#পরিণয়_প্রহেলিকা
#লেখিকা_সিনথীয়া
#পর্ব_৫২
মাস পেরিয়েছে। এরই মধ্যে মিহরান শৈলীর বিয়েও হয়েছে ধুমধাম করে। হইহুল্লোড়ে চারপাশ মুখরিত করে দুজন সমাজের বুকে নিজেদের একত্বের নাম লিখিয়েছে। এখন শৈলীর স্থায়ী ঠিকানা চিলেকোঠার সেই স্টুডিও এ্যাপার্টমেন্ট টায়। ভরা পরিবারের মাঝেও একটা আলাদা ছোট্ট টোনাটুনির সংসার গড়েছে দুজন। তিন বেলা খাবার নিচে সবার সাথে খেলেও, চা কফি বা মধ্যরাতের কিছু খাবার যা গল্পের মাঝে সঙ্গী হয়, এসব শৈলী নিজ হাতে রুমেই বানায়। মিহরান পুরো রুমটাই ওর হাতে ছেড়ে দিয়েছে। এখন শৈলী এক একটা দিন সময় নিয়ে নিয়ে নিজেদের নীড় পূর্ণ ভালোবাসা দিয়ে গড়ে তুলছে।
শ্বশুরবাড়ির সবার সাথেও বেশ জমে উঠেছে শৈলীর। মিহরানের বাবা মা ওকে ভীষণ আদর করেন। মাহিবের বউ আর শৈলীর তো আগে থেকেই খাতির ছিল, এখন দুই জা মিলে বেশ মজায় আছে। ছোট ফুফু প্রথমে একটু নাক সিটকালেও এখন শৈলীকে কাছে থেকে দেখার পর ওকে আপন করে নিয়েছেন। বড় ফুফুশাশুড়ি আর চাচাশ্বশুরদের তো আগে থেকেই ওকে নিয়ে কোনো সমস্যা ছিলই না। মামাশ্বশুর দের পরিবারও ওকে প্রচুর পছন্দ করেছে। শুধু সমস্যা এখনো মীহরানের ছোট খালা কে নিয়ে। নিজের মেয়েকে মিহরানের গলায় না ঝুলাতে পারার ব্যর্থতা তাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। এবং এই ব্যর্থতার জন্য সে একমাত্র শৈলীকেই দায়ী করেন। আপাতত এই বিরহে তিনি বোনের বাসায় আসাই বাদ দিয়েছেন, তবে এটা আফিয়াকে অতোটা বিচলিত করছে না। কারণ আসিয়ার মূল উদ্দেশ্য জানতে পেরে একপ্রকার হতভম্ভ হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। অতটুকুন মেয়ে ঐশ্বর্য, তার সাথে কিনা মিহরানকে জুটাতে চেয়েছিল ওর বোন? পাগল নাকি?
…………..
আজ ভার্সিটিতে একটা প্রেসন্টেশন আছে শৈলীর। সেই দরূণ শাড়ি পরেছে সে। চাঁপা গাড় নীলের মাঝে অফ ওয়াইট রঙের এ্যান্ডি কটনের শাড়ি। কুঁচি দিয়ে পরিপাটি করে পরেছে। বড় চুলে বেনী বেধেছে সুন্দর করে। এক মুঠি মোটা বেণী সামনে একপাশে এনে নিজেকে পুরো একবার দেখতেই আয়নায় প্রতিফলন হয় স্বামীর মুগ্ধ অভিব্যক্তি। এই চাহনী এখন শৈলীর চেনা তাই মুচকি হেসে ফেললো ও। ততক্ষণে মিহরান কাছে চলে এসেছে। শৈলীর পেছন ঘেষে দাড়িয়ে নিবিড় ভাবে স্ত্রীকে পর্যবেক্ষণ করে। শৈলী স্বামীর উত্তর জেনেও প্রশ্ন ছোড়ে,
-কি জনাব? ঠিকঠাক লাগছে তো?
মিহরান কোমড় জড়িয়ে শৈলীর বুক নিজের পিঠে লাগায়। স্ত্রীর করা প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে নিজের আদেশ শৈলীর ওপর জারি করে,
– আজকে প্রেসেন্টেশন শেষ করেই বাসায় চলে আসবা, আমি তোমাকে নামিয়ে দিয়ে যাব।
শৈলী পুরাই হতবাক,
-কেন? হঠাৎ? বাকি ক্লাস করবো না কেন?
কন্ঠ খাদে নামায় মিহরান,
– আমার হুরের মতন সুন্দরী বউয়ের নেশায় অন্য কেউ পড়ুক সেটা চাই না আমি। এই নেশায় মত্ত হওয়ার অধিকার শুধু আমার।
এইবার মিহরানের এই হুট করে দেওয়া আদেশের মূল কারণ উদঘাটন হলো শৈলীর সামনে আর তাতেই বড় করে হেসে দিল ও। স্বামীর বাহু বন্ধনে ঘুরেই মুখোমুখি হলো। মিহরানের গাল দুটো হাতের মাঝে নিয়ে মজার ছলে বললো,
– ওল্লে, আমার জামাই দেখি বউ কে চোখে হারায়।
মিহরানের ভাবলেশহীণ জবাব,
– এটা আজ বুঝলা?
শৈলী হাসি বজায় রাখে,
– আপনি চিন্তা করবেন না মহাশয়, আপনার বউয়ের দিকে কেউ চোখ দেওয়ার সাহস পাবে না।
মিহরান ততক্ষণে শৈলীকে ছেড়ে দিয়ে ড্রেসিংটেবিলের ওপর থেকে ব্রাশ নিয়ে নিজের চুল ঠিক করতে লাগে,
– তোমার হঠাৎ এরকম কেন মনে হলো?
– আরেহ্! না মনে হওয়ার কি আছে? আমাদের বিয়ের ছবি সোশাল মিডিয়ার মাধ্যমে এমন ভাবে ছড়িয়েছে যেন ভার্সিটিতে দাবানল লেগেছে। ক্যাম্পাসের পিপড়ারাও মনে হয় এখন জানে যে আমি তোমার বউ। জানো তোমার ক্লাসে ঢুকতে কেমন অস্বস্থি লাগে আমার? আগে তুমি আসার সাথেসাথে রুমটা নিরবতায় ছেয়ে যেত, এখন আমি ঢুকলেও একই পরিস্থিতি ঘটে। কতো সিনিয়র আপুদের যে দুই চোক্ষের বিষ হয়েছি আমি, তার হিসেব নেই। বদদোয়া তো কুড়েছি মনে হয় অগণিত। নাউযুবিল্লাহ!
শৈলীর কথা শুনে মিহরান মুচকি হাসে। নিজেকে পরিপাটি ভাবে দেখে স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে রুমের বাইরে হাটা দেয়,
– শকুনের দোয়ায় গরু মরে না বুঝছো?
………………..
দুপুরের লাঞ্চের সময় ক্যান্টিনে বসে শৈলী আর মাহিরা খাচ্ছিলো। মাহিরাকে চিন্তিত দেখাচ্ছে বেশ। শৈলী জানে কারণ তাই ওর হাতে হাত রাখলো,
– মালিহা আপুর কি অবস্থা বলতো? উনি কি এখনো উত্তেজিত? আমি তো গতরাতে আমার প্রেসেন্টেশনের চক্করে নিচে বেশীক্ষণ সময়ই দিতে পারলাম না। আমার আসার পর নতুন কিছু হয়েছে?
মাহিরা দির্ঘশ্বাস ফেলে,
-নাহ্। তুই চলে যাওয়ার পরও আপু ওভাবেই কেঁদেছে কিছুক্ষণ। আসলে আপুকে শুধু ছবিতে দেখেই যে পাত্রপক্ষ এভাবে পছন্দ করে ফেলবে এটা আপু ভাবেও নি। সোজা বিয়ের ডেইট ফিক্স করতে চলে আসবে এটা কে জানতো বল্?
– হমম্। আমিও তো এটা শুনে অবাক হলাম। তবে পরে বিষয়টা বুঝতে পেরেছি। বাবার বন্ধু যেহেতু আনসার আঙ্কেল, আমাদের পরিবারের ব্যাপারে সবই তার জানা। তাই ছেলের সন্মন্ধ এখানে করতে একটুও সময় নেননি। কিন্তু আমি টেনশনে আছি, আপু কি করবে? তার রিলেশনের কি হবে?
মাহিরা এই পর্যায়ে খুব বিরক্ত হয়। প্লেটে এক প্রকার হাতে রাখা চামচটাকে ছুড়ে ফেলে সে,
– একটা কথা বলি শৈলী? সত্যি বলতে আপুর এই রিলেশন টা কেন যেন আমার ভালো লাগছে না। ছেলেটা, আমার মন বলছে, ভালো না। কারণ ভালো থাকলে সে এতো সময় বসে থাকতো না। দেখ্, আমার আর তন্ময়ের ব্যাপারটাও পর্যন্ত সামনে চলে আসলো, কারণ আমরা আমাদের সম্পর্কের সঠিক নাম দিতে চাচ্ছি। কিন্তু আপুর বয়ফ্রেন্ডের মনে হয় এসবে কোনো মাথা ব্যাথাই নেই। আরে আমি তো এটাই বুঝে পাই না যে এতো লুকোচুরি কিসের রে ভাই? পছন্দ করসো, বলে দিলেই পারো। কিন্তু না, ছেলেটা কোনো ভাবেও সামনে আসতে চাচ্ছে না। এক একটা অজুহাত দেখিয়ে আড়ালে থাকছে। আমি শিওর আপুও ব্যাপারটা বুঝতেসে, কিন্তু নিজের ইমোশনের সামনে আসলে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। এখন দেখ কি একটা সমস্যা। যেহেতু বাসায় আপু নিজের সম্পর্কের ব্যাপারে খুলে কথা বলতে পারছে না, তাই বড়দের অগ্রগতির খেলাপিও করতে পারছে না। ধুর!
শৈলী ঠোট কামড়ে গম্ভীর হয়। মাহিরা যা বলছে, শৈলীর মনেও ঠিক একই চিন্তা চলেছে। মালিহার জন্য আসলেই টেনশন হলো ওর। মেয়েটা ভুল কোনো গর্তে পা দিয়ে ফেললো না তো।
……………………..
মিহরানের ক্লাসে শৈলী ঢুকতেই রুম পুরা চুপচাপ হয়ে গেল। শৈলী দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বুঝতে বাকি নেই যে এরকম রিসেপশন সে এখন সবসময়ই পাবে। এতে বিচলিত হয়ে আর লাভ নেই। শৈলী তাই কোনো অভিব্যক্তি না প্রকাশ করে ওর ওপর পরা সব মেয়েদের তীক্ষ নজরের মাঝ দিয়েই সোজা যেয়ে কেয়ার পাশে বসলো। ওকে দেখেই দুষ্টুমির হাসি দেয় কেয়া,
– সো মিসেস মিহরান হাসান। কেমন আছেন আপনি?
শৈলী কপট রাগ দেখায়,
– তুইও কেয়া?
– আরে? আমি কি করলাম?
– অন্যদের মতন তুইয়ো ক্ষেপাচ্ছিস আমাকে। তোদের আসলে সমস্যা কি বলতো।
কেয়া এবার সটান হয়ে বসে,
– আমাদের সমস্যা হওয়া উচিত না বলছিস? তুই আমাদের ডিপার্টমেন্টের জাতীয় ক্রাশকে একদম নিজের হালখাতায় সাক্ষর করিয়ে নিলি আর আমদের সেটা নিয়ে হইহুললোড় করবো বলতো?
শৈলী বান্ধুবীর খোটায় মুচকি হাসে,
-পিয়াল ভাইকে জানাবো তোর ক্রাশের ব্যাপারে?
কেয়ার মুখে কোনো নতুন ভাব দেখা দিল না,
– তোর পিয়াল ভাই এখন এই নিয়ে আর টেনশন করবে না। এমন সেটিং দিয়েছি, যে সব ফিট হয়ে গিয়েছে।
শৈলী ভ্রু কুচকায়,
– মানে কি? কি এমন করসিশ তুই?
– আব্বু আম্মুকে আমার আর পিয়ালের কথা বলে দিয়েছি।
শৈলী চমকে উঠে মুখ ঢাকে হাত দিয়ে। তা দেখে হেসে দেয় কেয়া। শৈলী বিচলিত হয়ে প্রশ্ন করে,
– কি বলিস কি? এতো বড় কান্ড করে ফেললি। আন্টি আঙ্কেল যেই স্ট্রিক্ট। তাদের রিয়্যাকশন কি ছিল?
– হমম। আমিও ভয় পাচ্ছিলাম আব্বু আম্মু কি বলবে। কিন্তু মজার বিষয় হলো ওনারা পিয়াল এবং ওর পরিবারকে বেশ পছন্দ করেছেন। পিয়াল তো আমাদের ব্যাপারে আগেই ওর বাবা মাকে বলে রেখেছিল। তাই কমিউনিকেশন টা বেশ স্মুদ হয়েছে।
শৈলী সব শুনে শান্তির এক হাসি দিয়ে কেয়াকে জড়িয়ে ধরলো,
– কন্গ্র্যাট্স বান্ধবী। আমি খুবই খুশি হলাম। যাক্ আমার আর তোর দুইজনেরই একটা গতি হলো। এখন এই প্রিতির সম্পর্কটা তীরে পৌছাক, ব্যাস। আচ্ছা প্রিতি কই? ওকে দেখছিনা কেন? ওর বয়ফ্রেন্ডের না আজকে ক্যাম্পাসে আসার কথা? আমাদের সাথে না দেখা করানোর কথা?
কেয়া হাসলো,
– ম্যাডাম ওয়াশরুমে। সাজগোজে ব্যাস্ত। তার উনি নাকি ক্যাম্পাসে বেশীক্ষণ থাকবে না। ওকে পিক্ করেই চলে যাবে ক্লাস শেষে। তাই এখনই সেজে নিচ্ছে ও। পুরাই গেসে এই মেয়ে বুঝছিস!
দুই বান্ধবীর হাসাহাসিই চললো তারপরে অনেক্ষণ।
……………..
বিকেলে ক্লাস শেষে শৈলী, কেয়া আর মাহিরা একসাথে বের হলো ক্যাম্পাসের গেটের সামনে। শৈলীর দরুন কেয়া আর প্রিতির সাথে মাহিরারও বেশ সক্ষতা জমেছে। তাই প্রিতি ওর প্রেমিকের সাথে দেখা করাতে মাহিরাকেও ডেকেছিল।
আসরের আজান শেষে হয়েছে কিছুক্ষণ আগে। পুরো ধরণী জুড়ে সূর্যের আধিপত্য। রোদ্রে চোখ খুলে তাকানো দায়। শৈলী সানগ্লাস পরেই একটা পিলারে হেলান দিয়ে দাড়িয়েছে। ওদিকে মাহিরাও গরমে অস্বস্তিতে ভুগছে।
– এই প্রিতি কই রে কেয়া?
কেয়া ফোন দিতে যাবে তখনই সামনে তাকালো,
– ওইত এসে গিয়েছে।
শৈলী কেয়ার কথায় সামনে তাকায়। প্রিতির সাথে হেটে আসতে থাকা মানুষটাকে দেখে বিস্ময়ে সানগ্লাস নামায় চোখ থেকে। ছেলেটাকে প্রিতি এক প্রকার টেনে হিচড়ে নিয়ে আসছে। বোঝাই যাচ্ছে সে এদিকে আসতে রাজি না। এই দৃশ্য অবাক হয়ে অনেকেই দেখছে, কিন্তু শৈলীর বিস্ময়ের কারণ এটা না। ও সটান দাড়িয়ে ভালো মতন আগে ছেলেটাকে আপাদমস্তক দেখে। তারপর ঝটকা দিয়ে তাকায় মাহিরার দিকে। যা ভেবেছিল তাই, মাহিরাও ঠিক একই অভিব্যাক্তি ধরে রেখেছে মুখে। ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া চেহারার দিকে শৈলী তাকাতে পারছে না। সাথেসাথে বান্ধবীর পাশে যেয়ে দাড়ায়,
– মাহি এটা…
– মালিহা আপুর বয়ফ্রেন্ড না শৈলী?
শৈলী হতাশা নিয়ে তাকায়। ওর বুক ছলকে উঠে আতঙ্কে। মালিহার সম্পর্কের ব্যাপারে জানার পর থেকে, অনেকবারই শৈলী আর মাহিরা ওর বয়ফ্রেন্ড রায়হানের ছবি দেখেছে। এই চেহারা এখন প্রায় মুখস্ত ওদের। চিনতে ভুল হতেই পারে না।
ততক্ষণে ছেলেটাকে নিয়ে প্রিতি সামনে চলে এসেছে। কেয়া হেসে হেসে কথা বলতে পারলেও শৈলী শুধু আনুষ্ঠানিক একটা হাসি দিল তাও শুধু প্রিতির খাতিরে। মাহিরা কোনো কথাই বললো না। রাগে কপালে রগ্ দপদপ করছে ওর। সবার থেকে একটু দূরে সরে সে মালিহাকে একটা ফোন দিল,
-আপু, তুমি কোথায়?
– আমি বাসার পথে মাহি।
– এখন কোথায়?
– এখন? বাসার কাছেই চলে এসেছি। কেন?
– আপু তুমি আমাদের ভার্সিটিতে আসতে পারবা? খুব জরুরী দরকার।
– কি হয়েছে মাহি? কোনো সমস্যা হয়েছে? তুই, শৈলী ঠিক আছিস তো? ভাইয়া কই?
-আপু, আমরা ঠিক আছি। তুমি ব্যাস তাড়াতাড়ি আসো।
– আচ্ছা দাড়া আসছি।
মাহিরা ফোন রেখে আবার সবার মাঝে আসে। ওর শক্ত চোয়াল দেখেই শৈলী বুঝে ও কিছু একটা করেছে।
এদিকে, মুরসালিন নামক, ছেলেটাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে ওদের সাথে দেখা করে বেশি একটা খুশি না। মুখচোরা স্বভাবের একটু। প্রিতিকে খুব তাড়া দিচ্ছিলো যাওয়ার জন্য। নিজের ব্যস্ততা দেখিয়ে ওকে নিয়ে চলে যাওয়ার জন্য তৎপর হচ্ছিলো। কেয়া দুই একবার ক্যান্টিনে যাওয়ার আমন্ত্রণও জানালো, কিন্তু ছেলেটা কোনোভাবেই মানছিলা না। এতে প্রিতি স্পষ্টত মন খারাপ করলো। কিন্তু বয়ফ্রেন্ডের মান রাখতে ওর সাথে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্তই নিল।
ওরা ঘুরে চলে যাবে তখনই মাহিরা দেখলো ওর বোনকে সামনে থেকে আসতে। মালিহা বোনের টেনশনে হন্তদন্ত হয়ে গাড়ি থেকে নেমে হেটে আসছিল। আশপাশে কে আছে প্রথমে খেয়ালই করেনি। একদম কাছে চলে আসার পর সামনের মানুষটাকে দেখতে পেয়ে চোখ ঠিকরে বের হয় ওর,
– রায়হান?
রায়হান প্রিতিকে এক পাশ থেকে জড়িয়ে নিয়ে হাটছিল। দুজন একে অপরের সাথে কথায় মত্ত থাকাতে, পাশ দিয়ে কে যাচ্ছে খেয়ালই করে নি। নিজের এই নাম এই পরিবেশে, তাও এক চেনা কন্ঠ থেকে শুনে একদম থমকে যায় ও। পাশ ফিরে মালিহাকে দেখে আত্মার পাখি খাঁচা থেকে উড়াল দেয়। এই মেয়ে এখানে কিভাবে?
মালিহা বিস্ফোরিত চোখে এখনো দেখে যাচ্ছে সামনে দাড়ানো তার তথাকথিত প্রেমিককে। পাশে ওর গা ঘেষে দাড়ানো মেয়েটাকে দেখে আরও জ্বালা দিচ্ছে মনে। পরিচিত চেহারা মেয়েটার কিন্তু কোথায় দেখেছে এখন মনে করতে পারছে না। সেটা বিষয়ও না। বিষয় হলো রায়হান।
মালিহা কোনো ভণিতা না করে, সোজা যেয়ে রায়হানের কলার ধরলো,
– এই খানে কেন তুমি? তুমি না বললা তোমার আজকে তোমার বাবার অফিসে মিটিং আছে? তা এই ভার্সিটিতে মিটিং হচ্ছে? এই মেয়ে তোমার ক্লায়েন্ট? কি রায়হান বলো? মুখ বন্ধ কেন তোমার? বলো?
মালিহার তোপের সামনে পরে রায়হান কি বলবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। পরিস্থিতির গেরাকলে ভালো ফাঁসা ফেসেছে ও। এদিকে এসব দেখে আর শুনে প্রিতি হতভম্ব। নিজের প্রিয় মানুষকে অপবাদের হাত থেকে বাঁচাতে মালিহার ওপর ঝাপিয়ে পরে ও,
– আপনি এগুলো কি বলছেন? আপনার মাথা ঠিক আছে নাকি আপনি পাগল? রায়হান ডাকছেন কাকে? ও রায়হান না মুরসালিন। আমার বয়ফ্রেন্ড। দেখুন, আপনি ভুল মানুষের ওপর অপবাদ লাগাচ্ছেন।
মালিহা রাগান্বিত স্বরে উত্তর দেয়,
– আপনার বয়ফ্রন্ড? আপনাকে কি নাম বলেছে? মুরসালিন? ওর পুরা নাম জানেন আপনি? রায়হান মুরসালিন জয়। আমার সাথে গত দুই বছরের বেশী থেকে সম্পর্ক ওর। আমি ওকে চিনতে ভুল করবো? মনে হয় আপনার?
প্রিতি হতবাক হয়ে চেয়ে থাকে। মালিহার থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে আসে রায়হানের দিকে। চাতক পাখির মতন এই আশায় থাকে যে ছেলেটা মালিহাকে ধমক দিবে, বলবে যে মালিহা ভুল বলছে। কিন্তু এমন কিছুই হয় না। হতাশা গ্রাশ করে প্রিতিকে তখনই। চোখ দিয়ে নোনা পানির স্রোত গড়ায় অজান্তেই। ততক্ষণে আশপাশে অনেক ভীড় জমে গিয়েছে। কেয়া শৈলী মাহিরা আরও আগেই এসে কাছে দাড়িয়েছে। মাহিরা মালিহার পাশে যেয়ে দাড়িয়েছে আর কেয়া প্রিতিকে সামলাতে ব্যস্ত। এদিকে এতোক্ষণ মালিহা শুধু গর্জালেও এখন বর্ষালো। পুরাই ভেঙে পরলো ও। রাস্তাতেই বিলাপ করতে থাকলো। দুই মেয়েকে সামলাতে গিয়ে তিন বান্ধবী এমনই ব্যস্ত হয়ে পরলো যে রায়হানের দিকে কারও নজর পরলো না। এই সুযোগটাই নিয়ে রায়হান ওখান থেকে ছুটলো। ভীড়ের মাঝে কেউ ধরার আগেই ও হলো পগারপার।
শৈলী এদিকে পরিস্থিতি বেগতিক দেখে প্রথমেই কল দিল মিহরানকে। স্ত্রীর কল পেয়েই মিহরান ঘটনাস্থলে চলে আসে। এসে মালিহার এরকম অবস্থা দেখে ওর চোখ কপালে উঠলো। সাথেসাথেই রাস্তার ভীড় কমালো ও। তারপর নিজের গাড়ি নিয়ে এসে মালিহাকে বসালো। কেয়াকে বললো প্রিতিকেও গাড়িতে ওঠাতে। তারপর শৈলীর কাছে প্রশ্ন করলো কি হয়েছে।
এখন আর কিছু লুকানোর নেই বলে শৈলী আর মাহিরা মিলে পুরো ঘটনাই বললো। সব শুনে মিহরানের চোখ দেখার মতন হয়েছিল। রায়হান ভেগেছে শুনে মুষ্টিবদ্ধ করলো নিজের হাত। সাথেসাথেই মাহিরাকে বললো, মালিহার ফোনটা নিয়ে আসতে। এদিকে ও নিজে ফোন লাগালো ওর এক পরিচিত বড় ভাইকে যিনি পুলিশের এক উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা। মালিহার মোবাইল থেকে রায়হানের ছবি কালেক্ট ওর ব্যাপারে সব ইনফর্মেশন মালিহার থেকে নিয়ে পাঠিয়ে দিল সেই পুলিশকে। সাথে নিজের চাহিদাও রাখলো যাতে এই ছেলেকে দ্রুত আইনের আয়োতায় আনা হয়।
ফোনটা রেখে বোনের মলিন চেহারার দিকে তাকালো মিহরান,
– এই বা*টার্ডকে আমি ছাড়বো না। আমার বোনের সাথে প্রতারণা করে ও পার পাবে না। আই উইল সি হিম।
চলবে।