#পরিণয়_প্রহেলিকা
#লেখিকা_সিনথীয়া
#পর্ব_৪২
রাত সাড়ে আটটা। ঢাকা শহরের বুকে কেবলই সন্ধ্যা বলা চলে। মানুষের হই হট্টোগোল আর যানবাহনের কৃত্রিম ঝড় তোলা শব্দে মুখরিত চারিপাশ। তবে হাসান পরিবারের ড্রয়িংরুমের চিত্রপট্ বাইরের পরিবেশ থেকে আজ সম্পূর্ণই ভীন্ন। পুরো থমথমে হয়ে আছে গোটা বাসা। নেই কারও কোনো ব্যস্ততা, না আছে কোনো তৎপরতা। সময় যেন থমকে গেছে এই পরিবেশে।
ড্রয়িং রুমের এক সোফায় বসেন আছেন বাবুল সাহেব আর আফিয়া বেগম। আরেক পাশের সোফায় রেহনা আর আজাদ সাহেব। তৃতীয় সেটে বসা মিহরান আর মাহিব। নিজের ছোট ভাইয়ের কাধে ভরসার হাত বাড়িয়ে রুমের আবহাওয়ার পড়ার চেষ্টি করছে মাহিব। আজ সন্ধ্যায় যা হলো তা ওর মতন সর্বদা হাস্যজ্জ্বল মানুষকেও চিন্তায় ফেলে দিতে বাধ্য করেছে।
অফিস থেকে মাহিব বের হয়েছিল একজন ফরেন ক্লাইয়েন্টের সাথে মিটিং এ। রাস্তা আধাও পার করতে পারেনি, যখন বাবার ফোন আসলো।
– মাহিব, মিটিং ক্যান্সেল করে দ্রুত বাসায় যাও, আমিও আসছি।
বাবার গলা অত্যন্ত শান্ত শোনালেও সেটার প্রখরতা বুঝতে কষ্ট হলো না মাহিবের। কোনো যে একটা অঘটন ঘটেছে সেটার আভাস বাবার কন্ঠেই ধরতে পারলো ও। প্রথমেই স্বাভাবিকভাবে মাথায় আটক করলো সদ্য আট মাসে পরা গর্ভবতী স্ত্রীর চিন্তা,
– কি হয়েছে আব্বু? ঝুমা ঠিক আছে তো?
– বৌমা ঠিক আছে। ওর কিছু হয়নি। তুমি বাসায় আসো, সব জানাচ্ছি।
মাহিবের চিন্তাটা একটু কমেছিল রাস্তায়। কিন্তু বাসায় এসে মিহরান আর শৈলীর বিয়ের খবর শুনে পুরা আকাশ থেকে পরার মতন অবস্থা হয়েছিল ওর। এই দুইজন মিললো কবে, প্রনয় হলোই কখন আর সেটা পরিনয়েই বা কিভাবে এতো দ্রুত আগালো, তাও সবার অগোচরে সেটা ধরতেই মস্তিষ্ক গুলিয়ে এসেছিলো ওর।
এর মাঝে মায়ের পাথরের মতন অভিব্যক্তি, বাবার থমথমে চেহারা এবং সবচাইতে জরুরী, মিহরানের শক্ত চোয়ালে বুকে হাত ভাজ করে দাড়িয়ে থাকাটা ভীষণ চিন্তায় ফেলে দিয়েছিল ওকে। সবার মূর্তিয়মান ভাবান্তর দেখে ও বুঝতে পেরেছিলো এখন ওকেই সবাইকে সামলাতে হবে।
ওদিকে ওপরে নাকি আরেক সমস্যা হয়েছে। মালিহার কোন বান্ধবী মনে হয়ে এসেছিল বাসায়। হঠাৎ করেই নাকি নিচে নামতে গিয়ে মাথা ঘুরে পরে গিয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। মরার ওপর খাড়ার ঘা বোধহয় এটাকেই বলে। বাসার এতো বাজে পরিস্থিতি, সেটাই কিভাবে সামলাবে মাহিব তাই বুঝতে পারছিল না, তার ওপর বাইরের মানুষেরও টেনশন করতে হয়েছিলো ওকে। তাও একদিক দিয়ে ভালো, বাসায় আজ সব ভাইবোন উপস্থিত ছিল। ঝুমা সহ ছোটদের সবাইকে মালিহার বান্ধবীর কাছে ওপরে থাকতে বলে মাহিব নিচে মিহরান সহ বাবা মাকে নিয়ে বৈঠকে বসেছিল।
এই ছিল গত দুই ঘন্টা আগের অবস্থা। এর মাঝে চিত্রপট পাল্টেছে, আরও ঘনিভূত হয়েছে পরিস্থিতি। কারণ রেহানা আর আজাদ সাহেব কেও ডেকে পাঠানো হয়েছে। এই বাড়ির ছেলে তো কান্ড ঐ বাড়ির মেয়ের সাথেই ঘটিয়েছে, তাদেরও সব জানার সমান অধিকার আছে।
…………………….,..
সন্ধ্যায় আজাদ সাহবে বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে যখন স্ত্রীর সাথে চা পান করতে বসেছেন, তখন রেহানা আবিদের প্রপোসাল টা ওনার সামনে রাখেন। প্রথমেই আজাদ সাহেবের ভ্রু কুচকে যায়,
– রেহানা, আমি তোমাকে আগেই বলেছি, এতো তাড়াতাড়ি আমার মেয়েদের বিয়ে আমি দিতে চাই না। মাত্র পড়াশোনা করছে শৈলী, আরো বড় হোক নিজের পায়ে দাড়াক তারপর নাহয় চিন্তা করবো। ওরা তো আর আমাদের ঘাড়ে বোঝা হয়ে নেই।
রেহানা ঠোট টানলেন। স্বামীর এই চিন্তাধারা ডায়লগ্ আকারে তার মুখস্ত।
-শোন, কোন বাবার কাছেই তাদের মেয়েরা বড় হয় না। তুমিও বেতিক্রম না। তবে এই বাস্তবতাও তোমার মাথায় রাখতে হবে যে মেয়ে এখন বিয়ের যোগ্য হয়েছে। সোসাইটি সামনে গেলে এরকম প্রপোজাল আসতেই থাকবে। আর আফিয়া ভাবীদের পরিবার তো খুবই ভালো। তাদের বংশের ছেলে অপছন্দ হওয়ার মতন না। আবিদ একটা প্রাইভেট ব্যাংকে আছে, ভালো আর্ন করে, তোমার মেয়েকেও নিজ থেকেই পছন্দ করেছে ও। তাহলে ওকে দেখতে সমস্যা কোথায়? অন্তত বিবেচনায় তো নিয়ে আসা যায় নাকি? ভালো না লাগলে…
কথা শেষ করতে পারেন না রেহানা তার আগেই কলিং বেল বাজে। নিপুন ভেতর থেকে দৌড়ে এসে দরজা খুলে।
– মাহিব ভাইয়া?
মাহিবের নাম শুনে রেহানা অবাক হন। স্বামীর দিকে এক পলক তাকিয়ে আপনাতেই বলে ওঠেন,
– মাহিব তো কখনো…আসেনা। হঠাৎ?
আজাদ সাহেবও একটু অবাক হয়েছেন,
– যেয়ে দেখ তো? ওর স্ত্রীকে নিয়ে আবার কোন সমস্যা হলো নাকি।
রেহানা স্বামীর কথায় আরও তৎপর হন। দ্রুত পায়ে হেটে সদর দরজার কাছে যান। সবসময়ে প্রানচঞ্চল থাকা মাহিবের থমকানো মুখটা দেখে মনে কু ডেকে উঠে ওনার।
-আব্বু, কি ব্যাপার? কোন সমস্যা?
মাহিব সালাম দেয়। রেহানা সালামের উত্তর দেওয়ার পর বলে,
– আঙ্কেল বাসায় ফিরেছেন আন্টি?
– হ্যা আব্বু, ফিরেছেন তো। কেন? ওনাকে লাগবে?
– আসলে আপনাদের দুজনকেই লাগবে আন্টি। যদি কিছু মনে না করেন তাহলে আমাদের বাসায় একটু আসতে হবে।
রেহানা খুব অবাক হন,
– কি ব্যাপার আব্বু? কোনো সমস্যা হয়েছে কি?
– আন্টি আপনারা আসুন…একসাথেই কথা হোক।
শুকনো মুখে রেহানা মাথা হাল্কা ঝাকিয়ে সম্মতি জানান। এরপর মাহিব চলে যায়। কিছুক্ষণ পর আজাদ সাহেব সহ রেহানা পৌছান পাশের বাসায়। ড্রয়িংরুমের থমথমে পরিস্থিতি দেখে কেন যেনো তার বুক ধ্বক করে ওঠে। আপনাতেই আল্লাহ্ র দরবারে দোয়া ওঠে,
– ইয়া আল্লাহ্ মান বাঁচিয়ো।
কেন ঠিক এই দোয়াই ভেতর থেকে ঠিকরে বের হলো, রেহানা জানেন না। তবে আফিয়ার মূর্তির মতন কঠোর চেহারা দেখেই হয়তো এসেছে এটা।
রেহানা স্বভাবতোই আফিয়ার কাছে যেতে চাইলেন, কিন্তু আরও অবাক হলেন যখন তিনি আগাতেই মাহিব সামনে আসলো।
– আন্টি,আঙ্কেল আপনারা বসুন।
উল্টো পাশের সোফার দিকে চোখ দিয়ে রেহানা আবার মাহিবের দিকে চায়,
– ভাবীর কি হয়েছে আব্বু?
এবার কথা বলেন বাবুল সাহেব,
– আস্সালামুআলাইকুম ভাবি, আস্সালামুআলাইকুম ভাই।
আফিয়ার চিন্তায় রেহানা বাবুল সাহেব কে দেখেননি পাশে। উনি এসে আজাদ সাহেবের সাথে করমর্দন করতে করতে রেহানা নিজের শাড়ির আঁচল আরও একটু টেনে কাধের পাশে আনলেন।
– ওয়ালাইকুম সালাম ভাই।
বাবুল সাহেব শুকনো একটা হাসি টানলেন ঠোটে।
– ভাবি বসেন। আমাদের কিছু বিষয়ে কথা বলতে হবে।
আজাদ, রেহানা দুজনই বিভ্রান্ত হয়ে দেখানো আসনে যেয়ে বসলেন। এই সময় চোখ বোলাতে গিয়ে রুমের এক পাশের দেয়ালে মিহরানকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে ওনারা অবাক। পরিবারের এই দুই ছেলের সাথেই সবচাইতে কম সাক্ষাৎ হয় তাদের। আর আজ এরাই সামনে এসেছে। তার মানে ভয়ংকর গম্ভীর কিছু ঘটেছে।
উৎসুক মুখে আজাদ দম্পতি সামনে তাকায়। বাবুল সাহেবকে আজাদ সাহেব এবার প্রশ্ন করেন,
– ভাই কোনো সমস্যা হয়েছে নাকি? ভাবিও মনে হচ্ছে একটু বিচলিত।
বাবুল সাহেব কপাল ভাজ করেন,
– একটুতো সমস্যা হয়েছে ভাই। একটা ঘটনা ঘটেছে।
আজাদ সাহেবের মুখেও ভাজ পরে,
– কি ঘটনা?
বাবুল সাহেব এবার ঘাড় ঘুরিয়ে নিজের ছেলের দিকে চাইলেন। গভীর শ্বাস নিতে নিতে ওকে একবার দেখে আবার সামনে ফিরলেন,
– দেখুন ভাই, ভাবী। এখন যা বলবো সেটাকে শুনে প্রথমেই বিচলিত হবেন না আপনারা। এটা অনুরোধ আমার। বিষয়টা একটু স্পর্শকাতর তাই আমাদের চিন্তা ভাবনা করে আগাতে হবে।
রেহানার ততক্ষণে নিঃশ্বাস এসে গলায় আটকেছে। কি শুনতে হবে ভেবেই ঘাম ছুটছে তার। একটু আগের দোয়াটা এখন জোড়ালো ভাবে নিজে নিজেই মন আউড়াচ্ছে। কি এমন বলবেন বাবুল ভাই?
আজাদ সাহেব খুব শীতল গলায় বললেন,
– আপনি বলুন।
বাবুল সাহেব একটা দীর্ঘ দম নিলেন। সাথেসাথেই রুমে বিরাজ করলো থমথমে নিরবতা,
– মিহরান আর শৈলী বিয়ে করেছে।
পিনপতন নিরবতায় একটি বাক্য বোমার মতন যেন ফুটে উঠলো। বোমা ফাটলে কি হয়? প্রথম ধাক্কায় কিছুই বোধ হয় না, তাই না? ঠিক সেরকমই একটা অনুভূতি ছিল আজাদ দম্পতির। বাবুল সাহেবের কথাটা শুনেও যেন শুনেননি, বুঝেও যেন বুঝেননি।
– কি বললেন ভাই? কার বিয়ে?
– মিহরান আর শৈলীর।
ধ্বক করে ওঠে রেহানার বুক। মলিন মুখটায় ভয় ছেয়ে একাকার অবস্থা। আজাদ সাহেবের চেহারাও হয়ে যায় ফ্যাকাশে তবে সেটা ভয়ে নয়, ক্ষোভে। সরাসরি উনি মিহরানের দিকে তাকান,
– এসব আপনারা কি উল্টাপাল্টা বলছেন আমার মেয়েকে নিয়ে?
বাবুল সাহেব পিঠ সোজা করেন। আজাদ সাহেবের রাগী হুঙ্কার তিনি ধরতে পারেন।
– কোন উল্টাপাল্টা কথা হচ্ছে না ভাই। আসলেই এরা দুজন বিয়ে করেছে দুই সপ্তাহ আগে।
আজাদ সাহেবের চোখ কোটর থেকে বের হওয়ার জোগাড়। দুই সপ্তাহ আগে মানে তো সেই শৈলীর পিকনিকে যাওয়ার সময়টা। তিনি সচকিতে ঘুরে তাকান নিজের সহধর্মিনীর দিকে,
– এই ব্যাপারে তুমি কিছু জানো?
রেহানা আতঙ্কিত চোখে স্বামীর দিকে চেয়ে মাথা বামে ডানে নাড়েন। উনি জানেন না। আজাদ সাহেব হঠাৎ তৎপর হন। উঠে দাড়াতে দাড়াতে বলেন,
– শৈলীকে ডাক দাও এক্ষুনি।
রেহানা স্বামীর কথা মতো উঠতে গেলে, এতোক্ষণের চুপ থাকা মিহরান সামনে আগায়। সরাসরি আজাদ সাহেবের দিকে তাকিয়ে গভীর কন্ঠে বলে,
– শৈলীকে আগেই ডাকবেন না আঙ্কেল। ও সবার সামনে এই ভাবে আসলে বিব্রতবোধ করতে পারে।
রক্তচক্ষু নিয়ে আজাদ সাহেব তাকালেন মিহরানের দিকে। কিছু বলতে যাবেন ওকে তার আগেই মাঝে আসে মাহিব,
-আঙ্কেল, আমার মনে হয় মিহরান ঠিক বলেছে। শৈলীকে এই মুহূর্তে এখানে এনেন না। সবার এরকম চেহারা দেখলে বেচারি ভয় পেয়ে যাবে। আর এমনিতেও আমরা কেউই ঘটনার কিছুই জানি না। আমাদের আগে বসে সব শুনে নেওয়া উচিত। আমি আমার ভাইকে চিনি। ও হুটহাট কোন সিদ্ধান্ত নেয় না। অধৈর্য ছেলে না ও। নিশ্চয়ই এই বিয়েটার পেছনে কোনো বড় কারণ আছে। আমার অনুরোধ আপনারা বসুন।
আজাদ সাহেব ঘন ঘন নিঃশ্বাস নেন। কিছুক্ষণ ওরকম থম মেরেই দাড়িয়ে থাকেন। তারপর ধপ করে সোফায় নিজের ভর ছেড়ে দেন। রেহানাও জবুথবু হয়ে বসে পরেন স্বামীর পাশে। ইশারা বুঝে মাহিবও মিহরানকে নিয়ে তৃতীয় সোফায় বসে।
– মিহরান, ভাই এইবার বল্ সবাইকে। কি হয়েছিল যে তোরা এতো বড় একটা স্টেপ নিলি।
মিহরান সময় নেয় না। রুমে উপস্থিতি সব বড়দের সন্মান দিয়ে কন্ঠে দৃঢ়তা টেনে একে একে বিস্তারিত পিকনিকের রাতের ঘটনা গুলো বলে। প্রতিটা কথা বোঝাতে ও পর্যাপ্ত সময় নেয় এবং ধ্যর্যের পরিচয় দেয়। শৈলীকে এভাবে কেউ বন্দি করে রেখেছিলো এটা শুনে হাউমাউ করে কান্নায় ভেঙে পরে রেহানা। এমনকি এই প্রথমবার আফিয়ার মুখেও আতঙ্ক ছড়ায়। মিহরানের দিকে তাকিয়ে মুখ ফুটেই বলেই ফেলেন,
– বলিস কি? শৈলীর সাথে এতো বড় দুর্ঘটনা ঘটেছিল।
মিহরান নিজের মাকেও আস্তে ধীরে বোঝায়। এরপর সেখান থেকে শৈলীকে বাঁচিয়ে গ্রামে ওদের পরিণতি, অতঃপর বিয়ে, সব কিছু গুছিয়ে ব্যক্ত করে।
সব কিছু বলার পর মিহরান থামে কিছুক্ষণের জন্য। নিজের ছোট ভাইয়ের কাধে ভরসার হাত বাড়িয়ে রুমের আবহাওয়া পড়ার চেষ্টা করছে মাহিব। দুই বাবা মাই শুন্যে তাকিয়ে বাকরুদ্ধ বনে গেছেন। মিহরান আবার কথা বলে,
– দেখুন, আমি জানি আমাদের তোলা পদক্ষেপে আপনারা কষ্ট পাচ্ছেন। তবে সেই জায়গায়, সেই মুহূর্তে এছাড়া আমাদের হাতে আর কোনো পথ ছিলো না। আমাদের বিয়ে তখন না হলে আমি শৈলীর মান বাঁচাতে অক্ষম হতাম। যেই কারণে ওকে নিয়ে আমি সেই খামার বাড়ি থেকে বের হয়েছিলাম, সেই ইজ্জতটাই হয়তো মেয়েটাকে খোয়াতে হতো, গ্রামবাসিদের মাঝে। কথা খামারবাড়ি পর্যন্ত পৌছতেও সময় লাগতো না। আমার কাছে তখন একমাত্র কনসার্ন ছিল শৈলী। নিজেদের বাঁচাতে আমার যেটা তখন ঠিক মনে হয়েছে আমি করেছি, এবং এটার জন্য আমি মোটেও দুঃখিত না।
মিহরানের শেষ কথায় মাহিবের লোম খাড়া হয়ে ওঠে। ভাইয়ের প্রতি গর্বে বুক ভরে যায় ওর। কাধে রাখা হাত দিয়ে চাপড় মেরে চোখের ইশারায় নিজের সমর্থন বোঝায় ও।
আজাদ সাহেব সামনে একটু ঝুকে মাটির দিকে তাকানো। তার চোখ এক বিন্দুতে আটকানো। মুখে কোন ভাজ না থাকলেও চিবুকের গোড়ায় চিকন ঘামের রেখা স্পষ্ট জানান দিচ্ছে ভেতরে কোন ঝড় উঠেছে তার।
এদিকে রেহানার অবস্থা ঠিক তার উল্টো। মেয়ের সাথে এতো ভয়াবহ ঘটনা ঘটতে যাচ্ছিলো এবং মা হয়ে তিনি এই বিষয়ে কিছুই জানতেন না ভেবেই বার বার কেঁপে উঠছিল তার শরীর। এক বন্ধ অন্ধকার ঘরে শৈলীর আতঙ্কিত মুখমন্ডল কল্পনা করে ক্ষনে ক্ষনেই দম আটকে আসছে ওনার। যখন তার মেয়ে এই বিভীষিকাময় সময়ের ওপর দিয়ে যাচ্ছিলো তখন তিনি এখানে কি করছিলেন? যদি কোনো দুর্ঘটনা হয়ে যেত কি করতেন তিনি? পারতেন কখনো নিজেকে মাফ করতে? পিকনিকে যাওয়ার পার্মিশান তো তিনিই দিয়েছিলেন।
মাহিব সবার দিকে এক এক করে তাকায়। শেষে এসে চোখ ঠেকে ওর মিহরানের ওপর। নিচে নামানো দৃষ্টিতে ওর নিজের নেওয়া সিদ্ধান্তের আত্মবিশ্বাস দেখে মুগ্ধ হয় মাহিবের চোখ। এরপর সরাসরি তাকায় নিজের বাবার দিকে।
-আব্বু, মিহরানের থেকে তো সব কথা জানাই হলো। ওর ভাষ্যে এটা স্পষ্ট যে ওদের হাতে এই বিয়ে ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। এবং পরিস্থিতিটা যদি আমরা কল্পনাতেও একবার নিয়ে আসি তাহলে আমাদেরও বুঝতে কষ্ট হবে না যে মিহরানের সিদ্ধান্তই সঠিক ছিল। আমি আমার ভাইকে পূর্ণ সমর্থন করি। বাকি তোমরা আমাদের থেকে আরও অনেক বেশী বুঝদার ও অভিজ্ঞ…..
বাবুল সাহেব সব শুনেন। ওপরের ঠোটের ওপর নিচের ঠোট উঠিয়ে নাক দিয়ে শ্বাস ছাড়েন। এরপর উঠে আসেন নিজের ছেলেদের বসা সোফার সামনে। আপনাতেই বাবাকে দেখে দুই ভাই দাড়িয়ে যায়। মাহিব ওনার দিকে তাকালেও মিহরান মুখ গম্ভীর করে ঘুরিয়ে রাখে।
বাবুল সাহেব প্রথমে মিহরানকে খুব ভালো মতন পর্যবেক্ষণ করেন। ভ্রু জোড়া কুচকে ছেলেকে যেন মাইক্রোস্কোপের নিচে নিয়ে আসেন। মিহরান না দেখলেও মাহিব সবটাই লক্ষ্য করে। শুকনো ঢোক গিলে ও। বাবা আবার কিনা কি বলে। ওর ভাই এমনিতেই ছোটবেলা থেকেই ঘাড়ত্যাড়া, বাবার কথায় আবার না সব বিগড়ে যায়।
কিন্তু মাহিবকে সম্পূর্ণ অবাক করে দিয়ে বাবুল সাহেব নিজের হাত শক্ত করে রাখলেন মিহরানের কাধে। মিহরান সেটা অনুসরন করে তার দিকে তাকাতেই দেখতে পেল হাস্যউজ্জ্বল তামাটে মুখটাকে। পরপরই শোনা গেল বাবুল সাহেবের কন্ঠস্বর,
– আই এ্যাম প্রাউড অফ ইউ মাই বয়। তুমি যা করেছো এবং যেভাবে করেছো, আমি সেটা জেনে ভীষণ গর্ববোধ করছি। এরকম পরিস্থিতিতে মাথা ঠান্ডা রেখে সমস্যা মোকাবেলা করতে সবাই পারে না। তুমি শুধু শৈলীরই না আমাদের পরিবারেও মান বাঁচিয়েছো বাবা।
মিহরানের ঠোটে হাসি না ভাঙলেও চোখে নমনীয়তা ছেয়ে পরে। বাবার চোখে চোখ রেখে নিজের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে ও।
মিহরানের কাধে আবার চাপড় মেরে বাবুল সাহেব আজাদ সাহেবের দিকে চোখ ফেরান। মানুষটা এখনো ঠিক একই ভাবে বসা দেখে ওনার কাছে যান,
– আজাদ ভাই।
আজাদ সাহেবের শরীর হাল্কা কেঁপে ওঠে। তিনি ধীর গতীতে ওপরে চোখ তোলেন। তার ক্লান্ত দৃষ্টি দেখে বাবুল সাহেবের খারাপ লাগে। তিনি নিজেও দুই কন্যার বাবা, একজন বাবার জন্য তার মেয়েকে নিয়ে এসব শোনা কতোটা দুর্বিষহ সেটা একটু হলেও আঁচ করতে পারছেন বাবুল।
– আজাদ ভাই, জানি আপনার মন এখন অনেক ভার হয়ে আছে। অনেক চিন্তাই ঘুরপাক খাচ্ছে মাথায়। কিন্তু এটাও ঠিক যে যেই ভয় ও শঙ্কা নিয়ে আমরা এই আলোচনা শুরু করেছিলাম সেগুলো কোনোটাই বাস্তবে রুপ নেয়নি। আমাদের সন্তানরা আমাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেনি। যা হয়েছে সেটা পুরোটাই ওরা পরিস্থিতির চাঁপে পরে করেছে। তাই আমার মনে হয় আমরা বিষয়টাকে স্বাভাবিক ভাবেই দেখি। কি বলেন?
আজাদ সাহেব বাবুল সাহেবের সব কথাই যেন রোবটের ন্যায় শুনলেন। এ থেকে কয়টা শব্দ যে আসলে তার মস্তিষ্কে ঢুকেছে তা বোঝা যাচ্ছে না। বাবুল সাহেবের কথাটা শেষ হতেই উনি বামে, মিহরানের দিকে তাকান। এরপর উঠে আসেন ওর সামনে। মুখ থেকে কোনো কথা না বের করে একেবারে জাপ্টে ধরেন তিনি মিহরানকে। নিজের বুকের সাথে লাগিয়ে পিঠে বেশ কয়েকবার চাপড় দেন। এরপর আবার মুখোমুখি হন ওর। মিহরান থমকে যায় ওনার চোখে পানির আভাস দেখে। আজাদ সাহেব ভাঙা কন্ঠে আউড়ান,
– আমার দুটো মেয়ে আমার দুই চোখের মনি। বাবা হিসেবে আহামরি কিছুই ওদের জন্য করিনি আমি, কিন্তু অনেক অনেক ভালোবেসেছি। সেই আমার মেয়ের জীবনের এতো বড় এক ঘটনায় ওকে বাঁচাতে আমি পাশে ছিলাম না। ওকে আগলে আমি রাখতে পারিনি। কিন্তু সেই দায়িত্বটা তুমি নিজের ঘাড়ে নিয়েছো। আমার শৈলীর সন্মান রক্ষা করেছো। এর জন্য আমি অন্তরের অন্তস্থল থেকে তোমার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই।
মিহরান দুই ঠোট চাঁপে। চোখ নামিয়ে ফেলে পরপর। ততক্ষণে আজাদ সাহেবের পাশে এসে দাড়ান বাবুল সাহেব। হাসিতে ওনার দাঁতের পাটি বের হয়ে গেছে।
– তো আজাদ ভাই। আমাদের সম্পর্ক তো প্রমোশন পেল কি বলেন? প্রতিবেশী থেকে বিয়াই তে রুপান্তরিত হলাম।
আজাদ সাহেব অনেক্ষণ পর হাসলেন। বাবুল সাহেব ততক্ষণে আফিয়ার এখনো থমথমে ভাবলেশহীন মুখের দিকে তাকালেন,
-কি ব্যাপার আফিয়া, তুমি এখনো বসে আছো কেন? আমাদের নতুন বিয়াই বিয়াইন বাসায় এসেছেন, মিষ্টি মুখ করাও।
আফিয়া নড়েচড়ে বসলেন একটু। অপর পাশে বসা রেহানার চোখে এই দৃশ্য এড়ালো না। আফিয়া শুকনো হেসে উঠে দাড়ান। চপল পায়ে ভেতরে যান, সোজা রান্নাঘরে।
এদিকে বাবুল সাহেব আজাদ সাহেব কে নিয়ে আলোচনায় বসেন,
– দেখুন ভাই, পরিস্থিতি যাই থাকুক না কেন, সবচেয়ে বড় সত্য যেটা, সেটা হলো, আমাদের দুই সন্তানের বিয়ে হয়েছে। মিহরান এবং শৈলী স্বামী স্ত্রী। এবং এই সম্পর্ক বৈধ। আমার মনে হয় এ নিয়ে আমাদের আর কোন বড় ঝামেলায় যাওয়ার মানে হয় না। ওদের দুজনের সম্পর্কটাকে মেনে নেওয়াই ভালো সিদ্ধান্ত, আপনি কি বলেন?
আজাদ সাহেব নিজের সহধর্মিনীর দিকে তাকান। চোখের ইশারায় প্রশ্ন করেন যে কি করবেন। কিন্তু স্ত্রীর থেকে আশানরুপ কোনো উত্তর পান না। এরপর একটু থেমে নিজেই বাবুল সাহেব কে জিজ্ঞেস করেন,
– ভাই আপনার কথা তো শতভাগ সঠিক। তবে আপনাদের…আসলে…আমাদের শৈলীকে মানতে…
বাবুল সাহেব সাথে সাথে থামিয়ে দেন কথা,
– কি বলছেন এসব ভাই? শৈলী মামুনিকে আমাদের মানতে আবার কি সমস্যা হবে? ওকে গত দেড় বছরের ওপর থেকে সামনে দেখছি। এতো লক্ষি, সুশীল মেয়ে আপনাদের, দেখতেও সে ভারী মিষ্টি। ওকে এই বাড়ির মেঝ বউ হিসেবে পেলে আমরা তো বরং খুশিই হবো, কি বলো আফিয়া?
ততক্ষণে আফিয়া বুয়াকে দিয়ে ট্রেতে করে খাবার নামাচ্ছে টেবিলে। ওনার থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে বাবুল সাহেব ভেবেছেন, উনি মনে হয় শোনেননি, তাই আবার বললেন,
– বলছি, শৈলী মামনীকে কি আমাদের মিহরানের বউ হিসেবে তোমার মানতে কোনো আপত্তি আছে?
আফিয়া নিজের স্বামী কে একবার দেখলেন। তারপর আজাদ আর রেহানার দিকে চেয়ে একটা শান্ত হাসি দিলেন।
– নাহ্। শৈলী মামনি তো অনেক ভালো মেয়ে।
বাবুল সাহেব উচ্ছাসিত কন্ঠে আউড়ালেন,
-তাহলে তো আমাদের তরফ থেকে সব ঠিকঠাক। এবার আপনারা বলুন, মিহরানকে জামাই হিসেবে পছন্দ হয়েছে কি না?
আজাদ সাহেব এবার প্রাণবন্ত হাসি হাসলেন,
– আমার মেয়ের সন্মান বাঁচাতে যে তাকে বিয়ে করে নিজের জীবন সঙ্গীনী বানাতে পারে, তার কাছে আমার মেয়েকে তুলে দিতে আমার কোনো দ্বিধা নেই। এবং আপনার ভাবিও একই মত দিবে আমি জানি।
সবার চোখ রেহানা তে পরলে, উনি নিজেও হেসে দেন। এক হাসিতেই সবার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল ওনার অনুভূতি। বাবুল সাহেব এবার উচ্ছাসিত হয়ে বললেন,
– তাহলে তো সব ঠিক হয়েই গেল। আজাদ ভাই, ভাবি এবার একটা ডেট দেন, আমাদের বৌমাকে দেখতে আসবো কবে আমরা? আমি কিন্তু আগেই বলে রাখি ওদের বিয়ে হয়ে গেলেও, একটা স্বাভাবিক বিয়ের সবকিছুই কিন্তু হবে ওদের জন্য। আমরা ধুমধাম করে আমাদের বৌ মাকে ঘরে তুলতে চাই। মিহরান তুমি কি বলো?
এতোক্ষণ সব কিছু শুনে মিহরান মনের ভেতর হাসছিল।বাবার কথায় ছোট করে বললো,
– তোমরা যেটা ভালো মনে করো।
আজাদ সাহেবও নিজের ইচ্ছা পোষণ করলেন,
-আপনারা না করলেও আমি শুনতাম না ভাই। আমার ঘরের প্রথম বিয়ে, মেয়েকে ধুমধাম করে বিয়ে দিব, এটা আমার অনেকদিনের স্বপ্ন।
– তাহলে শুভ কাজে দেরী কিসের? বলুন কবে আসবো বিয়ের তারিখ ফিক্স করতে?
– কালই আসুন?
বাবুল সাহেব কিছু বলতে যাচ্ছিলেন তার আগেই এবার কথা বললেন আফিয়া,
– না না ভাই কাল না। আমাদের আত্মীয়দেরকেও তো সব জানাতে হবে। অন্তত ভাই বোনদের সাথে তো শেয়ার করতেই হবে। ওরাও তো বিয়ে পাকাপাকি করার দিন থাকতে চাবে। একদুই দিন সময় দিন আমাদের।
আজাদ সাহেব সহমত পোষণ করেন,
– আপনি ঠিক বলেছেন ভাবি। আমাদেরও আত্মীয়দের জানাতে হবে। ঠিকাছে, আমরা সময় নেই নাহলে দু তিন দিন। পাশের বাড়িই তো, যখন বলবেন তখনই আমরা তৈরী থাকবো আপনাদের আপ্যায়নে।
এই বলে আজাদ সাহেব উঠে দাড়ান, ওনার দেখা দেখি বাকিরাও ওঠে।
– তাহলে আজ উঠি ভাবি।
আফিয়া জোর দিলেন,
– সেকি ভাই, ভাবি। রাত তো অনেক হয়েছে। আজকে আমাদের সাথে ডিনার করে যান।
– এখন তো বিয়াইনের হাতে যখন তখন খেতে এসে পরবো ভাবি, চিন্তা করবেন না। তবে আজ উঠি। মেয়েদের সাথেও কথা আছে।
এই কথার পরে আর ওনাদের থামানো যায় না বলে বাবুল সাহেবও কিছু বললেন না। হাসিমুখে দরজা পর্যন্ত বিদায় দিতে চলে গেলেন ওনাদের।
আফিয়া বেগম তখন উঠে গেলেন উপরে। মালিহার বান্ধবী তুরিনের জ্ঞান ফিরেছে সেটা রান্নাঘরে যাওয়ার সময়ই শুনেছিলেন তিনি। ওর মায়ের সাথে কথা বলে মেয়েটাকে আজ রেখেই দিতে চাচ্ছিলেন কিন্তু তুরিনের মা মেয়েকে নিয়ে ভীষণ টেনশনে পরেছেন। ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবেন বলে উনি তুরিনকে নিতে আসছেন বলেছেন। এখন আফিয়া মালিহার রুমেই যাচ্ছেন, তুরিনের খোজ নিতে।
চলবে।
আজ লিখতে গিয়ে নিজেকে থামাতে পারছিলাম না। ইচ্ছা হচ্ছিলো পুরোটুকু একসাথে লিখে ফেলি। কি হয় শেষ পর্যন্ত মিহরান শৈলীর তা জানার ইচ্ছা তো আপনাদের মতন আমারও ব্যাপক। কিন্তু আফসোস দিনে ঘন্টা মাত্র চব্বিশটাই তাই এটুকুই দিতে পারলাম। দেখি রাতে বসে আরেকটা ছোট্ট পর্ব দিতে পারি কি না।