#পরিণয়_প্রহেলিকা
#লেখিকা_সিনথীয়া
#বোনাস_পর্ব
সেদিন সকালে……
রেহানা সারা রাত ঘুমননি বিধায় সকাল বেলা খাট থেকে উঠতে গিয়ে কেমন একটা চক্কর বোধ করলেন মাথায়। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখেন দশটা আট বাজে। বাসার থেকে সবাই নিজ নিজ গন্তব্যে চলে গিয়েছে ভেবে আস্তে ধীরে খাট ছাড়েন রেহানা। মুখটা ভার করে রেখেছেন সেই গত কাল রাত থেকে। সারা রাত চিন্তায় নিমজ্জিত ছিলেন তিনি। শৈলীকে নিয়েই সব চিন্তা।
গতকাল বাবুল সাহেবের বাসায় যতক্ষণ ছিলেন, রেহানা ততক্ষণ শুধু আফিয়া বেগম কে পর্যবেক্ষণ করেছেন। ওনার কঠোর শক্ত মুখখানি দেখে ভেতর থেকে শঙ্কায় নিমজ্জিত ছিলেন তিনি। আফিয়া বেগম যে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত মিহরান-শৈলীর সম্পর্কটা মন থেকে মেনে নিতে পারেননি, সেটা বাকিরা না বুঝলেও রেহানা ঠিকই ধরতে পেরেছেন। পারবেন না কেন? তিনি নিজেও তো একজন মা। এক মা আরেক মায়ের মন বুঝবে না?
সারা রাত রেহানা বসে এই ভাবনাতেই ছিলেন। তার বড় মেয়ে শৈলী। তার প্রথম সন্তান, যে তাকে একজন মেয়ে থেকে মা বানিয়েছিল। এক নতুন ভুবনে রেহানা প্রবেশ করেছিলেন শৈলীর হাত ধরে। ছোট্ট সুন্দর বাবুটা আস্তে আস্তে বড় হতে থাকে, ওর মুখ থেকে বের করা প্রথম শব্দ, প্রথম উঠে বসা, প্রথম হামাগুড়ি আবার নিজে থেকে একদিন কিছু না ধরে হাটতে শিখে যাওয়া, রেহানার সব মনে আছে, সব। ছবির মতন চোখের সামনে ভাসছে। সেই ছোট্ট শৈলীর সাথে আজ ঘটেছে এক অঘটন। অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবেই মেয়েটা জড়িয়ে পরেছে বিয়ে নামক এক স্থায়ী বন্ধনে। মা হিসেবে রেহানার বুকটা ছিড়ে গিয়েছিল গতকাল যখন তার কর্ণকুহরে এসব কথা ঘুরপাক খাচ্ছিলো। কিন্তু সেইসময় মলম হিসেবে তার ক্ষত সারাতে সামনে ছিল মিহরান। ছেলেটার শান্ত কিন্তু আত্মবিশ্বাসে ভরা কন্ঠ ও চিন্তা রেহানাকে নিশ্চিন্ত করতে পেরেছিলো যে আর যাই হোক, তার মেয়ে জীবনসঙ্গী ভালো পেয়েছে।
কিন্তু সঙ্গী সাথে থাকলেও, তার মা যদি রাজি না থাকে, তাহলে শৈলী বউ হওয়ার প্রাপ্য সন্মান টা পাবে কেমন করে? কিভাবে মানাবে ওখানে তার মেয়ে?
………….
রুম থেকে বের হয়ে নিপুণ কে দেখে অবাক হন রেহানা।
– তুই আজ কলেজ যাসনি?
– না আম্মু, একটা মাত্র ক্লাস ছিল তো। তাই আর যাই নি।
-ওওও।
এরপর রেহানা ভালো মতন ফ্রেশ হয়ে রান্নায় ঢোকেন। তবে আজ রান্নায় তার বিশেষ মন নেই। ঝাল,নুন কোনোটাই চেখে দেখছেন না তিনি। কিসে কি ঢালছেন তাও খেয়ালে নেই। কিছুই ভালো লাগছে না তার।
…………..
বিকেল গড়ায়। রেহানা আসর নামাজ শেষ করে নিপুনের রুমে যান। দরজা দিয়েই শুনতে পান নিপুণ বান্ধবীর সাথে ফোনে কথা বলছে,
– সরি দোস্ত, আজ বের হবো না। আম্মু একটু অসুস্থ বোধ করছেন, বাসায় আর কেউ নাই। তোরা যা, আমি পরে আরেকদিন জয়েন করবো তোদেরকে।
রেহানার মায়া হয়। আহারে! মেয়েটা তার ছোট হলেও অনেক বুঝদার। তিনি রুমে ঢুকে মেয়েকে বললেন,
– তোর বান্ধবীরা ডাকছে, তুই যাচ্ছিস না কেন?
-এমনিই।
রেহানা মেয়ের পাশে বসেন।
– আমি ঠিক আছি। তুই যা বাইরে। সারাদিন খুপড়িতে কবুতরের ছানা হয়ে বসেছিলি, এখন যা। কিছুক্ষণের মধ্যে আকলিমা আসবে কাজ করতে, আমি একা থাকবো না।
তবুও নিপুন যেতে চাচ্ছিলো না, রেহানা জোর করেই পাঠালেন। নিপুন বের হওয়ার এক ঘন্টা পর বাসায় আসলো আকলিমা বুয়া। রেহানাদের বাসায় বিকেলের কাজে আসেন তিনি। রেহানা তাকে দেখে ঘড়ির দিকে তাকালেন,
– কি ব্যাপার আকলিমা? আজ দেরী যে?
আকলিমা এসে ডাইনিং হলের ফ্লোরে ধপ্ করে বসে,
– আর কইয়েন না গো খালাম্মা। হয়রান হইয়া গেসি।
– কেন? এই সময় তো তোমার আর কোথাও কাজ থাকে না।
– আইজকা ছিল। আইজ পাশের বাড়ির খালাম্মার বাসায় বহুত মেহমান আইবো নাকি রাতে। উনার বুন টুন রাতো ছইলাই আইসে। ঐহানে কাজে ডাকসিল আলেয়া আফায়। তার সাহাজ্য লাগতো।
এক দম শ্বাস নেয় আকলিমা। তারপর গলা খাদে নামায়,
– জানেন খালাম্মা? ঐ বাড়িত মেলা গন্ডগোল ছলতাসে। সিরাম ছিল্লাছিল্লি হইতাসে। বিশেষ কইরা তিন তলার খালাম্মা, মানে স্যারের বুন আর এই খালাম্মার ছুট বুন বেশী ছিল্লাইতাসে। কোন ভাড়াটিয়ার মাইয়ারে লইয়া ক্যাছাল বাধসে যানি। বিয়া শাদির মামলা বুঝসেন? এক খালাম্মা ছিল্লাইতাসিল, যে এই বাড়ির ছেলেরে নাকি ঐ ভাড়াটিয়ার মাইয়া ফুশলায় ফাশলায় বিয়া করসে। আমি রান্নাঘর থেইকা এইটুকুই শুনসি। আলেয়া আপারে জিজ্ঞেস করসিলাম কি হইসে, কারে নিয়া কথা কয় এরা?কিন্তু হেও মুখে কুলুপ আটসে। অনেক বসর ধইরা হেই বাসায় আসেতো? এতো সহজে মুখ খুলবো না। বুঝছেন খালাম্মা?
রেহানার এসব কথা শুনে সকালের মত তবে তার থেকেও কয়েকগুন বেশী জোড়ে মাথা ঘোরা শুরু করলো। তার সারাদিনের দুশ্চিন্তাগুলো এরকম বড় আকারে বাস্তবে রুপ নিবে সেটা সে আঁচ করতে পারলেও শোনার জন্য হয়তো প্রস্তুত ছিলেন না। ডাইনিং এর চেয়ারে বসতে গেলে ভারসম্য হারালেন নিজের। আকলিমা দৌড়ে এসে না ধরলে পরেই যেতেন ফ্লোরে।
– আরে খালাম্মা হঠাৎ কি হইলো আপনার? খারাপ লাগে নাকি? পানি খান। পানি খান।
কোনমতে একটু পানি মুখে দিলেন রেহানা। তারপর আকলিমা ওনাকে রুমে নিয়ে শুইয়ে দিলেন।
একটু নিজেকে সামলেই মোবাইলটা হাতে নিলেন রেহানা। ঝটপট ফোন দিলেন তার স্বামীকে।
-শৈলীর আব্বু? কোথায় তুমি?….তাড়াতাড়ি বাসায় আসো। খুব জরুরী কথা আছে তোমার সাথে। তাড়াতাড়ি আসো।
চলবে।