে প্রথম ক্লাসের সময় হয়ে যাওয়াতে, শৈলী সবাইকে তাড়া দেয়। ওদের আলোচনার আপাতত ওখানেই ইতি টানতে হয়।
……………………
দিন গড়িয়ে দুপুর হয়। শৈলীরা লাঞ্চ করে আবার ক্লাসের দিকে ফিরছে। এখন মিহরানের ক্লাস। সেই যে গাড়িতে শেষ দেখলো, আর দর্শন হয়নি মানুষটার। একদিকে তাকে দেখার উত্তেজনা অন্যদিকে তাকে মানানোর টেনশন, দুটো মিলে শৈলীর শরীরের অনুভূতিগুলো রীতিমতো ঘুরপাক খাচ্ছে। ক্লাসে তাই ও বেশ চুপচাপ ছিল, বান্ধবীদের সাথে আড্ডায় যোগ দিচ্ছিলো না। তখনই তটস্থ পায়ে মিহরান ক্লাসে প্রবেশ করলো। ওকে দেখে সবাই ওঠাতে শৈলীও উঠলো। মিহরান একবার সবাইকে দেখে বসতে বলে সোজা পড়ানো শুরু করলো। শৈলীর দিকে তাকালোই না। শৈলীর মনটা ডুব দিল মন খারাপের নদীতে। এই পাহাড়সম অভিমান গলায় কেমনে ও?
পুরো ক্লাসে পিন পতন নিরবতা বিরাজ করে মিহরান একাধারে পড়িয়ে গেল। মাঝে মাঝে যখনই স্টুডেন্টদের বোঝানোর জন্য মুখ তুলেছে, শৈলীর সাইডে ভুল করেও তাকায়নি। অনেকবার উৎসুক শৈলী ও দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করেছে, মিহরান প্রশ্ন করলে ও হাত তুলেছে উত্তর দেয়ার জন্য, কিন্তু সবই বিফল হয় একে একে। মিহরান দেখেই না শৈলীর প্রচেষ্টা।
ক্লাস শেষে মিহরান প্রস্থান করতেই সবাই বলাবলি করা শুরু করলো মিহরানের মেজাজের ব্যাপারে। সবার কাছেই স্পষ্ট ছিল ওর রাগি ভাবটা। শৈলী শুনছে মেয়েদের বলতে,
– দেখ্ যেয়ে স্যারের গার্লফ্রেন্ডের সাথে ঝগড়া হয়েছে। তাই বেচারা মেজাজ গরম।
– আরে নাহ্। স্যারের কোনো গার্লফ্রেন্ড নাই।
– বলসে তোকে! এতো সুদর্শন পুরুষ আবার সিঙ্গেল থাকে নাকি? অবশ্যই আছে কেউ।
– না রে। আমি খোজ নিসি। নাই কেউ। আর স্যার দেখতে সুন্দর এটাতে নো ডাউট, কিন্তু যেই ধরনের একজন রোবট তিনি তাতে তার গার্লফ্রেন্ড থাকাও সন্দেহে পরে। এরকম রগচটা গম্ভীর আনরোমান্টিক মানুষের সাথে কেমনে কেউ জীবন কাটাবে, বল তো?
শৈলী সব শোনে আর মনে মনে লজ্জায় হাসে। গত দুদিনের ওদের একান্ত কাটানো সময়গুলোর চিত্র ভেসে ওঠে চোখের পর্দায়। ইশ! মেয়েগুলো জানতেই পারবে না কখনো, কোন প্রকৃতির রোমান্টিক মানুষ এই মিহরান হাসান।
নামটা মাথায় আসতেই টনক নড়ে শৈলীর। ঝট্ করে হাতঘড়ির দিকে তাকায়। আয় হায়! মিহরান না ওর জন্য পার্কিং লটে ওয়েট করবে বলসিলো? আর মাত্র পাঁচ মিনিট বাকি, আর শৈলী এখানেই বসে বসে অন্যের কথা গিলছে? আবার সেইম ভুল। ধুৎ শৈলী! তুই একটা গবেট।
শৈলী তাড়াতাড়ি ব্যাগ গুছিয়ে কোনমতে বান্ধবীদের বাই বলে দৌড় দেয়। পেছনে এক অবাক কেয়া আর প্রিতিকে রেখে রুম থেকে ঝড়ের গতিতে বের হয়।
…………,
পার্কিংলটের যাওয়ার লিফ্টে চাপ দিয়ে অপেক্ষারত শৈলী নিজের চিন্তায় ডোবে। বাসায় যাওয়ার পথে যেভাবেই হোক মিহরানের মন গলাতেই হবে। নাহলে আজ প্রোগ্রামের ব্যস্ততায় আর সময় মিলবে না।
লিফ্ট খুলতেই মিহরানকে সামনে দেখে হোচট খায় শৈলী। তবে মনে মনে আবার স্বস্তিও মেলে। যাক্, মানুষটাও এখুনি নামছে, ও লেইট করেনি।
শৈলী ঢুকতেই মিহরান লিফ্টের বন্ধ হওয়ার বাটনে চাপ দেয়। কিছুটা দূর থেকেই একজন আসছিল, কিন্তু তার আসার আগেই বন্ধ হয়ে যায় লিফ্ট। শৈলী মুচকি হাসে। চলো, এটা অন্তত ভালো যে মিহরান ওদের দুজনের মাঝে তৃতীয় কাউকে লিফ্টে ঢুকতে দেয়নি। নিজেদের প্রাইভেসি মেনটেইন করেছে। রাগ করলেও, সম্পর্কের প্রাধান্যটা ঠিকই আছে।
শৈলী এবার আগ বাড়িয়ে মিহরানের হাত ধরে। পুরুষালি তালুতে নিজের পুরো কব্জি ডুবিয়ে দেয়। মিহরান ঝট করে পাশে তাকায় নিজের হাতের দিকে, তারপর শৈলীর দিকে, আবার হাতের দিকে। তারপর সেই একই গতিতে হাত ছাড়িয়ে নেয়।
শৈলী ঝটকা খায় এতে। ও ভেবেছিল হয়তো মিহরান হাতটা ধরতে দিবে অন্তত। নাহ্ তাও দিল না। আচ্ছা জ্বালা তো!
লিফ্ট থেকে নেমে মিহরান সোজা গাড়ি আনতে চলে গেল।
পাঁচ মিনিটের মাথায় গাড়িটা এনে শৈলীর সামনে দাড় করালো। ক্যাম্পাস ছেড়ে বের হতেই আবার শৈলী মিহরানের হাত ধরলো। এবার শুধু ধরলো না, একেবারে টেনে নিয়ে রাখলো নিজের কোলের মাঝে। মিহরান অবাক চোখে ওকে দেখে আবার দ্রুত সামনে তাকায়।
– আরে করছোটা কি? হাত ছাড়ো।
– একদম না। আজকে এই হাত ছাড়বো না আমি।
– আরে, তো গাড়ি চালাবো কিভাবে?
– এক হাত দিয়েই তো চালাচ্ছেন, সেটাই করেন।
-কি বাচ্চামো করছো শৈলী? হাত না ছাড়লে গিয়ার শিফ্ট করবো কেমনে?
– আপনি এখন সোজাই যাবেন, সো গিয়ার শিফ্ট করা লাগবে না। আর এটা বাচ্চামো হলে হবে, তবুও আমি হাত ছাড়বো না যতক্ষণ না আপনি বলবেন যে আপনি আমাকে মাফ কখন করবেন। এটলিস্ট আপনাকে সরি বলার একটা চান্স তো দিন। ভুল হইসে, মানছি তো। তাই বলে আমার জান নিবেন নাকি?
এতো কথা এক নাগাড়ে বলে শৈলী দম নেয়। পুরো গাড়ি জুড়ে বিরাজ করে একদম নিস্তব্ধ পরিবেশ। মিহরান একবার শান্ত চোখে নিজের স্ত্রীকে দেখে নেয়। তারপর আবার মন দেয় ড্রাইভিংয়ে।
– আমি রাগ করিনি। ছাড়ো এখন।
– এটা আপনার মুখের কথা। তা নাহলে এতোক্ষণে আমার আঙ্গুল আপনার আঙ্গুলের ভাজে গলে যেত। আপনি এখনো রাগ আমার ওপর।
ততক্ষণে নিজেদের বাসার গলিতে প্রবেশ করে ওদের গাড়ি। সময় ফুরিয়ে গেছে দেখে শৈলীর ভীষণ মন খারাপ হয়ে যায়। হাত ছেড়ে দেয় ও মিহরানের। লিফ্টের কাছে এসে গাড়ি থামতেই শৈলী নেমে দরজা বন্ধ করতেই জানালা নামে।
শৈলী থমকে যায় পেছনের ডাকে,
– স্বামীর অভিমান ভাঙানোর কৌশল স্ত্রীদের জানা থাকেই। একটু মাথা খাটালেই সেটা খুজে পাওয়া এতো কঠিন কিছু না।
হকচকানো শৈলী বোঝার আগেই জানালা আবার উঠে যায়। বদ্ধ জায়গায় আওয়াজ তুলে গাড়িটা চলে যায় বেসমেন্টের দিকে।
……………..
হাসান পরিবারে বিকেল নামে আজ খুব দ্রুত। ওদের এরিয়ার ভেতরেই একটা ছোট কনভেনশন হলে আজ ওদের অনুষ্ঠান। কিন্তু ওদের অনুষ্ঠান কিন্তু ছোট করে হচ্ছে না। প্রায় ছয়শো লোকের আয়োজন। মাহিব আর মেহরাব প্রায় দুপুর বারোটার পর থেকেই বাবুর্চিদের সাথে তদারকিতে লেগে আছে। মিহরান বাসায় ফিরে নামাজ পরে, একদম রেডি হয়ে চলে গেছে ওখানে। নিজে উপস্থিত থেকে ভাইদের ফ্রি করে দিয়েছে রেডি হবার জন্য।
মাহিরা আর মালিহাকে ভয়ংকর রকমের সুন্দর দেখাচ্ছে। শৈলীর আইডিয়াটা আসলেই জমেছে। লেহেঙ্গাতেই মানিয়েছে ওদের। ঝুমা আজ একটা ফিউশন পরেছে। দেখে আনারকলি কামিজের মতন হলেও আসলে পরেছে ও গাউন। বুকের নিচ থেকে পা পর্যন্ত পুরোটুকুই ঢোলা, টান খাওয়ার সম্ভবনাই নেই। আফিয়া বুদ্ধি করে বানিয়ে দিয়েছেন এটা।
কিছুক্ষণ পর শৈলীও ওদের সাথে যোগ দিল। টিয়া আর কালো কম্বিনেশনের লেহেঙ্গা-গাউনটাতে এতো মানিয়েছে ওকে উপস্থিত একটা মানুষও না প্রশংসা করে পারলো না। এই ড্রেস টার জন্য মা কে মিথ্যা বলতে হয়েছে ওকে। বলেছে মিহরানের সাথে ঐ দোকানে মানি ব্যাগ খুজতে গিয়ে এটা পছন্দ হয়ে গিয়েছিল বলে কিনে ফেলেছে। মা শুনে আর কিছু বলেননি।
এশার আজানের আগে আগে ঝুমাকে নিয়ে সবাই প্রোগ্রামে হাজির হলো। শৈলী এসেই এপাশ ওপাশ খুজে চলেছে মিহরানকে। বিরক্তও হচ্ছে ও। আরে? গেল কই মানুষটা?
তখনই গাঢ় সবুজ ফরমাল শার্ট আর কালো প্যান্ট পরে ওর সামনে প্রকট হয় মিহরান। শৈলী নিজেকে কি দেখাবে, মিহরানকে দেখে ওর চক্ষু চরকগাছ। এতো বেশী হ্যান্ডসম লাগছে মানুষটাকে! চুলটা সুন্দর করে জেল দিয়ে সেট করা, হাতে বড় ডায়ালের ঘড়ি আর শরীরে মাদকময় পারফিউমের ঘ্রাণ। শৈলী আপনাতেই চোখ বন্ধ করে ফেলে, ওর ঠোট শুকায়, একটুপর গলাও।
মিহরান শৈলীর সামনে দাড়ালেও কথা বলছে মালিহার সাথে। একবার দেখেছে ওকে, মাথা থেকে পা পর্যন্ত চোখ বুলিয়েছে, কিন্তু অতটুকুই। শৈলী মাথা নোয়ায়। বিকালের মিহরানের শেষ কথাটা নিয়ে বাসায় এসে অনেক ভেবেছে ও। একসময় পেয়েছেও খুজে।
মিহরান চলে যাওয়ার পর শৈলী মাহিরাকে কনুই ধরে টানে,
-মাহি আমার জন্য একটা কাজ করে দিবি?
-কি কাজ?
শৈলী কানের কাছে কিছু একটা ফিসফিস করে বলে। শুনে মাহিরা ভাব নেয়,
– আমি তোমাদের ভালোবাসার পায়রা হইসি, তাই না? তোমাদের বার্তা আদান প্রদান করি শুধু। সকালে ভাইয়া পাঠাইসে তোর কাছে এখন আবার তুই পাঠাচ্ছিস ভাইয়ার কাছে। বাহ্।
শৈলী মিনমিন করে,
– এমন করিস কেন বোন? তোর ভাইকে মানানোর কৌশল পেয়েছি তো। এখন একটু হেল্প কর্ না।
মাহিরা উৎসুক হয়ে প্রশ্ন করে,
– এই কি কৌশল কি কৌশল? বল না?
শৈলী লজ্জায় চোখ বড় করে মাহিরার কাধে আল্তো চাপড় দেয়,
– তোর এসব শুনতে হবে না। আগে তন্ময় ভাইয়াকে বিয়ে কর্, তারপর বলবো। এখন আমার উপকারটা করে দে না বোন।
মাহিরা খিলখিলিয়ে হাসে। তারপর চোখের ইশারায় শৈলীকে আস্বস্ত করে। মিহরানের কাছে শৈলীর বার্তা সহিসালামতে পৌছে যাবে।
………..
মালিহার সপ্তম কলে তুরিন ফোন ধরেছে। ও চলে এসেছে প্রায় শুনে মালিহার স্বস্তি হয়। এই মেয়েকে আজ এখানে আনতে মালিহার যে কতো কাঠখোর পোড়াতে হয়েছে ঐ জানে সেটা।
তুরিন গাড়ি থেকে নামে ভারাক্রান্ত মুখে। গতকাল যেই হালে গিয়েছে, আজ ওর আসার কোনো কারণই ছিল না। কিন্তু এসেছে। কারণ ও নিজে থেকেই আজ যাচাই করবে সত্যটা। গতকাল যা দেখেছে ও সেটা প্র্যাক্টিকালি আসলে কিছুই ছিল না। ওর মনে হয়েছে মিহরান শৈলী সম্পর্কে জড়িয়েছে। কিন্তু আসলে এটা সত্যি কি না, তা তো জানে না ও। সেটাই আজ জানবে।
হলে ঢুকেই তুরিন একজনকে খুজলো তবে সেটা মালিহা না। কাঙ্ক্ষিত মানুষটাকে পেয়ে আগালো ও।
– মাহিরা?
মাহিরা এক কাজিনের সাথে কথা বলছিল। ডাক শুনে ফিরে তাকায় পেছনে,
– তুরিন আপু। কেমন আছো? কখন এলে?
-এইতো মাত্র।
– আপুকে খুজছো? এখানেই ছিল তো।
-না মালিহাকে পেয়েছি। দেখা হয়েছে। তোমার সাথেই আসলে কথা ছিল একটু।
মাহিরা অবাক হয়,
– হ্যা বলো।
– তোমার ঐ যে বান্ধবিটা আছে না, শৈলী নাম মনে হয়। আমাদের সাথে শপিং এ ছিল?
– হ্যা হ্যা শৈলী।
-হ্যা। আচ্ছা ও দেখতে খুব সুইট। ওর কি কোনো পছন্দ টছন্দ আছে নাকি? কোনো রিলেশন? কিছু জানো?
মাহিরা ঢোক গিলে। এই সারসে! তুরিন আপুকে কিছু বললে সেটা মালিহা আপু পর্যন্ত যেতে সময় লাগবে না। আর আপু শৈলী আর মেঝ ভাইয়ার ব্যাপারে জেনে গেছে এটা মেঝ ভাইয়া জানলে ওকে আস্ত রাখবে না।
– না আপু, ওর কোনো পছন্দ নেই? কিন্তু তুমি হঠাৎ ওর ব্যাপারে জিজ্ঞেস করছো কেন?
তুরিনের সারা গা চনমনিয়ে ওঠে খুশিতে। মাহিরা আর শৈলী খুবই ক্লোজ। যদি মাহিরা বলে শৈলীর কেউ নেই, তাহলে সেটা বিশ্বাস করাই যায়।
– তেমন কোনো কারণ নেই মাহি। আসলে মেয়েটা খুব সুইট দেখতে তো, তাই এমনিতেই জিজ্ঞেস করলাম আরকি। আচ্ছা প্রোগ্রাম এঞ্জয় করো। আমি মালিহার কাছে যাই।
ওখান থেকে সরে এসে তুরিন পারলে একটা লাফ্ দেয়। গলার পাথরটা নেমেছে। এখন মিহরানকে নিয়ে ওর কোনো টেনশন নেই। মিহরান ওর হবেই।
………………..
পুরোটা প্রোগ্রাম শৈলী আর মিহরানের কোনো কথা হয়নি। মাহিরা এসে জানিয়েছে যে ওর বার্তা পৌছানো হয়েছে মিহরানের কাছে। মিহরান শুনেছে পুরোটুকু, কিন্তু কোনো উত্তর দেয়নি। শৈলী এটাতে একটু মন খারাপ করায়, মাহিরা আস্বস্তি দিয়েছে যে চুপ থাকা সম্মতির লক্ষণ।
এদিকে তুরিনও আজ কোনো সুযোগই পায়নি মিহরানের সাথে কথা বলার। আত্মীয় দিয়ে ঘেরা মিহারানের ধারে কাছে ঘেষতে পারেনি ও। এমনকি সালামটাও দেওয়া হয়নি। তবে তাতে তুরিনের খারাপ লাগছে না। আজ না হোক, সামনে তো কথাবার্তা হতেই থাকবে। তাও আবার একান্তে।
চলবে।
আজ মধ্যরাতের দিকে চেষ্টা করবো ছোট একটা পর্ব পোস্ট করতে, শুধু শৈলী আর মিহরানকে ঘিরে।
ভালোবাসা অবিরাম।